প্রেমকাব্য,পর্ব_০২

0
1562

#গল্পঃ প্রেমকাব্য,পর্ব_০২
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

দোলন কিছুদূর যেতেই একটা রিকশা এসে থামে সামনে।কালক্ষেপণ না করে দোলন রিকশায় উঠে পড়ে।রিকশা এসে কলেজের গেইটে থামতেই দোলন ভাড়া মিটিয়ে আসতে চাইলে রিকশাওয়ালা বলেন,স্যার ভাড়া দিয়া দিছে।
দোলন কপালে ভাঁজ ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে।সাধারণত মেয়েদের কপালে ভাঁজ পড়েনা।ছেলেরা বিরক্তি প্রকাশ করলেই তাদের কপালে ভাজ দেখা যায়।দোলন বলল,কোন স্যার ভাড়া দিয়েছে?
রিকশাওয়ালা হাত উঁচিয়ে বললেন,ওই যে বাইকওয়ালা স্যার উনিই আমারে পাঠাইছেন আপনারে কলেজে পৌঁছাইয়া দিতে সাথে ভাড়াও দিয়া দিছে।
দোলন মুখ বাঁকিয়ে কলেজের ভেতর চলে গেছে।বাইকে করে আনতে পারলোনা এখন রিকশা পাঠিয়ে ঢং করতেছে যত্তসব আদিখ্যেতা হুহ।

প্রাইভেট শেষ করে সবাই মিলে বের হওয়ার সময় পেছন থেকে কেউ একজন দোলনের পিঠে চাপড় মেরে উঠে।তড়িৎগতিতে পেছনে ঘুরতেই তেমন কাউকে ঠাওর করতে পারলো না দোলন।দোলন এটা নিশ্চিত ওর পিঠে যে চাপড় মেরেছে সে একজন ছেলে।তার হাত ছিল শক্তপোক্ত পুরুষালি কোনো মেয়ের হাত এতটা শক্ত নয়।দোলনের যতটা না অস্বস্তি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি রাগ লাগছে।
একে একে সব স্টুডেন্ট বেরিয়ে তাদের ক্লাসের দিকে চলে গেলো আর দোলন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
পেছনে কেউ শিষ বাজিয়ে বলল,আজকের ছোঁয়া টা কেমন ছিলো?
দোলন পেছন ঘুরে তাকাতেই যে এই কথাটা বলেছে সে সহ আরো কয়েকটা ছেলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
মুহূর্তেই রাগে গা রিরি করে উঠলো দোলনের।আশপাশ কোনো কিছু না দেখেই সজোরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির গালে চড় বসিয়ে দিলো।
ছেলেটি গালে হাত দিয়ে চোখমুখ লাল করে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে দোলনের দিকে।

দোলন আঙ্গুল তুলে বলল,এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তোমাদের বখাটেপনা করার জায়গা নয়।আর কার সাথে বেয়াদবি করেছো তুমি?তুমি জানো আমি তোমার সিনিয়র।তোমাদের সাথে পরীক্ষা দেবো তারমানে এই নয় তোমরা যা খুশি করতে পারো।দ্বিতীয়বার এরকম বেয়াদবি করতে আসলে ফল ভালো হবেনা।এখনতো শুধু চড় মেরেছি পরে সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেবো বেয়াদব ছেলে।
দোলন চলে আসতেই ছেলেগুলো তেড়ে দোলনকে ধরতে যাবে তার আগেই চড় খাওয়া ছেলেটি ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,পাখি কি বলেছে শুনিসনি?এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।এখানে বখাটেপনা চলবেনা।তারমানে বাইরে চলবে সেই হিন্টস দিয়ে গেলো আমাদের বুঝিসনি? বলেই কুৎসিতভাবে হেসে উঠলো।পাশের ছেলে গুলোও হো হো করে হেসে দিলো।
একটা রিকশা ডেকে দোলন বাসায় চলে এসেছে।

অফিসের কাজ কিছুটা কমিয়ে ক্লান্ত,ঘর্মাক্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝে রইলো তাহিম।সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করে যেতে হয়।মাঝখানে লাঞ্চ টাইমে ব্রেক আছে।তাহিম সহ আরো একজন আছে নাম রুমা যার কাজে বস সন্তুষ্ট।এরা দুজন কাজে অত্যন্ত দক্ষ।তাহিম পেশায় একজন আর্কিটেক্ট।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে রিলাক্স করার মাঝেই পিয়ন দরজায় নক করলো।তাহিম উনাকে ভেতরে আসতে বলে আবারো চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়।

স্যার আপনাকে বড় স্যার উনার কেবিনে ডেকেছেন বলেই পিয়ন চলে যায়।তাহিম লম্বা দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেকে পিট পাট করে বসের কেবিনে গিয়ে নক করলো।তাহিমের বস শায়েখ চৌধুরী একগাল হেসে দিয়ে বললেন,কাম মাই বয়।উত্তরে তাহিম ও মুচকি হাসি দেয়।শায়েখ চৌধুরী পিয়নকে দুটো কফি দিয়ে যেতে বলেন।
তাহিম সাবলীলভাবে শায়েখ চৌধুরীকে প্রশ্ন করলো,স্যার এনিথিং রং?আমাকে ডেকে পাঠালেন।
শায়েখ চৌধুরী মুচকি হেসে বলল,তোমাকে ডেকেছি একটা প্রস্তাব দেওয়ার জন্য?
তাহিম অবাক হয়ে বলল,কিসের প্রস্তাব?

শায়েখ চৌধুরী হাত দুটো একসাথ করে টেবিলের উপর রেখে বলেন,আমার এক ফ্রেন্ড তার মেয়ের জন্য ভালো একটা ছেলে খুঁজছে।আমাকে বলায় আমি তোমার কথাটা ভেবে দেখলাম।আমাদের অফিসে তুমি একমাত্র ছেলে যে সবদিক থেকেই পারফেক্ট।আমি ওদেরকে কিছু বলিনি যদি তুমি চাও তাহলে আমার ফ্রেন্ডের মেয়ের সাথে দেখা করতে পারো।শি ইজ বিউটিফুল গার্ল!

তাহিম হালকা হেসে বলল,মা আমার জন্য অলরেডি মেয়ে দেখে রেখেছে।
শায়েখ চৌধুরী খুশি হয়ে বললেন,কংগ্রাচুলেশনস!তা তোমার পিয়ন্সের কোনো ছবি দেখার সৌভাগ্য হবে নাকি আমার?
তাহিম শব্দ করে হেসে দিলো সাথে শায়েখ চৌধুরী ও সামিল হলেন।তাহিম গ্যালারি থেকে খুজে দোলনের একটা ছবি বের করলো যেটাতে পাশে তানজু ও আছে।তানজু মাঝে মধ্যেই তাহিমের ফোন নিয়ে ছবি তুলে পরে নিজের ফোনে নিয়ে নেয়।সেরকম একটা ছবিতে সাথে দোলন ও ছিলো।এগুলো তাহিমের ফোন থেকে ডিলিট করা হয়নি।তাহিম ছবিটা শায়েখ চৌধুরীকে দেখাতেই উনি কনফিউজড হয়ে গেলেন।কারণ এখানে দুজনের ছবি আছে।উনাকে ভ্রু কুচকাতে দেখে তাহিম দেখিয়ে দিলো কোনটা দোলনের ছবি।শায়েখ চৌধুরী হেসে বললেন,তোমার মায়ের পছন্দ আছে।অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।তাহিম ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলল,মিষ্টি মেয়ে নাকি তিতা মেয়ে আপনি একদিন ওর সাথে থাকলেই বুঝে যাবেন।
শায়েখ চৌধুরী বললেন,কিছু বললে?তাহিম মেকি হেসে বলল,না স্যার কি বলবো?
ইতিমধ্যে পিয়ন কফি দিয়ে গেছে।তাহিম উঠতে গেলেই শায়েখ চৌধুরী বললেন,উহু!আগে কফি শেষ করে তারপর যেও।তাহিম ও সৌজন্যতার খাতিরে কফিটা শেষ করলো।

দোলন আজ আর তাহিমের বাসায় গেলো না।প্রতিদিন নিয়ম করে একবার হলেও যাওয়া হয়।কিন্তু আজকে কলেজ থেকে ফেরার পর থেকেই মুড অফ হয়ে আছে তাই আর তাহিমের বাসায় গেলো না।রাতে বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে নিজের ঘরে এসে বই নিয়ে বসে।পড়াগুলো এই নিয়ে তিনবছর ধরে পড়ে তবুও যেনো মনে হয় এটা পারলে ওটা পারিনা ওটা পারলে এটা পারিনা।মাঝেমাঝে মাথা হ্যাং হয়ে গেলে পড়ালেখা আবিষ্কারককে হাই লেভেলের গালি দেওয়া শুরু করে।মন চায় ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে ব্যাটার মস্তিষ্ক বের করে ফেলতে।ব্যাটার মাথায় এসব কুটিল বুদ্ধি কোত্থেকে এলো এটাই ভেবে পায়না দোলন।কিছুক্ষণ বই ঘাটাঘাটি করে এবার গল্পের বই নিয়ে বসলো মন ভালো করার জন্য।

তাহিম আজকে বাসায় দোলনকে না দেখে ভ্রু কুচকালো।সাধারণত তাহিম অফিস থেকে আসলেই দোলনকে সোফার রুমে দেখতে পায়।তারপর ভাবলো তানজুর ঘরে আছে নিশ্চয়ই।এসবে মাথা না ঘামিয়ে নিজের ঘরে চলে এসে সোজা শাওয়ারে চলে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে গেলো অথচ একবারো দোলনকে দেখা গেলো না ভেবে তাহিম অবাক হয়।পানি নেওয়ার জন্য নিচে আসতেই সোফায় বসে নাজমা বেগম আর তানজুকে দেখলো টিভি দেখছে।তাহিম এখানেও দোলনকে না দেখে নিশ্চিত হলো যে আজ দোলন আসেনি।কি ব্যাপার কালকের কথায় কি মাথায় সুবুদ্ধি এলো নাকি?সোফার দিকে তাকিয়ে তাহিমের উতালপাতাল ভাবনার মাঝেই নাজমা বেগম বলে উঠেন,যাকে খুজছিস সে আজ আসেনি।কালকে মেয়েটাকে কি না কি বলেছিস?

তাহিম হালকা গলা ঝেড়ে বলল,হাউ ফানি!ও আসলেই কি আর না আসলেই কি।আমি কেনো ওই বিচ্ছু মেয়েটাকে খুজতে যাবো?
তাহিম পানি নিয়ে উপরে চলে যেতেই নাজমা বেগম মুচকি হেসে টিভির দিকে মনযোগ দিলেন।তাহিম সিঁড়ি বেয়ে কিছুদূর গিয়ে তানজুকে উদ্দেশ্য করে বলল,সারাদিন টিভির সামনেই বসে থাকিস পড়ালেখা করা লাগবেনা।তারপর বিড়বিড় করে বলে একজনের সারাদিন নাচানাচি,ঘোরাঘুরি আরেকজনের টিভি হলেই চলে।এরা কিভাবে পারে এসব ডিজগাস্টিং।
তানজু আর বসে না থেকে আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে গেলো।নাজমা বেগম সিরিয়ালে নায়িকার দুঃখ দেখে চোখ মুছচ্ছেন।এরকম কোনো স্যাড সিন দেখালেই উনি ইমোশনাল হয়ে পড়েন।

রাতের খাবার খেয়ে দোলন ফোন হাতে নিলো।রাতের খাবার ওর বাবা ওকে খাইয়ে দেয়।দোলনকে দেলোয়ার হোসেন কখনো কোনো অভাব বুঝতে দেননি।কিন্তু মায়ের অভাবটা ও পূরণ করতে পারেননি।উনি চাইলেই পারতেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করে দোলনকে মা এনে দিতে। কিন্তু উনি ভেবেছেন আমি কাজের জন্য সারাদিন বাইরে থাকবো।যাকে আমার মেয়ের জন্য মা হিসেবে নিয়ে আসবো সে যদি আমার মেয়েটাকে মানতে না পারে?আমার মেয়েটা যদি কষ্ট পায়?এসব ভেবেই আর বিয়ে করেননি।
ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে যতই দেখছে সব কাশবনে গিয়ে ছবি আপলোড করার পিক।তাই দোলন নিজেও একটা পোস্ট দিলো।

“I wish!কেউ যদি আমাকে কাশবনে ঘুরতে নিয়ে যেতো?”

ছেলেরা সবাই হুমড়ি খেয়ে একেকজন একেক কমেন্ট করছে।কেউ বলছে আমিতো এক পায়ে রাজি তোমাকে নিয়ে কাশবন যেতে।কেউ বলছে তুমি থাকলে রাজি আমি ডাকবো কাজি।
হঠাৎ টুংটাং করে মেসেঞ্জারে মেসেজ আসতেই দোলন ওপেন করে দেখে তাহিমের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে,”তাড়াতাড়ি এই পোস্ট ডিলিট করো।নয়তো কাল তোমার খবর আছে।”
দোলন মেসেজ সিন করে রেখে দিয়েছে।হু কেয়ারস ভাব নিয়ে বলল,ব্যাটা তুই কে আমার খবর করার?আ’ম মাহিমা দোলন।
তারপর গান ধরলো।

“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবোনা।
ছেড়ে দিলে হাত পা ভেঙে মরে যাবে,
তখন দোষ আমার হবে।”
তাই রিস্ক নিতে চাইনা।

#চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here