প্রিয় দিও বিরহ,পর্ব:৬,৭,৮

0
831

“প্রিয় দিও বিরহ,পর্ব:৬,৭,৮
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
৬.

গলদেশ বেয়ে যাচ্ছে চপচপে লহু। তাজা রক্তের থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুতুরে গন্ধ। ছটফট করে মেহতিশা।
প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে বসে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। মেহতিশা নিজের শরীরের দিকে চোখ বুলায়৷ নাহ, সব ঠিক আছে। তাহলে সব স্বপ্ন ছিলো! এতোটা বাস্তব রূপে! কীসের সংকেত ছিলো এটা? গলা শুকিয়ে কাঠ। চারদিকে অল্প আলোয় ভূতূড়ে দেখাচ্ছে৷ মেহতিশা পাশ ফিরে তাকায়। কোনো মানুষের অস্তিত্ব বুঝতে পেরে লাফিয়ে দূরে সরে। দর্পণের চিন্তিত মুখ দেখা যায়। দর্পণ অস্থির গলায় বলে,

‘কী হয়েছে বউজান? খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? ‘

দর্পণ মেহতিশার হাত টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। মেহতিশার এলোমেলো সুরতহাল৷ এখনো ভয়ে ঘাবড়ে আছে। বুকের মাঝে ধরাস ধরাস করে কাঁপছে। মেহতিশার মুখের হাবভাবে বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই কোনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে। দর্পণ মেহতিশার মাথাটা টেনে বুকে রাখে। মেহতিশা সরে আসতে চায়, পারেনা বিপরীতমুখী শক্তির সাথে। দর্পণ মেহতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘ভুলে যান বউজান, স্বপ্ন ছিলো। ‘

মেহতিশা ক্লান্ত হয়ে সিটিয়ে যায়। গলায় বারবার হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক এখানটায় কিছুক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল কেউ দড়ি বেঁধে টানছে। অথচ, এখন কিছুই নেই। আচ্ছা দর্পণ কখন এলো? মেহতিশা মৃদু কন্ঠে বলল,

‘আপনি কখন এসেছেন? ‘

‘আধাঘন্টা হলো শুয়েছি। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আপনার বাবার বাড়িও তো যেতে হবে। ‘

‘আপনি সেসময় অমন ব্যবহার করলেন কেনো? ‘

‘কেমন ব্যবহার করেছি? ‘

‘ঐ যে আপনার বান্ধবীর সামনে। ‘

‘কিছুই তো করিনি। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করুন। ‘

‘আমি ঘরে এসেছি সাড়ে দশটায়। আপনি এতোটা সময় কোথায় ছিলেন? ‘

‘কিছু কাজ করছিলাম। ‘

‘মিথ্যা কথা। ‘

‘আমি মিথ্যা বলিনা বউজান। বড্ড বেশি প্রশ্ন করেন আপনি। ‘

মেহতিশার চুলের ভাঁজে নিজের সকল স্নেহ মিশিয়ে দিতে থাকে হাত দিয়ে দর্পণ। আবেশে ঘোর লেগে চোখ বন্ধ হয়ে যায় মেহতিশার। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে পুনরায়। ঘড়ির কাটা একের কাছে পৌঁছাতে থাকে। দর্পণ মেহতিশার ঘুমন্ত চেহারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে হাসে। হাতের শাহাদাত আঙুল উঁচু করে মেহতিশার কপাল থেকে ধীরে ধীরে গলদেশে নামিয়ে আনে, জিহ্বা নেড়ে বলে,

‘আপনাকে আমি নিঃশ্বাস থাকতে আর ছাড়ছি না বউজান। ‘

প্রভাতের কুহেলিকার আচ্ছন্ন ডাক। আকাশের প্রথমাংশে আঁধার কাটিয়ে অরুনের প্রগমন। পাখিদের কলরব। কাঁধের একটু নিচ পর্যন্তে ভেজা চুলগুলো মুছে হেয়ার ড্রেয়ার দিয়ে শুকিয়ে নেয় মেহতিশা। মনটা ভারি উৎফুল্ল। তাই হয়তো আনমনেই গলা ছাপিয়ে গুণগুণে গান বের হচ্ছে। ঝলমলে পায়ে আনন্দ নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। বাহির থেকে ঘরে আসলো দর্পণ। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে আনন্দের কারণ। মৃদু হেসে ফেলে সে। মেহতিশা সেদিকে তাকায়। প্রথম বার নিজ থেকে উৎসাহিত হয়ে বলে,

‘আপনার ব্যাগপত্রও গুছিয়ে রেখেছি। আমার জামা কাপড় গোছানোও শেষ। কখন রওনা হবো আমরা? ‘

দর্পণ হাসিমুখে বলল,

‘শান্ত হন বউজান ৷ আমরা নাস্তা খেয়ে রওনা দেবো। ‘

মেহতিশা খানিকটা লজ্জা পায়। বুঝতে পারে বেশি উত্তেজিত হয়ে গেছে সে। অস্বস্তি লুকাতে বলে,

‘আচ্ছা, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনি যাবেন? ‘

‘নিয়ে চলুন, আপনাকে ছাড়া ঘরে একা থাকা বড়ই বেদনাদায়ক। ‘

সরল স্বীকারোক্তিতে কপট রাগ দেখিয়ে মেহতিশা বলে,

‘ঢং!’

দর্পণ হাসে। মেহতিশা আলতো পায়ে এগিয়ে এসে দর্পণের হুইলচেয়ারটা নিয়ে যেতে থাকে ডাইনিং রুমে।
বিয়ের দিন মেহতিশা দ্বিতীয় তলার রুমে থাকলেও পরবর্তীতে নিচতলায় শিফট করে। হুইলচেয়ার উপর থেকে নিচে নামাতে একটু সমস্যা হয়ে যায়। মেহতিশা আর দর্পণ ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। দর্পণের বাবা নিয়ামত শেখ, আর লালিমা শেখ একসাথে বসে গল্প করছিলেন। মেহতিশা আশেপাশে তাকায়। কী আশ্চর্য! এতো বড় বাড়িটায় মাত্র এই কয়েক জন লোকের বাস। টেবিলে আরেকটা মেয়েও বসে আছে।
মেহতিশা জানে এটা হচ্ছে, দর্পণের ছোট বোন দিয়া। অবাকই হয়, দিয়া মেহতিশার সঙ্গে একটিবারও কথা বলেনি। কী কারণে, জানেনা মেহতিশা। জানতেও চায়না। কার্যসিদ্ধি করে বাড়ি ত্যাগ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। কে কী করলো তা দিয়ে ওর কী? তবুও কৌতূহল জাগে মাঝে মধ্যে। মেহতিশা নিজের প্লেট থেকে কাবাবটা তুলে নেয়। কামড় বসানোর আগেই দর্পণ আঁটকে দিয়ে বলে,

‘ওটা রাখুন। ওটায় গরুর গোশত আছে। আপনি এটা নিন।’

বলেই মুখের সামনে একটা চিকেন বল তুলে দেয় দর্পণ। মেহতিশা প্রথমে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগলেও পরে হা করে। কিন্তু মুখে নেয়ার আগেই কে যেনো দর্পণের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়। মেহতিশার সামনে রাখা প্লেটটা তুলে মেঝেতে আছাড় মারে। মেহতিশা হতভম্ব হয়ে তাকায়। ভীত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখে সাদা শাড়ি পরিহিত একজন মহিলা। মেহতিশার দিকে তেড়ে এসে ডান হাতটা মুচড়ে ধরে। ক্ষোভ প্রকাশ করা গলায় বলে,

‘খুন করতে এসেছিস? আবার কাকে খুন করবি? আর কার কোল খালি করবি তোরা? ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

”প্রিয় দিও বিরহ ”

৭.

পদতলের ভূমিতে কম্পন হচ্ছে মেহতিশার। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে আচমকা আক্রমণে। সাদা শাড়ির এলোমেলো মহিলাটির মাঝে যেনো অসুরের শক্তি ভর করেছে। দুই হাত দিয়ে মেহতিশার কোমল গলা চেপে ধরেছেন। মেহতিশার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চোখে অশ্রু ভীড়েছে। বাকী সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেও, দ্রুত লালিমা শেখ ছুটে এলেন। মেহতিশার গলা থেকে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,

‘নিশিতা, ছাড়ো বলছি! মেহতিশা এই বাড়ির বউ। ‘

মেয়েটার হাত হাল্কা হয়ে আসলো। চোখ দু’টো করুণ টলমলে হয়ে আছে। মেয়েটা কাঁপছে। মেহতিশার থেকে দুই হাত পিছিয়ে গেলো। মেহতিশা বুকে হাত চেপে হা করে শ্বাস নিচ্ছে। দর্পণ পাশ থেকে এক গ্লাস পানি মুখের সামনে ধরলো। মেহতিশা পানিটুকু ঢকঢক করে পান করে নিলো। মেহতিশা বুঝতে পারছে না, কে এই মেয়ে। দুইদিনে একবারও দেখেনি একে। মেয়েটার পোশাক, চুল যদিও এলোমেলো পাগলাটে। তবে, চেহারায় চকচকে তরুণী ভাব। লালিমা মেয়েটাকে ধরে বারবার বলছেন,

‘নিশিতা, চলো মা তোমাকে ঘরে দিয়ে আসি। ‘

নিশিতা নামক মেয়েটা কান্নারত গলায় বলল,

‘না, আমি যাবো না। তুমি কী বললে? ওই মেয়েটা এ বাড়ির বউ! না না, এ বাড়ির বউ তো শুধু আমি। কে এই মেয়ে? ‘

লালিমা আমতা আমতা করে বললেন,

‘তুমি যেমন তেমনই মেহতিশাও। পাগলামি করে না মা, চলো। ‘

‘এই এই মেয়েকে চলে যেতে বলো, নাহলে আমি কিন্তু সেই চাকুটা দিয়ে আবারও হাত কেটে ফেলবো। ‘

বলে মেয়েটা বাম হাতের আঙুল দিয়ে ডান হাতের শিরায় রাখলো। যেনো ওটাই একটা ধারালো ছুরি। মেয়েটার যে মানসিক রোগ আছে তা বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না। মেহতিশা কৌতুহলী চোখে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ভয়ে, আগে থেকেই দর্পণের হাতটা আঁকড়ে রেখেছে। মেয়েটা হঠাৎ করেই দর্পণের কাছে আসলো। দর্পণের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক একেবারে। নিশিতা মেহতিশাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। মেহতিশা ভড়কে গিয়ে পাশের চেয়ারটা ধরলো। নিশিতা হাঁটুগেড়ে দর্পণের হুইলচেয়ারটার সামনে বসে পড়লো। দর্পণের হাত মুষ্টিমেয় করে বলল,

‘মা, এসব কী বলছে! মিথ্যা বলে তাই না? ‘

দর্পণ মুচকি হেসে বলল,

‘মা, মজা করে বলছে ৷ তুমি জানো না, মা কত মজা করে! ‘

নিশিতা উৎফুল্ল হয়ে হাত তালি দিয়ে ওঠে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে,

‘আমি জানতাম, আমি জানতাম। তুমি তো শুধু আমাকে ভালোবাসো তাই না? কথা দিয়েছিলে, কখনো অন্য মেয়ের দিকে তাকাবে না। চলো আমার সঙ্গে, ওই পঁচা মেয়েটার দিকে কিন্তু তাকিয়োনা। ‘

‘ঠিক আছে, চলো। ‘

‘নিশুপাখি বলো! ‘

‘আচ্ছা বাবা,নিশুপাখি৷ ‘

নিশিতা হাততালি দিতে দিতে লাফিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটে। দর্পণের স্বাভাবিক মুখশ্রী। হুইলচেয়ারটা একজন কাজের লোক সেদিকেই নিয়ে যেতে থাকে দর্পণের আদেশে৷ মাঝখানে লালিমা বাঁধা দিয়ে বলেন,

‘এই দর্পণ, তুই ওই মেয়ের কথা শুনে কেনো চলে যাচ্ছিস? মেহতিশার বাপের বাড়ি যেতে হবে না? ‘

দর্পণ থেমে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

‘নিশিতার এখন আমাকে প্রয়োজন। ‘

‘আর মেহতিশার! ‘

‘মেহতিশা একা যেতে পারবে। কী মেহতিশা পারবে না?’

মেহতিশা নিস্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে। ক্ষনিকের মাঝেই কী ঘটে গেলো! মেহতিশা মনের অজস্র ক্ষতকে লুকিয়ে মুখে হ্যা বলে। দর্পণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে। লালিমা শেখ ইতস্তত করছেন। মেহতিশা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে,

‘মা, এই মেয়েটা কে? আর এমন পাগলামী করছিলো কেনো? ‘

লালিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,

‘ও হলো নিশিতা। আমার বড় ছেলের বউ। ‘

‘বড় ছেলে! ‘

‘হ্যা আমার বড় ছেলে অর্পণ। ‘

মেহতিশা চমকে গিয়ে বলল,

‘কী! এক মিনিট, আমি তো জানি দর্পণ এ বাড়ির একমাত্র ছেলে। আর সেই অর্পণ ভাইয়া এখন কোথায়? ‘

‘ওসব কথা পরে হবে মা, তুমি এখন রওনা হও। চিন্তা করো না, দুপুরের আগেই দর্পণকে পাঠিয়ে দেবো আমি। ‘

মেহতিশা একরাশ কৌতূহল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। দারোয়ান এসে লাগেজ টেনে গাড়িতে ওঠালেন। মেহতিশা গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ছাড়ার আগ পর্যন্ত মেহতিশা শেখ মহলের প্রতিটি ইটকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। কীসের একটা রহস্য পুরো বাড়িটাকে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে। যার রহস্য ভেদ করতে গিয়ে নিজেই আরো বেশি তলিয়ে যাচ্ছে। নাহ, এভাবে নয়। ঘি সোজা আঙুল না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। আর তা ভালো করেই জানে মেহতিশা জামান। চলন্ত গাড়ির জানালার বাহিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। নিজের নামের সঙ্গে শেখ নাম কখনোই যুক্ত করবে না সে। থাকুক কাগজে, সমাজের চোখে। নিজের কাছে মেহতিশা বিশুদ্ধ। তবে, এই বিশুদ্ধতা যে তাঁকে বিসর্জন দিতে হবে এই শেখ মহলেই তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত সে।

দেখতে দেখতে গাড়ি অনেকটা পথ অতিক্রম করে কল্যাণপুর এসে পৌঁছায়। মেহতিশা নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। এই বাড়ির আনাচে-কানাচেতে কত প্রাণ জুড়ানো স্মৃতি ভেসে বেড়ায়। মেহতিশা গেটের দিকে পা বাড়াতেই সেখানে বসে থাকা কুকুরটা ঘেউঘেউ করে হাঁক ছাড়লো। মেহতিশা চমকালো না। ছোটবেলা থেকেই কীসের একটা শত্রুতা এই কুকুরের সঙ্গে। মেহতিশা বোঝে না, কোন কুক্ষণে বাবা এই কুকুরটাকে বাড়ি আনে। না আছে দেখতে কোনো সৌন্দর্য। আর না কোনো আদব। কম সময় তো হয়নি মানুষের সাথে থাকছে। তবুও কেমন করে বিচ্ছিরী গলায় খ্যাকখ্যাক করে। মেহতিশা গেট দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে কুকুরটাকে দেখে বলল,

‘এই পাগলা কুকুর তুই এখনো এখানে বসে আছিস কেনো? ওহ, পাশের বাসার মেয়ে কুকুর সিলভী বুঝি পাত্তা দেয়নি! ভেরী স্যাড। ‘

প্রথমত কুকুরটা মোটেও পছন্দ করে না কেউ তাকে পাগলা কুকুর বললে। তার জন্য বিশেষ আয়োজন করে একটা নাম রাখা হয়েছিলো, জেমি। শামীউল্লাহ জামানের আদরের কুকুর কিনা। জেমিকে যেদিন বাড়িতে আনা হয়, তখন অদ্ভুত ভাবেই মেহতিশার সঙ্গে দন্দ লেগে যায়। মূলত তখন মেহতিশার বয়স মাত্র ষোলো বছর। জেমির নোংরা ধুলোবালি ভরে থাকা শরীর দেখে ছিটকিয়ে বলেছিলো, ওকে নিয়ে রাস্তায় রেখে আসতে। কিন্তু তিনি করেননি। বাসায় মেহতিশাকে দেখলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচায়। সামনে একদমই যেনো সহ্য করতে পারে না। আড়ালে যদিও ওকে খুঁজে বেরায়। মেহতিশা আবার অন্য দিকে জেমিকে খোঁচায়। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে কুকুর থাকে। ওখানের একজন পালে শখ করে। নাম রেখেছে সিলভী। সেই সিলভী আবার বিদেশি সুন্দরী কুকুর। জেমি প্রায়ই টহল দিতে থাকে পুলিশের ন্যায়। বাড়ির আশেপাশে কোনো অন্য ছেলে কুকুর দেখলেই শাসায়। এটা মেহতিশা লক্ষ্য করে। এতে যখনই সুযোগ পায় দু’টো কথা শোনাতে ছাড়ে না। জেমি এতগুলো দিন পরিবারের লোকজনের সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক কিছুই বোঝে। কেউ হেয় করে কথা বললেই খবর আছে। তবে, হয়তো আজ পণ করেছিলো সে মেহতিশা আসলে কোনোরকম ঝগড়া করবেনা। তাই এতক্ষণ বের করে রাখা লম্বা জিহ্বাটা মুখে পুড়ে মুখ ভেঙচিয়ে চলে গেলো লেজ নাড়াতে নাড়াতে। মেহতিশা ওটার দিকে তাকিয়ে বকতে বকতে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

পরিবারের সবাই একে একে ঝাপিয়ে এসে পড়ে মেহতিশার দিকে। মেহতিশা নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে যায়। মা বাবা,চাচা চাচি, চাচাতো ভাই বোন মারিয়া, আশফিন সবাই জড়িয়ে ধরে। একে একে সবার সাথে কথা বলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে আসে মেহতিশা। হয়তো কিছু একটা লুকাতে৷ নিজের ঘরটায়
এসে বিছানায় ধপ করে বসে মেহতিশা। বুকের একপাশে তীব্র জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। চোখের পানিগুলো আটকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করতেই টপটপ করে পানি ঝরে পড়ে। মেহতিশা শূন্যে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,

‘আমি কী এতোটাই গুরুত্বহীন দর্পণ! ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

৮.

মুঠোভর্তি শিউলি ফুল। ভেসে আসছে মন মোহনী সুরভী। হয়তোবা ফুলগুলো ধন্য হচ্ছে গৌড় বর্ণের সুশ্রী সুদর্শনা নারীর স্পর্শে। তবে, নারীটির হয়তো ভীষণ মন খারাপ। হাতের ফুলগুলো নাকের ডগায় এঁটে আখিঁজোড়া বন্ধ করে গাঢ় শ্বাস টেনে নেয়। শিউলী ফুল মেহতিশার বড্ড প্রিয়। সে উঠে দাঁড়ায়। দুপুরে খেয়ে লম্বা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো যখন ঘুম ভাঙে তখন বিকেল পাঁচটে। এতোটা সময় ঘুমিয়ে শরীর ভার হয়ে আছে। উঠে চোখ কচলে টেবিলের দিকে নজর এঁটে বসে। ভ্রু কুঞ্চন হয় মুহুর্তেই। একটা শিউলী ফুলের মালা রাখা সঙ্গে গুটিকয়েক সদ্য শিশির ভেজা শিউলী ফুল। মেহতিশা সযত্নে সেগুলো হাতে তুলে নেয়। ছলাৎ করে একফালি দীর্ঘ শ্বাস বেরোয় বুকের অন্তস্তল থেকে। মেহতিশা জানে কে এই ফুলের প্রেরক। এই সুন্দর সফেদ ফুলগুলোই হয়ে ওঠে বেদনার কারণ। মেহতিশা উঠে যায় বিছানা ছেড়ে। মুঠোফোনের ওপর একবার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে তাকায়। নাহ! আসেনি কোন কল। আর না এসেছে দর্পণ। মেহতিশা সেদিকে বেশি ভাবেনা। বুকে শিকলবন্দী করে আবেগকে। আবেগ নিয়ে পড়ে থাকলে মেহতিশা বাস্তবতায় হেরে যাবে। কী দরকার সেখানে হারানোর। মেহতিশা দ্বিধা অনুভব করে। তার মনে হয় দর্পণ সত্যিকারেই একটা আরশিজাল। যার চোখের দিকে তাকালে একসমুদ্র ভালোবাসার অনল প্রবাহিত হয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যার মুখের মায়াজালে আবদ্ধ হতে তীব্র লোভ জাগে। যাকে মেহতিশা শত ইচ্ছেতেও দূর দূর করতে পারে না। এটাকে ভালোবাসা বলা যায় কিনা জানেনা মেহতিশা। জানতে চায়না বলেই ভাবতে চায় না। ভয় হয় বড্ড। যদি সত্যি সত্যি ভালোবাসা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে! তবে যে কতগুলো মানুষকে দেয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে। মেহতিশা তো দর্পণের কাছে এসেছেই ধ্বংস করতে। মেহতিশা বিশ্বাস করে,

‘মানুষকে ভেতর থেকে ধ্বংস করার প্রধান হাতিয়ার হলো ভালোবাসায় আসক্ত করে হৃদয়ভঙ্গ করা।’

মেহতিশা মুখ হাত ধুয়ে আসে। মোবাইল হাতে নিয়ে বের হয়। সবাই হয়তো তারই অপেক্ষায় ছিলো। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আশফিন আর মারিয়া লুডু খেলছে। শামীউল্লাহ জামান নিজের স্টাডি রুমে। তিনি একজন পেশাগত উকিল ছিলেন। রিটায়ার্ডের পর নিজস্ব ব্যাবসা শুরু করেন। শামীউল্লাহ আর তার ছোট ভাই শফিকুল দুজন মিলে অনেক টাকা ইনভেস্ট করে একটি কোম্পানি খুলেন। সেটা একটা টেক্সটাইল কোম্পানি। বেশ জনপ্রিয়। মাসে কোটি টাকা আয় হয় সেখান।

মেহতিশা এগিয়ে আসলো সোফার দিকে। পা উঠিয়ে আরাম করে বসলো। টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে কোনো একটা নিউজ। সেদিক থেকে নয়ন সরায়। নিচে দুজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে থাকতে। আশফিনের আর এক উঠলেই জিতে যাবে। এদিকে মারিয়ার দুটো গুটি এখনো কাঁচা। বারবার চেষ্টা করছে জিতবার। মাঝে মাঝে ন্যাকা সুরে কান্না করে আশফিনের মনোযোগ সরাচ্ছে। তবে শেষমেষ আশফিনই জিতলো। মারিয়া গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে পা দাপাতে দাপাতে চলে গেলো। আর আশফিনের অট্টহাসিতে ফেটে চৌচির হলো হলরুম। এসব নিত্যনৈমত্যিক কার্যক্রম। বরাবরই নিরপেক্ষ মেহতিশা। মুচকি হেসে মোবাইলে মনোনিবেশ করে।
হঠাৎই সোফায় কম্পন অনুভব হয়। পাশ ফিরে তাকায় মেহতিশা। চমকায় না যদিও৷ চশমা পড়া টসটসে ফর্সা রঙের ছেলেটা তার দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।
হয়তো বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাবার আকন্ঠা। মেহতিশা গম্ভীর গলায় বলে,

‘কেমন আছিস সৌজন্য? ‘

অপরপক্ষে সৌজন্য বিরক্ত হয়। চোখের চশমা খুলে হাতে নিয়ে বলে,

‘তোমাকে কতবার বলবো আমাকে তুই বলবে না?’

মেহতিশা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,

‘তিন বছরের ছোট তুই। আপনি করে বলতে হবে? ‘

‘না। তবে তোমার মুখে তুই সুন্দর দেখায় না তিশা। ‘

‘তোকে না বলেছি, আমাকে নাম ধরে না ডাকতে। আপু বল। ‘

‘কখন এসেছো? ‘

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। স্পষ্ট কন্ঠস্বরের কাছে বলে,

‘তুই আমার ঘরে গিয়েছিলি কেনো? মেয়েদের ঘরে ঢুকতে নেই। আমি এখন বিবাহিত জানিস?’

‘জানি। ‘

ছোট করে বলেই উঠে যায় সৌজন্য। কিছুটা ক্ষোভ আর একবুক হাহাকার নিয়ে হলরুম ছাড়ে। মেহতিশা জানে, যখন মেহতিশার বিয়ে হয় তখন সৌজন্য হোস্টেলে ছিলো। মূলত ওকে জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলো চাচীমা৷ বাসার সবাই জানে, সৌজন্যে ছোট্ট বেলা থেকে কতোটা পাগল মেহতিশার জন্য।
সৌজন্যও মেহতিশার চাচাতো ভাই। এই বাড়ির বড় ছেলে৷ মেহতিশা সবার বড়। তারপর চাচার বড় ছেলে সৌজন্য হয়। যে মেহতিশার তিন বছরের ছোট। এরপর একে একে মারিয়া আর আশফিন। মেহতিশার ঘরে খুব ভোরেই একমুঠো শিউলী ফুল তুলে রেখে আসতো সৌজন্য৷ সেই ধারা আজও বজায় রেখেছে।
ভালোবাসা হয়তো মানুষকে সত্যিই বড় বোকা বানিয়ে ফেলে। সেখানে একবার ডুবলে আত্মসম্মান, বোধ বুদ্ধিও বিসর্জন দেয় মানুষ। আবেগে ভেসে টুকরো হয়। সৌজন্য প্রচন্ড বুদ্ধিমান ছেলে। তবুও মেহতিশা অন্য কারো হয়ে গেছে জেনেও পাগলামি করে। মেহতিশা মনে মনে কৌতূহল নিয়ে নিজেকেই সুধায়-

‘আসলে ভালোবাসা কী? কেনো মানুষ প্রাণ আহুতি দিতেও দু’বার ভাবেনা? ভালোবাসার এতো শক্তি! আশ্চর্যজনক! ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here