প্রিয়কাহন❤️,৮,৯

0
709

#প্রিয়কাহন❤️,৮,৯
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |৮|

এভাবে অভীর দরজা লাগানোতে সচকিত হলো প্রিয়তা। এখন এই ঘরটিতে ওদের দুজনের ছাড়া আর কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রিয়তার ভয় হলো, সন্দেহ জাগলো অভীর কার্যকলাপের জন্য৷ তবুও বুকে সাহস নিয়ে শেষমেষ বললো,

‘ দরজা লাগালেন কেন আপনি?’

‘ কিছু কাজ দরজা খুলে করা যায় না তাই।’

অভীর নির্বিকার প্রতিউত্তর। প্রিয়তার মুখ হা হয়ে গেলো। বোলতার মতো ভনভন করতে লাগলো মাথা৷ অভীকে এতদিন সে জানতো ভদ্রবেশী ছেলে হিসেবে, আর আজ সেই ছেলের চট করে আমূল পরিবর্তন প্রিয়তার মাথার উপর দিয়ে যেন সাঁ সাঁ করে উড়ে যেতে থাকলো। অভী এগোলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা পেছালো। এক পা, দু’ পা তিন পা – কিন্তু অভী থামলো না। শেষমেশ সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘ পেছাচ্ছো কেন তুমি?’

‘ আপনি নিরাপদ দুরত্ব নিয়ে দাঁড়ালেই আমি পেছাবো না ‘

‘ ফাইন।’

দাঁড়িয়ে পড়লো অভী। প্রিয়তা হাফ ছাড়লো। বোর্ড রুমের দক্ষিণা জানালা দিয়ে দিঘীর দৃশ্যপট অপূর্ব লাগছে। নাকে ভেসে আসছে আমপাতার সুবাস। পরিত্যাক্ত কোণঠাসা এই ঘরটিতে ভরদুপুরের আলো পড়াতে যেন প্রাচীনকালের কোনো গল্পের দৃশ্যপট মনে হচ্ছে। অভী সচকিত হলো। হাত পকেটে গুঁজে নিখাদ স্বরে বললো,

‘ আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসার কারন?’

প্রিয়তা উত্তর খুঁজে পেলো না। সে যে ঠিক কি কারনে বরকত হলে এসেছে সে নিজেও জানে না। শুধু জানে যে তখন প্রিয়তার রাগ উঠেছিলো৷ হ্যাঁ এটা সত্য যে অভী তার হবু বর কিন্তু এই জিনিসটা নিজেদের মধ্যে থাকলেই কি ভালো হতো না? এমন না যে তারা ভুল জানে বা অভীর সাথে তার এই তথ্যটাও ভুঁয়া খবর তবুও কেন যেন সব কিছুর নষ্টের মূল এই ছেলেটাকেই মনে হচ্ছে।

প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ধাতস্থ করলো। বললো,

‘ আপনি এসব ইচ্ছে করেই করেছেন তাই না?’

‘ কিসব?’

‘ এই যে আমাদের বিয়ের খবরটা?’

বিরক্ত হলো অভী। বলে উঠলো,

‘ আরে আমি এসব ইচ্ছে করে কেন করতে যাবো?

‘ কারন আপনার ইগোতে লেগেছে যে আমি আপনাকে রিজেক্ট করতে চাচ্ছি, লাগাটাই স্বাভাবিক। আপনি ব্রাইট স্টুডেন্ট, এসএসসি – এইচএসসিতে চট্টগ্রাম বোর্ডে ফার্স্ট, চবি ভর্তি পরীক্ষায়ও হাইয়েস্ট রেজাল্ট, ভালো সিজিপিএ নিয়ে অনার্স কমপ্লিট, কদিন পর মাস্টার্স শেষ করে একটা ভালো জবে ঢুকবেন আর আমার মতো মেয়ে কিনা আপনাকে রিজেক্ট করছে সেটা আপনার সহ্য হচ্ছে না।’

অভীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে কন্ঠে বললো,

‘ তুমি নিজেও কিন্তু ব্রাইট স্টুডেন্ট প্রিয়তা। ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল, চবি তে ঢুকা কখনোই এতটা সহজ না বাট তুমি পেরেছো। তারপরও বাচ্চাদের মতো এমন লেইম এক্সকিউজ দিচ্ছো কেন তুমি?’

‘ আপনার জন্যই এসব বলছি। এখন আপনি যেভাবে পারবেন বিষয়টা থামাবেন!’

অভী হাসলো কিঞ্চিত। জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি বলে থামাবো?’

‘ বলবেন প্রিয়তা একটা গাধি মেয়ে, যেখানে সেখানে হুটহাট করে অজ্ঞান হয়ে যায়। কথাবার্তা বাচ্চাদের মতো। বাবার জন্যই আপনি চুপ আছেন নতুবা আপনার মোটেও আমায় পছন্দ না।’

‘ কিন্তু আমি মিথ্যা কেন বলবো?’

সচকিত হলো প্রিয়তা। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকালো অভীর দিকে। বললো,

‘ আপনি তো আমায় পছন্দ করেন না। তাই না?’

প্রিয়তা ভড়কে গেছে। চট করে নির্বিকার ছেলেটার আমূল পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলেছে। অভী কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। ঝুঁকে এসে স্ফীত কন্ঠে বললো,

‘ কে বলেছে তুমি আমার পছন্দ না?’

বিস্ফোরিত হলো প্রিয়তার চোখ। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো অভীর প্রচ্ছন্ন মুখের দিকে। ভয় হচ্ছে। মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না এর। মিথ্যে বলার কথা বললো মানে? তাহলে এতদিন কি প্রিয়তার ধারনা ভুল ছিলো? গম্ভীর ছেলেটা যে কি না সব মেয়েদের এড়িয়ে চলতো সে তাইলে আসলেই পছন্দ করতো প্রিয়তাকে? আর এজন্যই তবে নুরুল স্যার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন? তাকে অবাক করে দিয়ে অভী অকপটে বললো,

‘ ঝামেলা আমি ক্রিয়েট করিনি প্রিয়তা৷ তোমার বোন অদ্রি করেছে, কপাল ভালো ও একটি মেয়ে। নাইলে সপাট করে চড় মেরে পাটির দাঁত ফেলে দিতাম৷ আমি মোটেও চাইনি যে আমাদের পারিবারিক এ ব্যাপরটি এখানে আসুক৷ জানো যেদিন আমি তোমায় দেখতে গিয়েছিলাম, আমি তখন থেকেই শিউর ছিলাম যে এটা জানাজানি হলে একটা হৈ হুল্লোড় হবে৷ এটাই স্বাভাবিক। আজ তুমি অন্য কোনো বাইরের ছেলেকে বিয়ে করলে এমন কিছুই হতো না, কিন্তু আমরা যেহেতু দুজনেই চবির স্টুডেন্ট, একটু তো মসলাদার ঘটনা হবেই!’

প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। শরীর হয়ে গেলো অসাড়। অভীকে রহস্যময় মানব মনে হচ্ছে, চোখের সামনে সবকিছুই লাগছে ধোঁয়াশা। এই ছেলে রীতিমতো হ্যালুসিনেট করছে ওকে। প্রিয়তা হঠাৎ করে বললো,

‘ আমায় এখানে ডেকেছিলেন কেন আপনি অভী?’

অভী অদ্ভুত হাসি দিলো। বিনাবাক্যে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার কাছাকাছি। প্রিয়তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো৷ আতঙ্কে বললো,

‘ একি আপনি কাছে…

‘ সাট আপ প্রিয়তা! কাছে এসে ভয়াবহ কিছু করবো না। আবার অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যেও না খবরদার। নাহলে আবারও তোমার মতো বস্তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। ‘

প্রিয়তার নাক ফুলে ফেপে উঠলো। রি রি কন্ঠে বললো,

‘ খবরদার কাছে….’

প্রিয়তার বাঁধা মানলো না অভী। অনুমতিবিহীনভাবে নিজের দু’হাত আবদ্ধ করে দিলো প্রিয়তার চুলে। দক্ষতার সাথে চুলে খোপা বেঁধে দিলো। ছন্নছাড়া হয়ে অভীকে পরখ করলো প্রিয়তা৷ বুকে দুরুক দুরুক শব্দ হচ্ছে , ঠোঁটজোড়া নিঃশ্বাসের উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে। অভী চুল ভালোমতো বেঁধে দিয়ে বললো,

‘ নাও পার্ফেক্ট!’

‘ কি করলেন এটা আপনি?’

অভী প্রিয়তার এমন ব্যাবহারে বিভ্রান্ত হলো না। অকপটে বললো,

‘ এজন্যই এখানে এনেছি তোমায় প্রিয়তা। তোমায় তখন দেখামাত্রই এই ইচ্ছেটা জেগে উঠেছিলো। আর এই ভয়ংকর ইচ্ছেটা আমি মোটেও চাইনি বন্ধুবান্ধবদের সামনে পূরন করতে। কাল থেকে এমনিতেও ওরা কম জ্বালায়নি। এমনকি সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসেও শিউর হয়ে গিয়েছে বাবার কাছে। আর তুমি কি ভাবো তোমার চুল বেঁধে দেওয়ার মতো কাজ আমি ওদের সামনে করবো? তাই এখানে আসতে বলেছি।’

প্রিয়তা কথা খুঁজে পেলো না। হয়ে গেলো বাক্যহীন।।অভী পুনরুপি বললো,

‘ ঘেমে মুখের কি হালচাল বানিয়েছো খেয়াল আছে? তার ওপর পরেছো পাতলা বেগুনি জামা। খুব শখ সিনিয়র ভাইয়াদের তোমার মর্মান্তিক রূপ দেখানোর?’

প্রিয়তার চোখ ছোট হয়ে এলো। অপমানটা ছ্যাত করে বুকে লেগেছে। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ আপনার মতো সিনিয়র ভাইয়াদের নিজের রূপ দেখানোর মোটেও ইচ্ছে নেই। নিজেকে কি ভাবেন আপনি? বিল গেটস যে সবার সামনে আমায় তুমুলভাবে এড়িয়ে আড়ালে আবডালে কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবেন?’

ভ্রুকুটি করলো অভী। বললো,

‘ তুমি এটাকে কাছাকাছি আসা বলছো?’

‘ একশবার বলছি।’

হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো অভী৷ কঠোর দৃষ্টি নিরূপন করলো। প্রিয়তা হঠাৎ বোকা বনে গেলো। পুরো ঝগড়ার মুড বানিয়ে নিয়েছিলো এখন তবে এই ছেলে চুপ হয়ে গেলো কেনো? প্রিয়তা মনে মনে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

‘ কথা বলেন অভী ভাইয়া। আপনি কথা না বললে ঝগড়া করতে পারবো না।’

বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা কাটালো অভী৷ বললো,

‘ তুমি কি বুঝো যে কাছাকাছি আসার মানেটা কি?’

অভীর কন্ঠ ভরাট, অদ্ভুত এক গাম্ভীর্যতা টের পেলো প্রিয়তা। বিনা সময় ব্যায়েই তাই সে প্রতিউত্তর দিলো,

‘ অবশ্যই বুঝি।’

অভী নিঃশ্বাস ফেললো। অতপর বলে উঠলো,

‘ ফাইন! এট এনি চান্স তুমি যদি আমায় বিয়ে করতে রাজি হও, তারপরই আমি দেখিয়ে দিবো প্রোপারলি কাছাকাছি আসা কিভাবে হয়।’

বলেই ঘটাঘট পদচারণে এই ঘর ত্যাগ করলো অভী। প্রিয়তা নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে রইলো। সারা পরিবেশে বিকট স্থবিরতা। প্রিয়তার কানে অভীর কথাগুলো বেজে চলছে শব্দতরঙ্গের ন্যায়।

চুপচাপ এখান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। অদূরেই আছে অভী তার বন্ধুদের সাথে। প্রিয়তা ঠিকই দেখলো তবে অভী একবারও ফিরে তাকালো না। কে বলবে এই শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র ছেলেটা কিছুক্ষণ আগে তার হবু বউকে এক ভয়ংকর কথা বলে এসেছে?

অদ্রির বরফ গোলা প্রায় শেষ পর্যায়ে। লেমন ফ্লেভারের হওয়াতে ওর ঠোঁট সবুজ হয়ে গিয়েছে। অদ্রি প্রিয়তাকে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললো,

‘ তুই এমন ব্লাশ করছিস কেন জানু? গাল দেখি টমেটো হয়ে গিয়েছে। আর ইউ ফাইন? আবার কোনো কান্ড করবি না তো?’

প্রিয়তা আমোদী হয়ে গেলো। টের পেলো লজ্জা তাকে আবিষ্ট করেছে। এই লজ্জা তাকে ছেড়ে যাবে না। গালে টুইটুম্বুর হয়ে তা ফুটে থাকবে।

___________________

গর্জন উঠেছে আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে নেমে পড়বে বৃষ্টি। প্রিয়তা এসময় এসেছে প্যারীদাস রোডের একটি দোতল বাসায়। মিথি নামের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়েকে ইংরেজি পড়ায় সপ্তাহে তিনদিন। মেয়েটা চরম ফাঁকিবাজ। পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়ার যত কারবার তার কাছে আছে।

মিথিরা দুই ভাইবোন। বড় ভাই প্রাণো এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বাবা নেই ওদের। বাড়ি ভাড়া নিয়ে কোনোমতে ওদের মা’ই সামলায়। আজকে মিথির মা নাস্তা দিয়ে বললো,

‘ শুনলাম তোমার নাকি নুরুল স্যারের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রিয়তা, আমাদের বলোনি যে?’

প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। মেকি হেসে বললো,

‘ ফাইনাল হয়নি আন্টি।’

‘ আরে ফাইনাল না হলে হয়ে যাবে। তোমার মতো লক্ষী মেয়েকে সবাই ঘরে নিতে চাইবে। আজ আমার ছেলে যদি তোমার চেয়ে বয়সে বড় হতো তবে আমিও তোমায় পুত্রবধূ বানাতাম।’

প্রিয়তা কথা বললো না। মিথির মা এবার বললেন,

‘ মিথির কি অবস্থা পড়ালেখার?’

‘ আন্টি আমি পড়া দিয়ে গেলে তো ও বাসায় মোটেও পড়ে না! ‘

‘ হায় রে, এই মেয়ে আমার সর্বনাশ করবে। পড়ালেখায় একটুও মন নেই তার। তুমি একটু খেয়াল রেখো কেমন? ‘

‘ ঠিক আছে।’

প্রিয়তা আজ ওকে ভালোমতো পড়াতে পারলো না৷ দুটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। হুট করে মিথি বললো,

‘ আচ্ছা আপু মেয়েদের কোন শাড়ি পড়লে ছেলেরা মুগ্ধ হবে?’

প্রিয়তা বড় বড় চোখ করে তাকালো মিথির দিকে। বললো,

‘ তুমি কাকে মুগ্ধ করতে চাও?’

লজ্জার ভান করলো মিথি। অতঃপর বললো,

‘ একজন ছেলে গতকাল আমায় প্রপোজ করেছে আপু। সে বলেছে আমায় নাকি সাদা শাড়ি পড়তে দেখে সে মুগ্ধ হয়েছে।’

প্রিয়তা বিস্ময়ে হা হয়ে রইলো। বললো,

‘ কে সেই হতভাগা?’

‘ আমার সাথেই পড়ে।’

প্রিয়তা শক্ত হওয়ার ভান করলো। বললো,

‘ এসব করার বয়স তোমার হয়নি মিথি। ভালোমতো পড়াশোনা করো।’

মিথি মুখ ভেংচালো। বললো,

‘ তুমি ভীষণ ইয়ে টাইপের। কোনো রস নেই।’

প্রিয়তার ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে উড়াধুরা মারতে। কিন্তু মারলেও কিছু হবে না। মিথি চরম উড়নচণ্ডী মেয়ে। এই বয়সেই পাড়ার বহু ছেলেকে নাটাই বানিয়েছে। মাঝে মাঝে ওকে দেখে আফসোস হয় প্রিয়তার। তাদের সময় সে ছেলেদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না আর এরা কি সব করে বেড়ায়। হুট করে মিথি বলে উঠলো,

‘ আচ্ছা তুমি কি অভী ভাইয়াকে কখনও চু’মু খেয়ছো আপু?’

#চলবে

#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |৯|

‘ আচ্ছা তুমি কি অভী ভাইয়াকে কখনও চুমু খেয়েছো আপু?’

নবম শ্রেণিতে পড়ে মিথি। অথচ এই প্রশ্ন করাতে ওর মনে বিন্দুমাত্র কোনো অস্বস্তির রেশ দেখা দিলো না। প্রিয়তার কান ভোঁতা হয়ে গেলো। চোখজোড়া হয়ে গেলো ডাগর ডাগর৷ এ পর্যন্ত বহু স্টুডেন্ট কে পড়িয়েছে প্রিয়তা, তবে কখনও এতটা বাড়াবাড়ি ভয়ংকর রকমের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না৷ বুক থরথর করে কাঁপছে উত্তেজনায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলে উঠলো,

‘ এসব কি প্রশ্ন মিথি?’

‘ আরে বলো না আপু, সমস্যা নেই। আমিই তো, তোমার ছোটোবোনের মতো৷ তুমি কিছু বললে আমি তো আর পাড়ায় পাড়ায় এসব কথা বলে বেড়াবো না তাই না?’

প্রিয়তার স্নায়ু যেনো অকেজো হয়ে গিয়েছে। মধ্য দুপুরের কাঠফাটা রোদের মতো মাথায় চলছে খরা। কি বলবে এখন সে? মিথি যা মেয়ে যদি ‘না’ উত্তর দেয় তবে বাজেভাবে টিটকারি মারবে। আর এমন ছোটপ্যাকেট বড় ধামাকাওয়ালী মিথির টিটকারি শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। আবার যদি মিথ্যে বলে, তবে তো আরও সমস্যা৷ অভীকে দেখা মাত্রই যে প্রিয়তা জ্ঞান হারিয়েছিলো সে যদি অকপটে চুমু খাওয়ার মতো ভয়াবহ কাজ করতো এতদিনে তার স্থান হতো সরকারি কোনো হাসপাতালের ছিপছিপে বিছানায়৷ হাজারো অতিথির মতো মিথিও ফলমূল নিয়ে হাজির হয়ে দুষ্টুমিসুরে বলতো,

‘ আরে আপু রে তুমি ভালো স্টুডেন্ট হলেও পুরাই হাদা মেয়ে। তোমার কাছে আমি ইংরেজি শিখলেও তোমার আমার কাছে প্রেমের ক্লাস করা উচিত। নাইলে চুমু খেয়ে এভাবে হাসপাতালে শুয়ে থাকতে না। ‘

প্রিয়তা নিঃশ্বাস ফেললো। হাতে লাল কলম নিয়ে মিথির খাতা হাতিয়ে নিলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘ অনেক আজেবাজে কথা বলেছো। কি লিখেছো দেখি তো!’

খাতা দেখে আরও একদফা চোখে সর্ষে ফুল দেখলো প্রিয়তা। মিথিকে সে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়েছিলো ‘The Rainy Day’ প্রসঙ্গে। আর এই মেয়ে ইংরেজী নভেলের কোনো প্রেমময় মুহুর্ত লিখে দিয়েছে। প্রিয়তা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি লিখেছো এসব?’

মিথি লাজুক হাসি দিলো৷ ওড়না আঙুলে পেচাতে পেচাতে বললো,

‘ শোয়েব গিফ্ট দিয়েছিলো আমায় একটা রোম্যান্টিক নভেল। নভেলের এই বৃষ্টির মুহুর্ত টা এত সুন্দর ছিলো যে ২-৩ বার পড়াতেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। তাই লিখেছি।’

হতাশাগ্রস্ত প্রিয়তা করুন চাহিনী দিলো মিথির দিকে। বললো,

‘ এসব পরীক্ষায় লিখলে গোল্লা পাবে মেয়ে। তোমার কি মনে একটুও ভয় নেই?’

‘ তখনের টা তখন দেখা যাবে। আচ্ছা লাইনগুলো কেমন লাগলো? এক কাজ করো। এখনই এই লাইনগুলো কপি করে অভী ভাইয়াকে টেক্সট করো। এমনিতেও বৃষ্টিময় ওয়েদার৷ এই রোম্যান্টিক লাইনগুলো দেখলে তার মনেও ফুলঝুরি ফুলে ফেপে উঠবে।’

প্রিয়তা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে এসব কেটে দিলো৷ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

‘ পরশুদিন এসে যেন দেখি তোমার প্যারাগ্রাফ মুখস্থ। আবার এসব আজেবাজে কাজ করলে তোমার মাকে সত্যি সত্যিই বলে দিবো মিথি।’

মিথির প্রাণোচ্ছল মুখে দেখা গেলো অন্ধকারের রেশ৷ প্রথমত প্রিয়তা থেকে কাঙ্খিত প্রশ্নের উত্তর পেলো না তার ওপর কেমন রেগে রেগে কথা বলে চলেছে। প্রিয়তা যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। ঘড়ির কাটায় দেখে নিলো সময়। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। বাইরে পড়ছে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি৷ চট্টগ্রাম শহরের পিচ্ছিল রাস্তায় এই সৌন্দর্য যেন আরও মায়াবী লাগে।
প্রিয়তা কি ভেবে যেন মেসেন্জারে ঢুকলো। অভীর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে সবুজ বাতিটি। নিচে ছোট অক্ষরে লিখা ”Active now”। প্রিয়তা ঠোঁট চেপে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে। অভীদের বাসা এই লেনেই৷ মিথিদের বাড়ি যেমন ভেতরের দিকে, অভীদের বাড়ি সামনের দিকে। নুরুল স্যার বড় শখ করে কিনেছিলেন সেই বাড়িটি। সামনে সুন্দর প্রশস্ত একটি রাস্তা আছে। প্রিয়তার অবচেতন মন কেন যেন বলে উঠলো হয়তো অভী রোয়াকেই আছে। দেখে চলছে বৃষ্টিস্নাত পিচ্ছিল প্রশস্ত পথ। হাতে মোবাইল আর সেখানে তার কোনো প্রেয়সীর সাথে প্রেমালাপ করে চলছে আনমনে। কথাটি ভাবতেই প্রিয়তার মন বিশ্রি অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো। ইসস! কি সব আবোল তাবোল ভাবছে সে? অভী এমন ছেলে না৷ মোটেও এমন না। কিন্ত কি যেন ভেবে আবার মিহিয়ে গেলো প্রিয়তা৷ অভী এমন হলে তারই বা কি৷ সে তো আর অভীকে বিয়ে করবে না। শুধু তিনদিনের অপেক্ষা। তারপরই সে এই রহস্যময় মানব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাবে।

প্রিয়তা স্ক্রিনে অভীর আইডিটি আনমনে দেখে এসব ভাবছিলো অমনেই পেছন থেকে মিথি উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠলো,

‘ কল দিতে ইচ্ছে করছে আপু?’

স্নায়ু প্রিয়তার স্বতন্ত্র হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ মোবাইলের পাওয়ার বাটন চেপে অফ করলো স্ক্রিন। মিথির চোখেমুখে দুষ্টুমির ঝলকানি৷ প্রিয়তা নামক বজ্জাত টিচারকে হাতে নাতে বিব্রত করতে পেরে যেন ওর অন্তরে অদ্ভুত শান্তির আনাগোনা চলছে। প্রিয়তা ঝুপ করে বললো,

‘ কারও মোবাইলে উঁকি দেওয়া কি ধরনের ভদ্রতা মিথি?’

‘ আচ্ছা আপু আর উকিঁ দিবো না, কিন্তু অভী ভাইয়ার চেহারা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি আপু, তাই উঁকি দিয়েছিলাম৷ তুমি তো জানোই প্রাণো ভাইয়া এখন যেখানে কোচিং করছে সেখানে অভী ভাইয়াও ওদের পড়ায়৷ প্রাণো ভাইয়ার মেয়ে ফ্রেন্ডগুলো বাসায় আসলে সবসময় তার নামে বদনামের আসর নিয়ে বসতো। যে অভী ভাইয়া নাকি খাটাস, শুধু ধমকায়। এটিটিউট নিয়ে চলে, কাউকে পাত্তা দেয় না। তামাটে গায়ের রং হলেও পার্সোনালিটি নাকি মাশাল্লাহ- আসলেই আপু, আমি দেখে ফিদা হয়েছি। তোমার সাথে দারুন মানাবে৷ আচ্ছা, তোমার নূরুল স্যারের না দুই ছেলে। এক অভী ভাইয়া হলে আরেকজনের সাথে আমার সেটিং করিয়ে দিও কেমন?’

প্রিয়তা কান মলা দিলো মিথির। বলে উঠলো,

‘ ফাজিল হয়ে গিয়েছো দিনদিন মিথি৷ এত ছেলে ছেলে করলে কপালে একটাও ভালো ছেলে জুটবে না৷ আমি গেলাম। খবরদার রাতে যদি আবার কল দিয়ে অভী ভাইয়ার সুর তুলেছো তবে ডিরেক্ট তোমার বাবাকে ফোন দিবো।’

ড্রইংরুমের দিকে গেলো প্রিয়তা। মিথির মা একপাশে বসে সিদ্ধ মটরশুঁটি আলাদা করে রাখছিলো৷ প্রিয়তাকে বের হতে দেখে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,

‘ আয়হায় মামণি, এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে কিভাবে?’
প্রিয়তা বিনয়ী হলো। এতক্ষণের সংযত করা রাগ তুলোর মতো মনের গহীনে পেচিয়ে রেখেই ঝপাঝপ বললো,

‘ সমস্যা নেই আন্টি, ছাতা আছে আমার কাছে।’

‘ আরে নাহ্! কি বলো? এই ভরা সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে তোমায় আমি একা যেতে দিবো ভেবেছো? তার ওপর আমাদের গলিটা অতও ভালোনা। মোড়েই ছাত্তার চাচার মুদির দোকানে কয়েকজন বখাটে ছেলেপেলে মাতলামি করে বেড়ায়। তুমি ওদিক দিয়ে একা যাওয়ার কথা ভাবলে কি করে?’

প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। মিথির মা কথাটি মন্দ বলেননি। আবার এদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কড়া নিয়ম সন্ধ্যা নামার আধঘন্টার মধ্যে সবাই যেন বাড়ি ফিরে যায়। প্রিয়তা জিজ্ঞাসু চোখে দৃষ্টি নিরূপন করলো মিথির মায়ের দিকে। বললো,

‘ কিন্তু আন্টি যা অবস্থা মনে হয় না বৃষ্টি কমবে। কি করবো তাহলে?’

মিথির মা চট করেই বললো,

‘ এক কাজ করো। প্রাণোকে তোমার সাথে পাঠাই কেমন?’

প্রিয়তা বিব্রত হলো। বিনাবাক্যে সহায়তাটি নিতে হিমশিম খেলো। সলজ্জ ভঙ্গিমায় বললো,

‘ কিন্তু আন্টি প্রাণোর তো সামনে পরীক্ষা। এখন ওকে বিরক্ত করার দরকার হবে?’

‘ তোমায় আধঘন্টার মধ্যে দিয়ে আসলে ওর পড়ার এমন কোনো ক্ষতি হবে না।………আরে প্রিয়তা তুমি কি কোনোভাবে বিব্রত হচ্ছো? আরে বোকা মেয়ে, প্রাণোই তো। তোমার ছোটো ভাইয়ের মতন। ও জোয়ান ছেলেপেলে হলে তোমার সাথে পাঠাতে ভাবতাম কিন্তু ওকে পাঠালে তো তোমার বড় আব্বু বা বাবা কিছু বলবে না। আর এই সন্ধ্যায় একটা ছেলেমানুষ সাথে থাকলে ভালো।’

বলেই প্রিয়তার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন না উনি। উঁচু গলায় নিজের বড় ছেলেকে ডাকতে লাগলেন। প্রাণো বেরিয়ে এলো। মায়ের কথা শুনে নির্বিকারে তাকালো প্রিয়তার দিকে। ছেলেটা আসলেই অদ্ভুত। বোন যেমন পাড়ায় নাটাইয়ের মতো ঘুরে বেড়ায়, ভবঘুরে , উড়নচন্ডী স্বভাবের – প্রাণো ঠিক উল্টো। প্রয়োজন ছাড়া কখনোই দুদন্ড প্রিয়তার সাথে কথা বলবে না। আর ওর প্রয়োজনই হয় জাগতিক পড়াশোনা নিয়ে।

প্রাণো জামা পাল্টে নিলো। একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে হাতে নিয়ে নিলো ছাতা। নীরবে বললো,

‘ চলো আপু!’

প্রিয়তা চুপচাপ ছেলেটাকে নিয়ে বেরোলো। সন্ধ্যা নেমেছে আকাশে। ঝুপড়ি ঘরের টিনের চালায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। নাকে এসে হানা দিচ্ছে কেউটে ফুলের সুবাস। দু’ধারে সারি সারি বাড়ি। প্রিয়তা রিক্সায় চুপচাপ বসে রইলো। পাশেই বসা প্রাণো। বৃষ্টির প্রবাহে ডান হাতের অনেকাংশ ভিজে টুইটুম্বুর। সেখান থেকে চুই চুই করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। ওরা শ্রীশদাস লেনের মাঝবরাবর আছে। দুমিনিট হেটে বায়ে গেলেই কাঁঠালবাগান। সেটা এখন বন্ধ। সংস্কারের কাজ চলছে। এই রিক্সাঅলা মামাকেও খুব কষ্টে মানিয়েছে প্রাণো। হুট করে প্রিয়তা জিঙ্গেস করলো,

‘ পড়াশোনার কি অবস্থা তোমার?’

‘ হুম ভালো।’

ব্যাস, তারপর নিশ্চুপ। শুধু শোনা যাচ্ছে প্যাডেলের শব্দ। শব্দটা ভালো লাগলো। একটু হলেও ভুলিয়ে দিলো জগত সংসারের চিন্তা। কিন্তু বিগত কিছুদিন যাবৎ প্রকৃতি বরাবরই প্রিয়তার ভাবনাহীন। আচমকা একটা বাইক রিক্সার ঠিক বরাবর থামাতে হিমশিম খেলো মামা। ব্রেকে চাপা দিতে প্রিয়তা হুমড়ি খেয়ে পড়বে অমনেই প্রাণো সামলে নিলো। প্রিয়তা সলজ্জ হলো। স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ না পেলেও দেখলো ছেলেটা অপ্রতিভ হচ্ছে। এমুহূর্তে সামনের লোকটার উপর ভয়াবহ রাগ জমলো তার। নিজেকে আগ্রাসী করে দু’চার কথা বলতে যাবে কিন্তু সামনে দেখা মাত্রই মুহূর্ত কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ বসে রইলো। মাথা হয়ে গেলো আধাঁরে আবৃত ঘনচ্ছটা।

ডানপিটে শরীরের ছেলেটি এগিয়ে এলো। গায়ে সাদা শার্ট আষ্টেপৃষ্টে গেঁথে আছে। শরীরের প্রতিটি গড়ন জানান দিচ্ছে কঠোরত্বের। চুলের পানিগুলো টপাটপ চোঁখ ছুঁয়ে ঠোঁটে এসে ভীড়ছে। দৃষ্টি ভেজালো। প্রিয়তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হলো। অভীকে হৃদয় মানতে পারলো না। এ যেন উপন্যাসের পাতা থেকে ছিঁড়ে আসা কোনো চরিত্র।

অভী একবার প্রিয়তার দিকে তাকালো তো একবার তাকালো প্রাণোর দিকে। আগ্রাসী অধিকারে প্রিয়তার হাত স্পর্শ করে নির্বিকারে বললো,

‘ এই ঝুম সন্ধ্যায় এখানে কি করছো তুমি?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here