#প্রিয়কাহন❤️,০২,০৩
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব ।২।
‘ ছোটআম্মু জলদি আসো, প্রিয়তা অভী ভাইয়ার গায়ে গোবরসহ ময়লা পানি ফেলে দিয়েছে!’
রুদ্রর এ কথায় প্রিয়তার শরীরে যেন অনবরত কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। কি করলো এটা সে? মা দেখলে তো মেরেই ফেলবে তাকে। অভীর নিজেকে হাস্যপাত্র মনে হচ্ছে। হবু শ্বশুড়বাড়িতে আসতে না আসতেই গোবর পানি দিয়ে এত সুন্দরভাবে বরণ করবে জানলে কস্মিক কালেও এখানে পা বাড়াতো না। সে দেখলো বাগান থেকে ছুটে আসছে সায়রা বানু। কিছুক্ষণ বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রইলো নিজের মেয়ে প্রিয়তা আর অভীর দিকে। হায় আল্লাহ! কি কান্ড করেছে এই মেয়ে? মানসম্মান সব ধুয়েই ছাড়বে এই গাধীটা। অভীকে দেখে সায়রা বানু কাদো কাদো সুরে বললো,
‘ আহা! বাবা এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার? জলদি আসো। জলদি ভেতরে এসে পরিষ্কার হয়ে নাও। হাতে কি এটা?’
অভী আরও একবার দেখে নিলো হাতে থাকা বগুড়ার দই। নাহ! এটার সর্বনাশ হয়েছে। প্রিয়তা নামের গাধা মেয়েটা ওকে সহ বগুড়ার দইকেও গোবর পানি দিয়ে গোসল করিয়েছ। গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বেরোচ্ছে এবার। সায়রা বানু কি করবে ভেবে পেলো না। রগচটা হয়ে তাকালো সে প্রিয়তার দিকে। বললো,
‘ চোখ কি আসমানে তুলে পানি ছুড়েছিস তুই? সামনে এত বড় ছেলেটাকে তুই দেখিসনি?’
প্রিয়তা কেঁপে উঠলো মায়ের ধমকে। তোতলাতে শুরু করলো। কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এ নতুন না। অভীকে দেখলে সবসময়ই তার কথা গুলায়। আগে যখন নুরুল স্যারের কাছে পড়তে যেত তখনও। শেষমেষ বলে ফেললো,
‘ আমার কি দোষ, আমি কি জানতাম এই লোক হনুমানের মতো এসে পড়বে?’
সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলো প্রিয়তা। ফট করে যে অভীর সামনেই অভীকে হনুমান তুল্য করবে এটা খেয়াল করেনি। সায়রা বানু আরও খেপে গেলেন। অভীর সামনেই কান মলা দিলেন প্রিয়তার। বলে উঠলেন,
‘ পাজি মেয়ে। আর একটা উল্টাপাল্টা কিছু বলবি থাপড়িয়ে দাঁত ছুটিয়ে ফেলবো। জলদি অভীর হাত থেকে দইয়ের পাতিল নিয়ে চোখের সামনে থেকে দূর হ! আর রুদ্র, তুই অভীকে গোসল খানায় নিয়ে যা। আল্লাহ! কি অবস্থা করেছে সোনার ছেলেটার।’
অভী লজ্জায় পড়ে গিয়েছে। না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই প্রিয়তার বোন অরিন, চাচী আর দাদি যেভাবে অভীর দিকে তাকিয়ে ছিলো যেন ছেলেটা কোনো ভিনগ্রহের প্রানী। অবশ্য এখন ভিনগ্রহেরই লাগছে। এ বাড়িতে আসবে বলে মা একটা ধবধবে সাদা শার্ট ইস্ত্রী করে দিয়েছিলো অভীকে। এখন সেটা গোবর রঙে রাঙায়িত। এই লজ্জায় নুন ছিটা দিতে এসে পড়লো অদ্রি। ঘুমুঘুমু চোখ মিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে অভীকে দেখে চিৎকার করে বললো,
‘ ও আল্লাহ! রুদ্র অভী ভাইয়ার এ অবস্থা কেনো?’
অভী কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করলো। ইচ্ছে করছে প্রিয়তাকেও গোবরে মাখামাখি করিয়ে রাখতে। এই মেয়ের সাথে বাবা যে কেন ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে গিয়েছে তা নিজেও জানেনা অভী। রুদ্র অভীকে নিয়ে এলো প্রিয়তার রুমে। পাশের রুম থেকে নিজের একটা ট্রাউজার দিয়ে বললো,
‘ আপনি এই রুমের ওয়াশরুমে ঢুকে একটা চনমনে গোসল দিন ভাইয়া। ইচ্ছে করেই প্রিয়তার রুমে আপনাকে নিয়ে এসেছি। ওর বাথরুমে শ্যাম্পু বডি ওয়াশ যা আছে সব শেষ করে দিন। গায়ে ঢেলে মনমতো গোসল করুন। বি ইজি। প্রিয়তা আপনার গায়ে গোবর পানি ফেলেছে। আপনারও উচিত ওর সব শ্যাম্পু সাবান শেষ করা। ইটস কলড রিভেন্জ টু রিভেন্জ।’
সুর টানতে টানতে প্রিয়তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রুদ্র। অভী নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর গোসলের জন্য পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে।
.
.
কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে প্রিয়তার। পরনে সুতি জামায় প্যাচপ্যাচে ভাব। চাচী রান্নাঘরে খুন্তি নিয়ে তীক্ষ্ণভাবে দেখে চলছে প্রিয়তাকে। পাশে সায়রা বানু সমানতালে বলে চলছে কি ঘটেছে একটু আগে। মাঝে মাঝে প্রিয়তার তো সায়রা বানুকে কুটনীবাজ মা মনে হয়। এই মহিলা কিছু পারুক আর না পারুক, নিজের পেটের সন্তানের বদনাম অন্যের কাছে বলতে পারদর্শী।
ইলিনা বেগম দম নিলো। বলে উঠলো,
‘ তুই কি জীবনে ঠিক হবি না রে প্রিয়তা?’
প্রিয়তা বলতে গেলেও কিছু বললো না। সে তো আর ইচ্ছে করে পানি ছুঁড়ে মারেনি। অদ্রি চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে বড়ই খাচ্ছিলো। আচমকা বললো,
‘ এখন এটা বলবি না যে তুই ওই হাতি সাইজ মানুষটাকে দেখিসনি।’
প্রিয়তা মনে মনে অদ্রিকে গালাগাল দিলো। ভয়াবহ টাইপ গালাগাল দিলো। মেয়েটা জানে যে সে এখন ভয়াবহ অবস্থায় আছে তবে এসব কথাবার্তা বলে উত্তাল করছে কেন পরিবেশ। সব ছেড়ে যদি সন্ন্যাসবেশে পালিয়ে যেয়ে অভী নামক উৎপাত থেকে পালাতে পারতো তাইলে বেশ হতো। সায়রা বানু বললেন,
‘ এই৷দূর হ চোখের সামনে থেকে। অভীর কাছে রুদ্র আছে। ভুলেও ওর ধারেকাছে যাবি না। নাইলে কি ঘটিয়ে দিবি খোদাই জানে। ‘
সায়রা বানুর কথাটি বলতে দেরি, অদ্রিকে হাত টেনে দৌঁড়ে বাগানের দিকে চলে গেলো দু’জনে। বাগানে অরিন সহ ওদের বাকি ভাইবোনেরা আছে। বাকি দুজন হলো রুশি আর তুশি, দুজনেই ছোট ফুপির ছয় এবং আট বছরের মেয়ে। রুশি তুশির বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের ফুপি এখানেই থাকছে। প্রিয়তা আর অদ্রিকে দেখা মাত্রই দুবোন হইহই করে ছুটে এলো তাদের কাছে।
অদ্রি গাল টেনে বললো,
‘ আমার ময়নাপাখিগণস! কি অবস্থা? কাচকলা ভর্তা খেয়েছিস!’
‘ হুম অদি আপু, ভীষন ইয়াম্মি। প্রিয়তা আপুর বিয়ে হলে দাদিকে বলবো, পোলাও মাংস না দিয়ে সবাইকে কাচকলা ভর্তা খাওয়াতে।’
হেসে দিলো প্রিয়তা। এই দুজনেই ভীষণ মজার কথা বলে। তুশির মুখ ভার। অদ্রি জিজ্ঞেস করলো,।
‘ তোর আবার কি হলো?’
‘ রুশি আমার ভাগ লুটেপুটে খেয়েছে অদি আপু। তুমি ওরে মাইর দাও।’
অদ্রি বিচক্ষণের মতো ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
‘ শোন পিচ্চি, কোনো ঝামেলা হলে বড়দের বলবি না, ডিরেক্ট ধুমধাম লাগিয়ে দিবি। একবার কি হয়েছে শোন৷ তোর রুদ্র ভাইয়া আর আমি একবার গাছে উঠেছিলাম আম পাড়তে। শালায় আমার হাতে থেকে আম টেনে সিঙ্গারা বানিয়ে খেয়েছে। ‘
তুশি রুশি আগ্রহ নিয়ে তাকালো অদ্রির দিকে৷ বললো,
‘ তারপর কিছু বলোনি ভাইয়াকে?’
‘ তুই কি আমায় প্রিয়তা পেয়েছিস যে কিছু হলেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম? আমি পাল্টা মেরেছি ওকে। পাছায় এমন এক লাত্থি দিয়েছি যে ব্যাটায় ফট করে গাছ থেকে পড়ে গেছে। চৌদ্দ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো৷ একমাস, বিছানায় চিৎ হয়ে শুতে পারেনি।’
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তুশি রুশি। প্রিয়তা রাগে কটমট করে বললো,
‘ কি শিখাচ্ছিস ওদের?’
‘ তুই এখানে নজর দিস না মামা? তুই তোর পেয়ারের বরের কাছে যা। ‘
‘ কি যা তা বলছিস? আমি অভী ভাইয়াকে বিয়ে করবো না।’
‘ তুই যা আকাম শুরু করেছিস সে নিজেও তোরে বিয়ে করবো না। সো টেনশন মুক্ত থাক। তবে ভেবে দেখিস জানু। পোলায় হট আছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সিনিয়র স্টুডেন্ট অভী ভাইয়া। আমাদের ব্যাচসহ সব ব্যাচেই তার নামডাক৷ তার ওপর তোর কলেজের স্যারের বড় ছেলে। এমন ছেলেরে কেমনে রিজেক্ট করতে চাস তুই?’
‘ তুই জানিসনা কেন?’
‘ হইসে, আর বলতে লাগবো না। এখন যা উপরে যা। আমি এখন ভর্তা খাবো।’
পা চালিয়ে উপরে গেলো প্রিয়তা। অভী মনে হয় রুদ্রর রুমে গোসল করছে। রুদ্ররও আশপাশে কোনো খবর নেই। প্রিয়তা দ্রুত জামা পাল্টানোর জন্য নিজের ঘরে গেলো। শরীরে ঘাম জবজব করছে উত্তেজনায়। প্রতিবারই অভীর সামনে কিছু না কিছু কান্ড করেছে সে। এগুলো করা যাবে না। কাল ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অভীকে পেলে সে ঠান্ডা মাথায় বুঝাবে যে সে বিয়ে করবে না। এখন এই জলসা বাড়িতে না বলাটাই শ্রেয়৷ প্রিয়তা মায়ের ভয়ে ড্রয়ার থেকে একটা পাতলা সুতির শাড়ি হাতে নিলো। পর্দা টেনে দিলো ঘরের। সকালে চনমনে রোদ উঠলেও ঘরে এখন আলো আধারীর নিবাস। প্রিয়তা নিজের জামার চেনে হাত দিলো। সেটা টেনে নিচে নামাতেই হঠাৎ পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা সুরে ভেসে এলো এক পুরুষালি কন্ঠস্বর,
‘ প-প্র-প্রিয়তা?’
হাত থেমে গেলো প্রিয়তার। নাহ! ভুল শুনেছে। এ অভী হতে পারে না। মোটেও অভী হতে পারে না। অভী হলে লজ্জায় আরও একদফা অজ্ঞান হয়ে যাবে সে। আল্লাহ! তুমি মেয়েটাকে সজ্ঞানে থাকার শক্তি দাও।
.
#চলবে
#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |৩|
প্রিয়তা একবার নিজের জামার খোলা চেইন দেখলো আর একবার দেখলো সামনে শুধু ট্রাউজার পড়া অভীর দিকে। অল্প মুহূর্তে চট করেই সে বুঝে ফেললো পরিস্থিতিটা। হাতে থাকা শাড়ির ভাঁজ খুলে নিচে পড়ে গেলো । কোনোমতে জামার চেইন লাগিয়ে চিৎকার দিতে যাবে সাথে সাথেই অদূরে দাঁড়ানো মানুষটা ঝড়ের গতিতে এসে পড়লো প্রিয়তার কাছে। দুরত্ব ঘুচালো। প্রিয়তাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো আতঙ্কে। এছাড়া উপায় নেই। নাহলে এই মেয়ে যা, চিল্লিয়ে পাড়া সুদ্ধ সবার কাছে ব্যাপারটা সম্প্রচার করে বেড়াবে।
প্রিয়তার বুক ধক করে উঠলো। অভীকে এত কাছে পেয়ে আরও একদফা জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো। অভীর গায়ে চিকচিক করছে মুক্তাদানার মতো পানি। চুলে ভেজা। সেখান থেকে সুরসুর করে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ বেরোচ্ছে। মাথা ধরে যাচ্ছে এই সুগন্ধে। ডানপিটে বলিষ্ঠ এই শরীরের চাপে প্রিয়তা যেন হিতাহিতজ্ঞান হারালো। অভী তা দেখে বলে উঠলো,
‘ খবরদার প্রিয়তা উল্টাপাল্টা কোনো অঘটন ঘটাবে না। এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্টে। ক্লিয়ার? এখন শান্ত হও।’
বলেই চট করে দূরে সরে এলো অভী। প্রিয়তা নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ক্রমাগত। অভীর দিকে তাকানোর শক্তি তার নেই। ছেলেটার শরীরের গড়ন ভয়ংকর, ভার্সিটিতে চেক শার্ট আর ডেনিমের ভীড়ে অভীর গায়ের এমন আকর্ষণীয় গঠন বোঝা দুষ্কর। প্রিয়তা ঠোঁট ভেজালো। শাণিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ আপনি আমার…আমার রুমে কি করছেন?’
বিরক্ত হলো অভী। ভেজা গা, টাওয়েল দেখে বুঝতে পারছে না বোকা মেয়েটা? অভী দাঁতো দাঁত চেপে বললো,
‘ খালি গায়ে ক্রিকেট খেলছি। আমার অ্যাম্পায়ার হবে নাকি?’
প্রিয়তা ভীমড়ি খেলো। ধরতে পারলো না অভীর অনির্দেশক কথা। বলে উঠলো,
‘ এটা কি ক্রিকেট খেলার জায়গা?’
অভী হাল ছাড়লো। নাহ! এই মেয়ে তার মাথা ঘুরিয়ে ফেলবে। নিঃশ্বাস ফেললো অভী। ঘন কালো চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে তা ঠেলে দিলো পেছনে। বললো,
‘ আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার ভাই রুদ্রিক কে পাঠাও। ছেলেটা আমায় শুধু ট্রাউজার দিয়েই সটকে পড়েছে। এখন শুধু ট্রাউজার পড়েই বাইরে বেরোবো নাকি?’
রুদ্রের ভালো নাম রুদ্রিক। তবে পরিবারের সবাই ওকে রুদ্র নামেই ডাকে। অভীর হঠাৎ এ নামে সম্বোধন করাতে প্রিয়তা যেন ভুলে গিয়েছিলো রুদ্রের সার্টিফাইড নাম। অতঃপর বললো,
‘ কেন আপনার জামা কই?’
প্রিয়তা ফট করে মুখ চেপে ধরলো এবার। হায় আল্লাহ! সে তো এত বোকা না। তাহলে অভীর সামনে এমন বোকা বনে গিয়েছে কেন সে? অভী কিড়মিড়িয়ে বললো,
‘ আমার শার্ট আর প্যান্ট কি তুমি পড়ার অবস্থায় রেখেছো?’
প্রিয়তা কথা বললো না। তাকালোও না অভীর দিকে। এর দিকে মোটেও তাকানো যাবে না। নাইলে অদ্রির মতো ভয়াবহ কয়েকটা বেফাঁস কথা বলে ফেলার সম্ভাবনা আছে। তবে মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে সে। এই কারনে, ঠিক এই কারনেই অভীকে তার পছন্দ না। ছেলেটা চরম ইগোস্টিক। ভাব তো এমন যে মেয়েদের সাথে কথা বলাই পাপ। প্রিয়তা নিজেকে ধাতস্থ করলো। বলে উঠলো,
‘ আপনি, আপনি থাকুন। আমি রুদ্রকে নিয়ে আসছি।’
বলেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলেই স্তব্ধ হলো প্রিয়তা। অদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। কোলে তুশি রুশি। হ্যাংলা পাতলা দুটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আসতে অদ্রির তেমন অসুবিধা হলো না। তবে সে এখন চরম বিস্ময়ে আছে। মাথা বাকিয়ে বোয়াল মাছের মতো হা করে দেখে নিলো অভীর আগুন রূপ। তারপর চেচিয়ে বলে উঠলো,
‘ ওএমজি, অভী ভাইয়া হাফ নেকেড হয়ে তোর রুমে কি করছে প্রিয়ু?’
প্রিয়তা বিষম খেলো। অস্থির হয়ে ইশারায় চুপ করতে বললো অদ্রিকে। তুশি রুশির দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে ওরা কিছুই বোঝেনি। তবুও ওরা আদরের অদি আপুর মতো ভনিতা করে প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ হাফ নেকেড হয়ে তোমার রুমে কি করছে হুম..হুম?’
অথচ এই দুটো পিচ্চি এখনও জানে না এর বাংলা অর্থ কি। অভী প্রিয়তাকে ইশারায় বললো অদ্রিকে নিয়ে ভেতরে আসতে। প্রিয়তা সাথে সাথে তাই করলো। অভীর মুখ ভার। চোখের শীতল দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তার মনে কি চলছে। রুদ্রিকও ইতিমধ্যে এসে পড়েছে পোলো শার্ট নিয়ে। সেটা অভী গায়ে গলিয়ে দিলো। তারপর নিখাদ কন্ঠে বললো,
‘ ট্রাস্ট মি রুদ্রিক আজ যদি এ বাড়িতে এজ এ তোমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়া হয়ে আসতাম কষিয়ে দুটা চড় মারতাম।’
রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। সে রীতিমতো ভুলে গিয়েছিলো অভীর কথা যে সে প্রিয়তার রুমে আছে। এমনিতেও অভীকে রুদ্র ভয় পায়, একটু না, বাড়াবাড়ি রকমেরই ভয় পায়। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ইভেন্ট চলাকালীন সময় প্রায়ই রুদ্রকে কাজ করতে হয়েছে অভীসহ আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র স্টুডেন্টদের সাথে। তারপর থেকেই অভীর গম্ভীরতা, প্রগাঢ় দৃষ্টি আর একরোখা টাইপ ব্যবহারের জন্য রুদ্র,অদ্রি,প্রিয়তার মতো আরও অনেক ডানপিটে স্বভাবের ছাত্রছাত্রীরাই ছিলো অতিষ্ঠ।
অভী উঠে দাঁড়ালো। চোখ বুলিয়ে নিলো প্রিয়তার ঘরে। মেয়েটা ভীষণ বই পড়ুয়া। এটা অবশ্য আগে থেকেই জানে। সেই সাথে একটু অস্থির ধরনের মেয়ে। যদিও অভীর সাথে বিয়ের ব্যাপার এগোনোর পর থেকে মেয়েটাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বোকা খেতাবি দিতে ইচ্ছে করছে। তুশি রুশি চকলেট খাচ্ছিলো। হুট করে অভীকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ তুমি এতক্ষণ কি করছিলে এখানে?’
প্রিয়তা সচকিত হয়ে তাকালো ওদের দিকে। এতক্ষণে অভীর ঠোঁটে ফুটলো হাসি। খুব সুক্ষ্ণ একধরনের হাসি। বলে উঠলো,
‘ তোমার প্রিয়ু আপুর সাথে ক্রিকেট ক্রিকেট খেলছিলাম।’
বিষম খেলো রুদ্র,অদ্রি। অকপটে চাইলো দুজনে প্রিয়তার দিকে। বলে উঠলো,
‘ শালী এই না ঢং দেখালি যে বিয়ে করবিনা, আর এখন বিয়ের আগেই ক্রিকেট-ফুটবল সব খেলা শেষ? আমিও তো বলি যে তুই আর ভাইয়া এক ঘরে কি করছিলি। হায় খোদা! তুই এতবড় ধোকাবাঁজ হতে পারলি? আমায় না বলে কয়ে সত্যিই তার সাথে ক্রিকেট খেললি?’
প্রিয়তা আড়চোখে দেখলো অভীর চোখে মুখে দুর্বোধ এক হাসি। যেন ইচ্ছে করেই অদ্রির সামনে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে কান্না জুড়ে দিলো তুশি রুশি। বলে উঠলো,
‘ জানো রুদ্র ভাইয়া যখন পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে চায় তখন আমাদের নেয়না। আমিও ক্রিকেট খেলতে চাই ভাইয়া।’
রুদ্র কোলে নিলো ওদের। বলে উঠলো,
‘ এই ক্রিকেট সেই ক্রিকেট না রে বইন। এই ক্রিকেট বেড রুমে খেলতে হয়। তোরা যেদিন বড় হবি, নিজেদের বেডরুম হবে, তখন ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি সব খেলিস।’
দুজনেই বোকা বোকা চোখে দৃষ্টিপাত করলো তাদের ভাইয়ার দিকে। প্রিয়তার মুখ হা। কি শুরু করেছে এরা। অভীর প্রতি ভয়ঙ্কর রাগ উঠছে প্রিয়তার। ছেলেটা ইচ্ছে করেই তাকে ফাসিয়েছে। এই শোধ সে নিয়েই ছাড়বে।
____________
পায়েস খাচ্ছে অভী। সামনে হা করে তাকে দেখছে অদ্রি আর প্রিয়তা। অভী নাস্তানাবুদ হলো। সায়রা বানু এক মুহূর্তের জন্য এখান থেকে চলে যেতেই সে শীতল কন্ঠে বললো,
‘ এমন বোয়াল মাছের মতো আমায় দেখছো কেনো অদ্রি?’
‘ হবু দুলাভাইকে দেখতে দোষ নেই ভাইয়া। প্রিয়তা মরে গেলেও এমন করে বিয়ের আগে আপনাকে দেখবে না। তাই শালী হিসেবে আমারই তো উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা। তাইনা?’
প্রিয়তা চিমটি দিলো অদ্রির উরুতে। বললো,
‘ আল্লাহর ওয়াস্তে ১০ মিনিটের জন্য তোর লু’চ্চা’মি অফ কর।’
অদ্রি পরোয়া করলো না। সায়রা বানু এসে প্রশ্ন করলেন,
‘ পায়েস টা তোমার কেমন লাগলো অভী বাবা?’
‘ ভালো হয়েছে।’
‘ আচ্ছা শোনো, আজ তো কথা ছিলো প্রিয়তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। কাল নাহয় যেও? সারাদিন ঘুরবে, একে অন্যকে টাইম দিবে। তাহলেই তো ব্যাপারটা এগোবে।’
প্রিয়তার মনে একটু ক্ষীণ আশা ছিলো হয়তো না বলবে। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেলো অভী। একপলক প্রিয়তার মুখ দেখে ক্ষীণ হাসি দিলো। প্রিয়তার কাছে মতিগতি ভালো লাগছে না অভীর। এই ছেলে মনেমনে ভয়ঙ্কর কিছু পরিকল্পনা করেছে।
অভী যাওয়ার অনিতপূর্বেই আস্তে করে কেটে পড়তে চাইলো প্রিয়তা। কিন্তু ওর ভাগ্যটা বড্ড খারাপ। এতগুলো অঘটনের পরও খোদা ওর ওপর রহম করলো না। অভী যাওয়ার পূর্বে সবার চক্ষুগোচরে হাতছানি দিলো প্রিয়তার। দুরত্ব ঘোচালো। এতদিন মুখ গম্ভীর থাকলেও এখন ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি। বলে উঠলো,
‘ আজকে বেডরুমে তোমায় ওই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রিয়তা। নেক্সট টাইম এমন কাজ করবে না। ভুলেও করবে না। বিয়ের পর এমন কোনো কান্ড বাঁধালে সাথে সাথে আছাঁড় মারবো তাহলে। আর হ্যাঁ, বেশি করে প্রোটিন খাও। এখন অজ্ঞান হওয়া টওয়া চলবে না। সামনের পরিস্থিতি গুলোতে তোমায় সটান হয়ে থাকতে হবে। সি ইউ টুমোরো মিস তাহমিনা প্রিয়তা। উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট!’
বলেই বাইরে পা বাড়ালো অভী। প্রিয়তা থমকে রইলো। ভুলে গেলো হিতাহিত পরিবেশ। কি বললো এসব অভী? এতকিছুর পরও সে কি সত্যি সত্যি বিয়ে করবে প্রিয়তাকে। অদ্রি পেছনে সবই শুনেছিলো। প্রিয়তার কাছে এসে বেপোরোয়া সুরে বললো,
‘ তোর চু’মুর পাওয়ারে পাল্টি খেয়েছে বস! কেন জানি মনে হচ্ছে তোর বিয়ে অভী ভাইয়ার সাথেই হবে।’
ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদন নিয়ে প্রিয়তার গ্লানি চোখজোড়া অদ্রিকে বিভৎসভাবে উপহাস করলো। মনে মনে সে বলে উঠলো,
‘ তোরা সবক’টা শয়তান। কাল আমিও ওই অভী ব্যাটাকে দেখাবো প্রিয়তার সাথে ঝামেলা করার মজা!’
.
.
.
#চলবে