“প্রিয় দিও বিরহ,২৮,২৯
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
২৮.
বাসের উৎকটে ধোঁয়ার গন্ধ। সঙ্গে অনবরত হর্ণ আর উঁচু নিচু ধাক্কা। সব মিলিয়ে বোরকার ভেতর থেকেই বমি পেয়ে যাচ্ছে মেহতিশার। পেটে মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। দুপুরের মৃদুমন্দ রোদও খুব বাজে লাগছে। ফজুল মির্জার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই শরীরটাও খারাপ লাগছে। চলে আসার সময় অবশ্য তুলি নামের মেয়েটার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। চোখদুটো ছলছল করছিলো মেয়েটার৷ মেহতিশা বুঝেছিলো ঘরের অবস্থা দেখেই, যে তারা খুব একটা ভালো নেই।
দারোয়ানের কাজ করা অব্দি ভালোই চলছিলো। কিন্তু, এখন তুলি এই বয়সেই পড়াশোনা খুব কষ্টে চালিয়ে দিনরাত টিউশনি করে। চেহারাটা দেখেই মেহতিশার ভীষণ মায়া লেগে গিয়েছে। তবে, ফেরার সময় তুলি মেহতিশাকে যখন বলল,
‘আপু, তুমি না খুব সুন্দর! খুব ভালোও। ‘
মেহতিশা তখন হেঁসে ফেললো। বোরকা পড়ায় প্রথমে মেহতিশার বয়স বা চেহারা বুঝতে না পারলেও। মেহতিশা যখন নিকাবটা খুলে পানি খাচ্ছিলো তখন হা করে তাকিয়ে কথাটা বলে ফেললো তুলি। মেহতিশা কোনোমতে ফজলুর মুখ থেকে কিছু তথ্য বের করে এনেছে। তিনি নাম বলার পর আর কিছু বলতে চাইছিলেন না। খুব চেষ্টা করে দুই তিনটা কথা বের করেছে। যদিও তথ্য গুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক কিছুই জেনেছে মেহতিশা। ঘটনার কিছুটা হলেও বুঝেছে। ফজলু মির্জা সেসময় যা বললেন তা হলো,
‘ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার প্রায় ছয় মাস আগে একদিন ফ্যাক্টরির অফিসে একটা ডিল হয়। যেখানে মেহতিশার চাচা ও বাবা দুজনেই ডিল করেন অনন্য শায়েরের সঙ্গে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজে তারা ফ্যাক্টরিতে আসতেন। হঠাৎ করেই কোনো কিছুর জের ধরে অনন্য শায়েরের মেহতিশার বাবার সঙ্গে তুমুল কথা কাটাকাটি হলো। অনন্য শায়ের বয়সে শামীউল্লাহ জামানের অনেক ছোট হলেও তেজ ও ব্যাক্তিত্বে চরম অহমিকা প্রকাশ পায়। বাহিরে মানুষরা তো আর অতকিছু জানতো না। কিন্তু,
আগুন লাগার সাত দিন আগে মারামারিও হয় দুপক্ষের। অনন্য শায়ের হুমকি দিয়ে যায় যে সে সবকিছু ধ্বংস করে ছাড়বে। ‘
এছাড়াও হয়তো ফজলু মির্জা আরও কিছু জানতেন কিন্তু বহু জোড়াজুড়ির পরও মুখ খুললেন না। তাই বাধ্য হয়ে বেরিয়েই আসলো মেহতিশা। এছাড়া দর্পণ যদি এসে পড়ে। যদিও এখন কোনো সময় না আসার। তবু্ও ভয় লাগে। দর্পণ ভালোর সময় অনেক ভালো। ভালোবাসার সময় একেবারে উজার করে দিবে।
কিন্তু, একবার রেগে গেলে কিছুর তোয়াক্কা করেনা। মানুষকে কনফিউজ করে দেয়, যে লোকটা আসলে ভালো নাকি খারাপ! আদৌতে, এরা হুটহাট রেগে যাওয়া পাবলিক৷ রাগে খিটমিট করলেও ভালোবাসাটা অসীম। মেহতিশার এতো দিনের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। মেহতিশা বুঝেছিলো, দর্পণ সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে কিন্তু সেদিন বলেছিলো সে প্রতিজ্ঞাবধ্য। তারমানে হতে পারে, দর্পণ কাউকে কিছু বলতে পারবেনা। বড় কোনো কারণ আছে পেছনে।
মোবাইলে রিংটোনের আওয়াজে কেঁপে উঠলো মেহতিশা। বাস এখনো চলছে। আসার সময় গাড়ি পাচ্ছিলো না বলে বাধ্য হয়ে বাসেই উঠলো। তখন বাসটাও মোটামুটি খালিই ছিলো। এখন দর্পণের কল দেখে ঘাবড়ে গেলো মেহতিশা। দর্পণ কী বাসায় ফিরে এলো! দর্পণ যদি ফিরে আসে কী করে সামলাবো! ভেবেই অস্থির হলো মেহতিশা। কল একবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার কল আসতেই মেহতিশা ভয়ে ভয়ে রিসিভ করলো। দর্পণের স্বাভাবিক কন্ঠ –
‘কী করছেন বউজান?’
মেহতিশা হাফ ছেড়ে বললো,
‘এইতো খাবার খেলাম মাত্র। ‘
‘কী খেলে?’
‘ইয়ে..ওই ডিম খেলাম ডিম! ‘
দর্পণ অবাক হয়ে গেলো। মেহতিশা তো ডিম একটুও পছন্দ করেনা। ডিম দেখে একদিন বমি করে ভাসিয়েছিলো।দর্পণ হেঁসে বললো,
‘মজা করছেন বউজান!’
‘না তো কেনো?’
‘আপনি তো ডিম দুচোখে দেখতেই পারেন না। তাহলে! ‘
মেহতিশা বুঝতে পারলো বোকার মতো একটা কথা বলে ফেলেছে। এবার কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো,
‘উহ! কীসব ডিম নিয়ে বসেছেন! আপনি খেয়েছেন? ‘
মেহতিশা সাধারণত দর্পণকে জিজ্ঞেস করেনা কী খেয়েছে বা কী করছে। কারণ মেহতিশার সঙ্গে সেইদিন কথা কাটাকাটি হওয়ার পর আগ বাড়িয়ে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। দর্পণ বাহিরে থাকাকালীন একা একাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা বলে। তবে, আজ দর্পণ সেসবে পাত্তা না দিয়ে খুশিই হলো। অভিমানীর বুঝি অভিমান কমলো। দর্পণও আগ্রহ নিয়ে এটা ওটা বলছে আবার গম্ভীর গলায় আদেশ দিচ্ছে ঘর থেকে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বের না হতে। মেহতিশা তখন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলছে। দর্পণ যদি জানে মেহতিশা শুধু ঘরই না বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেছে তাহলে, কী যে করবে ওকে! ভেবেই বুকটা দুরুদুরু করে কাপছে। কোনোভাবে মেনেজ করে মেহতিশা যেই না কলটা রাখবে তখনই বাস কন্টাক্টর এসে বলল,
‘ভাড়া দেন আপা। ‘
বাসের তীব্র বেগের হর্ণটাও তখনি বেজে উঠলো। মেহতিশার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম। দর্পণ ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করে বলছে,
‘এটা কীসের আওয়াজ হলো? ‘
‘ওইতো বাস্তায় গাড়ির আওয়াজ। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছি তো তাই।’
বলেই ফোনটা কেটে দিলো মেহতিশা। ভাড়াটা দিয়ে বাসায় ফিরলো। তখন বেলা বারোটা গড়িয়েছে। পেটে চিনচিন করছে। ক্ষুধায় হয়তোবা। লালিমা শেখ তখন ড্রইংরুমে নেই। ঘর ফাঁকা। সুবিধাই হয়েছে। মেহতিশাকে ঢুকতে দেখে রান্নাঘর থেকে মালা ছুটে আসলো। ফরফর করে বলতে লাগলো,
‘আফনে এতো দেরি কইরা আইলেন ক্যান আফা! আমি যে ভয়ডা পাইসি! যাই হোক, ভাইজানরে সারপেরাইজ দিসেন ছুডু আফা? ‘
মেহতিশা বেজায় ক্লান্ত। কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা। ভরা পেটে এতদূরে অনেক দিন হয়েছে জার্নি করা হয়নি। তাই, খারাপ লাগছে। এখন কিছু না খেলে অজ্ঞান হতে বেশী সময় নিবেনা। মেহতিশা ঘোলা চোখে তাকিয়ে বললো,
‘মালা, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। তুমি দ্রুত খাবারটা ঘরে নিয়ে এসো। তোমার ভাইজান এলে ভুলেও আমার বাহিরে যাওয়ার কথাটা বলবেনা। খেয়াল রেখো। ‘
মালা কিছু বুঝতে না পেরে মাথা কাত করে হ্যা বললো। তারপর দৌড়ে ছুটে গেলো খাবার আনতে। মেহতিশা ঘরে এসে বোরকাটা খুলে আলমারিতে রেখেই খাটে শুয়ে পড়লো। নাহ! দুপুরে যাওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এছাড়া সময়ও তো ছিলোনা। দর্পণ তো বিকেল হওয়ার আগে আগেই চলে আসে। এরপর অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। নাহলে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলে এতো এতো রহস্য গুলোর সমাধান করবে কী করে!
পাঁচ মিনিট পরই খাবারের প্লেট হাতে ছুটে এলো মালা। মেহতিশা উঠে দূর্বল হাতে খেতে খেতে বললো,
‘নিশি আপু খেয়েছে? ‘
মালা এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘হ, জানেন আইজতো চমৎকার হই গেছে। ‘
মেহতিশা ভ্রু কুচকে বলল,
‘কীসের চমৎকার! ‘
‘খালাম্মা নিজের হাত দিয়া নিশিতা ভাবিরে খাওয়াই দিসে। ‘
‘কীহ! সত্যি বলছো! ‘
‘আমি ভাত নিয়া গেলাম খাওয়াইতে। ওমা! আমার হাত থিকা প্লেট নিয়া খালাম্মা কয় সেই নাকি খাওয়াইবো। আমি তো পুরাই বেআক্কল হই গেলাম। কী আর কবো! ‘
মেহতিশার খুশিতে চোখ ঝলমল করে উঠলো। এতদিনের চেষ্টা সফল হলো তাহলে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক, এবার থেকে নিশিতা একটু হলেও যত্নে থাকবে। মেহতিশা খাওয়া শেষ করে শুয়ে রইলো ঘরের পর্দা দিয়ে।
–
সন্ধ্যার ফুল ফুটছে। আকাশে লালাভ রঙ সরে গিয়ে আস্তে আস্তে নীলিমাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। অপূর্ব সুন্দর পাখিগুলো নিজ নিজ বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সবারই তো একটা আশ্রয়স্থল আছে। যেখানে আর কিছু করা যাক আর না যাক শান্তিতে চোখ বুজে শুয়ে মাথার উপরের ছাদটা দেখে বলা যায় আমারও একটা নীড় আছে। আমি নীড়হীনা নই। শীত যেহেতু শেষের পথে তাই হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আরকি। রাস্তাঘাটকে পরিষ্কার করছে বলা যায়। মেহতিশা শুয়ে শুয়ে হাতে একটা বই নিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করছিলো।
ঘরের দরজা খুলে ভেতরে আসলো দর্পণ। আজ সারাদিনে প্রচুর ব্যস্ত ছিলো সে। নাওয়াখাওয়া ভুলে গিয়েছিলো একপ্রকার। রোজ বিকেলের একটু আগে ফিরলেও আজকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেকটাই দেরি হলো। মেহতিশা ওকে দেখে উঠে এলো। গায়ে ওড়ে জড়িয়ে এগিয়ে আসলো। দর্পণের শরীরটা ভিজে গেছে। বৃষ্টি হয়তো বেড়েছে। চুলগুলো থেকে টুপটাপ ফোঁটা ঝড়ছে। মোহনীয় লাগছে দেখতে। হাতে কোর্টটা ঝুলছে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে পাশে রাখলো মেহতিশা। নিঃশব্দে টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘মুছে নিন। ‘
দর্পণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। মেহতিশা দূরে সরতে নিলে হেঁচকা টানে বললো,
‘মুছে দিন। ‘
‘আপনাকে লাগুর পাইনা আমি। ‘
দর্পণ মুচকি হাসলো। খাটে বসে মেহতিশা হাতে টাওয়াল ধরিয়ে দিলো। মেহতিশাও বিনাবাক্য প্রদানেই যত্ন নিয়ে টাওয়াল দিয়ে চুল, হাত, মুখ মুছে দিলো। দর্পণ এতক্ষণ তাকিয়েই ছিলো। হঠাৎ বললো,
‘মেহতিশা, জানো আমি মিথ্যা পছন্দ করিনা?’
মেহতিশা ভড়কে গেলো। তবে কী জেনে গেলো দর্পণ, মেহতিশা যে মিথ্যা বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিলো! এবার কী হবে?
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
২৯.
শান্ত নৈশব্দিক বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। চারপাশে এক বিন্দু আওয়াজ নেই। পিন ড্রপ অফ সাইলেন্স। কিন্তু, আদৌও কী পরিবেশ এতোটা ঠান্ডা? দর্পণের মুখশ্রী একেবারে স্বাভাবিক।
চোখ মুখে হাসি। অথচ,মেহতিশার চোখ মুখে ভয়াবহ আতঙ্ক। মনে মনে বারবার প্রার্থনা করছে এবারের মতো আল্লাহ বাঁচিয়ে দাও। মেহতিশাকে অবাক করে দর্পণ বলল,
‘তুমি আজকে ডিম খাওনি, তবুও মিথ্যা বললে কেনো? ‘
মেহতিশা বড় বাঁচা বাঁচল। জানটা এতোক্ষণ হাতে চলে এসেছিলো। বড় একটা শ্বাস নিয়ে উপরওয়ালার শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
‘আসলে, মালা ডিম নিয়ে এসেছিলো কিন্তু আমার বমি পাচ্ছিলো বলে খেতে পারিনি। মালা বলল,আপনার কাছে বিচার দিবে তাই আরকি। সরি!’
দর্পণ হাসলো। মেহতিশাকে টেনে পাশে কোলে বসালো। মেহতিশা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। দর্পণ তার চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘বউজান,এই যে আমি তোমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছি এটা কী আমার জন্য? তুমি না খেয়ে দেখো কী দূর্বল হয়ে গেছো! সাত মাসে কিন্তু পেট অনেকটাই বেড়ে যায় তোমার কিন্তু তেমন বাড়েনি। তুমি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারোনা। দূর্বল হয়ে যাও। ডক্টর কিন্তু বলে দিয়েছে এমন হতে থাকলে তোমার সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হবে। নরমালে করালে তোমার কোনো রিস্ক থাকবেনা, সিজারিয়ানে কিন্তু অনেক ভোগান্তি। তাছাড়া অনেক সাইড ইফেক্ট আছে। তুমি এমন কেনো করো? ‘
‘আমি খেতে না পারলে কী করবো! ‘ আহ্লাদী সুরে বলল মেহতিশা।
‘আমি এখন থেকে তোমাকে খাইয়ে দিবো। তাহলে হবে?’
‘খুব হবে! ‘
‘পাগলী আমার! ‘
–
মোবাইলটা হাতে নিয়ে একের পর এক কল করছে মেহতিশা। কালকে অবিরাম খুনসুটির পর। দুজন অনেকক্ষণ গল্প করেছে। আজকে দর্পণ অফিসে চলে যাওয়ার পর মেহতিশা দরজা বন্ধ করে দিয়ে যতটুকু তথ্য আপাতত জমা আছে ততটুকু দিয়েই কাজ শুরু করে দিলো। প্রথমে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফায়ারবেটাল ইন্ডাস্ট্রির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বের করলো৷ তারপর, সেখানের মালিকের কিছু তথ্য জেনে নিলো। দেখা গেল, ২০১০ এ শুরু হওয়া এই কোম্পানি খুব একটা জনপ্রিয় ছিলোনা। তেমন প্রফিটও মিলছিলোনা। কিন্তু, হঠাৎ করেই আজ থেকে দুই বছর আগে থেকে আগুনের মতো তড়তড় করে লাভ, ডাকনাম সব বেড়ে গেলো। একের পর একে বেস্ট ডিল গুলো এই কোম্পানিই ক্র্যাক করে যাচ্ছে। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেলো, দর্পণের কোম্পানি বেটার চয়েজ এবং মেহতিশার বাবার কোম্পানি ময়ূখ দু’টোই অনেকগুলো বছর টপে ছিলো কিন্তু, ঠিক দুই বছর ধরে এই দুটোকে পিছে ফেলে টপলিস্টে জায়গা করে নিয়েছে ফায়ারবেটাল। কিন্তু কীভাবে! মাত্র দুই বছরেই কী করে এতোটা ডেভেলপমেন্ট হলো! এর পেছনে কোনো রহস্য নেই তো!
বিরাট একটা খটকা লেগে গেলো মেহতিশার মনে। একের পর এক তথ্য বের করার চেষ্টায় অনড়ভাবে এগিয়ে আসলো মেহতিশা। অনন্য শায়েরের নামে সার্চ করে দেখলো, সেখানে শ্যাম বর্ণের একজন ফ্যাশেনেবল চশমা পরিহিত একজনের ছবি দেখা যাচ্ছে। একটা আরাম চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। একটা পা অন্যটার উপর তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে ছবিটা তুলেছে। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। স্বাভাবিকও হতে পারে। কিন্তু, মেহতিশার চোখে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র জিনিসও বিশাল লাগছে। ল্যাপটপ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কাগজে লিখে নিলো সে। তারপর অনেকটা সময় পর একটা নাম্বার খুঁজে পেলো। যদিও এটা অনন্য শায়েরের এসিস্ট্যান্টের। হতেই তো পারে, এর মাধ্যমেই অনন্য শায়েরের দেখা পাওয়া সম্ভব! মেহতিশা মোবাইলে নাম্বারটা উঠিয়ে কল করা শুরু করলো। কিন্তু ওকে হতাশ করে দিয়ে বারবার কল কেটে যেতে লাগলো। মেহতিশা পঞ্চম যেইনা অধৈর্য হয়ে নিজেই কল কেটে দিতে নিলো তখনই বিস্মিত করে একজন ছেলে কন্ঠে বলল,
‘হেলো, কে বলছেন?’
মেহতিশার মুখে হাসি ফুটলো। খুশিতে খাটে উঠে লাফাতে ইচ্ছে করলো কিন্তু তা এই মুহূর্তে করা একেবারেই সম্ভব না। মেহতিশা খুশিটা সামলে বলল,
‘মিস্টার অনন্য শায়েরকে পাওয়া যাবে?’
অপরপক্ষ থেকে একটা বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দ ভেসে আসলো। মনে হচ্ছে মহা ব্যস্ত লোক।
‘পাওয়া যাবে, কিন্তু সবার জন্য নয়। ‘
‘দেখুন, প্লিজ তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই আমি। আপনি কলটা তাঁকে দিন। নাহলে, তাঁর নাম্বারটাই দিন। ‘
‘স্যারের নাম্বারটা বুঝি মগের মুল্লুক পেয়েছেন! যে চাবে তাঁকেই দিয়ে দেবো! আরে কে আপনি?’
‘আমি বেটার চয়েজের মালিক দর্পণ শেখের স্ত্রী মেহতিশা বলছি।’
‘ওহ নতুন প্রধানমন্ত্রী বুঝি? ‘
‘আপনি কী আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছেন?’
‘আপনি বুঝলেন কী করে! ‘
‘প্লিজ, একটু সাহায্য করুন আমার। আমার নাম আর পরিচয় বললেই আপনার স্যার আমাকে চিনবেন। ‘
‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে! আমি বলছি। ‘
অনেকটা বিরক্তি নিয়ে কল কেটে দিলো অমি। গলার টাইটা টেনে ঢিলে করে নিলো। মনে মনে ভাবলো, এসব পাগল আসে কোথা থেকে! দর্পণ শেখের স্ত্রী! কচুও চিনবেনা অনন্য স্যার। দেখা যাক,কথায় কথায় নামটা জিজ্ঞেস করবে। নাহলে, তিনি যে মানুষ!
ডেস্ক থেকে নেক্সট এপয়মেন্টের ডেট ফিক্স করে উঠলো অমি।
তারপর, ছুটলো বসের রুমের দিকে। হাতে কাগজপত্র একগাদা।
ভয়ে ভয়ে দরজায় নক করলো। ভয়ের কিছুই নেই তবুও অমির প্রচুর ভয় লাগে। এ পর্যন্ত স্যার তাঁর সঙ্গে বিন্দুমাত্র কড়া চোখে তাকায়নি তবুও ওই বাজপাখির মতো দৃষ্টি দেখে কাপে থরথর করে সে। মনে হয়, মুখ না মস্তিষ্ক দিয়ে সব কাজ চালায় লোকটা। দরজা খুলে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। কাচুমাচু করে বলল,
‘স্যার, মিস্টার দত্তর ফাইলগুলো রেডি হয়ে গেছে। এখন আপনার সাইন লাগবে। ‘
চোখের চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে অনন্য। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল,
‘দত্ত সাহেব কী এমাউন্টের ব্যাপারে কিছু বললেন?’
‘স্যার, তিনি বললেন ৪০ কোটির উপরে আর এক টাকাও বেশি দিবেন না তিনি। ‘
অনন্য চোখ খুলে ঠোঁট কাপড়ে হাসলো। টেবিলে রাখা হাতগুলো নাচাতে নাচাতে বলল,
‘দত্ত সাহেবের ভালো থাকতে ইচ্ছে করেনা বোধ হয়! ‘
অমি ভড়কে গিয়ে আঁড়চোখে তাকালো। ওর দৃষ্টি দেখে অনন্য স্বশব্দে বলল,
‘ওহ কাম অন, বাই হুক ওর বাই ক্রক কাজ হাসিল করে নিতে শেখো অমি! ষ্টুপিডটি করা কী মানায় দুনিয়ায়! কেউ কারো জন্য এক টাকাও খরচ করেনা মনে রাখবে। ‘
‘জ্বি স্যার! ‘
ফাইলগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
‘স্যার, ইয়ে মানে একটা কথা ছিলো। ‘
‘বলে ফেলো। ‘
‘একটা মেয়ে ফোন করেছিলো! আপনাকে চাইছিলো। ‘
অনন্য মুখে তুলে তাকিয়ে বলল,
‘সে তো রোজই কতশত করে! নতুন কী? ‘
‘না স্যার, আজকে যিনি কল করেছিলেন তিনি বেটার চয়েজ কোম্পানির মালিকের স্ত্রী বলছিলেন,আর তাঁকে নাকি আপনি চিনবেন। ‘
অনন্য একটা ফাইলে সাক্ষর দিচ্ছিলো। হাতটা থমকে গেলো তাঁর। মনটাও যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে ভেসে গেলো অন্য কোথায়। কলম রেখে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলল,
‘কী বলেছে সে?’
‘উনি বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। আর আপনার নাম্বারও চাইছিলেন। ‘
‘দিয়েছো তুমি? ‘
‘না স্যার, আমি বেশ ধমকি-ধামকি দিয়ে না করে দিয়েছি। ‘
বেশ গৌরব নিয়ে কথাটা বলল অমি। কত মেয়েই রোজ কল করে অনন্যের নম্বর চায়। কিন্তু, সবকিছু অমি হ্যান্ডেল করে নেয়।
এতে কেমন যেন একটা আত্মতুষ্টির অনুভূতি পায় সে। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে কত মেয়ে পেছনে ঘুরেছে, হাজার হাজার কল দিয়েছে সবার ইগনোরেন্সই পেয়েছে বেশিরভাগ। এখন, কত মেয়ে কল দেয়! অথচ,সে ঝাড়ি দিয়ে কল কাটে। সেখানেই তো মজা! অমি দাঁত বের করে হাসছে। অনন্যের কী হলো বোঝা গেলোনা। সে গম্ভীর গলায় বলল,
‘মেয়েটাকে কল করো এবং জানাও সে যখন সময় পাবে তখনই চলে আসতে, কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আর আগ বাড়িয়ে পাকনামি করতে কে বলেছে তোমাকে! ‘
অমি হা করে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম বার এমন কোনো ঘটনা হলো যার আগামাথা বুঝলোইনা সে। থতমত খেয়ে বলল,
‘সত্যি স্যার! ‘
‘কাগজগুলো উঠাও আর বের হও। আই নিড রেস্ট। ‘
অমি হা করেই বের হলো। তারপর ডায়াললিস্ট থেকে নাম্বারটা বের করে মেহতিশাকে কল করে জানিয়ে দিলো। সে যখন পারে তখনই যেনো আসে।
–
মেহতিশা ইয়াহু বলে চিৎকার করলো। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, অনন্য শায়ের এতো দ্রুত কীভাবে রাজি হয়ে গেলো! এটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা! তবে? সে যাই হোক মেহতিশা যতদ্রুত সম্ভব হয় যাবে। দেখা করাটা খুব দরকার!
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।