প্রিয়_তুই,০৯,১০

0
257

#প্রিয়_তুই,০৯,১০
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৯

তিতাস বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে বাসার পথে রওনা হলো। তার মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত রুপ ধারণ করেছে। মস্তিষ্কে ঘুরছে চিন্তার পাহাড়। তার একটাই প্রার্থনা, ভোর যেন পাল্টি না খায়। তাহলেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তখন
সবটা একা সামলানো তার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। আর এই মুহূর্তে ভোরকে তার বাবা-মায়ের কথা জানানো উচিত।
এটা লুকিয়ে রাখার ব্যাপার নয়। তবুও সে চেপে গিয়েছিল, পূর্বের কথা ভেবে। তাছাড়া ভোরের বাবা মায়ের সঙ্গে যখন তখন ভালো ম/ন্দ কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।উনারা প্রতি
সেকেন্ডে বাঁচার জন্য যু/দ্ধে করে যাচ্ছেন। হয়তো হাল ছেড়ে দেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। অবস্থার উপর ভিত্তি করে, সে চায়লেও আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এরচেয়ে এখন জানানোই শ্রেয়। এসব ভেবে সে বাসায় গিয়ে কাউকে পেলো না। ঘড়িতে তখন ছয়টা ছাব্বিশ।পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, ভোরের আগমনী বার্তা। সিগ্ধ শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে পৃথিবীর বুকে। কিন্ত কিছু মানুষ পারছে না, এই আবহাওয়া উপভোগ করতে, প্রশান্তি টুকু লুফে নিতে। তিতাস অস্থির চিত্তে একে একে সবাইকেই কল দিলো। কিন্তু কেউই রিসিভ করলেন না। কল হতে হতে কেটে গেল। এবার সে দ্রুতপায়ে গেল দারোয়ানের কাছে। উনি হয়তো কিছু বলতে পারবে, তিতাসকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে দারোয়ানই তড়িঘড়ি করে উঠে আসলেন। না জিজ্ঞাসা করার আগেই জানালেন, সবাই হসপিটালে গেছে।
উনাদের যাওয়া ঘন্টা দু’য়েক হচ্ছে। তারমানে তিতাস আসার পরপরই তারা হসপিটালে পৌঁছেছে।তিতাস যা বোঝার বুঝে গেল।সে তড়িঘড়ি পোশাক বদলে আবার ছুটল হসপিটালের পথে। না জানি ওখানকার কি অবস্থা!

তিতাসের বাবা- মা চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছেন। চাচী রোজাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। তখন তিতাস দ্রুতপায়ে হেঁটে সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে ওর মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
-”এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? ভোরের বাবা-মা..।’
-”জানি, ভোর কোথায়?”
-”ভেতরে।”
-”আচ্ছা দেখছি।”
একথা বলে তিতাস দৌড়ে ভেতরের দিকে ছুটে গেল। ভেতর বোর্ড বসানো হয়েছে। ভোর বাবা-মায়ের উন্নত চিকিৎসার
ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে ডাক্তার আনা হোক, নয়তো জুরুরিভাবে উনাদের বাইরের দেশে পাঠানো হোক। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা একথায় দ্বি-মত পোষণ করলেন।
কারণ রোগী এত ধকল সহ্য করতে পারবে না। এমনও হতে
পারে যাওয়ার পথেই সব শেষ।একথা শুনে ভোর নেত্রজোড়া
বন্ধ করে ঢোক গিলল।একবুক সাহস নিয়ে শেষ চেষ্টা করার
আগ্রহ দেখাল। তিতাস অদূরে দাঁড়িয়ে ভোরকে দেখছে। কী সুন্দরভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। অথচ বাবা-মায়ের জন্য তার প্রাণ কাঁদছে, পু/ড়/ছে। আলোচনার শেষ পর্যায়ে একজন নার্স ছুটে এসে খবর দিলেন, ভোরের বাবা রেসপন্স করছেন না। একথা শুনে ভোর দৌড়ে গিয়ে চেক করে, একবার, দুইবার, বহুবার, সত্যিই তার বাবা নেই।
তবুও সে তিতাসকে আরেকবার দেখতে বলল। তিতাস দেখে না বোধক মাথা নাড়াল অর্থাৎ নেই, উনি মারা গেছেন। ভোর
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। জোরে জোরে বার কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে স্থির দৃষ্টিতে বাবার মুখপানে চেয়ে থাকে।কিন্তু তিতাসের কপালে ভাঁজ পড়ল অক্সিজেন মাক্স বেডের নিচে পড়ে থাকতে দেখে।সে নিজে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে নার্সকে
বারবার খেয়াল রাখতে বলে তারপর বেরিয়েছিল। তাহলে কেউ সেটা খুলে দিলো?নাকি ছটফট করাতে পড়ে গিয়েছে? তিতাস পরখ করতে দুই ধাপ এগোতেই ভোর বলল,
-”তিতাস!”
-”হুম।”
-”বাবা মারা গেলেন কেন জানিস?”
-”কেন?”
-”আমি লাল শাড়ি পরেছি তাই। আমি আর কখনো লাল শাড়ি পরব না। নয়তো তুইও….! ”

তিতাস জবাবে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। মেয়েটা পুনরায় মনে ভুল ধারণা পোষণ করল। তবে এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না তাই চুপ রইল। ভোর তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে, এটা দেখে তিতাস কিঞ্চিৎ খুশি হলো। তবে সেই খুশি প্রকাশ না করে গোপনে নিজের কাছেই রেখে দিলো। ঘন্টা খানিক পরে, ভোর এই দুঃসংবাদটা তার ভাইদের জানাল। উনারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল আর ভোর নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেল। ভোরের ছোট ভাই নিশাদ ইতালিতে থাকে। আর বড় ভাই মিশান নিজের ব্যবসার কাজে কাতারে গিয়েছেন। উনারা কেউই আসতে পারবেন না। এজন্য তিতাসই নিজের দায়িত্বে লা/শ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। তারপর সে
ভোরকে নিয়ে গেল ভোরদের বাসায়। সেখানে ভোরের ভাবি আর ভোম্বল ছাড়া কেউ নেই। ভোম্বল দাদুকে দেখে চিৎকার করে কাঁদল। কোলে যাওয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়েও দিলো।
তবুও কোলে নিচ্ছে না দেখে ভোরকেও অভিযোগ জানাল।
তারপর নিকট আত্নীয়দের উপস্থিতিতে আসর পরে ভোরের বাবার দাফনকার্য সম্পূর্ণ করা হলো। একে একে সবাই বাণী ছড়িয়ে বিদায় নিলো। তবুও ভোর কাঁদল না, শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখে গেল।স্বচ্ছ দিন পেরিয়ে রাতের আগমন হলো। ধীরে ধীরে সময় বাড়তে লাগল। বড় ভাবির বাবা-মাকে ভাবির কাছে থাকতে বলে পুনরায় হসপিটালে এলো, রাত আর তিতাস। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা।তিতাস ভোরকে তার আম্মুর কেবিনে রেখে নিজের কাজে চলে গেল। আর ভোর ওর আম্মুর হাতখানা কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। আর ওর দু’চোখ দিয়ে ঝরে গেল অবাধ্য নোনাজল।

এর ঘন্টা দু’য়েক পর, তিতাস নার্সের সঙ্গে কথা বলে ভোরের পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে ভোরকে ডেকে বাইরে যাওয়ার ইশারা করল। ভোর আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে
গিয়ে দাঁড়াতেই তিতাস বলল,
-‘গাড়ি এসে গেছে বাসায় চলুন।”
-”আমি আজ এখানে থাকব।'”
-”ভোর অহেতুক জেদ করবেন না, যেতে বলছি যাবেন।”
-”এ ব্যাপারে কথা বাড়াস না, ভালো লাগছে না।”

তিতাস আর কথা বাড়াল না। ভোরের বাহু ধরে বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। ভোর ছাড়াতে চায়লেও পারল না। ওরা গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা বাচ্চা পথ আগলে দাঁড়াল। তার
বয়স দশ থেকে বারো। হাতে চায়ের ফ্লাক্স। হয়তো ঘুরে ঘুরে
চা বিক্রি করে। তখন তিতাস বলল,

-”সমস্যা কি ছোটভাই?”
-”চা খাবেন?”
-‘না অন্যদিন, এখন মন ভালো নেই।”
-”এই নিন, এটা আপনাকে দিতে বলেছে।”
-”কে দিতে বলল, আর কি এটা?”
-”কাগজের চিঠি।”

তিতাস ভোরের বাহু ছেড়ে চার ভাঁজ করা চিরকুটটা খুলে পড়ল,

-”আমার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিস বুঝি? আহারে, বেচারা! তা ওকে আর কতদিন এভাবে রাখবি? না নিজে খাচ্ছিস আর না আমাকে খেতে দিচ্ছিস! এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না, ছোটভাই। এরচেয়ে পাখিটাকে আমার হাতে তুলে দে, আমি আমার ইচ্ছে মেটায়।”

তিতাস চিরকুটটা পড়ে ছিঁড়ে বিরক্ত মুখে ভোরকে বলল,

-”আমাকে দেখে কার যেন খুব খুব পছন্দ হয়েছে। সে নাকি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমার রুপে সে পাগল দিওয়ানা।
ফোন নাম্বার চাচ্ছে। নয়তো বাসায় যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এর কোনো মানে হয়? কিছু কিছু মেয়ে এত্ত হেং/লা বলার বাইরে। একথা আবার চিরকুটে লিখে পাঠাচ্ছে। ছিঃ! এখন
আমারই লজ্জা লাগছে, দেখুন তো লজ্জায় আমার গাল লাল হয়েছে নাকি? হয় নি, না? বোধহয় একটু পরে হবে।”

তারপর ভোরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে থাকল নির্দিষ্ট পথ ধরে। ভোরকে সন্দেহ করা সুযোগও দিলো না তিতাস। তবে সে রাগে ফেটে পড়ছে।
মনে হচ্ছে, সবকিছু ভেঙে গু/ড়ি/য়ে দিতে। অথচ ওর রাগের বর্হিপ্রকাশ নীরব, নিশ্চুপ। ভোর সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে।
মলিন মুখ, বন্ধ চোখ।তিতাস ভোরের দিকে সরে বসে মাথায় হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিতে থাকল।ভোর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাল। বয়সে ছোট, অথচ ছেলেটা দায়িত্ব পালনে তৎপর। আজ সারাদিন তার ছত্রছায়া হয়ে থেকে তিতাস। কোনোভাবেই তাকে একা ছাড়ে নি। তখন ভোরকে নিশ্চিত করতে তিতাস বলল,

-”আন্টিকে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। নার্সরাও সজাগ। তাছাড়া ঘন্টা দু’য়েক পরে আমি আবার আসব। আজকের রাত সেখানেই থাকব তাই দুঃচিন্তার কিছু নেই।”

ভোর এই মুহূর্তে গভীরভাবে অনুধাবন করল,দুঃসময়ে এমন কথা বলার একজন মানুষের বড্ড দরকার। যার শক্ত হাতটা আঁকড়ে ধরে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর সাহস হবে। তার বিশ্বস্ত কাঁধে মাথা রেখে শান্তি খোঁজা যাবে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলে অজুহাত দেখিয়ে একটু কেঁদে নিতে পারবে। সময় অসময়ে
প্রশস্ত বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে নিজের অবস্থানটা পরিমাপ করা যাবে। যার হৃদস্পন্দের গতিতে নিজের নাম অনুভব করতে পারবে।এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের চোখজোড়া এমনিতেই বুজে এলো। মাথা ব্যথায় জর্জরিত ভোর আরাম পেয়ে ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমাল। শ্বাস-প্রশ্বাসও ঘন হলো। তখন তিতাস অতি সন্তর্পণে ভোরের মাথাটা তার বুকের উপর রাখল। এক মিনিট, দুই মিনিট, করে কিছু সময় অতিবাহিত হলে ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে তিতাস বলল,

-”ভালোবাসার অভিনয়ে মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও পারদর্শী।
এর জলজ্যান্ত প্রমান, আমি।”

To be continue…..!!

#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১০

-”ভালোবাসার অভিনয়ে মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও পারদর্শী।
এর জলজ্যান্ত প্রমাণ, আমি।”

একথা বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভোরের মাথাটা বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। ক্লান্ত শরীর আর ক্ষুধার্থ পেটে ঘুমে অতিয়েও গেল। তিতাসের উপরোক্ত
কথাটা বলার উদ্দেশ্যে ভিন্ন। সত্যিই সে অভিনয়ে পারদর্শী।
স্বেচ্ছায় যাকে ভাবির আসনে বসানো হয়। তাকে এত সহজে ভালোবাসা যায়? না, যায় না। সেও পারে নি। অথচ নিখুঁত প্রেমিকের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে সে। যেন ভোরকে আগে থেকেই ভালোবাসত, খুব করে চায়ত। তিতাস চঞ্চল প্রানবন্ত ছেলে, তার চঞ্চলতার মাঝেই ঢাকা পড়ে যায় অভিমানী এক ছেলের রুপ। যে কখনো নিজের কথা নয়, ভেবেছে স্বপ্ন ভঙ্গ এক মেয়ের কথা আর নিজের মায়ের আদেশ। যেখানে তার সিদ্ধান্তের ছিঁটেফোঁটা মূল্য সে নিজেই দেয় নি। ভোর বয়সে বড়, সম্পর্কে ভাবি ছিল, এসব তার সমস্যা নয়। ভোরকে না ভালোবাসার হেতুও নয়। এমনও না যে সে কারো প্রতি দূর্বল ছিল। সে মূলত সময় নিতে চেয়েছিল। নিজেকে সবকিছুর জন্য গুছিয়ে নেওয়ার সময়। কিন্তু সে সেটা পায় নি। তাছাড়া ভালোবাসা কি জোরপূর্বক হয়? সে চেষ্টাও করে না। কারণ
ভোর এখন তার বউ। ওর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার। চায়লেও সে দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তবে দায়িত্বের চাপে নয়, ভোরের সিগ্ধ মুখটা দেখে আজকাল ওর মনে মায়া কাজ করে। মনে হয়, তাকে সর্বদা সঙ্গ দিতে, আগলে রাখতে। তার অশ্রু না ঝরাতে। কারণে অকারণে ওকে রাগিয়ে দিয়ে রাগী মুখখানা দেখতে। এভাবেই যদি ভালো থাকা যায় তবে ভালোবাসার কী প্রয়োজন? এভাবে দিন কেটে যাক, বছর পেরিয়ে যাক।
বর্তমান সময়গুলো অতীত হয়ে যাক। সর্বনাশা মায়া থেকে যাক চিরন্তন।

হঠাৎ গাড়ির ঝাঁকুনিতে ভোরের ঘুমটা ভেঙে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করল পুরুষালি শক্ত বাহুডোরে। কেউ স্বযত্নে আগলে রেখেছে তাকে। ভোর নড়তে গেলে বাঁধা পেলো, বরং আরো শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো ওকে।খুব চেনা পারফিউমের সুগন্ধ এসে নাকে বিঁধছে।ভোর স্থির হয়ে গেল।তার মস্তিষ্ক জানিয়ে দিলো, সে কে। মানুষটার হৃদস্পন্দের ধুকপুক শব্দও শুনতে পেলো। কেন জানি সে অনুভব করল এই প্রশস্ত বুক শান্তির আবাস। আর এই শান্তিটুকু তার প্রয়োজন, বড্ড প্রয়োজন।
একখন্ড শান্তির দেখা পেয়ে তার মনটাও লোভী হয়ে উঠল, আঁচলভর্তি শান্তি কুড়াতে ইচ্ছেরা দলবদ্ধভাবে সায় দিলো। কিন্তু তাৎক্ষণিক সে নিজেকে সামলে নিলো। অবাধ্য মনকে কড়াভাবে শাসিয়ে নিলো। তারপর জোর খাঁটিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় নামল। তখন তিতাস বলল,

-” একাধিক বার চেষ্টা করুন।”
-”দিন দিন তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে, ছাড় আমাকে।”
-”পারব না।”
-”তিতাস!”
-”সুন্দর করেও তো ডাকা যায়, তাই না? বড় বলে সবসময় ধমকাতে হবে?”
-”এবার কিন্তু কামড়ে দিবো।”
-”আমিও।”
-”আজ আমার বাবা মারা গেছে, কষ্টের মুহূর্তে ফাজলামি করিস না, প্লিজ।”
-”এজন্য ই তো সুযোগ দিচ্ছি।”
-”কিসের?”
-”আমার বুকে লুটিয়ে পড়ে কান্না করার। নিন কাঁদুন, যতবার ইচ্ছে হবে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদবেন। এটা আপনার জন্য উন্মুক্ত।”

ততক্ষণে জ্যামের কারণে গাড়ি থেমে গেছে। ভোর ছটফট করাতে তিতাস এবার ছেড়ে দিলো। তখন গাড়ির গ্লাসে কেউ নক করল। পথশিশু হবে হয়তো। বেলি ফুলের মালা অথবা অন্যকিছু নেওয়ার জন্য। তিতাস গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, আয়মান। পাশের গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভোরের দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন বিশ্বজয় করে সবে ফিরেছে। তিতাস ওকে দেখে ফিচেল গলায় বলল,

–”পথশিশুর মতো নক দিচ্ছেন, খুচরো পয়সা টয়সা লাগবে নাকি?”

একথা শুনে আয়মানের মুখটা রাগে থমথমে হয়ে গেল। সে
তবুও নিজের স্বাভাবিক রাখল। কারণ এখানে ভোর আছে। তার সামনে আসল রুপ বের করা আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা সমান। তখন ভোর রেগে তাকালে তিতাস চুপ হয়ে গেল। তবে তার ছটফটানি বেড়ে গেল, সে শুভ্র শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বলল,

-”আপনি আমার শশুড় বাড়ির লোক আপনাকে খালি মুখে যেতেই দিবো না, চলুন ওই সামনের দোকানে গিয়ে কিছুমিছু খাইয়ে আনি।”

-” থাক, এত কষ্ট করতে হবে না।”

-”তা বললে হয় নাকি?”

একথা বলে তিতাসগাড়ি থেকে বের হয়ে আয়মানকেও টেনে বের করল। তারপর তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। যেন তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভোর প্রচন্ড বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। এই ছেলে কী দিয়ে তার বোধগম্য হয় না।ক্ষনিকেই শান্ত খানিকেই দূরন্ত। মাঝরাস্তায় আতিথিয়েতার মানে হয়! তাও এই মুহূর্তে। ভোর দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করল।বাবার সঙ্গে ম/রে গেলে মন্দ হয় না। এই পৃথিবীর আলো বাতাসও স্বার্থপর। এসব ভেবে
পুনরায় তার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। তার জীবনের গতিপথ এমন পর্যায়ে এসে থমকে গেছে, না পারছে এগিয়ে যেতে আর না পারছে বাঁধন কেটে হারিয়ে যেতে। তিতাস কী সত্যিই তাকে মেনে নিয়েছে? নাকি করুণার বশে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে? তার সঙ্গে কী সত্যিই বাকি পথ পাড়ি দিবে? নাকি মাঝপথে হাত ছেড়ে চলে যাওয়ার তাগাদা দিবে?এসব
প্রশ্নগুলো সর্বদা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।সে ওর বাবাকে
কথাও দিয়েছিল, তিতাস যদি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়, সে দুই হাত বাড়াবে, স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে। বিয়ে করে এক রুমে থাকলেই স্বামী-স্ত্রী হওয়া যায় না। এখানে বিশ্বাস এবং ভালোবাসার স্থান সবার ঊর্ধ্বে। কিন্তু তারা এখনো অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতেই পারি না। সেদিন তিতাসের বড় বোন নোংরা কথাগুলো বলা মাত্রই, তিতাসের মা’ও উপস্থিত হয়েছিলেন।
উনি সবকথা শুনেছিলেন। নিজের মেয়ের মুখের ভাষা শুনে
উনি কিছু বলার রুচিই হারিয়ে ফেলেছেন। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ভোরের মুখপানে। ভোর অবলীলায় এসব কথা হজম করে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো। তখন তিনি
ভোর হাত দু’টো ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,

-” আমার পিয়াস আমার কোলশূন্য করে চলে গেছে। আমার তিতাসটাও মরে যাবে। পিয়াসের অকাল মৃত্যু তিতাস মানতে পারে নি। সে কাঁদে নি, একটুও কাঁদে নি। আমি জানি পিয়াস তার কাছে কী ছিল। ঠিক কতটা ভালো সম্পর্ক দুই ভাইয়ের মধ্যে। কিন্তু এখন তোকে ও পিয়াসকে জড়িয়ে নোংরা কথা শুনতে হয়। অনেকেই তোর নাম করে তিতাসকেও খোঁচাতে কম করে না। যে ছেলেটা কখনো কারো কথা শুনতে পারত না, আমার সেই ছেলেটা নিশ্চুপ হয়ে সবটা সহ্য করে যায়।
কিন্তু ওর চোখ বলে, ‘মা, আমি ভালো নেই।’

-”আমাকে কিছুদিন সময় দিন আমি সুইডেন চলে যাবো।”

-”পালাতে চাচ্ছিস? এর চেয়ে সমাধানে আসা যায় না?”

-”মানে?”

-”বিয়েতে এবার তুই সম্মতি দে মা। আমার ছেলের দায়িত্বটা আমি তোর কাঁধে ফেলে আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে চাই।”

তারপর ভোর একপ্রকার রেগে গিয়ে তিতাসকে বিয়ের কথা বলেছিল। সে ভেবেছিল তিতাস নাকচ করবে। আর পাঁচটা ছেলের মতো বিধবাকে বিয়ে করতে নাক কুঁচকাবে। দ্বি-মত পোষণ করে চলে যাবে। সেই সঙ্গে লোক দেখানো তার করা
পাগলামিও বন্ধ হবে। কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে সে বিয়ের ব্যবস্থা বিয়েও করে ফেলল। এখন সেই ছেলেটা তার স্বামী। এসব ভেবে ভোর দীর্ঘশ্বাস।

আর তিতাস আয়মানের কাঁধটা শক্ত করে ধরে কথা বলতে যাচ্ছে। কথা না ঠিক,রাগের মাত্রা দেখাচ্ছে। কারণ আয়মান
এতক্ষণ তাদের ফলো করছিল। যদিও সে সর্বদা তাই করে।
কিন্তু আজকে কেন জানি তার রাগ হচ্ছে। তীব্র রাগের চোটে
কথা বলতে পারছে না। যদিও সে রাগ সংবরণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে। তখন আয়মান কৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর ভোরের দিকে তাকিয়ে পুনরায় হাসল। ভোর ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তিতাসও মুখভর্তি হাসি নিয়ে পেছনে ফিরে ভোরকে দেখে নিলো। তারপর দু’টো আইসক্রিম নিয়ে
নিজেই খেতে শুরু করল। একবারও আয়মানকে সাধল না। খেতে সাধার জন্য আয়মানকে এখানে আনেও নি সে। মূলত এসেছে, কিছু কথা জানতে এবং জানাতে। তখন আয়মান তিতাসের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

– “ওই সংবাদটা এতক্ষণে পেয়ে গেছো তাই না?”
-”কোন সংবাদ?”
-”লোক লাগিয়ে এক্সিডেন্ট করানোর সংবাদ।”
-”কে করেছে, তুই?”
-”উহুম, ভোর নিজেই।”

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here