প্রিয়_তুই,৩১,৩২ শেষ

0
339

#প্রিয়_তুই,৩১,৩২ শেষ
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_৩১

ভোর আজ তৃপ্তি সহকারে তিতাসের হাতে পেটপুরে খাবার খাচ্ছে। কেন জানি তার ভালো লাগছে, মনে প্রশান্তি অনুভব করছে। কোনোভাবেই দ্বিধা কাজ করছে না। সংকোচে মুখও মলিন হচ্ছে না। বরং স্বপ্নটা দেখার পর থেকে সে তিতাসের প্রতি টান অনুভব করছে। বার বার মনে হচ্ছে, তিতাস তার। আর তাকে ওরই আগলে রাখতে হবে। মায়ার বাঁধনে বন্দি
করতে হবে যেন এই বাঁধন কখনোই ভাঙতে না পারে। ভোর এবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নিজেই এগিয়ে গেল, আরো এক ধাপ। হোক নিন্দা, হোক তীব্র রুপে সীমা লঙ্ঘন। তবুও সে কোনো কিছুর পুরোয়া করবে না। জীবন তার, মর্জি তার। এবার ভালো থাকার প্রয়াসে নেওয়া সিদ্ধান্তও তার। অনেক হলো রাখ ঢাক চুপিচুপি ভালোবাসা বিনিময়। এবার নাহলে উন্মুক্ত হোক ওর প্রণয়কাব্য। তিতাসকে জানিয়ে দিক, সেও হৃদয়ের দ্বার খুলে তিতাসকে সাদরে স্বাগতম জানাচ্ছে। এই কথাগুলো ভোর তিতাসের পানে তাকিয়ে ভাবছিল। তখন
ওকে রাগানোর জন্য তিতাস বলল,

-”কে যেন একদিন বলেছিল জুনিয়র ছেলেকে বিয়ে করবে না। অথচ এখন…!”
-”তো?”
-”প্রমাণ পেলেন?”
-”কিসের প্রমাণ?”
-”এই যে জুনিয়ররাও ভালোবাসতে জানে, বউয়ের আবদার মিটাতে পারে।”
-” একটা আবদার পূরণ করে এত গর্ব?”
-”আরো আছে নাকি?”
-”অবশ্যই সাহেব।”
-”আগে শুনি, কী কী আবদার আছে আপনার?”
-”তুই আমার কে?”
-” সিনিয়র জুনিয়র কাটাকাটি করে শুধুমাত্র প্রিয়তম।”

তিতাসের জবাব শুনে ভোর মনে মনে হেসে তিতাসকে খেয়ে আসতে বলল। তারপর শুয়ে শুয়ে নাহয় ওর আবদারগুলো জানাবে। একথা শুনে তিতাস কথা না বাড়িয়ে খেয়ে আসল। তখন ঘড়ির কাঁটা চারের ঘরে।ভোর শুয়ে ফোন স্কল করছে। তিতাস পাশে শুয়ে ফোনটা কেড়ে ভোরকে তার দিকে ঘুরিয়ে
বলতে ইশারা করল। ভোর আজ সংকোচ দূরে ঠেলে বলল,

-”সর্বপ্রথম আবদার তোকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতে দে। আমার সকল চাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে আমার তোকে’ই চাই।
আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোর সঙ্গ চায়। বয়সে ছোট বড় হিসাব নির্বাসনে পাঠিয়ে একে অপরের পরিপূর্রক হতে চাই। তোকে সঙ্গে নিয়ে সুখরাজ্য গড়তে চাই। রাতের সোডিয়ামের নিয়ত আলোয় তোর সঙ্গে হাঁটতে চাই, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতেও চাই। বিনাসংকোচে তোর প্রশস্ত বুকটা আমার নামের দলিল করতে চাই, তোকে আমার সকল আবদার পূরনের সম্পূরক করতে চাই। তোর কোনো আবদার নেই?”

-”আছে তো। আমারও অনেক আবদার আছে। আর আমার সর্বপ্রথম আবদার, আমি চিরকাল আপনার #প্রিয়_তুই হয়ে থাকতে চাই। ”

-“সম্বোধন এবার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন আমাদের।”

-”আনব তো। এবার আপনি তুই থেকে তুমিতে নেমে আসুন আর আমি আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসি। তবে আগেই বলে দিচ্ছি, চার দেওয়ালে মাঝে আমাদের সম্বোধন আপনি তুইতে সীমাবদ্ধ থাকবে, ঠিক আছে?”

-”কেন?”

-” কারণ আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছে তুই আর আপনিতে। তাছাড়া নিজেরা ঠিক থাকলে সম্বোধনে আর কী এসে যায় বলুন?”

-”হুম।”
???গল্পগুচ্ছ সমগ্র??❤️
এভাবে কথা বলতে বলতে দু’জনে ঘুমিয়ে গেল। তবে আজ ভোরের মাথা রাখার স্থান ছিল তিতাসের প্রশ্বস্ত বুকে। আর সেখানে মাথা রেখে প্রশান্তি লুফে নিয়ে ভোর আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। চটজলদি ঘুমাতে দেখে তিতাস নিঃশব্দে হেসে ওকে
শক্ত করে চেপে ধরেছে বুকের সঙ্গে। পরপর ঠোঁট ছুঁইয়েছে, ভোরের চোখে, ঠোঁট, গালে। সে আজ আবার প্রমাণ পেলো, মেয়েরা হচ্ছে তরল পদার্থ। তাদের যখন যে স্থানে রাখা হবে তারা সেখানেই নিদারুন ভাবে জায়গা দখল করবে। আর এর জলজ্যান্ত উদাহরণ ভোর। এসব ভেবে সেও নেত্রজোড়া বন্ধ করে নিলো।

এর প্রায় মাস দু’য়েক পরের ঘটনা,

এই দুইমাসে সবকিছু ঠিক ভাবেই চলেছে। কোথাও কোনো ভাবে বিপত্তি ঘটতে দেখা যায় নি। তিতাসেরও ইন্টার্নি শেষ। সে এবার পরের ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোর রেগুলার রোগী দেখে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পার করছে। বর্তমানে সে সরকারী ও বেসরকারি দুই হসপিটালেই সময় দেয়। সঙ্গে চলমান প্রাপ্ত ডিগ্রী অর্জনের জন্য পড়াশোনা। রোজাকে নিয়েই তিতাসের মায়ের সময় কেটে যায়। বাসার ঝুটা কাজের বুয়া রেখেছে তিতাস। উনারা সব কাজ করে দিয়ে যান। তিতাসের বাবার ব্যবসাতে বেশ উন্নতি দেখা দিয়েছে। পূর্বের ন্যায় ফুলে ফেঁপে উঠছে উনার ব্যবসা। তবে ছোট্ট রোজা দু’তিনদিন কেঁদেছে আম্মু যাবো বলে। কিন্তু শাহিনা মেয়ের খোঁজে আসে নি। সে মজে আছে নিজের ভুবনে।ঘৃণা/য় কেউ উনার খোঁজও নেয়
নি। যারা টাকার পোকা টাকার লোভ তাদের বিবেক নড়বড়ে করে দেয়। ওরা ডানে বামে যেদিকে যাক লাভের দিক আগে ভাবে। যেমন শাহিনা নিজের অসুস্থ মেয়েটাকে চোখের দেখা ভুল করেও দেখতে আসে না, খোঁজও করে না। তবে ঠিকই তিতাসদের পূর্বের বাসাটা নিজের নামে করে নিয়েছে। সেটা বিক্রি করার ফন্দি এঁটেছে। তিতাস কিছু করতে চায়লে, ওর
বাবা ছেলেকে আঁটকে দিয়েছেন। এসব ঝোটঝামেলা উনার পছন্দ নয়। বাসা নিচ্ছে নিক, তবুও উনার যা আছে তিতাস আর রোজার অভাব হবে না। আর সারার মৃ/ত্যু/র খবরটা কেন জানি ধামাচাপা পড়ে গেছে।পুলিশের টেবিলে রাখা শত শত ফাইলের নিচে চাপা পড়ে গেছে সারার মৃ/ত্যু/র রহস্যও।
এখন সবকিছু ভালোই হচ্ছে। তিতাসের চঞ্চলতায় সকলকে
ভালো রেখেছে।

আজ শুক্রবার। তিতাস আর ভোর দু’জনেই বাসায় থাকবে।
গতরাতে দু’জন রুম নোং/রা করা নিয়ে ঝগড়া করেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়েও ফেলেছে। এই নিয়ম তিতাস জারি করেছে।বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেলেও পাঁচ মিনিটের বেশি ওরা কথা বলা বন্ধ করবে না, রুমও আলাদা না হয়। বরং ঝগড়া শুরু যে করবে তাকেই অপর ব্যক্তিকে আগে জড়িয়ে ধরতে হবে, মান ভাঙাতে হবে। কিন্তু ভোর এর বিরোধিতা করেছে।
তার ভাষ্যমতে, দোষ যারই হোক ‘ সরি ‘ তিতাসকেই বলতে হবে। কারণ এটা ওর বর গত দায়িত্ব। ভালো বরটা সবসময়
নিজেদের হার মেনে নেয়, তিতাসকেও মানতে হবে। তিতাস ভোরের সঙ্গে এই নিয়েও খোঁচাখুঁচি করে পরে নিজেই সরি বলে। পরিশেষে তিতাস রুম গুছিয়ে বেলকনিতে বসে চন্দ্র বিলাস করেছে, সঙ্গে খুনসুটিময় মুহূর্ত। তবে তিতাস আগে খুব আফসোস করতো ভোর আবদার করত না তাই।অথচ
এখন বউয়ের আবদারের ঠেলায় নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে
তাকে। তিতাস সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ওর বাবার কাছে গেল। তারপর বাবার প্রেশার মেপে ওষুধ লিখে কাগজখানা হাতেই ধরে রাখল। ওর বাবা এক হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে বললেন,

-”ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছি ভিজিট দেওয়ার জন্য? ”

-”ভাবতেও অবাক লাগে তুমি আমার বাবা।”

-”মানে?”
পেজের রিভিউ অপশনে গিয়ে রিভিউ দিয়ে আসবেন প্লিজ ?গল্পগুচ্ছ সমগ্র
-”বিয়ে করেছি সবে কয়েক মাস হলো, বাবা হয়ে হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে তা না করে ঘাপটি মেরে বসে আছো। এটা কী দায়িত্ববান বাবার কাজ, তুমিই বলো?”

-”আমি তো ভোরকে জিজ্ঞাসা করেছি, সে যে বলল এখন ছুটি নিতে পারবে না। পরে কোথাও থেকে ঘুরে আসবে।”

-”সে পুত্রবধূ হয়ে শশুড়কে কীভাবে বলবে, ‘বাবা আপনার ছেলের সঙ্গে আমি হানিমুনে যেতে চাই।’ তোমার শরীরের সঙ্গে বুদ্ধি গুলোই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বাবা।”

-”বেদ্দপ, দূর হ আমার সামনে থেকে।”

-”তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করো নয়তো দেখাবো না কিন্তু? ”

-”কী দেখাবি না?”

-”তোমার নাতি-নাতনীদের চাঁদমুখ।”

-”আশ্চর্য, নাতি নাতনীদের মুখ দেখতে হলে হানিমুনে যেতে হবে? আমি তো তোর মাকে নিয়ে হানিমুনে যায় নি, তোরা তো ঠিকই পৃথিবীতে এসেছিস।”

-”আমার দাদা- দাদীমা তোমার মতো আহম্মক ছিলো না।
এজন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে। তুমি কি করো, আমি ফ্রি হয়ে
রুমের ঢুকলেই তো চেঁচাও, ‘তিতাস পানির বিল দিয়ে আয়, তিতাস ফাইল টা দেখে দে, তিতাস ওমুক কর, তমুক কর। তাহলে কীভাবে কী হবে বলো?তাই বলছি এবার স্পেস চাই, স্পেস দাও।”

-”এক্ষুণি আমার মুখের সামনে থেকে সর, ফাজিল ছেলে।”

তিতাস টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে হেলেদুলে চলে গেল। ছেলের কথায় তিতাসের বাবা থম মেরে বসে রইলেন। তিতাস এবার
ভোরকে খোঁচাতে গিয়ে দেখে ওর আম্মুও সঙ্গে আছে। তাই সেখান থেকে ফিরে এসে রোজার কাছে গেল। রোজা ফোনে গেম খেলছে। তিতাস রোজার চুল টেনে ওর আধখানা মিষ্টি রোজার মুখে পুরে বলল,

-”এই মিষ্টিটাতে বি/ষ মিশানো ছিলো। আমার একা একা মরতে ইচ্ছে করছে না তাই তোকেও খাওয়ালাম।”

-”এটা কি করলে ভাইয়া? আমি ম/রে গেলে আমার পুতুলটা কার কাছে রেখে যাবো?”

-”আমি আমার বউকে রেখে মরতে পারলে তুই পুতুল রেখে মরতে পারছিস না, ছিঃ রোজ ছিঃ।”

তিতাসের কথা শুনে রোজা একগাল হেসে ফোনটা পাশে রাখল। তিতাস ভোরের ফোনটা নিয়ে ভোরের ছবি দেখতে থাকল। ওর চোখে একরাশ মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।
রোজার দৃষ্টিও ফোনের দিকে। হঠাৎ রোজা একটা ছবি দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

-”আরে এই লোকটা তো আমার আম্মু সঙ্গে ঘুমায়।”

-”কোন লোকটা ডান পাশের টা নাকি বাম পাশের টা।”

ভোর তার আঙুল দিয়ে বাম পাশের জনকে দেখিয়ে দিলো। তিতাস কৌতুহলবশত পুনরায় একই কথা জিজ্ঞাসা করল। রোজা পূর্বের মতো বাম পাশের জনকেই দেখিয়ে দিলো। সে এটাও বলল, তার ভুল হচ্ছে না। কারণ ওর আম্মু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম করে ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করতো। প্রায় দিন তাকে একটা রুমে বসিয়ে রেখে তার আম্মু কোথা চলে যেতো। পরে অনেকক্ষণ পর ফিরে আসতো সঙ্গে ওই লোকও থাকত। রোজার কথা শুনে তিতাস ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। কারণ ওর করা এতদিনের অনুমান সব ভুল ছিলো। তাহলে এই খেলার আসল খিলাড়ি নিশান নয় স্বয়ং মিশান চৌধুরী।

To be continue……….!!

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্বঃ৩২(অন্তিম পার্ট)

তখন সকাল সাড়ে দশটা। রৌদ্রময় দিন। সময়ের দিকে লক্ষ রেখে ভোর ঝটপট রান্নাঘরের কাজ সেরে নিচ্ছে। সে আজ
নিজে হাতে রান্না করছে বাহারি পদের খাবার। সেসব খাবার
নিজস্ব ঘ্রাণ ছড়িয়ে মৌ মৌ করছে চারিপাশ। তিতাস দু’বার
জিজ্ঞাসা করেছে কেউ আসবে কী না? জবাবে ভোর মুচকি হেসে মাথা নেড়েছে অর্থাৎ আসবে বিশেষ কেউ। বোধহয় সে মাঝরাস্তা অবধি চলেও এসেছে। শাশুড়ি মায়ের সাহায্যে সে অর্ধেক কাজ সেরেও ফেলেছে। এবার বাকি রান্না শেষ করে রান্নাঘর গুছিয়ে নিলেই হবে।এসব ভেবে শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করতে করতে কাজ সেরে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ইস, রান্নার ঝামেলায় কখন যে ঘন্টা তিনেক সময় পেরিয়ে গেছে লক্ষই করে নি। এখন ঘড়িতে বাজে একটা সতেরো। সেই অতিথি হয়তো দোর গোড়ায় এসে পড়েছে। ভোর নিজের ফোন চেক করে আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত ছুটল ওয়াশরুমের দিকে।

ওইদিকে তিতাস তার মুখে হাসির রেখা টেনে রোজার থেকে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছে। সেই সঙ্গে তার সন্দেহগুলোও পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবার শুধু তাদের পতনের অপেক্ষায়। রবিনও তাকে এমন কিছুর ধারণায় দিয়েছিল। তবে নিশান আসাতে মিশানকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল। ওর ধারণা ছিল শাহিনার সঙ্গে নিশানের সম্পর্ক আছে। এ ছাড়াও মিশানকে সে কখনো শাহিনার ধারে কাছে দেখে নি।
বরং নিশানকে দেখেছে। সেদিন রাতে শাহিনার সঙ্গে নিশান
ছিল।ওর ভাবতেও অবাক লাগে, বোনের শত্রু ভাই হয়? কই সে তো কখনো সারাকে মারার কথা ভাবতেও পারে নি। সারা খারাপ কাজে লিপ্ত জেনেও। হ্যাঁ, মুখে হাজার কটু কথা বলে পরে সে নীরবে কেঁদেছে, কষ্ট পেয়েছে। বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সারার অশ্রুসিদ্ধ মলিন মুখ।আর ভোর
ওর ভাইদের অনেক ভালোবাসে, সন্মান করে। ওর ব্যবহারে তা বোঝা যায়। বাবার পরে সে ভাইদের আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে। বাবার স্নেহ আশা করেছিল মিশানের থেকে৷ অথচ
মিশান ভোরের সর্বসুখ কেড়ে নেওয়ার পায়তারা জুড়েছে। এমনকি ভোরকে পদে পদে বিপদে ফেলার চেষ্টাও করেছে।
সেই সাথে সারার মৃ/ত্যুতে ভোরকে দোষী বানাতেও চেয়েছে, শুধুমাত্র শাহিনাকে বাঁচানোর তাগিদে। ” মায়ের চেয়ে মাসীর
দরদ বেশি “ঠিক এই প্রবাদটার মতো। নয়তো মিশান রাগের
বশে এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারত না। তবে মিশান এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে, ‘সবাই সন্মানের যোগ্য নয়।’
যদি হতোও তবে ঘৃণা বলে কোনো শব্দের অস্বস্তি পৃথিবীতে থাকত না। ঠিক তখন উপর থেকে ভোরের ডাক শোনা গেল,

-”তিতাস তোমার ফোনে কল এসেছে।”

ভোরের ‘তুমি’ সম্বোধন তিতাসের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ভোর এখন তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে।
যেটা ওর ভীষণ অপছন্দ। তবে তাকে বলেও লাভ নেই। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। ভোরের ডাক শুনে তিতাস রোজার গালে চিমটি কেটে চলে গেল। আর রোজা ভেংচি দিয়ে গেম খেলায় মনোযোগী হলো। ভোর তখন চুলে খোঁপা বাঁধছিল। হঠাৎ হেঁচকা টানে তাল সামলাতে না পেরে সে স্বজোরে বারি খেলো তিতাসের প্রশ্বস্ত বুকে। ভোর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে নাক ডলে সরতে গেলে তিতাস কোমর আঁটকে ধরল। ভোর কিছু বলার আগেই তিতাস তাকে ঘুরিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল,

-”কিছু জানতে চাই।”

-“বল।”

-”মিশানের সঙ্গে চাচী জড়ালো কীভাবে? ”

-”জানি না।”

-”যদি এখন আমি মরে যাই তবে কিন্তু.. ”

-”যখন তোরা পিয়াসের বউ করতে আমাকে প্রথমবার দেখে এসেছিলি।”

-”তাহলে সেদিন চাচীর সঙ্গে নিশানকে দেখলাম কেন?”

-”তোর চাচীকে অনুরোধ করতে নাহিদ সেখানে গিয়েছিল। যেন মিশানের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। কারণ ওই মহিলা আমাদের তিনভাইবোনের সুখ নিয়ে খেলছে, মজা নিচ্ছে। বিশ্বাস কর,
আমি এতদিন জানতাম না এসবের পিছনেও মিশান দায়ী। ভেবেছিলাম হয়তো আয়মানের করা চক্রান্ত। কিন্তু গতকাল
রাতে নিশান আমাকে সব জানিয়েছে। মিশান নাকি ভোম্বল আর ভাবিকেও বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। ভাবিও আর সহ্য করতে না পেরে উনার বাবার বাসায় চলে গেছেন। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, দেহে প্রাণ থাকতে উনি মিশানের সংসার আর করবেন না।”

-”এরপরেও কী আমাকে চুপ থাকতে বলবেন?”

-”মোটেও না। আমি ভুলে গেছি সে আমার ভাই। এবার তুমি তার সঙ্গে যা ইচ্ছে করতে পারো। আর হ্যাঁ, সাহায্য লাগলে বলিও ।”

তিতাস সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। জীবনটা স্বাভাবিক রুপে ফিরিয়ে আনতে চায়লে কয়েকটা অমানুষ
মারতে হবে। কারণ তারা বিনাশ না হওয়া অবধি থামবে না।
তিতাস জুরুরি ভিত্তিতে রবিনকে কল করে ডাকল। রবিনও
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিতাসের বলা স্থানে পৌঁছাল। তারপর ওরা দু’জন পুনরায় গেল শাহিনার বাসায়। আর আজ এসে হাতেনাতে মিশানকেও পেলো। সদ্য গোসল সেরে দুজন এসে বসেছে বিলাশ বহুল ড্রয়িংরুমে। সামনে আছে গরম কফির মগ। তিতাস হনহন করে বাসায় ঢুকে বিনাবাক্যে মিশানকে একের পর ঘুষি দিতে থাকল। না কিছু বলতে দিলো আর না পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দিলো। আজ যেন তিতাসের রাগ নিজের কনট্রোলে নেই। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তার। এরা সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। তখন মিশান ছু/রি দিয়ে
তিতাসকে পাল্টা আঘাত করতে গেলে তিতাস তার মাথাতে ফুলদানি দিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তেই ফুলদানি ভেঙে পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। মিশানও মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। রবিনও থেমে নেই। সেও শাহিনাকে একের পর থাপ্পড় দিতেই আছে যতক্ষণ না সে ক্লান্ত হয়। এই মহিলাটা মানুষের জাতই না। অনেক বেশি প্যারা দিয়েছে তাদেরকে। পুরুষালি শক্ত হাতের থাপ্পড়ে শাহিনার অবস্থা বেগতিক। সে পরক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। তাদের এই অবস্থা দেখেও তিতাসের মন গললো না। সে এবার ওদেরকে
কারেন্টের তার দিয়ে বেঁধে পাশাপাশি শুইয়ে দিলো। তারপর খুঁটিনাটি কীসব করে রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা বের হওয়ার পরপরই মিশান আর শাহিনার শরীরে কারেন্ট লেগে গেল। দু’জনে কাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। ছোট্ট রোজাকে শাহিনা বুঝিয়েছিল, কারেন্টের সুইচের ফুটোয় আঙ্গুল দিলে নাকি পুরো পৃথিবীর দেখা যায়। এজন্য তাকে কারেন্টের মাধ্যমে মৃ/ত্যু দেখিয়ে দেওয়া হলো। একটু পরেই তিতাসের কথায় রবিন বাইরে থেকে মেইন সুইচ বন্ধ করে চলল বাসার পথে। আর সেখানে সেভাবেই পড়ে রইল শাহিনা আর মিশানের মৃত দেহ। শাহিনা আর মিশানের গল্প শুরু হয়েছিল ভোরকে দেখতে গিয়ে। মিশান তখন তার বাবার সঙ্গে খুব তর্ক করছিল।আর ওর বাবার কথা বোনকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে অথচ বড় ভাই উপস্থিত না থাকলে
কেমন দেখায়। পাত্রপক্ষরা জিজ্ঞাসা করলে বলবেন বা কী?
এসব নিয়ে তর্ক করতে করতে ভোর যে ওর সৎবোন একথা মিশান বলে ফেলে।ঠিক তখন পানির গ্লাস নিতে এসেশাহিনা
কথাগুলো শুনে ফেলে। আর এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মিশানের ফোন নাম্বার জোগাড় করে রসের আলাপও জুড়ে দেন। কারণ ভোরকে অশান্তির রাখার অ/স্ত্র উনি পেয়েছেন,
আর সেই অ/স্ত্র স্বয়ং মিশান। ওটার সাহায্যে ধীরে ধীরে উনি সব হাতাবেন। তাছাড়া ঘরে যখন শত্রু আছে তাহলে তাকেই কাজে লাগানো দরকার। এছাড়া পিয়াস আর তিতাসের বউ বাচ্চা মানেই সম্পত্তির ভাগ কমে যাওয়া। যেটা উনি মানবেন না। আর মিশান যেহেতু ভোরকে দেখতে পারে না তাই উনার কাজটা আরো সহজ হয়েছিলো।তারপরে পিয়াস মারা গেল, এরপর ধীরে ধীরে শয়তানী বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ওরাও ঠান্ডা মাথায় তিতাস এবং ভোরের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লাগল।
তবে তারা কখনো পাপ এবং পূর্ণের ধার ধারে নি। সম্পর্কের মানে বোঝারও চেষ্টা করে নি। এজন্যই বোধহয় পরিশেষে পতন। প্রায় তিনদির পরে, আননোন নাম্বার থেকে কল করে পুলিশকে জানিয়েছে শাহিনার লা/শে/র কথা। পরে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করেছে।

এরপর দিন চলল দিনের মনে। সময়ও কাটল লাগল নিজস্ব গতিতে। এভাবে দেখতে দেখতে কেটেও গেল একটা বছর।
সেই সঙ্গে পরিবর্তন আসল তাদের সকলের জীবনে। বিপদ কেটে অবশেষে পেয়েছে সুখের দেখা।

গতসপ্তাহে রোজাকে নিয়ে তিতাসের বাবা মা বাইরের দেশে গেছেন। মূলত রোজার পায়ের চিকিৎসা করাতে। ভোর এবং তিতাসের যাওয়ার কথা থাকলেও পরে তারা যেতে পারে নি।
এর একমাত্র কারণ ভোর। এজন্য তিতাস দেশে থেকে সমস্ত কিছুর সু-ব্যবস্থা করে দিয়েছে।তাছাড়া ভোরের খুব পরিচিত ডাক্তারের কাছে পাঠানোতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তিতাস এখন পরিপূর্ণ ডাক্তার।গুটি কয়েক হসপিটালে বসে কতশত
রোগীও দেখে। তবে একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার হলেও তার মধ্যে চঞ্চলতা এখনো অবধারিত। ডাক্তারের পাশাপাশি সে মানুষ এটা ভুলে না। কোনো না কোনো ভাবে বিনোদন খুঁজে নিবেই নিবে। আর এই চঞ্চলতার তার আপনজনদের মায়ার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে, সম্পর্কগুলোকে দৃঢ়ও করেছে। পাওয়া না পাওয়াসহ হারানোর ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করেছে। নতুনভাবে পরিবারের হাসিও ফিরিয়ে এনেছে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ওর ভোরের আঁচলে সুখ বাঁধতে সক্ষম হয়েছে। এখন সে প্রশান্তি হাসি সমেত একবুক ভালোবাসা নিয়ে বলতেও পারে, ”সিনিয়র বউ ভালোবাসি তোমায়।”

আজ সরকারি ছুটির দিন।তিতাস আর ভোর দু’জনে বাসায়
আছে। ভোর সকালবেলা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানিয়ে তিতাসকে ডাকতে ওদের রুমে গেল। রুমে গিয়ে তিতাসের অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ল।কারণ এটা ছাড়া ওর কিচ্ছু করারও নেই। এই একটা বছরেও তিতাসকে সে একটুও গোছালো করতে পারে নি। বরং আরো অগাছালো হয়েছে। বলে বলে সে ক্লান্ত তারপরেও তিতাস অপরিবর্তনশীল। আর এখন তিতাস শুধু টাওজার পরে উদাম শরীরে ঘুমাচ্ছে। তার বালিশখানা পড়ে আছে মেঝেতে। চাদরখানার বেহাল অবস্থা। পুরো বিছানার চাদর দলা পাকিয়ে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে। ভোর
সুন্দর করে তিতাসকে বার কয়েক ডাকল। জবাবে তিতাস বিরবির করে বলল,

-” আমি তোমাকেও খুব ভালোবাসি রুম্পা। বাসায় ভোরকে ভালোবাসি আর বাইরে গেলে তোমাকে ভালোবাসি।”

একথা বলে তিতাস খুব সুন্দর করে হাসল। যাকে বলে মন কাড়া হাসি। ভোর এবার রেগে তিতাসের চুল ধরে ইচ্ছেমতো টেনে চেঁচিয়ে বলল,

-”সারারাত আমাকে জ্বালিয়ে সকালবেলা স্বপ্নে তুই রুম্পাকে দেখছিস। কয়টা লাগে তোর? আজ দেখ তোর একদিন কী আমার একদিন।”

তিতাস চুল টান খেয়ে তড়িঘড়ি উঠে বসল। ভোরের হাত ওর চুল থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে জানাল, সে মজা করছে। একথা
আর বলবে না। ভোর জবাবে কিছু না বলে নিচে যেতে যেতে হাসল। কারণ সে জানত তিতাস জেগে আছে, ওকে রাগাতে
এসব বলছে। তারপর দু’জনে নাস্তা সেরে ঠিক করল আজ ওরা সারাটাদিন বাইরে ঘুরবে, খাবে। তিতাসের তাড়াহুড়োয়
ভোর কোনোমতে হাতের কাজটা সেরে রেডি হয়ে বেরিয়েও পড়ল। এই ছেলের সব কাজে তাড়াহুড়ো। অতঃপর গাড়িতে বসে তিতাসের কাঁধে মাথা রেখে ভোর চুপ করে বাইরের দৃশ্য দেখছে। এখন আর তিতাসের হাতটা ধরতে, জড়িয়ে ধরতে, বুকে মাথা রাখতে সংকোচবোধ করে না।বরং অধিকার বোধ কাজ করে। মন জোর দিয়ে বলে, ‘সে তোর, একান্তই তোর।’
আর তিতাসও ওর হৃদয়কে খোলা আকাশের মতো ভোরের সামনে নিজেকে মেলে ধরে। ভোরের অপূর্নতার আক্ষেপকে সে পূর্ণতা দিয়েছে। তার নারী মনে চাওয়া আবদারগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে, পূরণ করেছে। এমনও হয়েছে, মাঝরাতে উঠে নতুন শাড়ি কিনে এনে পরে দেখানোর আবদার করেছে। ওর পায়ে আলতা পরিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকেছে অনেকটা সময়।বেনুণি করে শিখেছে, হাতখোঁপা করে শিখেছে। যাতে সময় অসময়ে ভোরকে করে দিতে পারে। একটা সময় তার খুব আফসোস হতো বয়সে ছোট এক ছেলেকে বিয়ে করার জন্য। মনেও হতো, তিতাস তাকে কখনোই বুঝবে না। কিন্তু তিতাস তার এই আফসোস দূর করে দিয়েছে। বার বার সে প্রমাণও পেয়েছে, ‘তিতাস ওর জন্য পার্রফেক্ট জীবনসঙ্গী।’
হঠাৎ ব্রেক করাতে ভোরের ভাবনার ছেদ ঘটল। সে মাথাটা তুলে দেখে তিতাস বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোর ওর দৃষ্টি অনুকরণ করে দেখে, আয়মানকে দু’জন ধরে গাড়িতে তুলে বসাচ্ছে। আয়মানে দুই পা সহ এক হাত নেই। তিতাস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-”আয়মানকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু পাপ নাকি তার বাপকেও ছাড়ে না। আয়মানের করা পাপই তাকে এই অবস্থায় ফেলেছে।’

-”ঠিক, সে তার পাপেরই শাস্তি পাচ্ছে।”

একথা বলে ভোর পুনরায় তিতাসের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। তবে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি।
মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। সত্যিই আয়মান তার পাপের শাস্তি ভোগ করছে। আর তাকে এই শাস্তি সে নিজে দিয়েছে।

~ সমাপ্ত

“(বিঃদ্রঃ- গল্পটা শুরু থেকে রহস্যে মোড়া ছিল। তাই শেষেও ছোট্ট একটা কিন্তু রেখে দিলাম নয়তো খুবই সাদামাটা মনে হতো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here