প্রিয় দিও বিরহ,১২,১৩,১৪

0
834

“প্রিয় দিও বিরহ,১২,১৩,১৪
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
১২.

আজ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে দর্পণ। শরীর মোটামুটি সুস্থ। বাসায় ফিরে একের পর কলেই সময় কাটাচ্ছে। মেহতিশা আগে যদিও জানতো দর্পণ রাজনীতির সাথে জড়িত। তবে এখন বুঝতে পারছে,
কয়েক দিন পরে ভোটে সে দাঁড়াবে। আনমনে মেহতিশা ভাবতে থাকে, যে নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারেনা সে কীভাবে ইলেকশনে দাঁড়াবে!ভাবতে ভাবতে দর্পণের দিকে তাকিয়ে থাকে। দর্পণ তখন ডান হাতে মোবাইল কানে দিয়ে আরেক হাতে কাগজে কিছু তুলছিলো। হঠাৎ মেহতিশার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। মেহতিশা অপ্রস্তুত হয়। তাড়াহুড়ো করে নিজের কাজে মন দেয়। কাঠের টেবিলটা মুছতে শুরু করে। দর্পণ মুচকি হেসে বলে,

‘আমার দিকে তাকালে আমি মাইন্ড করবো না, বউজান। ‘

মেহতিশা লজ্জিত হয়। এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘মোটেও না, আমি তো এমনি ওদিকে তাকিয়েছি। ‘

‘ওদিকে কোথায়? ‘

‘ঐ যে আপনার পেছনে। ‘

‘আমার পেছনে কী আছে?’

‘খাট! ইশ, কী ধুলো পড়েছে! ওটাই দেখছিলাম। মুছতে হবে। ‘

দর্পণ হেসে ফেলে। মেহতিশা সেদিকে ধ্যান দেয়না। এগিয়ে আসে হাতের কাপড়টা নিয়ে খাটের উপরের বক্সটা মুছতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই যেনো করছে সে। দর্পণ ক্ষণকাল তাকায়। হাতের মোবাইলটা পাশে রাখে। মেহতিশা উবু হয়ে মুছছিলো। দর্পণ দুষ্ট হেসে মেহতিশার ঢিলে আঁচল ধরে টানতেই মেহতিশা ধপাস করে বিছানায় পড়ে।
আকস্মিক ঘটনায় অবাকতার রেশ কাটেনা। কী থেকে কী হলো বোধগম্য হয়নি। পিটপিট করে তাকাতেই দেখলো দর্পণের উত্তপ্ত শ্বাস পড়ছে তার মুখমন্ডলে।
অস্বস্তিতে কুঁকড়ে আসে মেহতিশা। দর্পণকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। দর্পণ নড়ে না। শক্তিতে পেরে ওঠেনা মেহতিশা। ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে,

‘সরুন৷ ‘

‘যদি না সরি? ‘

দর্পণের নির্লিপ্ত উত্তর। মুখে বিরাট হাসি। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয় মেহতিশা। লজ্জামাখা হাসিতে
মাথা নিচু করে। দর্পণ তাকে চমকে দিয়ে অঁধরে গাঢ় স্পর্শ দিয়ে সরে আসে। মেহতিশা বিশাল লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে শুনতে পায়, দর্পণের প্রাণখোলা হাসি৷

ঝিঁঝি পোকার ডাক। নিস্তব্ধ রাত্রি। আকাশের ঠিক মধ্যেখানে সাদা গোল রুটির মতো একটা চাঁদ উঠেছে।
সেই ঝকঝকে সাদা চাঁদটাতেও একটা আবছায়া দাগ লেগে আছে। কল্পসাহিত্যের অর্ধেকটাই এই চন্দ্র নিয়ে।
তবুও এর রহস্য একচুল পরিমাণ কমেনি।

কী অদ্ভুত এই রাত! অবশ্য নিশিতার জন্য প্রতিটা রাতই একাকী নিঃসঙ্গ। নিশিতা হাতের শিকলটার দিকে তাকায়। হেসে দেয় ফিক করে। জোর করে খাওয়ানোর জন্য সকালে কাজের মহিলাটাকে কষে থাপ্পড় মেরেছিলো সে। নিশিতার মতে সে ঠিকই করেছে। সে বারবার বলছিলো, তাকে তার অর্পণ আসবে। খাইয়ে দিবে। নিশুপাখি বলে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কাজের মহিলাটা খ্যাকখ্যাক করে বলছিলো ‘ওরে পাগলিনী! তোর স্বামী মরেছে। আর আসবে না।’ তাইতো গালে চরটা দিয়েছিলো সে। তার বিনিময়ে তাকে লালিমা ঘরের জানালার সাথে হাত বেঁধে শিকলবন্দী করে দেন।

নিশিতা চুপচাপ চেয়ে থাকে হাতটার দিকে। একদিন হাতটা ধরেই এক প্রেমিক পুরুষ কথা দিয়েছিলো কখনো ছেড়ে যাবেনা তাকে। কথা রাখেনি সে। চলে গেছে দূর, বহুদূর। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।
নিশিতা নিজের এলোমেলো চুলগুলো মাথা নাড়িয়ে সরায়। হেলান দিয়ে দরজায় বসে। বিছানার উপর থেকে ফটোফ্রেমটা টেনে নিয়ে আসে। বুকে জড়িয়ে ধরে। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে।
একজন সুদর্শন যুবক হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে বোয়ালখালী চোখে পাশে তাকাচ্ছে। পাশ দিয়ে শাড়ি পরিহিত নিশিতা সলজ্জ হেসে বান্ধবীদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। কী মধুময় স্মৃতি ছিলো! তবে আজ সব ধূসর কেনো! কেনো সেই প্রিয় মানুষটা হারিয়ে গেলো অতীত হয়ে। নিশিতা ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে বলে,

‘প্রিয়, তোমার নামের বিরহ আমাকে ভালো থাকতে দেয়না। ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৩.

মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। একপাশে থেকে রক্তাক্ত কিছু টেনে আনার গাঢ় ছাপ।
দুজন লোক দাঁড়িয়ে কিছু হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে। শিমুল নামের একজনকে হাঁক ছেড়ে ডাকতেই ষোল, সতেরো বছরের ছেলেটা এসে হাজির হয়। বোঝাই যাচ্ছে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। দু’জন লোকের মাঝে হায়দার নামের লোকটা শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘সব পরিষ্কার করেছিস তো? স্যার কিন্তু অপরিষ্কার জিনিস পছন্দ করেনা৷ ‘

শিমুল একগাল হেঁসে বলল,

‘হেয়া মুই জানি। হের লেইগেই তো এত দৌড় দিয়া দৌড় দিয়া কাজ করবার লাগসি। ‘

‘ঠিক আছে, শোন ঐটার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এটার দিকে সবাই নজর রাখবি। ভুলেও যেন পালাতে না পারে। এটাকে যে কেনো এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে বলল স্যার, কে জানে! ‘

কথাটা বলে চেয়ারা বাঁধা যুবকের দিকে নির্দেশ করে ফজলু। ওর কথা শুনে হায়দার বলে,

‘জানিনা। শালা অনেক দিন ধরে স্যারের উপর নজরদারি করতেসিলো। কিন্তু টিকতে আর পারলো কই! ‘

বলেই দুজনে হো হো করে হেঁসে উঠলো। যেনো বিরাট কোনো কৌতুক পেশ হয়েছে এখানে। কথা বলতে বলতে বাহির থেকে হর্ণের আওয়াজ শুনলো দুজনে।
হড়বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। দরজা খুলে এক সুঠাম দেহী পুরুষ প্রবেশ করলো। দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘কাজ শেষ? ‘

তিনজনই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। পুরুষটি ওষ্ঠে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, তোমরা এখন যাও। আমি এখন এখানে কিছু কাজ করতে চাই। আমাকে একটা ধারালো ছুরি আর হাতুড়ি দিয়ে যেও। ‘

হায়দার নিচুস্বরে বলল,

‘ওসব রেডি করেই রেখেছি স্যার। আপনি চাইবেন জানতাম৷ ‘

পুরুষটি হেঁসে বলল,

‘হায়দার ওয়েল ডান। ‘

হায়দার, শিমুল আর ফজলু চুপচাপ স্থান ত্যাগ করে। তারা সবাই জানে এখানে এখন কী হবে। পুরুষটির মুখ থেকে প্রস্ফুটিত হাসিটি সরে যায়। ভেসে ওঠে তুমুল হিংস্রতা। কপালের অদৃশ্য রগগুলো দৃশ্যমান হতে থাকে। এক হাঁটু মুড়ে বসে ফ্লোরে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় চেয়ারে বেঁধে রাখা যুবকটির দিকে। এতটা সময় ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেশার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও এখন জ্ঞান আছে সম্পূর্ণ। সে বুঝতে পারছে, এখন তার সাথে খুব একটা ভালো কিছু হবেনা। নিজেই যে নিজের বিরাট বিপদ ডেকে এনেছে সে। ভয়ে ভয়ে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর কখনো তার হয়ে কাজ করবো না। ‘

কথাটা বলার ঠিক এক মুহুর্ত পরই তারই দেহের থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গেলো। পরিণত হলো লাশে। সামনের পুরুষটির সাদা পাঞ্জাবিটি রক্তে মেখে গেলো। এখন তার মুখের দিকে কেউ তাকালে বুঝতেও পারবেনা, যে সে হাতের ছুড়িটা দিয়ে এইমাত্র লোকটার মাথার উপরিভাগ কেটে দিয়েছে। মাথার উপরের অংশগুলো কেটে গিয়ে ভেতরের ব্রেইন আর রক্ত টগবগ করছে। যেন শরীরটা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা। পুরুষটি দীর্ঘক্ষণ সেই টগবগে রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সাইড থেকে রুমাল উঠিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,

‘এতোটা সহজ মৃত্যু তোকে শুধু এজন্যই দিলাম কারণ শেষ মুহুর্তে তুই ক্ষমা চেয়েছিস। ওপারে ভালো থাকিস। ‘

পুরুষটি বের হয়ে যায়। শিমুল ততক্ষণে বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘স্যার, এটাকেও কী সবার মতো মাটিতে পুঁতে দেবো?’

‘না, এটার মাথাটা কেটে আমার শ্বশুর মশাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে, বাকিটা টুকরো করে পাশের কুকুর গুলোকে খাইয়ে দিস। ‘

‘ওকে বস। ‘

আকাশে তিমির কেটে গিয়ে আলোর কিরণ ফুটেছে।
আঁধার কাটিয়ে আরেকটা ঝলমলে সোনালী দিনের আগমন। কী সুন্দর রোদ এসে ঘর ছুঁয়েছে! দক্ষিণা বাতাস বইছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে ঘরের পর্দাগুলোকে। দর্পণ এক হাতে হেলান দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি বরাবরই নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রায় শায়িত মেহতিশা। মুখে অনবরত উষ্ণ শ্বাস পড়ায় ঘুম হালকা হয়। চোখ খুলেই দর্পণকে দেখে মুচকি হেসে দেয়। দর্পণও বিনিময়ে প্রশস্ত হাসে। মেহতিশার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

‘শুভ প্রভাত বউজান। ‘

‘শুভ প্রভাত। ‘

দর্পণের সাথে মিশে চোখ বুজে থাকে। দর্পণ মুচকি হেসে বলে,

‘উঠুন বউজান। তৈরি থাকুন। ‘

মেহতিশা ভ্রু কুচকে বলল,

‘কীসের জন্য তৈরি থাকবো? ‘

‘আপনার বাবাকে শান্তনা তো দিতে হবে তাই না? ‘

‘মানে? ‘

‘ফোনটা হাতে রাখুন। কখন কার মৃত্যু আসে বলা তো যায়না, ইন্না-লিল্লাহ। ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৪.

‘মৃত্যু’ কী ছোট্ট একটা সহজ শব্দ, কিন্তু সত্যিকারেই কী এর অর্থ সামান্য? মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী। একটা উক্তি আছে, মানুষ এমনভাবে বাঁচে যেনো তার কখনো মৃত্যু হবেনা। অথচ,মৃত্যুর পর মনে হয় যে তার কোনো কখনো পৃথিবী বুকে অস্তিত্বই ছিলো না। কতটা অস্তিত্বহীন হয় মানুষ মৃত্যুর পরে।

শামীউল্লাহ জামান থরথর করে কাঁপছেন। তার কল্পনাতেও কখনো তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। গায়ের প্রতিটি লোমকূপ তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছে, সামনে ভয়ঙ্কর পরিণাম তার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি কপালের ঘাম মুছলেন৷ বাড়ির সামনের
খাটিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সেদিকে ঠিক ঠাক মতো তাকাতে পারছেন না তিনি। যতবার তাকাচ্ছেন, রূহ কেঁপে উঠছে। কী নিষ্ঠুর মৃত্যু দিয়েছে ছেলেটাকে! সবুজ নামের ছেলেটার কাটা মাথাটা পড়ে আছে খাটিয়ায়। তাও অক্ষত নয়। উপরিভাগটা কেটে চুল ফেলে দেয়া। বাকি শরীরটা যে কোথায় আছে কেউ হদীস জানেনা। এর থেকেও ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে, সকাল ভোর ছয়টায় হঠাৎ করেই সদরদরজায় টুং করে কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলেছিলো মেহতিশার মা। একটা কার্টুন বক্স দেখে কৌতূহল বশত খুলেছিলেন। ভেতরের মাথাটা দেখা মাত্রই চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। শামীউল্লাহ জামান বক্সটা হাতিয়ে দেখলেন, সেখানে একটা চিরকুটও লেখা আছে। কাঁপা হাতে কাগজটা খুলে দেখলেন রক্ত দিয়েই সেখানে কিছু লিখে রাখা। পেচানো হাতে লেখা,

‘কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। তোর পাঠানো সামান্য ছেলেটার যদি আমি এই অবস্থা করতে পারি। চিন্তা কর, আমি তোকে কী করবো।’

ভেবে আরেকদফা গলা শুকিয়ে আসলো শামীউল্লাহ জামানের। এই কাজ যে কে করেছে বুঝতে পারছে না।
তবে সন্দেহের তীর একজায়গায় ঠিকই গিয়ে লেগেছে। তিনি তৎক্ষনাৎ ফোনটা হাতে নিলেন। ডায়ালে গিয়ে মেহতিশাকে কল করলেন।

ডক্টরের কাছ থেকে চেক আপ করিয়ে মাত্র বাসায় ফিরলো দর্পণ আর মেহতিশা। দর্পণের পায়ের অবস্থার জন্য প্রতি মাসে একবার করে চেকআপ করে
আনতে হয়। প্রত্যেক বার বাবার সাথেই আসে সে। এবার মেহতিশা নিজেই বললো, সেই সাথে আসবে।
ডক্টর দেখিয়ে বাসায় এসে গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দর্পণ। মেহতিশা দর্পণের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো গুছিয়ে দিলো। একজন সার্ভেন্ট প্রতি দিন দর্পণের গোসলের সময় তাকে সাহায্য করে। মেহতিশা যদিও সাথে সাহায্য করতে চায় কিন্তু দ্বিধায় এগিয়ে যেতে পারে না। অতএব, দর্পণ ওয়াশরুমে ঢোকার পর মেহতিশা বিছানা গুছিয়ে নিয়ে বের হচ্ছিল। পেছনে মোবাইলের রিংটোনে ফিরে আসলো।
মোবাইলটা উঠিয়ে “বাবা” নামটা দেখতেই কপালে ভাজ পড়ে। মেহতিশা দোনোমোনো করে কলটা রিসিভ করে। কানে ধরতেই ভেসে আসে উত্তেজিত কন্ঠ-

‘মেহতিশা, তুমি এখন থেকে আরও সাবধানে থাকবে! কোনোরকম ভুল করবে না। ‘

মেহতিশা ভড়কে যায়। বুঝতে না পেরে বলে,

‘কী হয়েছে বাবা? ‘

‘সবুজ মারা গেছে। ‘

‘কে সবুজ?’

‘আরে! যাকে আমি দর্পণের দিকে নজর রাখতে বলেছিলাম। ‘

‘আশ্চর্য! বাবা, আমি তোমাকে বলেছি দর্পণের উপর আমরা সন্দেহ করে কিছু করতে পারিনা। তুমি আমাকে বিয়ে দিয়েছো শুধু মাত্র সন্দেহ করে। মেনে নিলাম,সেই কাগজটা যদি আমি পাই তাহলে দর্পণ অপরাধী কিন্তু না পেলে আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না সে এমন কিছু করেছে আর না চাচাকে মেরেছে। আর দর্পণ যদি ভুল কিছু না করে আমি তাকে কখনোই ছাড়বোনা। ‘

রাগান্বিত কন্ঠে সম্পূর্ণ কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠলো মেহতিশা। বুঝতে পারলো, দর্পণ নামক রহস্যময় মানুষটার সঙ্গে থাকতে থাকতে কতোটা মায়ামমতা জন্মে গেছে। সে কী দর্পণকে ভালোবেসে ফেললো! ধ্যান ভাঙে শামীউল্লাহ জামানের কথায়।

‘মেহতিশা! ভুলেও এমন কিছু করবে না তুমি। আমাকে তুমি যেমনটা কথা দিয়েছো তেমনটাই হবে। তোমার কাছে সময় ছয় মাস। তারপর আশা করি বাকীটা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবেনা। ‘

শামীউল্লাহ জামান ফোন রাখলেন ক্রোধ নিয়ে। রাগ উঠে গেলো তার। কী বোকা মেয়েটা! দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়েটাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন নিজ হাতে। মেহতিশা ঠিক নারকেলের মতোন। বাহিরে শক্ত রাগী দেখালেও দুটো মিষ্টি কথায় গলে পানি হয়ে যায়। সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। বড্ড ভালোওবাসেন তিনি। পৃথিবীতে সে একজন খারাপ মানুষ হতে পারেন। কিন্তু খারাপ বাবা বলা যায় না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মেহতিশাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। তবে, জোর দিয়ে হলেও সেখান থেকে বের করে আনবেন। বোকা মেয়েটা হয়তো নিজেও বুঝতে পারছেনা, কী ভয়ঙ্কর ফাঁদেই না সে পা দিয়েছে। পুরো দাবা খালায় সামন্য একটা গুটি মাত্র মেহতিশা।

চোখ দুটো টলটল দীঘির জলের মতো উপচে এলো মেহতিশার। নাক ফুলিয়ে কান্না দমালো সে। বিয়ের কদিন আগ থেকে এ পর্যন্ত কী কর্কশ আচরণই না করছেন তিনি। অথচ, ছোট বেলায় একটা ফুলের টোকাও গায়ে লাগতে দেননি তিনি। পদে পদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন,পর কখনো আপন হয়না। মেহতিশা তবুও চুপ থাকে। তবে রাগ দমাতে পারেনা। দর্পণকে সে সেই প্রথম দিন থেকেই প্রচন্ড ধমকা ধামকির উপর রেখেছে। পায়ে পায়ে দোষ ধরেছে। সন্দেহ নিয়ে কথা শুনিয়েছে অযথাই। কিন্তু সত্যি হলো, এ পর্যন্ত কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায়নি। তাহলে শুধু শুধু কেনো সে দর্পণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে? এর তো কোনো মানেই হয়না। নিজের মনকেই সবশেষে প্রশ্রয় দেয় মেহতিশা। এখন মনে মনে দর্পণকে আগের মতো সন্দেহ চোখে দেখেনা। বিশ্বাস যেনো অন্তঃকরণে ঠাই পেয়েছে পাকাপোক্ত ভাবে। সে বিশ্বাস নিজ হাতে সযত্নে রোপণ করেছে দর্পণ। সেখানে হাজার হাজার সন্দেহজনক তীরও ঠুনকো মেহতিশার কাছে। এতোটা বিশ্বাস কীভাবে নিজের প্রতি তৈরি করেছে দর্পণ কে জানে! এখন মেহতিশার মনে হয় সে প্রেমে পড়েছে। দর্পণ নামক মিষ্টি হাসির মানুষটার দিকে তাকালে এখন আর কোনো বিরক্তি কাজ করেনা। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রাণভরে ভালোবাসতে।

কিন্তু, বাবার কারণে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অক্ষম হয় সে। মেহতিশা মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ঠিক করেছে।
সে ততোদিন পর্যন্ত দর্পণকে মনের কথা বলবে না, যতদিন না দর্পণকে সে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারে। মেহতিশা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, দর্পণ কখনোই এতোটা হিংস্র হতে পারেনা। আচ্ছা, যে মানুষটা হুইলচেয়ার ছাড়া উঠতেও পারেনা সে কীভাবে এতো বড় কাজ করবে!আজ রাতই সে তল্লাশি করবে। তারপর বাবার সামনে হাসিমুখে বলবে, “বাবা, আমি বলেছিলাম না, দর্পণ খুব ভালো একজন মানুষ। সে কখনোই এমন করতে পারেনা। ” ভেবে আলতো হাসে সে।

আঁচলে টান লাগতেই পেছনে ফেরে। দর্পণের স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখটা চোখে পড়ে। মেহতিশা হাসি লুকিয়ে বলে,

‘চুল মোছেননি কেনো? ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

‘আপনি মুছে দিন। ‘

মেহতিশা লজ্জা পায়। দ্বিধা কাটিয়ে সাইড থেকে টাওয়াল উঠিয়ে নেয়। ঝুঁকে টাওয়ালটা নিয়ে মুছে দিতে থাকে। দর্পণের মুগ্ধ দৃষ্টি জোড়া তখন মেহতিশার দিকে আবদ্ধ। মেহতিশা মনোযোগ দিয়ে যত্ন করে চুল মুছে দিচ্ছে। দর্পণ আচানক মেহতিশার কোমর টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। মেহতিশা ধরফর করে উঠতে নিলেই দর্পণ, মেহতিশার হাত দুটো চেপে ধরে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাকায়। মেহতিশা দৃষ্টি নত করে রাখে।
অস্বস্তিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে দর্পণ। দুষ্ট ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দেয় মেহতিশার কোমল গালে। ক্ষণকাল কেটে যায়। মেহতিশা একটু স্বাভাবিক হয়ে একটা প্রশ্ন করে,

‘আপনি প্যারালাইজড কবে থেকে দর্পণ?’

দর্পণের চোয়াল শক্ত হয়। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দুই বছর ছয় মাস থেকে। ‘

মেহতিশার কলিজায় কামড় লাগে। ঠিক দুই বছর ছয় মাস আগেই তো মেঝো চাচার মৃত্যু হয়েছিলো!

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here