“প্রিয় দিও বিরহ,৩০,৩১
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
৩০.
চকচকে তকতকে আসবাবপত্রে সাজানো অফিসটা। চারিদিকে ব্যস্ত হয়ে সবাই ছুটাছুটি করছে। কখনো ফাইল কোথাও থেকে সাইন করিয়ে আনছে তো আবার কখনো ইংরেজিতে ‘হেলো, হেলো, স্পিকিং ফ্রম ফায়ারবেটাল কোম্পানি, আর ইউ হেয়ার মি?’ অপপাশ থেকে বিপরীতে কী উত্তর মিলছে সে ব্যাপারে তেমন একটা ধারণা নেই মেহতিশার। নিজেকে আবারও আড়াল করে গায়ে বোরকা জড়িয়ে মাঠে নেমেছে সে। না, এটা কোনো ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার ময়দান নয়। এটি রহস্যভেদের খেলা।
চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে কোমড়ে ব্যাথা করছে তাঁর। এখানের মানুষগুলো এতো ব্যস্ত যে দু’টো কথা বলার সময় নেই। আজকে দর্পণ দুপুরে অফিসে গিয়েছে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে মেহতিশা বেরিয়ে গেছে। আজকে সে শ্বাশুড়িকে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে বলেছে,তাঁর এক বান্ধবী রেস্টুরেন্টে এসেছে দেখা করতে। তিনি যেহেতু মেহতিশার অতিভক্ত তাই কোনো সমস্যা হয়নি। মালা যদিও প্রশ্ন করতে এসেছিলো কিন্তু আজ সে কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছে, তাঁর খেয়াল রাখার জন্য কাউকে প্রয়োজন নেই। মালার এতো কনসার্ন হওয়ার দরকার নেই। মালা বিপরীতে নির্বাক হয়ে আহত চোখে তাকিয়ে ছিলো। মনে মনে খারাপ লেগেছে অবশ্য। মালা সারাক্ষণ হাসিমুখে কোমরে ছোট্ট একটা ওড়না বেঁধে ছুটাছুটি করে বলে, আফা আপনে মেলা সুন্দর হই গেছেন!আপনের লিগা কিছু আনি?ভাইজান খুশি অইবো! মেহতিশা কিছু বলেনি। চুপচাপ বেরিয়ে এসেছে। নাহলে,মায়ায় পড়ে আর আসতেই পারবেনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পার্পেল রঙের দেয়ালে টাঙানো বড় গোলাকৃতি ঘড়িটায় তাকিয়ে দেখলো,এখানে আসার চল্লিশ মিনিট পূর্ণ হলো। গরমে ঘেমে গেছে ইতিমধ্যে। কেউ নেইও যে বলবে এক গ্লাস পানি দিতে। নিকাবটাও খোলার জো নেই। ভেতরের জামাটা ভিজে চুবচুব করছে। উশখুশ করে উঠে দাঁড়ালো। রিসিপশনের মেয়েটার কাছে আধা ঘণ্টা আগে বলেছিলো ওর পরিচয়টা। কিন্তু, মেয়েটা এমন হেলা নিয়ে তাকাচ্ছিলো যে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো মেহতিশা। এমন তাচ্ছিল্যে দৃষ্টির মানেও বুঝলো। প্রথমত, কালো ছিমছাম বোরকা পেট মোটা কাউকে বয়স্ক অশিক্ষিতই ভেবেছে । আর দ্বিতীয়তে, সবার স্কুল কলেজে ভার্সিটির লাইফে এমন কিছু স্টুডেন্ট থাকে যারা কিনা নিজেকে সুস্বাদু বিরিয়ানি মনে করে আর অন্যদের ডালভাত। সেরকমই ঘটেছে। মেয়েটা নিজেকে টপ কোম্পানির একজন রিসিপশনিস্ট হওয়ায় যতোটা অহমিকা দেখাচ্ছে তেমনই অন্য আট দশটা কোম্পানিকে অত্যন্ত নিচু চোখে দেখছে।
এতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না মেহতিশার। কে কী ভাবলো, তা নিয়ে এখন আর ভাবেনা সে। মানুষ বলার সময় গলা উঁচু করে কটু কথা বা দৃষ্টি দিয়ে আহত করতে পারলেও,কোনো বিপদের সময় দৌড়ে পালায়।
উঠে এসে আবারও রিসিপশনের সামনে দাঁড়ালো সে। রিসিপশনের মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে কলম দিয়ে খাতায় কী যেনো তুলছে। মোবাইলটাও কানে তুলে রেখেছে। মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা। কিন্তু, পরে মেহতিশা শুনলো, মেয়েটা বলছে- বাবু রাগ করোনা প্লিজ,তুমি এড্রেস বলো আমি আজই আসবো। হ্যা হ্যা!..
মেহতিশা ইতস্তত চোখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। মেয়েটা দেখেও এমন ভান করলো দেখেও ওকে দেখছেনা। মেহতিশার হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা রাগটা ছলাৎ ছলাৎ করছে। মন চাচ্ছে কষিয়ে গালে একটা চড় মেরে দিতে। বেয়াদব যেনো কোথাকার! রাগ দমিয়ে বলল,
‘এক্সকিউজ মি, আপনি বলেছিলেন আপনার স্যারকে জানিয়েছেন। তাহলে, এতক্ষণ কেন লাগছে! ‘
মেয়েটা তখনও ফোনে কথা বলেই চলেছে। ভ্রু কুচকে ফোনটা একটু সাইডে রেখে বলল,
‘ওয়ের্ড তো! আমি তো স্যারকে বলেছিই। এখন আপনার কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে নাকি?’
‘জবাবদিহি কেন হবে! আমারও সময়ের দাম আছে। এখন আমি কী এখানে সারাদিন বসে থাকবো নাকি! ‘
মেয়েটা বেজায় বিরক্ত হলো। এতক্ষণ বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই বসেছিলো কল করার কথাটা। এখন তো দেখা যায়, কল না করলে চেচিয়ে মানুষ জড়ো করে ফেলবে। ইমেজটা নষ্ট হওয়ার ভয়ে মেয়েটা রগচটা গলায় উত্তর দিলো,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে! বসুন আপনি আমি আবারও কল করছি। ‘
মেহতিশা চোখ মুখ গরম করে তাকিয়ে আছে। সে জানে মেয়েটি কল করেনি একবারও। অকপটে কতো বড় মিথ্যা কথা বলে ফেললো! দাঁড়িয়েই রইলো মেহতিশা এক সাইডে। মেয়েটা কল করে মিনমিন করে কী যেনো বলছে। দুই মিনিটের মাথায় মেয়েটি বলল,আপনি দোতলায় ২০১ নম্বর রুমে চলে যান। ওখানেই স্যারকে পাবেন।
মেহতিশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হেঁটে চললো। হাঁটতে যদিও কষ্ট হয়না। কিন্তু সিঁড়ি চলাচলটাই ভোগায়। একটা সিঁড়ি উঠে দুই মিনিট হাঁপাতে হয় ওকে। মা হওয়া কতো কষ্টের তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এজন্যই হয়তো বলা হয়,মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।
রুমের দরজায় নক করার আগেই গম্ভীরতর এক কন্ঠ বেজে উঠলো কানে,
‘কাম ইন। ‘
মেহতিশা বুঝতে পারলো না কীভাবে তার উপস্থিতি টের পেলো ভেতরের কেউ। উপর তাকিয়ে পরখ করে নিলো, কোথাও কোনো সিসিটিভি স্থাপন করা নেইতো! নাহ, সিসিটিভি গুলো একদম মাথায় লাগানো তাও উল্টো করে। দ্বিধান্বিত মনে ভেতরে আসলো। চেয়ারে বসে আছে চশমা পরিহিত সেই লোকটি যাকে মেহতিশা ছবিতে দেখেছিলো। ছবির মতো শ্যামবর্ণীয় মায়াবী চেহেরার লোক। সুদর্শন বটে। তা মানতে হয়। কিশোরী বয়স এবং অবিবাহিতা হলে হয়তো মেহতিশা নিজেই লোকটার প্রেমে পড়ে যেতো। মেহতিশা মনে মনে হেঁসে ফেললো। কী চিন্তা ভাবনা! ছিহ! দর্পণ যদি এখন শুনতো মেহতিশা লোকটাকে দেখে মনে মনে এইসব ভেবেছে তাহলে খবর হয়ে যেতো। যত যাই হোক,এখন দর্পণকে ছাড়া কাউকেই ভালো লাগে না। দর্পণও তো যথেষ্ট সৌন্দর্যমন্ডিত। এর চাইতেও বেশি ফর্সা। মেহতিশার চিন্তাভাবনা অন্য কোথাও, কেননা ছবিটা দেখে মনে না হলেও এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে এই ব্যাক্তিকে সে এর আগেও কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় মনে পড়ছে না। সামনে বসা লোকটি বিনয়ী হাসলেন। ভারিক্কি কন্ঠে বললেন,
‘মিসেস মেহতিশা, প্লিজ সিট। ‘
হাত দিয়ে ইশারা করে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল অনন্য।
মেহতিশা চেয়ার টেনে বসলো। বসতেই এমন ভাবে চেয়ারটা কেঁপে উঠলো যে মেহতিশা ভয় পেয়ে বুকে হাত চেপে উঠে গেলো। অনন্য হেঁসে বলল,
‘আরে ভয় নেই, এটা বসার পর স্প্রিং সিস্টেমে নিচে নেমে যায়। ‘
মেহতিশা দোটানা নিয়ে ধীরে সুস্থে আবারও বসলো। তারপর গজগজ করা রাগ চাপা কন্ঠে বলল,
‘আপনার অফিসের সবারই কী এমন প্রবলেম আছে! ‘
অনন্য কথার মানে না বুঝে হা করে বলল,
‘সরি?’
‘আই মিন,সব মানুষ আর জিনিসপত্র গুলোরই! ‘
‘মানুষ বলতে কাকে বোঝালেন? আমাকে?’
‘সব বলতে সবই বোঝালাম। এক ঘন্টা যাবৎ বসিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়াই বুঝি উদ্দেশ্য ছিলো? বললেই তো হতো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসতে। ‘
‘আপনার এক ঘন্টা হয়েছে! আই এম সো সরি! আমি তো কিছুক্ষণ আগে জানলাম। আমি ক্ষমা চাচ্ছি সবকিছুর জন্য। আমি আয়েশা, মানে রিসিপশনিস্টকে এরজন্য অবশ্যই শাস্তি দেবো। ‘
মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এতক্ষণের রাগটা কমে গেছে। সরিতে বুঝি জাদু আছে। এজন্যই মানুষ কোনো কিছুতেই সরি বলে ফেলে। নাহলে, গত একঘন্টা ওকে ভুগিয়ে একটা সরিতেই কী করে রাগ দমে গেলো! যাই হোক, এখন মূলকথাগুলো জানতে হবে। মেহতিশা বলল,
‘আমি এখানে কেনো এসেছি জানেন? ‘
‘জানি। ‘
মেহতিশা অবাক হয়ে বলল,
‘মানে! কীভাবে জানেন?’
‘ভবিষ্যত জানিনা কিন্তু ভবিতব্য তো আন্দাজ করতেই পারি। আপনার তো আসারই ছিলো মেহতিশা। ‘
‘আপনি কী আমাকে আগে থেকেই চিনতেন? ‘
‘জ্বি। ‘
‘কীভাবে?আমাকে বলুন প্লিজ। ‘
‘আপনাকে তো জানতেই হতো মিস! বলবো আমি। উত্তেজিত হবেন না। ‘
মেহতিশা শান্ত হয়ে বসতে চাইলো কিন্তু পারলো না। এমন সময় কী শান্ত হওয়া যায়! মোটেও না। উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘আমার বাবার কোম্পানিতে আগুন কী আপনার কথাতেই লাগানো হয়েছিলো? সত্যি করে বলবেন! ‘
‘বললে আমি কী পাবো?’
‘আশ্চর্য! সত্যি বলতে আবার কিছু দিতে হবে! ‘
‘তাহলে,আমার মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করতে আমি মোটেও ইচ্ছে্ুক নই। আপনি আসতে পারেন। ‘
মেহতিশা বিস্ময় লুকাতে পারলোনা। এতক্ষণ কী সুন্দর বিনয়ী ব্যবহার করছিলো অথচ এখন কী রুক্ষভাষী আচরণ! এটাই হয়তো লোকটার আসল রূপ। এতদূর পর্যন্ত এসে এখন ফেরত গিয়েও তো শান্তি নেই। মেহতিশা বাধ্য হয়ে বলল,
‘বলুন, আপনি যা চাইবেন তা পাবেন।’
‘ভেবে বলছেন?’
‘জ্বি। ‘
‘তাহলে, আপনিটাকে দিয়ে দিন যার জন্য গত সাত বছরের লড়াই আমার। ‘
‘মানে! ‘
‘ভালোবাসি। ‘
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ”
৩১.
বারান্দার গ্রিলের চিকন চিকন ফাঁকগুলোর মধ্যে দিয়ে ভো ভো করে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। কখনোবা টালমাটাল বাতাস এসে গায়ে আছড়ে পড়ে জামা কাপড় উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখের পাপড়ি গুলো লেপ্টে থাকা জল সরিয়ে শুকিয়ে কাঠ করে দিয়েছে। ব্রাউন শেডের হেয়ার কালার করা পিঠ এলিয়ে থাকা চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে উড়ে চলছে। সুদীপ্ত বিশাল আকাশটা আজ পরিষ্কার। তবে কী আজ আকাশও মেহতিশার মতো সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে? জেনে গেছে অতীতের সকল রহস্য? হয়তোবা।
আনমনা চোখে দূরদূরান্তে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহতিশা। এতগুলো সত্যি হঠাৎ হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এতো সহজেই সবটা সমাধান হয়ে গেলো, তা চিন্তাও করতে পারছেনা। এটাই তবে ভবিতব্য ছিলো। অমীমাংসিত রহস্য গুলোর পাজেলগুলো মিললো অবশেষে। মেহতিশার চোখ দু’টো ডুবন্ত সূর্যের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। কী চমৎকার সাজে সজ্জিত আকাশটা। রাঙাবধূর মতো দেখাচ্ছে। অপূর্ব!
‘ম্যাডাম, আপনাকে খালা ডাকছেন খাবার খেতে। ‘
কুসুমের ডাকে ধ্যান ভাঙে মেহতিশার। গ্রিলের উপর থেকে হাত সরিয়ে বারান্দার দরজা আঁটকে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। পায়ের স্লিপারগুলো পায়ে পড়ে বলল,
‘যাও, আসছি। ‘
মেয়ে সার্ভেন্ট কুসুম মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায়। মেহতিশা ফোনটা হাতে নিয়ে বের হলো। ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা টেনে বসলো। বিনাবাক্যে চামচ উঠিয়ে সালাদ খাওয়া শুরু করলো। অথচ,সে জানে টেবিলের সাত জোড়া চোখ তাঁর দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। গোগ্রাসে গিলতে থাকে মেহতিশা।
চোখ মুখ শক্ত একেবারে। মুখাবয়ব গম্ভীর। মেহতিশার মা কিছুক্ষণ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। শামীউল্লাহ জামান গলা পরিষ্কার করে চামচ দিয়ে টুংটাং করে বললেন,
‘কী সিদ্ধান্ত নিলে তুমি? ‘
মেহতিশা মুখের খাবারটুকু গিলে গলধকরণ করে। পানির গ্লাসটা ভরতে ভরতে বলে,
‘নতুন করেও আবার কিছু বলতে হবে? যখন সিদ্ধান্ত বললাম তখন কোথায় ছিলেন?নাকি আমি এ বাড়িতে আসলেও এখন বিরাট সমস্যা! বিপদ হয়ে গেছি কিনা! নাহলে, ডিলে লাভ ছাড়া আর কীবা কাজে আসি আমি?’
ভড়কে চুপ মেরে রইলেন তিনি। মেহতিশা নিষ্প্রাণ দৃষ্টি দিয়ে উঠে চলে এলো। খাবারের বাকি এঁটো থালায় অবহেলায় রয়ে গেলো।
মেহতিশার মা ক্ষোভভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘হলো তো! শান্তি হয়েছে?সমস্যা কী তোমার? আসলে,দোষটা আমারই। যদি মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার সময়ই প্রতিবাদ করতাম। তাহলে, আজ এমনটা হতোনা। যেদিন আমার বোনের মেয়েকে নিজের পরিচয় দিয়ে বড় করার কথা বলেছিলো অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। এখন জানি, মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করার জন্যই তুমি এনেছিলে। লাভ লোকসান অতশত আমি বুঝিনা। আমার মেয়েটা এখন যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে তোমাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না। ‘
গজরাতে গজরাতে চলে গেলেন তিনি। কিছুটা স্বামীর প্রতি ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি এবং নিজের চুপ থাকার অনুশোচনা দগ্ধ করছে। তবে, সময় গেলে সাধন হয়না!
শামীউল্লাহ জামান মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তার ছোট ভাই বললেন,
‘বড় ভাই, প্রতিশোধের নেশায় আমরা এতোই অন্ধ ছিলাম ঠিক ভুল বিচার করিনি। আজ এর ফল আমাদের বাড়ির মেয়েটাকে ভোগ করতে হচ্ছে। ‘
শামীউল্লাহ জামান নিম্নস্বরে বললেন,
‘পাপ করার সময় সবাই-ই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হুঁশ তখনই ফিরে যখন ফলটা ভোগ করতে হয়। ‘
‘যে যাওয়ার সে তো যাবেই, অথচ আমরা এই সত্যিটাই মানতে পারছিলাম না। মেঝো যে আমাদের সবার আগে চলে যাবে তা বিশ্বাস করাটা অনেক কঠিন ছিলো।আমরা সত্যিই বোকা!একজন মৃতের জন্য জীবিত মেয়েটাকে খেলার গুটি বানিয়ে রেখেছিলাম। ‘
সবাই টেবিল থেকে উঠে গেলো। শামীউল্লাহ জামান মাথা চেপে রাখলেন। বুকপকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখটা মুছে নিলেন। রুমালটায় চোখ পড়লো। সাদা কাপড়ের উপর সেলাই করে কাঁচা হাতে লেখা -মাই হ্যান্ডসাম ড্যাডি!
তিনি আরও একবার চোখ মুছে নিলেন। আজ যে কেনো এতো কান্না পাচ্ছে কে জানে!
–
তুলতুলে টেডিবিয়ারটা বুকে জড়িয়ে খাটের এক কোণায় মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে মেহতিশা। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। এসিটা বন্ধ। গায়ে টপস একটা। এই বাড়িতে আসার সময় কোনো জামা কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। অনন্যের কোম্পানি থেকে ফিরে আর ওই বাড়িমুখো হয়নি সে। সরাসরি এখানেই চলে এসেছে। বিছানা হাতরিয়ে মোবাইলটা নিলো। সাইলেন্ট মোডে দেয়ায় ভাইব্রেট করছে সেই কখন থেকে। সতেরোতম বার মেহতিশা কল কাটতে নিয়েও কাটলো না৷ রিসিভ করে কানে দিলো। হ্যা, ওর ধারণাকে সত্যি করেই অস্থির এক ক্লান্ত কন্ঠ কানে এসে লাগলো,
‘মেহতিশা, তুমি কোথায় আছো? এরকমটা কেউ করে! জানো আমি কতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম! রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে ফেলেছি! দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছি। মা কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। হেলো, হেলো?’
মেহতিশা নিঃশব্দে সবটা শুনে গেলো, যেমন এতগুলো দিন সে শুনে এসেছে। নিস্তব্ধ গলায় বলল,
‘বলা শেষ? ‘
দর্পণ অবাক হয়ে বলল,
‘মানে? ‘
‘মানে, আপনার কথা শেষ হয়েছে? এবার আমি বলি?’
দর্পণ শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো। এতক্ষণ যাবৎ মনে হচ্ছিল শুধু শরীরটাই আছে। আত্মা নেই। মূল্যহীন অচল দেহ। গত তিন ঘন্টা পাগলের মতো ছুটাছুটি করেছে। মেহতিশা ভালো আছে, সুস্থ আছে এখন এটাই মূলকথা৷
‘বলো। ‘
‘প্রথমত, আমি আপনাদের খেলার পুতুল নই যে যা মন চায় করবেন। কেউ নিজের প্রতিশোধের জন্য জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে, কেউ বিয়ে করে নিজের কাছে আঁটকে রাখবে। আমি তো আর মেশিন নই। আমারও অনুভূতি আছে। দ্বিতীয়ত, যে নিজের স্ত্রীকে একবিন্দু বিশ্বাস না করে এতবড় সত্যিটা আড়াল করে রাখে তাঁকে নিয়ে অন্তত সংসার করা সম্ভব নয়। ‘
দর্পণ ভেঙে ভেঙে কাঁপা গলায় বলল,
‘আপনি এসব কী বলছেন বউজান?’
মেহতিশার কঠিন কন্ঠ –
‘ভালো থাকবেন। ‘
‘এটা তুমি করতে পারো না! আমি এখুনি আসছি তোমাকে নিতে। তুমি কোথাও যাবেনা। তুমি যেতে পারোনা! আমার বাচ্চাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারবেনা তুমি! ‘
‘আমি পারবো দর্পণ, আমি পারবো! ‘
–
মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো মেঝেতে দর্পণ। এটা কীভাবে সম্ভব! এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! মেহতিশাকে কে বলল সবকিছু! দর্পণ তো চেয়েছিলো বেবি হওয়ার পর সব খুলে বুঝিয়ে বলবে সে। অথচ, মেহতিশা সবটা আগেই কী করে জানলো! মুখ চেপে ডুকরে উঠলো সে। এটা সেই ঘর যেখানে দর্পণ আগে থাকতো। চারপাশে বিরাট বিরাট আয়না দিয়ে ঘেরাও করা। প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিটি কোণা। যেই আয়নায় একসময় নিজের এক রহস্যময়ী অবয়ব দর্পণ দেখতো, সেই আয়নাই যেনো আজ তাঁকে তাচ্ছিল্যে হো হো করে হেঁসে উঠলো।
দর্পণ রাগে দুঃখে দেয়ালে টাঙানো পুরনো আমলের বন্দুকটায় গুলি লোড করে সবগুলো আয়নায় অনবরত চালাতে থাকলো। প্রত্যেকটা কাচের আয়না খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ে রইলো। ভাঙাচোরা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে হাসলো দর্পণ। শক্ত করে ঠোঁট দুটো চেপে রাখলো দাঁত দিয়ে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। পাশেই জ্বলজ্বল করে ওঠা মোবাইলে একটা মেসেজ পড়ে, দর্পণ নিজের চুল নিজেই টানতে বলল,
‘অনন্য অনন্য অনন্য, তোর ভালোবাসা চাওয়াচাওয়ির ফল আমি তোকে দেখাচ্ছি!’
ফ্লোরে ভাঙা আয়নাগুলোতে দর্পণের দর্পণ বা অবয়বই ভেসে উঠলো বিকৃতাকারে। ঠোঁটের চারিদিকে রক্ত মাখানো ফর্সাদেহী মানুষটাকে দেখে হয়তো দেয়ালেরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। কী অবাকতর এ দৃশ্য!
চলবে-