#প্রিয়কাহন❤️,২২,২৩
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |২২|
দিনগুলো পেরিয়ে গেলো ঝড়া পাতার দিনের মতো করে। প্রিয়তা তৃতীয় বর্ষের টানাপোড়নের প্রবাহ শেষ। এখন বিরতি নিয়ে রেজাল্ট দেওয়ার পর চতুর্থ বর্ষের অপেক্ষা। অভী এখন ছুটছে চাকরির পেছনে, যদিও তার যোগ্যতা আর সিজিপিএ ভালো চাকরিরই বন্দোবস্ত করতে পারে- তবুও তার এত সময় লাগছে কেন কে জানে? অন্তু বাবার ব্যাবসা সামলাচ্ছে, আর বাকিরাও কেউ না কেউ হয়তো চাকরি করছে নতুবা একটি চাকরির আশায় তৃষ্ণাপ্রার্থী। প্রিয়তা খুব বেশি ভাবলোনা, হয়তো অভীর জন্য ভালো কিছুই আছে।
.
উষ্ণতার অন্তিম প্রহর। এতদিনের তিতকুটে গরম আর ভারি বাতাসের ইতি টেনে আগমন ঘটেছে শ্রাবণের বিধ্বংসী হাওয়ার। যখন তখন আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা নিয়ে এসে পড়ে মুষলধারে বৃষ্টি। ভাবতেই অবাক লাগে ওদের প্রণয় হয়েছিলো কোনো এক রোদনভরা বসন্তে। আর আজ চলছে আষাঢ়ের প্রহর পেরিয়ে শ্রাবণের লীলাখেলা। প্রিয়তা হাই তুললো আনমনে। বসে আছে তাদের বাড়ির ছাদে পাতানো চেয়ারে। প্রতি বর্ষায় তার চাচা এখানে চেয়ার পেতে রাখে যাতে বৃষ্টির ঠিক অন্তিম মুহূর্তে এখানে বসে দৃশ্যবিলাশ করতে পারে। উপভোগ করতে পারে ছোট বড় সাজানো গোছানো মানুষের বাড়িগুলো পেরিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ি উপত্যকা।
প্রিয়তার হাতে একটি বই। জেমস রেলিন্সের ‘অ্যামাজনিয়া’, বইটি তিনদিন ধরে সে ধার নিয়েছে প্রাণোর কাছে থেকে।চরম থ্রিলার আর অ্যাডভেঞ্চারাস একটি বই। অনায়াসে হলিউডের একটি মুভি বানানো সম্ভব। বিকেলে আজ অনেকদিন পর দেখা যাচ্ছে মিষ্টি রোদ্দুর। এসময়ে বকুল ছায়াতলে ছাদে বসে বই পড়া মন্দ ব্যাপার না। রোদের প্রতিফলনে চিকচিক করছে অনামিকা আঙুলে পরা আংটিটি। অভীর চিহ্ন এটি। দিয়েছিলো খুব শখ করে। অতি সাবধানে এটি নিয়ে চলাফেরা করলেও শেষ মেষ বাবা-মা সবার হাতেই ধরা পড়ে যায়৷ তারা মিটমিটিয়ে হেসেছিলো শুধু যখন শুনেছে এটা অভী দিয়েছে। প্রিয়তা যে কিভাবে তখন নিজের মুখ লুকিয়েছিলো কে জানে?
‘ আপু!’
ডাক পড়লো প্রিয়তার। সামনে তাকিয়ে দেখলো অরিন। হাঁপাচ্ছে সে। বুক ওঠানামা করছে তালে তালে। বললো,
‘ একটু আগে নুরুল আঙ্কেল ফোন করেছিলো। তারা আসছে।’
চট করে বোধগম্য হলোনা প্রিয়তার কথাটি। বললো,
‘ তারা আসছে মানে? সবাই?’
‘ জ্বি মেরি আপা। সবাই বলতে অভী ভাইয়াও আসছে।’
ব্যাপারটা শুনতেই শ্রাবণ মাসেও মনে ফুরফুরে হাওয়া বইতে লাগলো বসন্তের মতো। অরিনের চক্ষুগোচর তা হয়নি৷ ঠোঁট চেপে বললো,
‘ তোমাদের এত প্রেম দেখলে বাঁচি না। এখন যাও। হাতে সময় নেই। এমনিতেও সব ঠিক আছে তবে আর অভী ভাইয়ার সামনে আরও একটু সুন্দর সাজতে চাইলে এখনই সেজেগুজে নাও। অদ্রি আপু বাসায় নেই। দেখলে ক্ষেপাবে আবার।’
চট করে উঠলো প্রিয়তা। বাঁধা চুলগুলো ভালোমতো বেঁধে নিচে দৌড় দিলো। মুখ হাত ধুয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। তৈলাক্ত মুখ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে এখন। অদ্ভুতভাবে প্রিয়তা আজ সেই শুভ্র জামাটিই পড়েছে যেটা সে পড়েছিলো অভীর সাথে নিশিপ্রহরের সাক্ষাৎ এর মুহুর্তে। অভী প্রথম কাছে এসেছিলো সেদিন। দিয়েছিলো অধরে নেশা লাগানো একটি স্পর্শ। প্রিয়তা সে দৃশ্য আর অনুভূতি কখনোই ভুলতে পারে না৷ চোখ বন্ধ করলে সেই সময়ের কথা ভাবলেই আরশির মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে সব।
প্রিয়তা চোখে কাজল দিলো। কাজল অভীর প্রিয়। সেই সাথে কানে পড়লো ছোট পাথুরে দুল। চিকচিক করছে সেটা। এতেই প্রিয়তাকে লাগছে অপ্সরীর মতো। আচ্ছা অভী কেন আসছে আজ সপরিবারে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে?
ভাবনার ছেদ কাটলো নিচে কলিংবেল বাজাতে। অবগত হলো তারা এসে পড়েছে। প্রিয়তার ফুপি এসেছিলো এর মধ্যে। বললো পরিপাটি হয়ে থাকতে। প্রিয়তা তাই নিচে বসার ঘরে গেলো চুপটি করে। বুকে বহমান একরাশ শুভ্র অনুভূতি।
অভী বসে আছে তার বাবা মায়ের পাশে। মনে তীব্র খচখচানি। এমন না যে এখানে সে ইতিপূর্বে আসেনি। কিন্তু এবারের উত্তেজনা কিছুটা অন্যরকম। প্রিয়তাকে মাত্র দেখেছে সে। বাবা-মা’কে সালাম দিয়েছে। এখন তার ফুপির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। তাকে দেখামাত্রই ধ্বক করে উঠলো অভীর বুক। ছুটতে লাগলো পাগলা ঘোড়ার মতো। মেয়েটা দিনদিন আরও মায়ারাণী হয়ে যাচ্ছে। অভীর মায়ারাণী। চুপসানো মুখের উজ্জল গড়ন, নত দৃষ্টি সবকিছুই গায়ে হিম ধরিয়ে দেয়। আড়চোখে তাকাচ্ছে একটু পর পর। অস্বস্তিতে ওড়নার মুঠো ধরে রেখেছে। অভী নিখুঁতভাবে শনাক্ত করছে প্রিয়তার প্রতিটি কার্যকলাপ। চোখের প্রগাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা তা দেখা মাত্রই হিম হলো। নত করলো মুখ। চোখাচোখি হওয়ার আর সাহস পেলো না। অভী এমন কেন? একটু কঠোর দৃষ্টিতে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়!
নুরুল সাহেব একটা হাসি দিলেন প্রিয়তার বাবার দিকে তাকিয়ে। বললেন,
‘ আসলে অনেক কথা তো বললাম। তবে এগুলো জরুরি বিষয় না। আমরা একটি ব্যাপার জানাতে এসেছি।’
এতক্ষণ হাসি আনন্দে পরিপূর্ণ মুখ নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেলো। অজান্তেই একটু ভয় পেলেন প্রিয়তার মা। সব ঠিক আছে তো? তার মেয়ে তো পাগল। এ উলট পালট কিছু করলো না তো? তাই তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন,
‘ সব ঠিক আছে তো?’
‘ আরে ভাবি ভয় পাবেন না। সবই আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছে। আসলে একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি। এটা আপনাদের কাছে সুসংবাদ হবে না অন্যকিছু তা বুঝতে পারছি না।………………… আসলে, অভীর জব হয়ে গিয়েছে। ‘
নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। অভী যা ছেলে আজ হোক বা কাল একটা ভালো চাকরি পেতোই। প্রিয়তার চাচা বললো,
‘ এটা তো সুসংবাদ ভাইজান। আপনি যেভাবে বললেন আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
‘ আসলে এখানেও একটি ব্যাপার আছে।’
‘ কি?’
নিঃশ্বাস ফেললো নুরুল সাহেব। জড়ানো গলায় বললেন,
‘ ইউএসএ তে জবটা হয়েছে অভীর। এর জন্য ছয় মাসের ট্রনিং এর জন্য আগেই ভার্জিনিয়ায় যেতে হবে।’
কথাটা নিঃসন্দেহে সুখের। তবে কেন যেন কেউ সুখী হতে পারলো না৷ প্রিয়তা তো একেবারেই না৷ ভার্জিনিয়া? এর মানে অভী তাকে এভাবে একা ফেলেই দূরে চলে যাবে? আর এসব কাজ তো একদিনে হয়নি। তাহলে জানালো না কেন এত বিরাট ঘটনা?
পুরো সাখাওয়াত ভিলা নীরব। কেউ কি বলবে ভেবে পেলো না৷ প্রিয়তার বাবা অস্বস্তি নিয়ে বললেন,
‘ এটা তো সুসংবাদ ভাইজান। কিন্তু অভী আর প্রিয়তার বিয়েটা তাহলে….’
‘ সেটাই সমস্যা ভাইজান। ছয় মাসের ট্রেনিং হলেও সেখানে সবটা সামলানো অভীর জন্য বছর কয়েকের ব্যাপার দাঁড়াবে। আর ওখানে যাওয়া মানে ওর লাইফ স্যাটেল। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে দিচ্ছি। আপনারা স্থগিত রাখবেন নাকি ভেঙে ফেলবেন?’
‘ভেঙ্গে ফেলবেন’ কথাটি কি চট করেই না বলে ফেললো সে? হয়তো অস্বস্তি ছিলো নুরুল সাহেবের মনে। তবে সেটা বহু কষ্টেই কাটিয়ে তুলেছে। প্রিয়তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। বহু কষ্টে সামলালো নিজেকে। প্রিয়তার বাবা বললো,
‘ তা তো হয় না ভাইজান। আমরা কি অভীকে এভাবেই প্রিয়তার জন্য পছন্দ করেছি? কবে যেতে হবে অভীর?’
‘ এ মাসেই।’
এটা আরও মর্মাহত খবর মনে হলো প্রিয়তার কাছে। কথা বললো না সে। চুপচাপ শুনে গেলো বড়দের কথা। তন্মধ্য অভী চট করে বললো,
‘ আপনারা প্রিয়তা থেকে মতামত নিয়ে নেবেন আঙ্কেল-আন্টি। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে, আমি নিশ্চয়ই এটা চাইবো না। তবুও আমি ওর সিদ্ধান্তকেই মেনে নিবো।’
কথা হলো আর অল্পক্ষণ। অতঃপর চলে গেলো তারা। প্রিয়তার পরিবারের এক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই দেখে প্রিয়তার অভিমান হলো খুব। বিয়ের জন্য এতবছর অপেক্ষা? বাবা-মা এমন কেন? একবারও জানার প্রয়োজন বোধ করলোনা যে অভী চলে গেলে সে সুখী হতে পারবে না? এই প্রথম নিজেকে স্বার্থপর লাগছে প্রিয়তার। কিন্তু কিছুই করার নেই। অভীর এমন ব্যাবহারও কাদিয়ে দিলো তাকে। তাই একপ্রকার রাগ হয়েই সে পরিবারের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলো। অভীর দোষ দিবে কেন সে? যেদিকে পরিবারই তাকে মূল্য দেয় না?
__________
দুদিন ধরে বাবার সাথে কথা বললো না প্রিয়তা। শুধু বাবার সাথে বললে ভুল হবে, একপ্রকার কারও সাথেই না। গুমোট হয়ে ঘরে বসে রইলো। বন্ধুবান্ধবরা ফোন করে- এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয় তবুও সে নীরব। অদ্রিও মনমরা হয়ে গেলো প্রিয়তার জন্য। মনে মনে আরও একদফা ইচ্ছে হলো অভীকে দুলাভাই থেকে বহিষ্কার করার। কিন্তু এখানে তো তারও কোনো দোষ নেই। অদ্রি বললো,
‘ আর কত এভাবে থাকবি জানু? ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা উচিত না?’
‘ কি ক্লিয়ার করবো আমি?’
‘ তোর কথা বলা উচিত। কম তো ফোন দিচ্ছে না ভাইয়া। একবার তো তাকে জানা? এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস- ভাইয়াকেও কষ্ট দিচ্ছিস!’
প্রিয়তা কিছু বললো না। চুপচাপ অদ্রিকে এড়িয়ে চলে গেলো। বেশ কয়েকদিন অভীকে ভার্সিটির আশেপাশে দেখলো প্রিয়তা। অভীর এখানে কাজ শেষ – তবুও এখানে সে কেন আসে তা প্রিয়তাসহ গোটা ক্যাম্পাস জানে। অস্থির লাগে অভীকে। অন্তু যখন তারই হবু বউকে এখনও ‘পটেটো’ বলে ক্ষেপায় ধুমধাম কিল বসিয়ে দেয়। প্রিয়তা দেখে, বুঝে- তবুও কিছু বলেনা। সন্ধ্যায় মোড় থেকে তুশি রুশির জন্য ফুচকা আনতে গেলে সেখানেও বন্ধুদের সাথে ঘোরাফেরা করে অভী। ক্লান্ত দেহ, সারাদিন এম্বাসির চক্করে দিন যায় তবুও এখানে আসতে ভুলে না। প্রিয়তা কারও সাথে কথায় কথায় কাছে দাঁড়ালে সতর্ক করে ইশারায়। প্রিয়তা তা দেখেও নিশ্চুপ। কি দরকার মায়া বাড়ানোর? মানুষটা তো চলেই যাবে বলে পণ করেছে।
এতদিন চুপ থাকলেও সেদিন অভী ঘটালো ভয়াবহ কান্ড। মিথিকে পড়িয়ে আসছিলো প্রিয়তা। বিকেলের সময়। রুদ্র ফুরিয়ে তপ্ত প্রহর। কোথেকে অভী এসে বাঁধা দিলো পথে। প্রিয়তা অসংকোচে পড়লো। বললো,
‘ কি হলো আপনার?’
‘ তোমার কি হয়েছে বলো!’
ভরাট কন্ঠ অভীর। স্পষ্ট প্রতীয়মান প্রিয়তার একটা বিহিত সে করেই ছাড়বে। প্রিয়তা ঋজু হলো। কোণঠাসা হয়ে উঠলো মন। বললো,
‘ কি হবে আমার?’
অভী অনেক কষ্টে সামলালো নিজেকে। একটা ট্যাক্সি ডেকে চুপচাপ বসে পড়লো ওটাতে। প্রিয়তাকে বসতে বললো ইশারায়। ওর মাথায় চেপেছে ভয়ঙ্কর রাগ। মেয়েটার এমন চুপসে যাওয়া ওকে ধৈর্যহারা বানিয়ে দিচ্ছে।। প্রিয়তা নত হলো। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই অভী থমথমে গলায় বললো,
‘ আমায় রাগিও না প্রিয়তা। ট্যাক্সিতে উঠো। ইউ নো হোয়াট, তোমায় জব্দ করার জন্য ট্যাক্সি সবচেয়ে বেস্ট প্লেস। তোমার কি হয়েছে সেটা যতক্ষণ অব্দি তুমি না বলবে ততক্ষণ তুমি নিস্তার পাবে না।’
প্রিয়তা দমে গেলো। রাগও হলো ভীষণ। দু চারটা ভারি কথা শোনাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু অভী রেগে আছে আরও ভয়াবহভাবে। এই মানুষটার চোখেই রয়েছে ভয়ঙ্কর মাদকতা। যা থেকে প্রিয়তা রেহাই পায় না। আজও পেলো না। তাই ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ অভীর পাশে বসলো সে। অভীকে সুন্দর লাগছে। রাগলেও তার ব্যাক্তিত্বে অন্যরকম আভাস দেখা যায়। আর আজ সে আভাসে আছে ভালোবাসার মাদকতা..
#চলবে..
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।
#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |২৩|
ম্লান বিকেল। বেবিট্যাক্সিতে বসে আছে প্রিয়তা। তা ঝিমুচ্ছে আর এগোচ্ছে। পাশে অভী নীরব, নির্বিকার৷ তার উথাল-পাতাল ঢেউ খেলানো মনে এখন কি চলছে তা প্রিয়তার অজানা। তবে প্রিয়তার মন প্রশ্নে জর্জরিত। কি করতে চাইছে অভী? প্রিয়তা তা তো কথামতো গুটিয়েই ফেলেছে নিজেকে যাতে পরবর্তীতে কষ্ট না পায়। তন্মধ্যেই বেবিট্যাক্সি ছাড়িয়ে গেলো শহরতলি। এবার অভী সচকিত হলো। যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো। গাম্ভীর্য টেনে ধরানো গলায় বললো,
‘ কি হয়েছে তোমার?’
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। বললো,
‘ আমার আর কি হবে? আই’ম টোটালি ফ্রি এন্ড ফাইন। মেয়ে হয়ে জন্মেছি তো, প্রথম থেকেই কম্প্রোমাইজ করা শিখাচ্ছে পরিবার। এখনও সেটা ধরে রেখেছি।’
‘ এসব ফিলোসোফিক্যাল কথা বলে আমায় ভং চং বুঝাবে না৷ মোবাইলের কল লিস্ট চেক করো তুমি। দেখেছো বিগত কয়েকদিনে কয়টা কল দিয়েছি?’
‘ কেন কল দিবেন আপনি আমায়?’
নিজের রূঢ় গলায় নিজেই সচকিত হলো প্রিয়তা। এর আগে নিজেকে বাহ্বা দিলেও এখন তাকে কিছু বলাতে নিজেরই কষ্ট লাগে। তবুও নিজের প্রতিমূর্তি বহাল রাখলো সে। বললো,
‘ যদি ভেবে থাকেন সে সেদিনকার বিকেলে আপনার বাবার কথার জন্য আমায় এক্সপ্লেনেশন দেওয়া উচিত তাহলে ভুল ভাবছেন। যেখানে আমার পরিবার বিয়ের সময় আর বিয়ে স্থগিত রাখার সময় – এ দু’ মুহূর্তেই আমার মত নিলো না সেদিকে আমার মতো তুচ্ছ একজনের কাছে আপনার সাফাই না দিলেও চলবে।’
রোদ্দুরের শেষ রশ্নিটা আছড়ে পড়ছে ট্যাক্সির ভেতর। কাচ নামিয়ে রাখায় শো শো করে এসে হানা দিতে থাকলো শীতল, স্নিগ্ধ বাতাস। অভী পুরোপুরি মাথা ঘুরিয়ে অবলোকন করলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ভঙ্গি ঋজু, মুখ নত। আর সেই নত মুখের ব্যার্থভাবে লুকানো চোখজোড়ায় চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু পানি৷ কোনোভাবেই সেটা সে যেন আড়াল করতে পারেনি। প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখেনি অভী, কখনোই না। আর আজ তার চোখে যখন অশ্রু হাতছানি দিলো তা যেন বিদ্ধ করলো অভীকে। সামনে ট্যাক্সিচালক নিজের আনন্দেই গাড়ি চালাচ্ছে। রিক্সাচালক আর ট্যাক্সিড্রাইভার- এ দু’জাতির মানুষের মাঝেই কোনো ভাবান্তর হওয়ার বৈশিষ্ট্য নেই। তাদের পেছনে অজস্র মানুষ বসে, বৈচিত্র্যময় নানা কথা বলে। শুরুতে তাদের আগ্রহ থাকলেও পরে তারা আগ্রহ হারায়৷ গাড়ি চালায় আস্ত রক্তমাংসে গড়া রোবটের মতো করে।
অভী তাই আর কোনো দ্বিধা রাখলো না৷ প্রিয়তার দিকে পুনরায় ফিরে সম্ভিত গলায় বললো,
‘ তুমি কি কোনোভাবে আমার যাওয়াতে খুশি না প্রিয়তা?’
সরাসরি প্রশ্ন অভীর। প্রিয়তা ভাবতে পারেনি অভী এভাবে সরাসরিই তাকে প্রশ্ন ছুঁড়বে। তাই কিছুটা অবাক হলো। দৃষ্টি পথে নিবদ্ধ করে বললো,
‘ আমার খুশি অখুশি বেশি গুরুত্ব বহন করে না৷ গুরুত্ব বহন করে আপনার ক্যারিয়ার,আপনার ইচ্ছে। আর আপনি খুবই ভাগ্যবান যে ইউএসএ থেকে জব এক্সেপ্টেন্স লেটার পেয়েছেন। দু’দিন বাদে ভার্জিনিয়া চলে যাবেন, আসবেন কয়েক বছর পর। তারপর এরমধ্যে কোনো বিদেশিনীর সাথে সম্পর্কে থাকলেও কেউ বুঝবে না। আর দেশে তো আমি রেডি আছিই- এসব ভাবছেন না?’
অভী যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রিয়তা যে ব্যাপারটা এতটা গভীরভাবে নিবে জানলে কখনোই আগাতো না সে ওদিকে। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো সে তপ্ত ঠোঁট। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মন খারাপ হলে কি সবারই এমন হয়? অভীর তা জানা নেই। অভী ভানিতা করলো না। সরাসরিই বললো,
‘ আমার যাওয়াতে যদি কোনো আপত্তি থাকে বলো আমায়। আমি তাহলে যাবো না৷ এখানেই আবার নিজের কোনো একটা ঠাই খুঁজে নিবো।’
বাধঁ ভাঙলো প্রিয়তার। সত্যি সত্যিই চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অভীকে মাঝে মধ্যে পাষাণ মনে হয়৷ ভীষণ পাষাণ। ইচ্ছে করে কষ্ট দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,
‘ আমার আপত্তিকে আপনি যদি এতই গুরুত্ব দিতেন তবে আমায় একটিবার হলেও জানাতেন যে আপনি ইউএসএ তে জবের জন্য এপ্লাই করছেন। অথচ কি করলেন? এক্সেপ্টেন্স লেটার পাওয়ার পর এসে বললেন ব্যাপারটা আমাদের হাতে। অথচ কেউ কি একটা বারও জানতে চেয়েছিলো যে আমি কি চাই? আমার মতামত কি? না কেউ জানতে চায়নি৷ সবাই শুধু নিজের ভালোমন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছাই আমার ওপর আরোপ করতে লাগলো। এখন আপনার কাছে আমার এসব বলে কি লাভ? আমি হলাম কাঠের পুতুল। যে যেভাবে নাচাবে- সেভাবেই নাচবো। আপনি চলে যেতে চান না? চলে যান, আমি কি চাই না চাই বিন্দুমাত্র ভাবতে হবে না। চিন্তা নেই আপনাকে ঠকাবো না। তবে আপনি যদি পরিস্থিতির কবলে পড়ে আমায় ঠকান তবে আমি সেটা আমার দুর্ভাগ্য মনে করবো। আপনি নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন কোনো পিছুটান ছাড়া।”
তারপর প্রিয়তা নীরব। ট্যাক্সি এগোচ্ছে নিজের চলমান ধারায়। পথও ম্লান। শুধু শোনা যাচ্ছে ইন্জিনের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ। অভীর কাছে প্রিয়তার প্রতিটা বাক্য ভারী শোনালো। এত ভারী যে সে ভার বইতে পারবে না বুকে বিদ্ধ করা এক টন স্বরুপ প্রতিটা শব্দ। অভী নিনির্মেষে বললো,
‘ সুযোগটা আমায় কাছে এসেছিলো তোমার সাথে সবকিছু হয়ে ওঠার আগে। তাই তখন এপ্লাই করেছিলাম। জব এপ্লাই না, ওখানে মাস তিনেকের একটা ট্রেনিং নিবো তার এপ্লাই। তবে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়াতে সিজিপিএ দেখে তারাই আমায় অফার করলো। তাই ভুল বুঝো না প্রিয়তা৷ তোমার অভী এতটাও অনুভূতিহীন না যে এভাবেই স্বার্থপরের মতো তার মায়ারাণীকে ছেড়ে স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি জমাবে।’
শেষ কথা শুনে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। হ্যাঁ কেঁপে উঠলো। অভীর মতো গুমোট স্বভাবের মানুষও যে প্রেম নামক অনুভূতিতে কতটা সিক্ত হতে পারে আজ আরও একবার তা ধারনা হলো। তার আচার আচরণ সবকিছুতেই মুগ্ধতা। মুহূর্তে মুহূর্তে মুগ্ধ হতে মন চায়। অতঃপর প্রিয়তা নীরবই রইলো। কেটে গেলো সময়। অভী গেলো না প্রিয়তাকে দিয়ে আসতে। বরং নেমে গেলো। ড্রাইভারকে বললো দিয়ে আসতে। তারপর আর কোনো কথা হলো না দুজনের৷ তবে অভীর চোখ স্পষ্ট বলে দিলো অন্যপন্থা নিবে সে। প্রিয়তাকে নিয়ে আর অনিশ্চয়তায় থাকবে না।
_______________
সকালটা রোজই সুন্দর হয়। চনমনে রোদ উঠলো সেই সুন্দরটা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। দুদিন জ্বরে জ্বরেই দিন পার হয়েছিলো প্রিয়তার। জ্বরটা কেনো হলো, কিসের সংস্পর্শে হলো- তা সে নিজেও জানেনা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতো শুধু। মা আসতো, একটু খাইয়ে দিতো, বাবা আর বড় আব্বু খোঁজখবর নিতো এসে এই ব্যাস। জ্বর কেটেছে গতসকাল। এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও আজব এক কারনে কেউ ওকে রুম থেকে বের হতে দিচ্ছে না গতকাল থেকে। নিচে মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে হট্টগোল। মানুষদের কথাবার্তা মনে প্রশ্ন আনলেও রুদ্র অদ্রি আর অরিন মিলে যেসব কথা সাজিয়ে গুছিয়ে শোনাচ্ছে সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও মেনে নেয়।
আজ সকালে উঠে নিজের ঘরে সকল ভাইবোনদের দেখে সে বিস্ময়ে ছেয়ে গেলো। রুদ্র আজ সাদা পান্জাবি পড়েছে। বাকি সবারও রমরমা ভাব৷ প্রিয়তা ভড়কে গেলো। ঘুম থেকে উঠে এমন দৃশ্য অবাক না হয়ে পারলো না৷ অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
‘ কি হয়েছে তোদের? সব ঠিক আছে তো?”
অদ্রি কথা না বলে একটা ছোট ব্যাগ রাখলো খাটে। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
‘ এখানে তোর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস আছে। ফ্রেশ হয়ে পড়ে নে। আজ বিয়ে পড়াবে তোর আর অভী ভাইয়ার। নিচে সব আত্নীয়স্বজনরা আছে।’
জীবনে এতটা বিস্ময়ের শিকার প্রিয়তা কখনও হয়নি আজ যতটা হলো। মনে পড়লো দুদিন আগের সেই প্রিয় মানুষটার মুখের অবয়ব। বিয়ে, আর আজ? অতিকাঙ্খিত জিনিস কখনও কি অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া যায়? চোখমুখ চকচক করছে অদ্রির। স্পষ্ট বোঝা যায় এর পুরো ঘটনাই তার নখদর্পনে। বলে উঠলো,
‘ তুইও ইউএসএ চলে যাবি রে! খুশিতে আমার নাচতে মন চাচ্ছে। এখন মোবাইল একটু চেক কর।অভী ভাইয়া তোকে কি যেন মেসেজ পাঠিয়েছে। উঠ ছেড়ি জলদি উঠ!’
#চলবে