#প্রিয়_তুমি,০৪,০৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
রৌদ্রস্নাত বিকেল। মিষ্টি বাতাসে গাছাগাছালি দুলছে। আকাশ কিছুটা কালচে নীল। বৃষ্টি নামার আগে যখন আকাশটা বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে যায়, অনেকটা তেমন। রোদে ধুয়ে চকচক করছে সেহেরের সাবলেট বাসার বারান্দাটা। ওখানে বসে শেফা আর রিমির সাথে গল্প করছে সেহের। আজ বিশেষ নাস্তাও তৈরি করেছে সেহের। হাতখরচের টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আজ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র ও কিনেছে। সেই টাকাটা ধার দিয়েছে শেফা। যদিও সেহের নিতে চায়নি, কিন্তু জোরজবরদস্তির চোটে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেনাকাটা অবশ্য সেহের ওদের দুজনকে সাথে নিয়েই করেছে। রিমি, শেফা আজ রাতটা এখানে কাটাবে বলে ঠিক করলো। একা একা সেহেরে একদম ভালো লাগেনা। তাছাড়া ওর মনমেজাজও কিছুদিন ধরে ঠিক যাচ্ছেনা! এসব কারণেই মূলত শেফা, রিমি এসেছে। তিন’জন মিলে যখন গল্পে মগ্ন তখন দেখলো কালো রঙের একটা গাড়ি ঠিক রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ এবং এই গাড়িটা আর কারোর নয়, পূরবের! সেহের ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো! যখন থেকে পূরবের আসল পরিচয় জানতে পেরেছে তখন থেকেই ওর মধ্যে উৎকন্ঠা কাজ করছে, ভয় হচ্ছে। এই বুঝি হাজার খানেক ক্যামেরা নিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো মিডিয়ার লোকজন। আর নানা বিব্রতকর প্রশ্নে ওকে জর্জরিত করা হলো! আর পূরবকে চোর বলা আর পানি ঢালার শাস্তি হিসেবে ওকে বেড়ধক পিটানো হয়েছে। হাজার হোক সেলিব্রিটি বলে কথা। মানবসেবায় নিজেকে শামিল করে অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গিয়েছেন এই লোক। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আর বাবা ইরফান আহমেদের ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেও বেশ ভালোই পরিচিতি পেয়েছেন। আর তাঁর ইউনিক স্টাইলে চলাফেলা, আর গুড লুকের জন্য সর্বদা তাঁর নামের ছড়াছড়ি। এককথায় সিনেমায় অভিনয় না করেও বাস্তব জীবনে সে সেলিব্রিটি। অসংখ্য মানুষ তাঁকে ভালোবাসে! কিন্তু এই মানবদরদী মহাপুরুষের যে ভালো মানুষের আড়ালে কুৎসিত একটা রুপ আছে, সেটা সেহেরের থেকে ভালো আর কে জানে??
পূরবের গাড়িটা ওরা তিন বান্ধবীই লক্ষ্য করেছে। শেফা মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা তো পূর.. পূরব ভাইয়ের গাড়ি!’
সেহের মিনমিন করে বলল, ‘ভাই? তোর ভাই লাগে?’
‘আরে ধুর…ভয়ের চোটে গলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
রিমি গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘সেহের? এখন কী হবে রে?’
সেহের চুপ করে বাইরে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। টেনশন হচ্ছে খুব। ইশ..একবার যদি জানতো এই লোক এমন কিছু করতে পারে তাহলে অভদ্র ব্যবহার করতোনা। কিন্তু এখন কী হবে? তাছাড়া পূরবকে ও দেখা যাচ্ছেনা! তবে কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থেকে পূরব আর জিসানকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে এই লোক। সেহের ভয় পেয়ে রুমে চলে এলো, পেছন পেছন রিমি আর শেফাও এলো। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বড়লোকদের সাথে লাগতে গেলে এমনই হবে রে সেহের। এবার লাত্থি-ঘুসি খা। মনে মনে কথাগুলো বলে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে রইলো সেহের!
মিনিটখানেক পরই দরজায় ঠকঠক ঠকঠক শব্দ হলো। ওরা তিন বান্ধবীই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
রিমি সেহেরের কাঁধ খামচে ধরে ঢোক গিলে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই তোকে ধরতে এসেছে, কি বলে ডাকবো আর ভাই ছাড়া। ভাইটাই ডেকে যদি কিছু একটা করতে পারি..’
শেফা দাঁত কটমট করে বলল, ‘চুপ থাক রিমি! টেনশনেই বাঁচিনা এখন তোর উল্টাপাল্টা কথা শোনার মুড নেই একদম। এই সেহের, দরজা খুলবো?’
‘ওনারা এসেছেন তাইনা?’
‘মনে তো হচ্ছে, আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখি!’
সেহেরের সাথে যে মেয়েগুলো ফ্ল্যাট শেয়ার করে তারা আজ বাসায় নেই, গ্রামে গিয়েছে। তাই কোনোরকম চিন্তাভাবনা নেই। শেফা মেইন দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে সাহসী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলোনা। শেফা আবারও ডাকলো কিন্তু কেউওই সাড়া দিলোনা। তাই ও ভাবলো বোধ হয় কেউ নেই আর পূরবরা এসে থাকলেও চলে গিয়েছে। নইলে তো সাড়া দিতোই। যাইহোক, কনফার্ম হওয়ার জন্য দরজাটা অল্প একটু খুলতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পূরব রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে তার বেস্ট ফ্রেন্ড জিসান। চিনতে পারলো শেফা। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাতে নিলেই দরজা ঠেলে একেবারে ঘরে এসে পড়ে পূরব। সেহের আর রিমি তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এতো সরাসরি বাসায় ঢুকে পড়েছে। এখন যদি ওকে মেরে ফেলা হতো তাহলে কেউ জানতেও পারবেনা, ভাগ্যিস শেফা, রিমি আছে!
ঘরে ঢুকেই পূরব প্রথমে যে কাজটা করলো সেটা হলো চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নাকে হাত দিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন সে কোনো ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। জিসান পূরবের এই কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো। কারণ সে যতোই হাই ক্লাস ফ্যামিলিতে বড় হোক বা স্টাইলিশভাবে চলাফেরা করুক এইধরনের কান্ড কস্মিনকালেও করেনি। বরংচ নিজ হাতে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করেছে। ডাস্টবিন পড়ে থাকা সদ্য জন্মানো শিশুকে বুকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু আজ একটা মেয়ের বাসায় এসে কোনো কারণ ছাড়াই যে উদ্বত্যভাব দেখাচ্ছে তা জিসানকে প্রচন্ড ভাবিয়ে তুলেছে! ওর ঘোর কাটলো পূরবের হুংকারে।
‘সেহের কে সেহের? আই মিন ওই বেয়াদব মেয়েটা,কোথায় সে?’
পেছনে ঘুরেই দেখলো কাঁচুমাচু হয়ে বিছানার সাথে লেপ্টে বসে থাকা সেহেরকে। মেয়েটার অসহায় মুখটা দেখে ও চরম মজা পাচ্ছে। চিল্লিয়ে বলে উঠলো, ‘এই বেয়াদব মেয়ে, নামো বলছি বিছানা থেকে ফার্স্ট… ‘
সেহেরের আত্না প্রায় বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পূরবের সামনে দাঁড়ালো। শেফা আর রিমি পূরবের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। পূরবের মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস। কিন্তু সেহেরের সাথে কথা বলতে বলতে চোখ থেকে নীল রঙা সানগ্লাসটা খুলে ফেললো। ভয়ংকর রাগী, কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়ার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকলো সেহের। এই প্রথম পূরবকে এভাবে দেখেছে। সানগ্লাস ছাড়া এই লোকটাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। যাইহোক, সেহের মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আমি সেহের। কীজন্য এসেছেন এখানে?’
‘তুমি আমায় কী কী বলে এসেছিলে সেগুলো আবার রিপিট করো। নাও লেটস স্টার্ট..’
সেহের ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল নাকি এই লোকটা? বাড়ি বয়ে এখানে এসেছে সিনেমাটিক ডায়লগ শুনতে?আর ও কী না কী ভেবে এতোক্ষণ বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করছিলো।
‘শুনুন, আপনার সাথে আমার ওরকম বিহেভ করা উচিৎ হয়নি। তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আসলে জানতাম না আপনি কে!’
‘কেন? জানলে কী করতে?’
‘জানলে আমি আপনাকে চোর বলতাম না। আর না আপনার মাথায় পানি ঢালতাম।’
পূরব কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘ওহহ তারপর?’
সেহের বিরক্ত চোখে তাকালো। বলল, ‘তারপর কিছুনা। স্যরিটা আপনার পাওনা ছিলো, মিটিয়ে দিলাম। এবার প্লিজ আমাকে ফলো করা বন্ধ করুন।’
পূরব রেগে বলল, ‘ফলো করি মানে?’
সেহের থতমত খেয়ে বলল, ‘করেনই তো। আমি যেখানে যাই সেখানেই আপনি হাজির, তাছাড়া সেদিন রাতে এসে আমার জানালায় ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করেছেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন, আবার রেস্টুরেন্টেও দেখা, ক্যান্টিনেও আপনি। মানে আমি যেখানে আপনি সেখানে টাইপ!’
পূরব ‘ফলো করা’ কথাটি শুনে রেগেমেগে একাকার। আজ পর্যন্ত ওর কাউকে ফলো করা তো দূর, বরং অন্যরা ওকে ফলো করে। আর সেখানে এই মেয়েটা এসব কি বলছে? সেহের ওর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘আর একটা কথা, আপনি আমার বাসার ঠিকানা জানলেন কী করে?’
‘জিসানননন….’
‘বল দোস্ত।’
‘একে বল চুপ থাকতে, নইলে ওর কী হাল করবো সেটা কিন্তু নিজেও বুঝতে পারছেনা!’
জিসান ওর কথার মানে বুঝতে পেরে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপুমণি তুমি ওর সাথে বেয়াদবের মতো আচরণ করোনা।’
‘আমিতো বেয়াদবি করছিনা, জাস্ট জানতে চাচ্ছি আমার বাসার ঠি..’
পূরব সেহেরের গাল চেপে ধরলো। জিসান, শেফা আর রিমি ভয় পেয়ে গেলো। সেহের অবাক হয়ে গেলো। পূরব হুংকার দেওয়া কন্ঠে বলল, ‘আমার কাছে কৈফিয়ত চাও? এতো সাহস? দেখি তোমার কত দম আছে আমার সাথে লাগার! আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ!’
এটুকু বলে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর আশপাশ খুঁজে একটা কলস দেখতে পেয়ে ওটা তুলে নিয়ে এলো। তারপর কলসের পুরো পানিটা সেহেরের উপর ঢেলে দিয়ে ওকে ভিজিয়ে দিলো। অবাক হয়ে গেলো বাকিরা। জিসান ওকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘তুই এরকম অদ্ভুত আচরণ কেন করছিস? ও একটা মেয়ে, এভাবে পানি ঢালাটা ঠিক হলোনা।’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
সেই মুহূর্তে লজ্জ্বায় সেহেরের গা- হাত-পা কাঁপছিলো। রাগ, জিদ আর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো সেই সময়টাতে। পাতলা ফিনফিনে কাপড়ের আড়ালে ওর সুগঠিত দেহের অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। শেফা মাথা নিচু করে শুকনো ওড়না এনে সেহেরেকে ঢেকে দেয়। জিসান বন্ধুর করা এহেন আচরণে প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে, পূরবের কাছ থেকে এমন কোনোকিছুই সে আশা করেনি। বারবার সেহেরকে স্যরি বলে পূরবকে একপ্রকার জোর করে টেনে নিয়ে আসে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আরেকটু পরেই আকাশখানি চাঁদের আলোয় গা ডুবিয়ে বসে থাকবে, গাঢ় আঁধারে ছেয়ে যাবে চারিপাশ।
পূরবের মাথা গরম হয়ে আছে। ওই মেয়েটার প্রতি জিসানের এতো আদিক্ষেতা দেখানোর কোনো মানে হয় নাকি? মেয়েটাকে আরও উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিলো। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। আবার তারই বন্ধু ওর প্রতি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে। বিষয়টা ওর মোটেও পছন্দ হলোনা। কোনোমতে বাসায় ফিরলো। একটা হট শাওয়ার নিয়ে ডিনারটা সেরে ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। খানিক বাদেই জিসান ফ্রেশ হয়ে বেরুলো ওয়াশরুম থেকে। পূরব কোনো কথা বললোনা। ঘুমানোর সময়ও এমন। জিসান বুঝতে পারলো পূরব তাকে ইগনোর করছে। তাই রাগ ভাঙাতে সে ডাকলো পূরবকে।
‘আমাদের রাজপুত্রের মনে কি কেউ আঘাত দিয়েছে? যার জন্য সে তার পরম বন্ধুর সঙ্গেও মত বিনিময় করছেনা?’
পূরব অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়লো জিসানের দিকে। ও মিনমিন করে নিচু স্বরে বলল,
‘এভাবে তাকাইস না ভাই, আমি ভয় পাই।’
‘তুই আমাকে ভয় পাস এটা আমার মানতে হবে?’
‘এভাবে বলিস না বন্ধু!’
‘তোর আজকের বিহেভিয়ার প্রুফ করে দিলো আমি তোর কেউ না।’
‘কী করলাম আমি?’
‘ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি?’
জিসান ওর কথার মানেটা বুঝতে পারলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি, আছিস আর ফিউচারেও থাকবি। তোর সব কাজে আমি তোকে সাপোর্ট করে গেছি। তার মানে এই নয় যে, তুই কোনো ভুল করলে আমি তা ধরিয়ে দেবো না। আমি ওমন বিশ্বাসঘাতক বন্ধু নই৷ সবসময় মেয়েদের প্রতি তোর আলাদা একটা জায়গা দেখতে পেয়েছি। যেটা সম্মানের যোগ্য!’
‘তাতে কী কোনো সন্দেহ আছে?’
জিসান হেসে বললো, ‘একদমই না।’
‘তাহলে হঠাৎ এমন কথা বললি কেন?’
‘বলছি তার কারণ আছে। ওই সেহের নামক মেয়েটা না হয় ভুল করে তোকে দুটো কথা শুনিয়েই দিয়েছিলো, বা অসভ্যতামি ও করেছে। বাট ক্ষমা তো চেয়েছে তাইনা?’
‘এর মানে? তুই কী বলতে চাইছিস?’
‘বুঝেও না বোঝার ভান করিস না!’
‘তো ভনিতা না করে বলে ফেল না।’
‘তোর আজকের আচরণে আমি বেশ লজ্জিত হয়েছি।
পূরব অবাক হয়ে বলল, ‘লজ্জিত হয়েছিস? বাট কেন? এরকম কোনো কাজই আমি করিনি যার কারণে কাউকে লজ্জা পেতে হয়।’
‘বিষয়টা মেয়েলি এবং সেনসেটিভ। তুই ওরকমভাবে পানি ঢেলে একদম ঠিক করিসনি৷ তাছাড়া বেরুনোর সময় মেয়েটার বান্ধবীকে বলতে শুনলাম ওর নাকি অনেক প্রবলেম আছে।’
‘সো হোয়াট?’
জিসান অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা তুই কী কিছুই বুঝতে পারছিস না? মেয়েটা যখন তোর কাছে মাফ চাইলো তোর উচিৎ ছিল ওকে ক্ষমা করে দেওয়া৷ তা না করে উলটো আরেক কান্ড ঘটালি। সেদিন রাতে জানালায় এভাবে ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করাটাও ঠিক হয়নি। আর নিজের বিবেককেই একবার প্রশ্ন করে দেখ না। তোর মতো একজন মানুষের কী এই কাজগুলো করা মানায়? যেখানে সবার সাহায্যে নিজে থেকে এগিয়ে আসিস ; সেখানে তুই নিজেই অন্যের সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিস!’
জিসানের বলা প্রতিটি সত্য কথা পূরবের মনে গভীর দাগ কাটলো। চিন্তায় ফেলে দিলো। পূরব নিজেও এবার নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। ক্ষমা চেয়েছিলো যখন মাফ করে দেওয়াটাই উত্তম ছিলো। কতশত মানুষই তো ওকে কটুক্তি করে, মানবসেবার কাজ করার জন্য। কই ও তো এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ করেনি৷ সেলিব্রেটিদের হেটার্স যেমন থাকে, লাভার্স ও তেমন থাকে। ধরে নেওয়া যাক সেহের তার হেটার্স, তাই বলে ওর সাথে ওরকম আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। আজকাল ও বড্ড অসচেতন হয়ে গিয়েছে। রাগ জিনিসটা সর্বদাই ওর শত্রু! কেন যে এতো রাগ ওর বুঝতে পারেনা। বংশগত বৈশিষ্ট্য বোধহয় একেই বলে, কারণ ওর দাদা নাকি ভীষণ রাগী ছিলেন। গ্রামের লোকেরা ওনার ভয়ে কাঁপতো! যাইহোক, সামান্য বিষয়টাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আকাশসমান করে তুলছে। পূরব ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটাকে সাজালো, বোঝার চেষ্টা করলো। আচ্ছা পূরব তুমি কী মানসিকভাবে সিক?? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো। জিসানের কোনো কথার জবাব না দিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো। আর তারপরই ওর মানসপটে ভেসে উঠলো সেহেরের কান্নারত মুখটা। মেয়েটা খুব বেশি ফর্সা নয়। গায়ের রঙ তামাটে, চুলগুলো কোমড় অবধি লম্বা, চোখগুলো ভীষণ সুন্দর, উচ্চতায় খুব বেশি লম্বাও নয়। এমনিতে পুতুল পুতুল চেহারা৷ তবে স্বভাবে বোঝা যায় মেয়েটা চঞ্চল ; কিন্তু কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।
এসব ভেবে ও নিজেই অবাক হচ্ছে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবছে। মেয়েটার সাথে বিভিন্ন কারণে, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাকতালীয়ভাবে পাঁচবার দেখা হয়েছে মাত্র। এর আগে কতশত মেয়ে ওর সাথে কাজ করেছে, প্রপোজ করেছে আরও নানা কিছু করেছে কিন্তু ও অতোটা ভাবেনি তাঁদের নিয়ে, যতোটা এই সেহেরকে নিয়ে ভেবেছে। অতি নগন্য কারণগুলোকেই ও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আর ফলাফলসরুপ ওকে এসব বিশ্রি ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
রাতের বেশিরভাগ সময়ই কেটে গেলো সেহেরের কথা ভাবতে ভাবতে। একসময় চোখ লেগে এলো তার। ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠলো কয়েকবার। শান্তিতে ঘুমাতে পারলোনা একটুও। বারবার মনে হতে লাগলো ইফরাজ পূরবকে এসব আচরণে মানায় না, সে তো সবার বন্ধু! তার আলাদা একটা জায়গা আছে মানুষের হৃদয়ে। সে কী করে এমন করতে পারে! শিট…
সকালে ঘুম ভাঙার পরে পূরব জিসানকে সেহেরের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে বললো। সব ইনফরমেশন জোগাড় করে ওকে জানাতে বললো। জিসান বেশ অবাক হলেও পূরবকে আর ঘাঁটালো না। পূরব ওর কালো রঙের ফেডোরা হ্যাটটি মাথায় চাপিয়ে জিসানকে নিয়ে রওয়ানা দিলো অফিসের উদ্দেশ্যে। এবার বেশ বড় একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ওরা। সেটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে ওর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠবে! লভ্যাংশের টাকাটা দিয়ে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবে ভাবছে। এ নিয়ে পূরবের বাবা ইরফান আহমেদের প্রাথমিক আলাপচারিতাও ইতোমধ্যে শেষ।
কাল ওরকম একটা ঘটনার পর রাতে সেহেরের বেশ জ্বর উঠেছিলো। শেফা আর রিমি না থাকলে মরেই পড়ে থাকতো বোধহয়, কেউ খোঁজ নিতে আসতোনা। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরে নিজেই সব নাস্তা তৈরি করলো। গমের রুটি আর ডালভাজি। শেফা আর রিমি ঘুম থেকে ওঠে ওর পাকনামি দেখে অনেকক্ষণ ধমকালো। অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করার মানে হয়? সেহেরের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। যাইহোক, তিন বান্ধবী মিলে ব্রেকফাস্ট শেষে একসাথেই ভার্সিটিতে রওয়ানা দিলো। কালকের ঘটনাটা ভুলে থাকার জন্য সেহের আপ্রাণ চেষ্টা করলো। বাড়ি বয়ে এসে এমন কান্ড..ছিঃ! পূরবের প্রতি ওর ভীষণ ঘৃণা হলো।
এরপর অনেকদিন ওর সাথে পূরবের দেখা হলোনা। সেহেরও ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেলো। নিজের মতোই দিন কাটতে লাগলো। কয়েকটা টিউশন যোগাড় করে বাড়িভাড়া আর পড়াশোনার খরচ চালানোর ব্যবস্থা করলো। যদিও মাস শেষে হাত পুরো খালি হয়ে যায়, তখন গলির দোকান থেকে বাকিতে চাল-ডাল কিনতে হয়। কী করবে, ওর খরচ চালানোর মতো তো কেউ নেই এই ব্রহ্মান্ডে! বাবা-মা হারা এতিম মেয়েদের কারো সংসারে বুঝি জায়গা হতে নেই। তাইতো চাচার সংসারে ওর জায়গা হয়নি! কিন্তু আজকাল টের পায় কেউ ওকে ফলো করছে, ওকে দেখছে সারাক্ষণ! এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে সেহের!
এই এতোগুলো দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে পূরবের। সেহেরের কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলো। কিন্তু জিসান মনে করিয়ে দিলো ওর কথা। একটা কাজে সিলেট গিয়েছিলো জিসান। সেখান থেকে ফিরে সোজা চলে এলো পূরবদের বাড়ি। এই বাড়িটাতে পূরব আর ওর বাবা ছাড়া আর কেউ থাকেনা, জিসানও থাকে ওদের সাথে। ইরফান আহমেদ ব্যবসার কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে বাড়িতে থাকার সুযোগই পান না। আর পূরবের মা এক বছর হলো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যাইহোক, জিসান লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছে সেহেরের। সে বিষয়ে কথা বলতেই এখন এসেছে পূরবের কাছে।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!