#গল্পঃ প্রেমকাব্য,পর্বঃ০৫
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
দেখতে দেখতে তাহিমের অফিসের পার্টির দিন চলে আসে।সবাই তাহিমের অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নেয়।দোলন এখনো আসছেনা তাহিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় চেইক করছে।
ঘড়ি থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাতেই কালো শাড়ি পরিহিত এক রমনীকে আবিষ্কার করলো তাহিম।চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেওয়া,কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ,কাঁধ থেকে হালকা নিচে চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে শাড়ির সাথে।ব্যস এতেই দোলনের সৌন্দর্য উপছে পড়ছে।তাহিম অপলক চেয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করে নেয়।
নাজমা বেগম দোলনের থুতনিতে হাত রেখে বললেন,বাহ কি মিষ্টি লাগছে আমার মেয়েটাকে।তানজু খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,ওয়াও আপু তোমাকে কি সুন্দর লাগছে।ভাইয়ার অফিসের সব ছেলেরা আজ তোমাকে দেখে ফিদা হয়ে যাবে।
দোলন মিষ্টি হেসে বলল,তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।
তাহিম উবার বুক করেছে সবার জন্য।পেছনের সিটে তানজু,নাজমা বেগম আর দোলন বসেছে।তাহিম ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটে বসেছে।দোলন তানজুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।তাহিম লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দোলনকে দেখছে যা নাজমা বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি।তিনি মুচকি হেসে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।গাড়ি এসে অফিসের সামনে থামতেই
সবাই নেমে ভেতরে চলে যায়।অফিসের ভেতরে খুব সুন্দর করে পার্টির এরেন্জ করা হয়েছে।
সবাই পার্টিতে উপস্থিত হতেই শায়েখ চৌধুরী সামনে গিয়ে এনাউন্স শুরু করলেন।
আপনারা হয়তো কেউই জানেন না আজকের এই পার্টির উদ্দেশ্য কি।আজকের পার্টির মূল উদ্দেশ্য হলো কিছুদিন আগে আমরা একটা ডিল হাতে পেয়েছিলাম।কিছু ঝামেলার কারনে তখন সেলিব্রেট করা হয় নি তাই আজকে আমি এই পার্টির ব্যবস্থা করলাম।তার সাথে আরো একটি কারন আছে সেটা হলো মিঃতাহিম আহমেদ এর প্রমোশন হয়েছে।তিনি এখন থেকে সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করবেন।
শায়েখ চৌধুরীর কথায় তাহিম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।সবাই জোরে করতালি দিয়ে তাহিমকে অভিনন্দন জানাতে লাগলো।তাহিমের মা,তানজু,দোলন সবাই খুব খুশি।
শায়েখ চৌধুরী তাহিমকে সামনে এসে নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বললেন।তাহিম নাজমা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি চোখের ইশারায় যেতে বললেন।
তাহিম সামনে গিয়ে প্রথমেই সালাম দিলো সবাইকে।
একজন বলে উঠলো স্যার আমরা আপনার সাফল্যের পেছনের কাহিনী শুনতে চাই।তার সাথে সমস্বরে সবাই সম্মতি জানায়।
তাহিম জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলে আমার সফলতার পেছনে আমার পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি।আগে এখনকার মতো সচ্ছল অবস্থা আমাদের ছিলোনা।আমার ছোট বোন তখন তিন বছরের।আমি আর আফার পড়ালেখার খরচ সাথে সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে বাবা হিমশিম খেতেন।আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো আমি পড়ালেখা করে ভালো কিছু করবো বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবো।আমার আগ্রহ আর বাবার অবস্থার কথা বিবেচনা করে ভালো স্টুডেন্ট হওয়া স্বত্বেও আমার আফা পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়।এখন শুধু আমার পড়ালেখার খরচ।আফাকে ঘরে বসিয়ে না রেখে ভালো পাত্র পেয়ে বাবা বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।আমার এসএসসি পরীক্ষার পরই বাবা মারা যায়।কথাগুলো বলতে গিয়ে তাহিমের চোখের কোনে জল জমা হয়।হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে খুব সন্তর্পণে চোখের কোনের জল মুছে তাহিম আবার বলে,তখন থেকে শুরু হয় আমার যুদ্ধ,মায়ের যুদ্ধ।বাবা চলে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম বাবা নামক ছায়াটা সন্তানের জন্য কতটা জরুরি।
তারপর টিউশন শুরু করলাম।অনেক কষ্ট করতে হয়েছে টিউশন জোগার করতে।পড়ালেখা ছাড়লাম না।মা বলে দিয়েছে যত কষ্টই হোক মা সামলে নিবে আমি যাতে পড়ালেখা না ছাড়ি।তখন রোগা পাতলা গড়ন ছিলো আমার টাকা পয়সা ছিলো না।দু’একজন ছাড়া তেমন কেউই ভালোভাবে কথা বলতে চাইতো না।আমার ও তখন উদ্দশ্য ছিলো পড়ালেখা করা।তাই কারো সাথে কথা বলে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করতাম না।কেউ কেউ পড়ালেখার খাতিরে কথা বলতো।তবে আমার যে বন্ধু ছিলেনা এমন না।দুজন বন্ধুকে আমি আমার পাশে পেয়েছি।অনেক কষ্টে পড়ালেখা করে যেদিন ভালো রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়েছি মা আমাকে জড়িয়ে খুশিতে কান্না করেছিলেন।আমার চাকরি হলো কষ্টের দিন কেটে গিয়ে সুখের মুখ দেখলাম।তাহিম তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,আগের তাহিম আহমেদকে মেয়েরা পছন্দ করতো না আর এই তাহিম আহমেদের পেছনে অনেক রমনীর ভীড়।
তাহিমের কথায় শুনে অনেকের চোখে পানি চলে এসেছে আবার অনেকের মনে অনুপ্রেরণা জন্মেছে।নাজমা বেগম চোখের জল মুছে হাসি মুখে ছেলের দিকে তাকালেন।দোলন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তাহিমের দিকে।এই মানুষটা কতটা কষ্ট করেছে আর আমি ছোটবেলা থেকে বাবার আদরে বড় হয়েছি।কষ্ট কি জিনিস বুঝতেই পারিনি।আমার জীবনে একটাই অভাব ছিলো সেটা “মা”। নাজমা আন্টির কাছ থেকে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।কিন্তু কথায় আছে না মায়ের তুলনা একমাত্র মা নিজেই।
পার্টি শেষ হতেই সবাই নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।গাড়ি কিছুদূর যেতেই তানজু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে।তাহিম পেছন ঘুরে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তানজু বায়না ধরলো সে আইসক্রিম খাবে।নাজমা বেগম চোখ গরম করে বললেন,আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।তানজু মুখ ফুলিয়ে বলল,একটা খেলে কিছুই হবেনা।আজতো তোমার ছেলের প্রমোশন হয়েছে আমাদেরকে ট্রিট দিতে হবে না?
তাহিম গাড়ি থেকে নেমে বলল,তুই বস আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।নাজমা বেগম বলে দিয়েছেন উনার জন্য যেন না আনে উনি খাবেন না।
তাহিম মাথা নেড়ে নাজমা বেগমের কথায় সায় জানিয়ে চলে গেলো আইসক্রিম আনতে।দুইহাতে দুই ফ্লেভারের দুটো আইসক্রিম এনে একটা তানজুর হাতে দিয়ে চকলেট ফ্লেভারেরটা দোলনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
দোলনের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম পছন্দ তাই তাহিম দোলনের জন্য চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম নিয়ে এসেছে।চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম দেখে দোলন মুচকি হেসে খেতে শুরু করে।দোলনের মুখে হাসি দেখে তাহিম ও হালকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে।
বাসায় এসে দোলন শাড়ি চেঞ্জ করে নেয়।এই কালো শাড়িটা ওর বাবার সাথে গিয়ে কিনে এনেছে।দোলনের বাবার আলমারিতে এখনো ওর মায়ের অনেকগুলো শাড়ি আছে।শাড়ি পড়তে ওর কাছে ভালো লাগে।আগে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পড়লেও এখন শাড়ি পড়াটা শিখে গেছে।
আজ আর স্যার পড়াতে আসেন নি।ফ্রেশ হয়ে বাবার রুমের দিকে গেলো।মেয়েকে দেখে দেলোয়ার হোসেন মুচকি হেসে বললেন,আজকে ঘুরাঘুরি করে কেমন লাগলো?
দোলন ভ্রু কুচকে বলল,ঘুরলাম কোথায়?যাস্ট গাড়িতে করে গিয়েছি আবার গাড়িতে করে বাসায় ফিরেছি।
দেলোয়ার হোসেন জোরে হেসে দেয়ে বললেন,তা পার্টিতে কেমন লাগলো?
দোলন হালকা একটু ভাবুকের ভঙ্গি করে বলল,ভালোই লেগেছে।
দেলোয়ার হোসেন খাট থেকে নামতে নামতে বললেন,আমি রান্না করেছি ডিনার করবে চলো।দোলন ভ্রু কুচকে বলল,তুমি রান্না করেছো মানে?আজকে রহিমা খালা আসেনি?
দেলোয়ার হোসেন বললেন,না আমি নিজেই না করে দিয়েছি।মন চাইলো তাই রান্নাটা আমিই করলাম।দোলন বলল,তাড়াতাড়ি চলো তুমি রান্না করেছো শুনে আমার পেটে ইঁদুর দৌঁড়ানো শুরু করে দিয়েছে।
দেলোয়ার হোসেন হেসে দিয়ে বললেন,চলো।
বাবা মেয়ে দুজনে ডিনার করে এসে শুয়ে পড়েছে।
আজ ঘুম থেকে উঠতে দোলনের একটু দেরি হয়ে গেলো।ভাবছে আজ আর প্রাইভেটে যাবেনা।পরে ভাবলো থাক পড়া গ্যাপ দিলে পরে আর এগুলো পড়তে মন চায় না।তাই ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও রেডি হয়ে প্রাইভেটে চলে গেলো।আজকে তাহিম বাইক নিয়ে দোলনের বাসার সামনে এসেছে।উদ্দেশ্য দোলনকে বাইকে করে কলেজে পৌঁছে দেবে।কিন্তু এখানে এসে দারোয়ানের কাছে শুনলো দোলন নাকি দশমিনিট মিনিট আগে রিকশা দিয়ে চলে গেছে।অগত্যা তাহিমকে একা একাই ফিরে আসতে হলো।নিজের অফিসের দিকে চলে গেলো।আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে দোলনকে কলেজ থেকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।মেয়েটার সাথে সব সময় রুড ব্যবহার করে ফেলে তাহিম তাই ভাবছে আজ একটু শহরের বাইরে গ্রামের দিক থেকে ঘুরিয়ে আনবে।
দোলন একা রিকশায় সামনে রিকশা চালক এছাড়া রাস্তায় তেমন কেউ নেই।দু’একজনকে দেখা যাচ্ছে নিজেদের কাজে তারা ব্যস্ত।আশেপাশে কি হচ্ছে সেসবে মন দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই।দোলন রিকশায় বসে পাশের গাছপালা গুলো দেখছে।যেন মনে হচ্ছে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় দোলন গাছ গুলোকে হারিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।যখন বাসে বা সিএনজিতে উঠে তখন বেশি ভালো লাগে এই দৃশ্যটা।
হঠাৎ রিকশা থেমে যেতেই দোলন কিছু বলবে সামনে তাকিয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেছে।সেদিনের কলেজের ছেলেগুলো রিকশাটাকে ঘিরে ধরেছে।রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে না।দোলন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,পপথ ছাড়ো।ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হেসে বলল,ওমা পাখি দেখি ভয় পাচ্ছে।
দোলন ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে বলল,দেখো আমার পথ ছাড়ো নইলে কিন্তু ভালো হবেনা বলে দিলাম।আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠে বলে,করো চিৎকার দেখি কে আসে তোমাকে বাঁচাতে।
রিকশাচালক কিছু বলতে নিলেই একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।জোরজবরদস্তি করে দোলনকে টেনে নিয়ে যায় ছেলেগুলো।
#চলবে……।