#প্রিয়_তুমি,১০,১১
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
শেফা মনে মনে প্রচুর হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে হয়তো পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’
সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’
‘কেন?’
‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’
‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’
সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’
‘তুই কীভাবে জানলি ওনার স্বভাব ভালোনা?’
‘ভালো হলে কী এসব করতো? কোনো অপরিচিত মেয়ের বাসায় এসে ঢিল ছুঁড়তো? নাকি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতো? আর কথা শুনলে তো গা জ্বলে যায়। আর কেমন সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী ভাব চেহারায় দেখলেই ভয় লাগে। মনে হয় এক্ষুনি গিলে খেতে আসবে।’
‘একবার বলিস চোর, এখন বলছিস সন্ত্রাসী? কিন্তু যা-ই বলিস না কেন ওনার ইউনিক লুকটা আমার বেশ পছন্দ। আহা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে হ্যাট পরে, আর এটিটিউডের কথা কী বলবো, উফ..জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং!’
‘তোর মাথা।’
‘আর কিছুসময়। তারপর ওনার বউ হলে সারাদিন চোর চোর বলিস৷ দেখব তখন এতো কিউট একটা ছেলেকে কেমনে তুই বাজে কথা বলিস!’
সেহের লজ্জা পেয়ে গেলো। ওর মনে যে পূরবের জন্য অনুভূতি নেই তা কিন্তু নয়৷ এতোদিনে পূরব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন রাত্রে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও শুধু সুন্দর লোকটাকেই দেখতো। মশার কামড় খেয়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো লোকটা? কিন্তু আজকাল আর আসেনা কেন? হয়তো রুচি বদলে গেছে তাই। লোকটা কি জানে ওর জন্য সেহের কতোরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে? ভালোবাসে কিনা জানেনা, ভালো তো লাগে! কিন্তু ও তো একটা গরিব ঘরের এতিম মেয়ে। পূরবের স্ট্যাটাসের নয়। ওদের মিল হওয়াটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবুও সেইরাতে যখন প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ার কথাটা সেহেরকে বলেছিলো পূরব, এক সমুদ্র ভালোলাগা হঠাৎ করেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো লোকটার প্রতি! সেই থেকে অপেক্ষার শুরু!
শেফার কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভান করে সেহের চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোর।’
‘এরকম বলতে পারলি? আমি কী বারোভাতারি মেয়ে? আমার একজন হলেই যথেষ্ট। আর সেটা পেয়েও গেছি।’
সেহের বলল, ‘জিসান ভাইকে মোটামুটি ভালোই মনে হয়। ওনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?’
‘মা আর বোন। বোন তো মাকে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে।’
‘কেন?’
‘পড়াশোনা করে তো। হোস্টেলে থাকতে চায়না, তাই ওনার বোনের কাছে আম্মাকে পাঠিয়েছে।’
‘ওহহ। তাই বল। কোথায় পড়ে?’
‘চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে।’
‘অনেক দূর!’
‘হুম।’
সেহেরের সাথে সারারাত অনেক গল্পই হলো শেফার। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো৷ ওদিকে পূরব ওর বাবাকে সেহেরের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। কারণ ইরফান আহমেদের জরুরি একটা মিটিং পড়ে গিয়েছে হঠাৎ, তাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে চলে গিয়েছেন৷ পূরব আর বাবাকে ডিস্টার্ব করতে চাইলোনা। জিসানকে সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে পূরব এগিয়ে গেলো। দুই-পা ওপরে তুলে বসলো। হাতঘড়ির স্ট্রিপটা খুলতে খুলতে পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আব্বু চলে গেল?’
‘কী বলবি আমায় বল না?’
‘তুই আমাকে জন্ম দিছোস? আমার তো আব্বুর পারমিশন লাগবে, তোর না।’
জিসান হেসে বলল, ‘ভাবসাব দেখেতো মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবি।’
‘অবশ্যই ইম্পোর্টেন্ট কথা বলব। আমি ফালতু কথা বলিনা, ফালতু কাজও করিনা৷ যা করি সেটা নিজের বা অন্যের প্রয়োজনে করি। আর সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। বাই দ্যা ওয়ে, তুই যে আমার সাথে ছলনা করিস সেটাতো আমি জানতাম না। নইলে এত ইম্পোর্টেন্ট একটা কথা তুই আমাকে একবারও জানালি না? এই তুই আমার জানের জিগার দোস্ত?’
জিসান অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কোনটার কথা বলছিস? কি বলিনি আমি?’
পূরব ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর সাথে শেফার সম্পর্ক আছে এটা জানাসনি কেন আমাকে?’
জিসান বোকার মতো তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কে বলেছে তোকে?’
‘কেন? শেফা নিজে বলেছে!’
জিসান লজ্জা পেয়ে গেলো। তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সে পূরবকে বলেনি শুধুমাত্র লজ্জার কারণে। এমনিতে সব বিষয় শেয়ার করে, কিন্তু এই ব্যাপারটা জানাতে গিয়ে বারবার ওর গলায় কথা আটকে গিয়েছে। শব্দ ভুলে গিয়েছে। পূরব ওকে আর কিছু বললোনা। ছোট্ট করে ‘কংগ্রাচুলেশনস’ জানালো। জিসানও হাসলো। পূরবকে কথাটা বলতে পারছিলোনা, ও যখন নিজেই জেনে গিয়েছে ভালোই হলো৷ প্রেম, ভালোবাসা বিষয়টা খুব সেন্সেটিভ মনে হয় জিসানের কাছে৷ এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা ওর খুবই অপছন্দ। ভালোবাসা হলো দুটো মানুষ আর দুটো পরিবারের মিলন। দুনিয়া ভুলে সারাদিন ফোনে কথা বলা বা অন্যান্য পাগলামো করাটা নেহায়াতই বোকার কাজ। কেউ তোমার হবার হলে সে এমনিই তোমার হবে। ঠিক এমন সময় ফোন বেজে উঠলো জিসানের।
জিসান ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে গেলো। পূরব বেশ ক্লান্ত ছিলো তাই নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। এসির টেম্পারেচার বাড়তি, তবুও কুলকুল করে ঘামছে ও। ইচ্ছে করছে এক ছুটে সেহেরের কাছে চলে যেতে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেরুনোটা ঠিক হবেনা৷ দু-রাত ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমিয়ে শরীরটাকে ঠিক করে নিতে হবে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। পেটে ক্ষিধেয় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। কি আশ্চর্য! খেয়েই তো এলো। পূরব ওঠে নিচে চলে গেলো। ফ্রিজ থেকে নুডুলসের বাটিটা বের করলো। খুব ঠান্ডা। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও তা গরম করে ঘরে চলে গেলো। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো। সারারাত ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান বের করলো। ওই মাহিমকে একটা শাস্তি দিতে পারলে তবেই ওর শান্তি! যা হবার হবে, এর একটা বিহিত করতেই হবে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়লো পূরব।
পরদিন সকালে ইরফান সাহেবকে ফ্রি পাওয়া গেলো। পূরব সরাসরি বলল, ‘এখন কথা বলতে পারবে?’
ইরফান সাহেব বললেন, ‘হুম।’
‘আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই।’
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কাকে?’
‘তোমার খুব প্রিয় একটা মানুষকে।’
ইরফান আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার প্রিয়? কে সে?’
‘সেহের!’
‘সত্যি?’
‘হুম। এখন বলো তুমি কী চাও!’
‘ওকেই পছন্দ তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
ইরফান সাহেব হেসে বললেন, ‘তাহলে আমার প্রবলেম নেই। আমি বরণ করতে রাজি!’
পূরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘থ্যাংকস আব্বু।’
ইরফান সাহেব যে রাজি হবেন সেটা জিসান, পূরব দুজনেই জানতো। সকালের নাস্তা সেরেই জিসানকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো পূরব। ও খুব ফুরফুরে মন নিয়ে অফিস করলো। আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন!! বারোটার দিকে অফিস শেষে সোজা চলে গেলো সেহেরের ভার্সিটিতে। এখন ওদের ক্লাস শেষ হবে। ও গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। তারপর জিসানকে ফোন লাগালো। কয়েকবার রিং হবার পর জিসানের কন্ঠ শোনা গেলো।
‘হ্যালো দোস্ত?’
‘হ্যাঁ তুই কোথায়?’
‘আমিতো অফিসে। তুই কই?’
‘আমি সেহেরের ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘কয়েকটা গুন্ডাপান্ডা ধরণের ছেলে জোগাড় করে দিতে পারবি?’
‘হঠাৎ গুন্ডাপান্ডা কেন?’
‘পারবি কিনা সেটা বল।’
‘পারবো। কিন্তু কেন সেটা তো বল?’
‘ফাহিম না কি যেন নাম ওই ছেলেটার? আরে তুই যার কথা বলেছিলি ওটাকে পিটাতে হবে।’
‘ফাহিম না মাহিম। কিন্তু মারবি কেন? তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?’
পূরব রেগে বলল, ‘তুই জেনেও না জানার ভান করছিস? এই তুই আমার বন্ধু? ড্যামেট…’
জিসান বলল, ‘ওকে ওকে। আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা। শেষে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।’
‘ডোন্ট ওরি!’
পূরব ফোন রেখে দিলো। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখলো। কালো চুলগুলো হালকা বাতাসে দুলছে। এখন যদি কেউ জানতে পারে ইফরাজ পূরব এখানে এসেছে, তাহলে মুহূর্তেই হুলস্থুল কান্ড লেগে যাবে৷ সেজন্য বাইরে বেরুলে ও সবসময় সানগ্লাস আর হ্যাট পরিধান করে থাকে৷ যদিও এটা এখন ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর প্রিয় মানুষটার দেখা পাবে। যাকে সে কোনোভাবেই হারাতে চায়না। সেই অসাধারণ রমণীটিকে সারাজীবন প্রিয় তুমি করে রাখবে!
(বোনাস) আপনারা তো অনেকেই বোনাস চান। আমি দিতে পারিনা৷ বাকি অংশটুকু বোনাস পর্ব হিসেবে লিখলাম।
ক্লাস শেষে মাহিম যখন বেরিয়ে এলো তখন ফাঁকা জায়গা দেখে কয়েকটা ছেলে ওকে ঘিরে ধরলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেগুলো ওকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। প্রায় দশমিনিট এভাবে মারার পরে ওরা চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো, আমাদের ভাবির কাছ থেকে অলওয়েজ দশ হাত দূরত্ব বজায় রাখবি। নইলে পূরব ভাই তোকে দুনিয়া থেকে আউট করে দেবে। পূরব কে চিনছিস তো? ইফরাজ পূরব! আর তার হবু বউ সেহের। তার সাথে আজ থেকে তোর মেলামেশা যেন না দেখি। বলেই ছেলেগুলো চলে গেলো। মাহিম হতভম্ব। ও বুঝতে পারছেনা হঠাৎ করে কোথা থেকে কারা এসে ওকে মেরে চলে গেলো। তাও সামান্য এক কারণে। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই। একপর্যায়ে ব্যথায় ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। সেহের, শেফা, রিমা এই খবর শুনে দ্রুত ছুটে এলো। কমন রুমে নিয়ে ওকে পানি ছিঁটিয়ে জ্ঞান ফিরানো হলো। সবাই কি হয়েছে জানতে চাইলে মাহিম পুরো ঘটনা খুলে বললো। শেফা, রিমি হাসতে হাসতে বলল, ‘কী জেলাস রে পূরব ভাইয়া৷ মাই গড! সেহের তুই পাইছিস..’
‘কী পেয়েছি?’
‘বলছিলাম না পূরব ভাই তোকে পছন্দ করে?’
সেহের মাথা নিচু করে মাহিমকে বলল, ‘দুঃখিত আমি। আমার জন্য এসব হলো। আমি এটা চাইনি।’
মাহিম হাসতে হাসতে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এরকম প্রেমিক তো জীবনে দেখিনি। প্রেমিকার সাথে কথা বললেও মাইর? ইউ আর ভেরি লাকি গার্ল সেহের। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিছু মনে করিনি। তোমার অপ্রস্তুত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অলওয়েজ বেস্টফ্রেন্ড থাকবো। আমারও এবার থেকে কঠোর প্রেমিক হতে হবে, আমিও তো চাইনা আমার প্রিয় মানুষটা কারো সাথে কথা বলুক, আফটার অল আমিও জেলাস হই। হাহা।’
রিমি কড়া চোখে মাহিমের দিকে তাকালো। সেহের খুব লজ্জ্বা পেলো। মাহিমের কাছে স্যরি চেয়ে বাসায় ফিরে এলো। এসবের মানে কী? পূরব সেহেরকে ভালোবাসে? তাহলে সামনে এসে বলেনা কেন? আর এটাও বুঝি সম্ভব? আকাশ আর পাতালের কোনোদিনও বুঝি মিল হয়? কোথায় রাজপুত্র আর কোথায় ঝি’য়ের মেয়ে। হাস্যকর হলেও সেহেরের মনে একটু প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। সঙ্গে খুব রাগ আর অভিমান হলো। ওর জন্য শুধু শুধু মার খেলো মাহিম! আসুক না বিয়ের কথা বলতে, মজা দেখিয়ে দেবে সেহের! দুটো কড়া কথা যদি না শুনিয়েছে তাহলে ওর নামও সেহের নয়! সেহেরের মনে প্রিয়ের জায়গা করে নেওয়াটা এতোটাও সহজ নয় কিন্তু, এটাও জানা উচিৎ লোকটার। সবকিছুতে এতোটা সিনেমাটিক হলে চলে না। বাস্তব বলে কিছু তো আছে। কই, নিজে থেকে এসে তো বলেনি ভালোবাসি৷ রাস্তার মানুষকে পিটিয়ে ভালোবাসা জানান দেওয়াটা কেমনতর কাজ? সাহস থাকলে সামনে এসে বলুক, হুহ!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!
#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
এরপর কিছুদিন কেটে গেলো। পূরব ভাবতে লাগলো কীভাবে সেহেরকে সবটা বলবে। কীভাবে জানালে সেহের বুঝতে পারবে যে পূরব ওকে ভালোবাসে? আর যদি সেহের না করে দেয়? তাহলে? পূরব কিছুতেই সেটা মানতে পারবেনা। খুব কষ্ট হবে৷ এতসব ভাবনায় এলোমেলো মস্তিষ্কটাকে সান্ত্বনা দিতে পূরব ঠিক করলো আগামীকালই সেহেরকে সবকিছু জানাবে। এর মধ্যে একটা নামীদামী পোশাক কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করতে ওকে অফার করা হলো। পূরব ওদেরকে হ্যাঁ না কিছুই বললোনা৷ এসবে ওর ইন্টারেস্ট না থাকলেও ইরফান আহমেদের প্রচুর ইন্টারেস্ট আছে। তিনি এটাও চান ছেলে মডেলিং করে যাতে ভালো একটা পজিশনে যেতে পারে। কিন্তু পূরবের মনে হয় এসব করা ওর কর্ম নয়, যেমন পজিশনে আছে তেমনই ভালো। এমনিতেই লোকচক্ষুর সামনে পড়লে ওর আর রক্ষা নেই, সেখানে মডেল হওয়া তো আরো রিস্কের৷ যখন তখন লোকজনের সামনে যাওয়া যাবেনা ইচ্ছে থাকলেও, মেয়েরা তো জেঁকে ধরবে একদম। তাই ও আর এই বিষয়ে ফাইনাল কোনো সিদ্ধান্ত নিলোনা। আপাতত পেন্ডিংয়ে রাখা হলো। এখন ওর কাজটা আগে শেষ করতে হবে৷
সেহেরের এক্সাম শেষ হয়েছে সপ্তাহ খানিক হলো। খুব একটা খারাপ হয়নি। তবে সিজিপিএ নিয়ে ওর খুব টেনশন হচ্ছে। টিউশন শেষে বাসায় ফিরে ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লো। গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘুমে দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। রাত নয়টার দিকে সুমা এসে ওকে ডেকে তুললো। সেহের ঘুমের মধ্যেই খুব বিরক্ত হলো, তবুও উঠলোনা। সুমা এবার কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘এই সেহের, সেহের উঠ না?’
‘ডি ডিস্টার্ব করিসস ন না।’
‘ডিস্টার্ব কই করলাম। কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে? খেতে উঠ।’
‘খাব ব ন না।’
‘আরে আমি নিজের হাতে রান্না করেছি। উঠ বলছি।’
‘বললাম তো খাবোনা।’
এভাবে অনেকক্ষণ জোরাজোরি করার পরেও সেহের উঠতে চাইলোনা অথচ পেটে ক্ষিধেয় ছুঁচো দৌঁড়াচ্ছে। কাঁথা টেনে মুখ ঢেকে ফেললো যার অর্থ সে খেতে উঠবেনা। সুমা ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়লোনা। হঠাৎই ওর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেলো। বিছানায় বসে গলার স্বরটা উঁচু করে শিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই শিলা দেখে যা কি কান্ড ঘটছে!’
শিলা রান্নাঘরে আলুভাজতে ব্যস্ত। সুমার কথা শুনে বলল, ‘কী হইসে?’
‘পূরব ভাইকে চিনস না? আরে আমাদের বাসার নিচে আইসা যে দাঁড়িয়ে থাকতো?’
শিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘লম্বা করে যে ওনি? আরে হ্যাট পরা মানব?’
‘হুম।’
‘কী হয়েছে ওনার?’
শিলা জিজ্ঞেস করতেই সুমা ওকে চোখ টিপে দিলো। যার অর্থ একটুখানি এক্টিংয়ে ওর সাথে তাল মেলাতে হবে, যাতে করে সেহেরকে এই ঘুম থেকে উঠাতে পারে। শিলা মুখ টিপে হেসে সুমার সাথে সায় জানালো। সুমা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করার ভঙ্গি করে নাক টেনে বলল, ‘আরে ওনার মতো বড়মাপের একজন লোক আমাকে ম্যাসেজ করেছে তুই ভাবতে পারোস?’
শিলা আকাশ থেকে পড়ার মতো ভান করে বলল, ‘কী বলস? ও আল্লাহ!’
‘হুম সত্যি। পূরব ভাই আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছে।’
ঘুমের মধ্যে থাকলেও সেহেরের কান ওর মস্তিষ্কে এই নামটা পৌঁছালো। কাঁথার ভেতর চোখ খুলে চাইলো। অবাক হয়ে সুমার কথা শুনতে লাগলো। পূরব সুমাকে ম্যাসেজ করেছে? সত্যিই?
শিলা বলল, ‘কী লিখেছে?’
সুমা ভাব নিয়ে বলল, ‘কথাটা তো আমাদের নিয়ে লেখেনি। লিখেছে সেহেরকে নিয়ে। আল্লাহ শিলা, আমরা যা ভাবতাম তাই রে। ওনি এজন্যই রাত-বিরেতে আমাদের এখানে এসে এতিমের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।’
শিলা উৎসুক কন্ঠে বলল, ‘সেহেরকে নিয়া লিখছে? কি লিখছে রে?’
‘খুবই গোপনীয় কথা। এটা শুধু ওকে বলতেই বলছে।’
সেহের ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ক কী লিখেছে?’
সুমা হেসে বললো, ‘জানতে চাস? এতো ইন্টারেস্ট কেন তোর? তাছাড়া এখন তো তুই ঘুমাবি, সো ঘুমিয়েই থাক।’
সেহের বলল, ‘প্লিজ বল না।’
‘বলব এক শর্তে।’
সেহেরের খুব জানতে ইচ্ছে করছে পূরবের ম্যাসেজের ব্যাপারটা। কী ওমন লিখেছে ওকে নিয়ে? ভ্রু কুঁচকে সুমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী শর্ত?’
‘খাবি আগে।’
সেহের হতাশ হয়ে বলল, ‘খেতেই হবে?’
‘হুম হবে।’
‘তোরা আবার আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিসনা তো?’
সুমা ভাব নিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস না করতে পারলে না-ই করতে পারিস৷ সম্পূর্ণটা তোর উপর।’
‘আচ্ছা। খাবো।’
সেহের ফ্রেশ হয়ে এসে সুমাদের সাথে বসে খেয়ে নিল। খাওয়াদাওয়া সেরে সবকিছু গুছিয়ে সেহের সুমার জন্য ওয়েট করতে লাগলো। ওর ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। কিন্তু ওকে পুরো অবাক করে দিয়ে সুমা আর শিলা নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার মানে ওকে খাওয়ানোর জন্য ওরা মিথ্যা বলেছে? আর সেহেরও সেটা বিশ্বাস করেছে। না জানি সুমা, শিলা পূরবের প্রতি ওর এতো ইন্টারেস্ট দেখে কি ভাবছে। ইশ কী লজ্জা!
★
সেহের টিউশন শেষে বাসায় ফিরছিল। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। গলির মুখে কিছু ছেলেদের দেখা যাচ্ছে। তাদের চেহারা দেখেই যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে ওরা বখাটেপনা করে বেড়ায়৷ সেহের দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো, ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে গল্প করায় মগ্ন৷ ওকে দেখতে পেল না। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। উফ বাঁচা গেল। সামনে পা বাড়ালো আবার। হঠাৎই লক্ষ্য করলো ওর পিছু কেউ আসছে৷ সেহের ওর ব্যাগ চেপে ধরলো। পা চালালো দ্রুত। নিশ্চয়ই ওই লোক গুলোর মধ্যে কেউ! ভয়ে একপর্যায়ে দৌড় শুরু করল। বড় একটা গাছের নিচে পৌঁছাতেই কেউ ওকে ডাকলো। না চাইতেও সেহের পেছনে ফিরে দেখলো হ্যাট পরা একটা লোক, মুখ দেখা যাচ্ছেনা। সেই মুহূর্তে হ্যাট পরা কোনো লোকের কথা ওর মাথায় এলোনা। ভয়ের চোটে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমি কিছু করিনি। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।’
পূরব অবাক হয়ে বলল, ‘হোয়াট??’
সেহের চোখ বন্ধ করে বলল, ‘প্লিজ আমায় যেতে দিন। আমার ক্ষতি করবেন না।’
পূরব আরেকটু এগিয়ে গেলো ওর দিকে। বুঝতে পারলো কোনো এক কারণে ও ভয় পাচ্ছে। পূরব বলল, ‘আমিতো ক্ষতি করতে আসিনি তোমার। নিয়ে যেতে এসেছি।’
সেহের ভয়ের চোটে এবার চোখ খুলল। সামনে পূরবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বলল, ‘আ আ আপনি?’
পূরব মুচকি হেসে বললো, ‘হুম আমি। কিন্তু তুমি এভাবে রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলে কেন? আর এত ভয়ই বা কেন পাচ্ছো? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি৷ সেরকম কোনো ইন্টেনশন আমার নেই।’
সেহের রেগে বলল, ‘তার মানে আপনি এতক্ষণ আমার পিছু নিচ্ছিলেন?’
পূরব বলল, ‘একদমই না৷ আমিতো তোমার বাসার দিকেই যাচ্ছিলাম৷ হঠাৎ দেখলাম তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো। আমি গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে ডাকলাম৷ তুমি হয়তো শুনোনি। আমি তোমার পিছনে পিছনে আসছিলাম, আচমকাই তুমি দৌড় শুরু করলে। বাই দ্যা ওয়ে, এরকম করার কারণ?’
সেহের নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বকলো। পূরবের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহারই করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ও এখানে কেন? তারপর বলল, ‘এমনিই। ভাবলাম কেউ হয়তো আমায় ভয় দেখাতে এরকম করছে।’
‘ওহহ। এত রাতে কোথা থেকে ফিরছ?’
‘টিউশন থেকে।’
পূরব বলল, ‘শুনো তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম৷ তোমার সাথে দরকার আছে!’
‘কীসের দরকার? তাও আবার আমার সাথে?’
‘হুম! রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে চাইনা। কোথাও বসার জায়গা আছে?’
‘এখানেই বলুন।’
‘আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পেশাল কথাগুলো আমি এভাবে বলতে চাচ্ছিনা। কোথাও বসে বললেই বেটার।’
সেহের চোখ গরম করে বলল, ‘আসুন তবে। সামনে একটা টঙ দোকানের পাশে পার্ক আছে। যাবেন?’
পূরব কিছুক্ষণ গাইগুই করে রাজি হলো। তারপর ওরা সেখানে গেল। দোকানী একজন বয়স্ক লোক। কম করে
হলেও আশি বছর বয়স তো হবেই। সেটার অদূরে একটা পার্ক। তার পাশে খোলা মতোন একটা জায়গা, ঘাসে ভরপুর। কাঠের তৈরি একটা বসার জায়গা দেখে সেহের আর পূরব সেখানে বসলো। সেহের বলল, ‘বলুন আপনার ইম্পোর্টেন্ট কথা।’
পূরব হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই এবং করবো।’
সেহের অবাক হলেও তা প্রকাশ করল না। মৃদু হেসে বলল, ‘কেন?’
‘কারণ তোমাকে ভালোবাসি।’
সেহের থমকে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইছেনা। তাও খুব কষ্টে বলল, ‘এটা কতটুকু সত্যি?’
‘যতটুকু সত্য ভালোবাসা নামক কথাটায়।’
‘এটা বিশ্বাস করব কী করে? আজকালকার দিনে ভালোবাসা হয়না, যা হয় পুরোটাই মোহ। আপনারও ঠিক সেটাই হয়েছে। মোহ কেটে গেলে আমার প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট উঠে যাবে। তাই প্লিজ বিয়েটিয়ের কথা বলবেন না।’
পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘প্লিজ আমার ভালোবাসাকে মোহ বলে চালানোর চেষ্টা করবেনা। আমি বাচ্চা নই। সাতাশ বছরের জীবনে কোনটা মোহ, কোনটা ভালোবাসা সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে শিখেছি। তাই আমার ভালোবাসাকে নিয়ে মজা বা অপমান কোনোটাই করার রাইট তোমার নেই।’
‘হঠাৎ করে আমার প্রতি ভালোবাসা উদয় হওয়ার কারণ? আপনার পাশে কোনো অপ্সরা মানায়। আমি কিন্তু দেখতে অপ্সরা নই।’
পূরব গভীর গলায় বলল, ‘আমি অপ্সরাকে ভালোবাসিনি, সেহেরকে ভালোবেসেছি।’
‘তবুও বলছি, আপনার পাশে অপ্সরা মানায়।’
পূরবের ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। কাঠ কাঠ গলায় সে বলল, ‘মানিয়ে নেওয়াটা আমার ব্যাপার। তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।’
‘কিন্তু জীবনটা তো আমার!’
‘উফ..বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।’
‘তা আমাকে বেছে নেওয়ার কারণটা ঠিক কী?’
পূরব স্বপ্নালু চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে। প্রথম যেদিন তোমার সাথে দেখা তখন থেকেই একটা ইন্টারেস্ট তৈরি হয় তোমার প্রতি। তোমাকে হেনস্থা করার জন্য যতটুকু টাইম ওয়েস্ট করেছি, ততটুকু টাইম আমি অন্য কোনো মেয়েকেও দিইনি। অথচ আমার আশেপাশে মেয়েদের অভাব ছিলনা কখনো। কিন্তু তুমি আলাদা। সেই থেকে ভালোলাগা। তারপর আব্বুকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে যখন বাঁচালে আব্বুও তোমাকে নিয়ে প্রশংসা করত। আমি তখন আরো তোমাতে মগ্ন হয়ে যাই। রাতেরবেলা একপলক দেখার জন্য ছুটে আসতাম, দাঁড়িয়ে থাকতাম পাগলের মতো। আব্বুর দেওয়া চাকরিটা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখেছিলে তাতে আমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে যাই। একসময় বুঝতে পারি তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।’
সেহের শুনলো সবটা। তারপর বলল, ‘আপনি আমার ব্যাপারে সব জানেন না। কিন্তু আপনার জানা দরকার আমি একটা এতিম মেয়ে। খুব সাধারণ একটা ফ্যামিলি থেকে বিলং করি। চাচীর সংসারে লাথি-ঝাটা খেয়ে দিনাতিপাত করেছি। একমুঠো খাবারের জন্য কত কি-না করেছি। ছেঁড়া জামাকাপড় পরেছি। স্কুলে যাওয়ার ইউনিফর্ম ছিলনা বলে ক্লাসে আউটড্রেস পরে যেতাম, সেজন্য কত মার খেয়েছি। কাজের লোকের মতো সারাদিন কাজ করেছি, বিনিময়ে নুন-পান্তা জুটেছে কপালে। শুধুমাত্র পড়াশোনা জানা ছিল বলে আজ আমি এতদূর এসেছি। এই তিনকূলে এক চাচা ছাড়া আমার আর কেউ নেই৷ তাও সেই চাচার সংসারে আমার কোনো জায়গা নেই। আপনার জানা উচিৎ, আমার সাথে আপনার স্ট্যাটাস মিলেনা। আপনার সাথে বড়লোক ঘরের মেয়েকেই খাটে, আমাকে নয়।’
পূরবের বুক কেঁপে উঠলো। সেহেরের হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘তবুও ভালোবাসি।’
সেহের অস্বস্তিভরা গলায় বলল, ‘ছাড়ুন হাত। প্লিজ। আপনার সাথে আমার যায়না। লোকে হাসবে। আমায় লোভী ভাববে।’
পূরব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিন্তু তুমি তা নও। তোমার সেল্ফ-রেস্পেক্ট তোমাকে সেটা ভাবতে বলেনা। তাছাড়া কোন সোসাইটির কথা ভাবছো, যেখানে তোমার শৈশব-কৈশোর এতো খারাপ কেটেছে! কই তখন তো কেউ এসে তোমাকে সাহায্য করেনি। কেউ তো দু-মুঠো অন্ন জোগাড় করে দেয়নি। সবাই নিজেদের নিয়ে যেখানে ব্যস্ত ছিলো, সেখানে তুমি নিজের যোগ্যতায় এতদূর এসেছো। আর আজ তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করলে সবাই কটুক্তি করবে, তা তুমি মেনে নিচ্ছো? তাদের কথা ভাবছো? ঘুরেফিরে সেই সমাজের কাছেই বাক্সবন্দি হয়ে থাকতে চাইছ! এটা কেমনতর কথা হলো?’
সেহের অবাক হয়ে পূরবের দিকে তাকালো। ওর পুরো কথাটাই তো ঠিক। কিন্তু… একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেহেরকে চিন্তায় মগ্ন দেখে পূরব বলল, ‘আজগুবি চিন্তা বন্ধ করো৷ কোনো ভয়-লজ্জা পাবার কারণ নেই। ইউ নো হোয়াট, তুমি নিজেও আমাকে ভালোবাসো, সেটা তোমার চোখগুলোই আমাকে জানান দিচ্ছে।
সেহের কপট রাগ নিয়ে বলল,’ইশ চুপ করুন। আপনি কিছুই জানেন না!’
পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী জানিনা? সব জানি আমি। কীভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি আমাকে দেখতে। ফ্রেন্ডসদের সাথে আমাকে নিয়ে আলোচনা করতে। ফার্স্ট টু লাস্ট অলওয়েজ তুমি আমাকে, আর আমি তোমাকে ভালোবাসবো। গট ইট… এবার সত্য কথাটা বলে ফেলো, এই রাতে আমি কথাটা শোনার জন্যই তোমার কাছে এসেছি!’
‘কোন কথা?’
‘ভালোবাসি বলাটা।’
সেহের ভীষণ লজ্জায় মুখ নুইয়ে ফেলল। এতেই পূরব বুঝতে পারলো প্রিয় মানুষটার ও ওর প্রতি বিশেষ অনুভূতি আছে। ওর লজ্জায় লাল হওয়া গালটাকে আরও রাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। আলতো করে গাল ছুঁইয়ে দিলো। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সেহের ওকে চুপ করিয়ে রেগে বলল, ‘আপনিই তাইনা? সেদিন মাহিমকে লোক দিয়ে পিটিয়েছিলেন? আর আমাকে নিজের হবু বউ পরিচয় দিয়েছিলেন? কি মিথ্যুক আপনি? এমন কেন করেছিলেন?’
পূরব রেগে বলল, ‘অভিয়েসলি আমি করেছি। তোমার আশেপাশে আবার দেখলে এবার জানে মেরে দিব। তুমি যেভাবে ওর সাথে কথা বলতে আমার রাগ উঠতো। তাই ধোলাই দিয়েছি। এবার যদি শিক্ষা হয়!”
সেহের গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল, ‘ও আমার ফ্রেন্ড রিমির ফিয়ন্সে।’
পূরব অবাক হয়ে গেলো। থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সেহের হাসতে লাগলো। পূরব মুগ্ধ করা সেই হাসি অবলোকন করে নিজেও মুচকি হাসলো৷ প্রশান্তির উষ্ণ নিঃশ্বাস জানান দিলো ভালোবাসার মানুষটির মনের সুপ্ত কথা। পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে পূরব হঠাৎ জোরালো গলায় বলে উঠলো, ‘ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি লাজুক হাসিতে মুগ্ধ করা সেই মেয়েটিকে, যে আমার বুকের বাঁ-পাশটা জুড়ে আছে।’
সেহের ওকে এরকম করতে দেখে নিঃশব্দে হাসছে। ঘন পাপড়িযুক্ত চোখ মেলে দেখছে তার হ্যাট পরা সেলিব্রেটি চোরটাকে। আহা তাঁর ভালোবাসাটা!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!