#প্রিয়_তুমি,১২,১৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
সেদিনের পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কয়েকদিন পর সেহেরের রেজাল্ট পাবলিশড হলো। দেখা গেলো রেজাল্ট মোটামুটি ভালো কিন্তু সেহের খুশি হতে পারলোনা। ও যেটা আশা করেছিল তার থেকে বেশ কিছু নাম্বার কম। যেটা ওর কাম্য নয়। শেফা, রিমি ওরাও ভালোই করেছে। এই খুশিতে ওরা সেহেরের আপসেট হওয়ার বিষয়টা মানতে পারলোনা। শেফা সেহেরের মুড ঠিক করার জন্য জোর করে একটা কফিশপে নিয়ে গেলো ওকে। কোল্ড কফি, বার্গার অর্ডার করলো শেফা। হাতমুখ ধুতে ওয়াশরুমে গেলো৷ ফোন আর পার্স পড়ে রইলো টেবিলের উপর। হঠাৎ শেফার ফোন বাজলো। ওরা কেউ অতোটা পাত্তা দিল না। কিন্তু বারবার ফোন আসতে থাকার সেহের বলল, ‘কীরে রিমি? কোথায় গেল শেফা? ফোন আসছে মনে হচ্ছে!’
রিমি বলল, ‘শেফা তো ওয়াশরুমে।’
‘বারবার কল আসছে। দরকারী নাকি?’
‘কী জানি।’
‘ধর ফোন।’
‘আমি?’
‘তুই ছাড়া যেহেতু এখানে কেউ নেই তাই তুই ধরবি।’
‘আরেকজনের ফোন ধরব?’
‘দরকারি হতে পারে!’
রিমি বিষন্ন স্বরে বলল, ‘আচ্ছা ধরছি।’
রিমি ফোনটা হতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে বয়স্ক মহিলার গলা শোনা গেলো। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ‘তুমি শেফা মা? আমি জিসানের আম্মু। চিনতে পারছো?’
রিমি কথাটা শুনেই ফোনের স্পিকার চেপে ধরে সেহেরকে নিচু স্বরে বলল, ‘জিসান ভাইয়ের আম্মা। কী কমু?’
‘তোর যা ইচ্ছে!’
‘বইলা দিই আপনার হবু বৌমা টয়লেটে গিয়েছে?’
সেহের কটমট করে বলল, ‘ফাজলামো করবিনা। সুন্দর করে কথা বল। হয়তো জরুরি কোনো কথা।’
রিমি মুখটা কালো করে ফোনটা কানে ধরলো। জিসানের মাকে বলল, ‘আসলে আন্টি আমি শেফার ফ্রেন্ড রিমি বলছি। শেফা একটু ওয়াশরুমে গিয়েছে।’
ওপাশ থেকে জিসানের মা বলল, ‘ওহ আচ্ছা।’
‘কেমন আছেন আন্টি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমিতো শেফার বান্ধবী তাইনা?’
‘জি।’
‘তবে তোমাকেই জিজ্ঞেস করি, তুমিতো শেফাকে কাছ থেকে দেখেছ? তাইনা?’
রিমি বিব্রতবোধ করছে। ফোনটা সেহেরের কাছে জোর করে দিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, ‘প্লিজ দোস্ত। তুই কথা বলে ম্যানেজ কর। আমি কী বলতে কী বলে ফেলব আল্লাহই জানে। নার্ভাস লাগছে।’
সেহের বিরক্ত হলো। ফোনটা নিয়ে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো এবং শেফার বিষয়ে প্রায় সবকিছুই শেয়ার করলো। ওর পছন্দ-অপছন্দ, ক্যারেক্টার কেমন তাও জেনে নিলো জিসানের আম্মা। আর পূরবের হবু বউ সেহের, জানতে পেরে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানালেন। ছোটবেলা থেকেই পূরবকে চেনেন তিনি। আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও ছেলেটা ভালো। টাকাপয়সা হতদরিদ্রদের দান করে, তাও খুব নিভৃতে। জিসানকে কতবার সাহায্য করেছে। বন্যা দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে কয়েকবছর আগে তো নিজেই মরতে বসেছিল পূরব। পাঁচদিন আই-সি-ইউতেও রাখা হয়েছে। অবশেষে সুস্থ হয়েছে। এরকম অনেক কথা তিনি সেহেরকে বললেন। অথচ সেহের এ বিষয়ে কিছুই জানতোনা। কথা বলার মাঝপথেই শেফা ফিরে এলো। দেখলো ওর ফোনে সেহের কারো সাথে কথা বলছে। রিমি ওর কানে কানে ফিসফিস করে সব কথা উগলে দিল। শেফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জিসানের আম্মার সাথে কথা বলতে ও জীবনেও পারতোনা। যাক সেহের সামলে নিয়েছে। কিন্তু ওর বিশ্বাসে পানি ঢেলে দিয়ে সেহের ওকে ফোন ধরিয়ে দিল। জিসানের আম্মা শেফার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। কীভাবে ওদের পরিচয়, কখন বিয়ে করতে চায় সবকিছু। শেফা লজ্জ্বামিশ্রিত কন্ঠে ওনার ওপর সবকিছু ছেড়ে দিল। জিসানের মা পুত্রবধূকে ঘরে নিতে দেরি করতে চান না। তাই তিনি আশ্বাস দিলেন খুব দ্রুতই শেফার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হবে। শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল শেফা।
কথা বলা শেষ করে ফোন রাখলো শেফা। তারপর সেহেরকে থ্যাংকস জানালো। ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। সেহের,রিমি ওকে নিয়ে বেশ মজাও করলো খানিকক্ষণ। ওয়েটার কফি, বার্গার দিয়ে গেছে সেই কখন! রিমি খাওয়া শুরু করলো। অর্ডারকৃত কফি পান করে, বিল মিটিয়ে মার্কেটে গেলো। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনলো শেফা, রিমি ওর বোনের জন্য একটা জামা নিলো। সেহের একটা ঘড়ি কিনলো। ওর হাতঘড়িটা মাস তিনেক আগে পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে ওরা যার যার বাসায় ফিরে গেলো, সেহের টিউশনে চলে এলো। পাঁচটা টিউশনের তিনটে কামাই দিয়ে দুটো পড়িয়ে বাসায় চলে এলো। গোসল সেরে, খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দিলো। এর মধ্যে সুমা আর শিলা ফ্রেন্ডের বাসা থেকে ফিরে এলো। বাসায় ফিরে দেখে সেহেরের প্রচন্ড জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে কয়েকবার বমিও করলো। সুমা ওকে ঔষধ খাইয়ে দিল, শিলা মাথায় পানি দিতে লাগলো। সুমা সেহেরের জ্বর দেখে কী করবে বুঝে উঠতে পারলোনা।
রাত সাড়ে তিনটা। শিলা ক্লান্ত হয়ে সেহেরের পিছনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। সুমার চোখ ঢুলছে, মাথাটা ভীষণ ভারে নুইয়ে পড়তে চাইছে। সেহেরের কপালে হাত দিয়ে চেক করে দেখলো জ্বর খানিকটা কমেছে। সেহেরের ফোনটা ড্রয়ারে ছিলো। ভ্রাইবেট করছিলো। সুমা হাতে নিয়ে দেখলো পূরব অসংখ্য ম্যাসেজ করে রেখেছে, ফোন করেছে। কিন্তু সেহের রিসিভ করেনি। করবে কীভাবে তখন তো জ্বরে অজ্ঞানের মতো পড়ে ছিল। সেহেরের শরীর ভালোনা সেটাতো ওকে জানানো দরকার। আফটার অল পূরব ওদেরকে বলে রেখেছে সেহেরের অসুবিধা হলে সেটা যেন ওকে জানায়। কিন্তু এতো রাতে পূরবকে ফোন করা ঠিক হবে কিনা? যা হয় হোক, সামান্য ঘুম ভাঙলে কোনো ক্ষতি হবেনা ভেবে ডায়াল করলো পূরবের নাম্বারে।
পূরবের চোখটা সবেমাত্র লেগেছে। প্রজেক্টের কাজ দেখতে দেখতে কখন যে রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেলো খেয়ালই হয়নি। সেহেরকে অনেকবার ফোন, ম্যাসেজ করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েটার সাথে আজ সারাদিন একবারের জন্যও কথা হয়নি ভেবেই মন খারাপ লাগছিলো। কিন্তু এত রাতে ফোন কলের শব্দে ওর বিরক্তি চরম আকার ধারণ করল। অফিস থেকে ফোন আসার সম্ভাবনা নেই, সেহের তো আরো করবেনা এত রাতে। তাহলে কে? খুব জরুরি না হলে তো কেউ ফোন করেনা৷ এই ভেবে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করলো পূরব। কে ফোন করেছে জিজ্ঞেস করতেই সুমার কন্ঠ শোনা গেলো।
‘হ্যালো ভাইয়া? আ আমি সুমা বলছি। সেহেরের রুমমেট।’
পূরব তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত রাতে? সেহেরের কিছু হয়েছে? ঠিক আছে ও?’
‘না ভাইয়া। ওর তো সন্ধ্যা থেকে জ্বর। অনেক জ্বর। জ্বরের ঘোরে একপ্রকার বেহুঁশের মতো পড়ে আছে।’
ওদিকে কথাটা শুনেই পূরবের গলা শুকিয়ে এলো। ভীষণ টেনশন শুরু হলো। পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আমাকে আগে জানালে না কেন?’
‘আসলে আপনার কথাটা মাথায় ছিল না।’
পূরব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘ওয়েট, আমি আসছি৷ ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।’
কথাটা শুনে সুমা অনুরোধের স্বরে বলল, ‘আপনার আসতে হবেনা ভাইয়া। আর এখন জ্বর কিছুটা কমেছে। আমি ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি। ঘুমাচ্ছে এখন। আপনি আসলে প্রবলেম হবে।’
পূরব ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কীসের প্রবলেম?’
‘এত রাতে মেয়েদের বাসায় আসবেন লোকে জানলে কত কথা রটাবে ভেবেছেন? কেউ তো আর সত্যটা জানতে আসবেনা, উলটো আমাদেরই সমস্যা হবে। খারাপ ভাববে। আর আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি তো।’
পূরব ভেবে দেখলো কথাটা আসলেই ঠিক। হতাশ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা৷ বাট কাল সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ওকে। আমি কথা বলে রাখবো। আর ওর এতো পরিশ্রম করার মানে হয়? ঠিকমতো খায়না, নিজের প্রতি নূন্যতম খেয়াল রাখেনা অসুস্থ তো হবেই। বেয়াদব মেয়ে একটা।’
সুমা হেসে ফেললো। পূরব ফোন রেখে দিলো আরও কিছু উপদেশ দিয়ে। সেহেরের দুইগালে থাপ্পড় দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। পরদিন সকালে জ্বর কমলে সুমা ওকে জোর করে একপ্রকার হুমকি দিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। হসপিটালে গিয়ে দেখলো সেখানে পূরবও ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। সুমার প্রতি রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেহের। পূরবকে জানানোর কী দরকার ছিল? যত্তসব! এখন ওর উপর খবরদারি শুরু করবে এই লোক। সেহের চুপচাপ হয়ে রইলো। পূরব ডাক্তারের চেম্বারে ওকে নিয়েই গেলো। কথাবার্তায় বোঝা গেলো ডাক্তার পূরবের পূর্ব পরিচিত। তিনি সেহেরকে পরিশ্রম কম করতে উপদেশ দিলেন। কিছু ঔষধপত্র লিস্ট করে দিলেন। ওখান থেকে বেরিয়ে পূরব সেহেরের সাথে রাগারাগি করলো খুব। আজ থেকে টিউশন বন্ধ। সেহের কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমি নিজের খেয়াল রাখবো। কিন্তু টিউশন বন্ধ করবোনা।’
‘ত্যাড়ামি যাবেনা এই মেয়ের। যত্তসব পাগলের পাল্লায় পড়েছি।’
সেহের চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘তাহলে পাগলের জন্য এত দরদ দেখাবেন না। যাচ্ছি আমি।’
পূরব পেছন থেকে ওর হাতটা টেনে ধরে বলল, ‘বিয়েটা এই সপ্তাহেই করছি। তারপর দেখবে কীভাবে ত্যাড়ামি ছুটাই তোমার। বেয়াদব কোথাকার।’
‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না।’
‘তোমার মতামত জানতে চাইনি।’
সেহের মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘চোর চোরই থাকে। কখনো ভালো হয়না।’
পূরব রেগে ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘কী বললে? এত সাহস? এখন তো শাস্তি দিতেই হবে..’
বলেই আচমকা সেহেরের গালে চুমু খেলো। সেহের কাঠ হয়ে গেল। আশেপাশের লোকজন দেখেছে কিনা আল্লাহ মাবুদ জানে। পূরবের বুকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘আসো আরেকটা দিই। চলো!’
‘শয়তান কোথাকার, দূরে যান বলছি৷ নির্লজ্জ লোক।’
পূরব ওর দিকে এগোতে লাগলো। হঠাৎ সুমা চলে আসায় পূরব ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদেরকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে সেহেরকে চোখ টিপে ওর কানে কানে বলল, ‘রেডি থেকো বউ। বিয়েটা এই সপ্তাহেই হচ্ছে।আমাকে চোর বলার সাধ সুদে-আসলে মিটিয়ে দেব।’
চলবে..ইনশাআল্লাহ!
#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
পূরব, সেহেরের বিয়ের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া শুরু করেছে ওর বাবা ইরফান আহমেদ। একমাত্র ছেলের বিয়েতে তিনি কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। ডেকোরেশনের কাজ, গেস্টদের ইনভাইটেশন পাঠানো সব কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাথে গরিব-দুঃখীদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। ওটা মূলত পূরবের ইচ্ছে।
পূরবের বিয়ের জন্য কোনো কনভেনশন সেন্টার বুক করেননি ইরফান সাহেব। তাঁদের বাড়ির সামনের জায়গাটাতেই বিয়ের সব আয়োজন চলছে। এসব কাজে ইরফান সাহেবকে হেল্প করছে জিসান। পূরবের বিয়েটা মিটে গেলে মাসখানিক পরে ওর আর শেফার বিয়ের ডেট ঠিক করা হবে। আপাতত এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবছেনা ও!
ওদিকে সেহেরের কোনো অভিভাবক না থাকায় ইরফান আহমেদের সাথে কথা বলে ওর চাচাই সব দায়িত্ব নিলেন। সেহের মোটেও তা চায়নি। কিন্তু অনেক জোরাজুরির পর ওকে রাজি করানো গেলো। ওর চাচী ফোন করলেন৷ সবসময় তিনি সেহেরের খারাপ চেয়েছেন, এবার খুব ইচ্ছে অন্তত মেয়েটার বিয়ে তাদের বাড়ি থেকে হোক। নিজের হাতে সেহেরের বিয়ের কাজ করবেন। যদিও খুব অসুস্থ সেহেরের চাচী। ওনার এক কথা, সারাজীবন তো আর কিছু করতে পারেননি সেহেরের জন্য, শুধু অত্যাচারই করেছেন। এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। সেজন্য বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে নিজের চাচার বাড়িতে উঠেছে সেহের। বিয়ে উপলক্ষে সুমা আর শিলাও ওর সঙ্গে এসেছে। শেফা আর রিমি আসবে একদিন পরে। সন্ধ্যাবেলায় আলমিরাতে বিয়ের জন্য শপিং করে আনা কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছিলো সেহের। ওকে সাহায্য করছে শিলা। আচমকাই পূরবের ফোন। কাজের মধ্যেও এই লোকের ফোন, দিনের মধ্যে নিয়ম করে তিনবার কথা না হলে পূরবের নাকি শান্তি লাগেনা। শিলাকে হাতের কাপড়টা ভাঁজ করতে দিয়ে সেহের ফোন রিসিভ করলো। পূরব ওর কথা শোনার আগেই কথা বলে উঠলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কী করছো?’
এটা জানার জন্য ফোন করেছে? কী জ্বালা। ভালোবাসার লোকগুলো কী এভাবেই জ্বালাতে ভালোবাসে নাকি? সময়ে-অসময়ে তাঁদের জানতে ইচ্ছে করে প্রিয় মানুষটি এই মুহূর্তে কী করছে? সেহেরের নাম না জানা এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিলো মুচকি হাসির রেখা। দোলনায় ঠেস দিয়ে বসলো। গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো, ‘ঠিক এই মুহূর্তে আমি সেহের ভীষণ ইম্পোর্টেন্ট কাজে ব্যস্ত আছি। আমিতো আর আপনার মতো অকর্মা মানুষ নই। সব কাজ একাই সামলাতে হয়।’
‘ওয়েট ওয়েট। আই মিন তুমি বলতে চাইছো আমি কোনো কাজ করিনা? যা করো সব তুমি? মানে পুরো পৃথিবীতে একমাত্র কর্মঠ লোক, আর তোমার কর্মের দ্বারা পুরো পৃথিবীর মানুষ খেয়েপড়ে বেঁচে আছে? ওহ নো সেহের..তোমার এই লজিকটা আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, তাঁরা মানবোনা।’
‘আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসেনা।।সব কাজ আমি একাই করতে পারি।’
পূরব বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক আছে মানলাম। তুমি অসুস্থ হলে তো নিজের সেবা নিজেই করতে পারো তাইনা? সারারাত জেগে থাকা থেকে শুরু করে হসপিটালে যাওয়াটা তো তুমি একাই করো। আর মাঝেমধ্যে হুটহাট চুমু তো তুমিই দাও তাইনা? এই অসম্ভব কাজগুলো তুমি পারো ভাবতেই আমার প্রাউড ফিল হচ্ছে। তোমার মতো কর্মঠ বউ পেয়ে সত্যিই আমি ধন্য।’
সেহের অভিমানী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপনি কী এমনই বেহায়া? আগেও এমন ছিলেন? আচ্ছা, কতজনের সঙ্গে আপনার আগে রিলেশন ছিল? ক’টা মেয়ে আপনাকে চুমু দিয়েছে?’
পূরব ওর অভিমান স্পষ্ট বুঝতে পেরে মজা করে বলল, ‘তা জেনে তোমার কী হবে? আমি সেলিব্রিটি মানুষ, কত মেয়ের চুমু খেয়েছি তা তো গুণে রাখিনি। তবে এদের মধ্যে বেস্ট ছিল একজনই। ওকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবোনা।’
সেহেরের চোখে জল টলমল করছে। শুধু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা বাকি। রাগ করে ফোন কেটে দিলো। পূরব একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে তাহলে সেহেরকে কেন বিয়ে করতে চায়? নাহ, ও যখন ওই মেয়েকে কোনোদিন ভুলতেই পারবেনা তাহলে সেহেরের ওকে বিয়ে করা উচিৎ হবেনা। অন্য কাউকে ভালোবাসবে আর সংসার করবে ওর সাথে তা কি করে হয়! সেহেরের দোলনায় মাথা এলিয়ে বসে রইলো। মৃদু হাওয়ায় ওড়না উড়ছে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এবার কেঁদেই ফেললো সে। কান্না শুনে সুমা, শিলা ছুটে এলো ওর কাছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সেহের কান্নারত কন্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘আমি ওনাকে বিয়ে করবোনা৷ বিয়ে ক্যান্সেল করে দে সুমা।’
ওরা দুজন হতভম্ব। সুমা সেহেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পূরবকে ফোন করে বললো সেহের ওকে বিয়ে করবেনা। যা যা ঘটেছে তার সব বলতেই ও হু হা করে হেসে উঠলো। সুমা অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইয়া আপনি হাসছেন? তার মানে আপনিও বিয়ে করতে চাননা?’
পূরব হেসে বললো, ‘তোমার গাধী বান্ধবীকে ফোনটা পাস করো।’
‘ও আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেনা।’
‘ওকে বলো আমার সেই প্রিয় মানুষটা সেহের নিজেই।’
সুমা বুঝতে না পেরে বলল, ‘কীসের মেয়ে?’
‘কিছুনা। সেহেরের কাছে ফোন দিয়ে তোমরা চলে যাও। আমি বুঝিয়ে বলছি।’
অগত্যা সুমা সেহেরের হাতে জোর করে ফোনটা ধরিয়ে শিলাকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। সেহের পূরবের ফোন বারবার কাটতে লাগলো। একসময় বাধ্য হয়ে ধরলো। পূরব সবটা ওকে বুঝিয়ে বলতেই নিজের কাছে নিজেই বোকা প্রমাণিত হলো সে। রেগে বলল, ‘আমার সাথে এধরণের মজা একদম করবেন না চোরমশাই।’
পূরব বলল, ‘আমার প্রিয় বলতে তুমিই আছো। অনেক ভালোবাসি আমার প্রিয় তুমিটাকে।’
সেহের চোখ মুছে গভীর কন্ঠে বলল, ‘কখনো ভুলে যাবেন না তো? সেলিব্রেটিরা নাকি বিয়ের পর সব ভুলে যায়? এমন হলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব!’
পূরব বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া আর কোনোকিছু তোমাকে ভুলাতে পারবেনা আমার মন থেকে। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।’
সেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম।’
সারারাত এভাবে কথা বলতে বলতে কেটে গেলো। সম্পর্ক হওয়ার পরে আজ প্রথম সারারাত কথা হলো দু’জনের মধ্যে। ভোররাতের দিকে ঘুমাতে গেল দুজন। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠে পড়লো সেহের। চাচা বাজারে যাবেন, সব লিস্ট ওর চাচী নিজের হাতে করে দিলেন। সেহেরের চাচাতো দুই ভাই বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ে খেতে এসেছে। তাছাড়া প্রতিবেশী আর কাছের আত্মীয়রা মিলে পঞ্চাশজনের মতো মেহমান হলো ওদের বাড়িতে।
মেহমানদের মধ্যে কেউ কেউ সেহের খুব প্রশংসা করলো আবার কেউ কেউ কটু কথা শোনাতেও পিছপা হলোনা। এত বড় মাপের একটা ছেলে কী দেখে এই এতিম মেয়েকে পছন্দ করেছে খোদা জানেন। তবে এসব কথা সেহেরের কর্ণগোচর হলোনা, আর হলেও সেহের পাত্তা দিতোনা। বিগত দিনগুলোতে ও একাই যুদ্ধ করে এতদূর এসেছে, আজ তাঁদের কথায় কেন ও পাত্তা দিবে? ওদের কথা শুনলে কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবেনা, তাই সেসব না শোনাই ভালো।
সারা বাড়িতে বিয়ের আমেজ। শেফা, রিমি ওরা এসে হাজির হলো বিকেলের দিকে। সেহের ভীষণ খুশি। এর মধ্যে পূরব দু-বার ফোন করে খোঁজখবর নিলো। ওর গায়ে-হলুদের আয়োজন করা হচ্ছে। সারা বাড়ি গেস্টে ভর্তি। মিনিট খানিক কথা বলে ফোন রেখে দিলো
সেহের। একটু পরে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। হলুদ দিয়ে গোসল করানো হলো। তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মানুষ কম থাকলেও জমকালো আয়োজন বলা চলে। দু-হাত ভরে মেহেদি, কাঁচা ফুলের গয়না আর হলদে-সোনালি শাড়িতে সেহেরকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো। ওর সাথে কালার কম্বিনেশন করে পূরবের পাঞ্জাবিটা কেনা হয়েছে। সুমা, শিলা, রিমি, শেফা সবাইকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। ওরা সবাই মিলে এক বাটি হলুদ সেহেরের মুখে মেখে দিলো। সেহের রেগে গেল। পুরো ভূত বানিয়ে দিয়েছে ওকে। আচ্ছামত ধমক দিলো ওদেরকে। শেফা ওর চেহারা দেখে হাসতে হাসতে অনেকগুলো ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলো পূরবকে।
পূরব এত এত মানুষের মাঝখানে দম ফেলার জো পাচ্ছেনা। তার নানা বাড়ি, দাদা বাড়ির লোকজন, বাবার বন্ধুরা, ওর বন্ধুরা, তাছাড়া পরিচিত সব ব্যবসায়ী, ডিলারসহ ব্যবসার খাতিরে তৈরি হওয়া সব লোকজন এসেছে। হঠাৎই ফোনে সেহেরের মিষ্টি ছবিটা দেখে ওর খুব ভালো লাগলো। গালে হলুদ ভর্তি। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা ওর থেকে। আরও একবার নতুন করে ওর মায়ায় ডুবে গেলো পূরব, নতুন করে আবার ভালোবেসে ফেললো প্রিয় তুমিটাকে। আর একটা দিন, তারপর সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ওর জীবনে পদার্পণ করবে এই মেয়েটি। কত ভালোবাসে সেহেরকে, তা যদি সেহেরকে বোঝাতে পারতো! আর কয়েকটা ঘন্টা, তারপর সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়বে একে-অপরের সাথে।
চলবে..ইনশাআল্লাহ!