#গল্পঃ প্রেমকাব্য,পর্ব_০৪
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
একটু পরই কেমিস্ট্রি টিচার আসবেন দোলনকে পড়াতে।বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেলে দোলন।কি দরকার এতবার এত টিচারের কাছে পড়া?আজকে স্যার আসুক আমার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যদি পড়ানো বাদ না দেয় তাহলে আমার নাম ও দোলন নয় হুহ।
সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত একঘন্টা পড়াবে।বিকালে বাসায় কেউ থাকেনা সন্ধ্যায় যেহেতু দেলোয়ার হোসেন বাসায় থাকেন তাই তাহিম স্যারকে বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় পড়াতে।
দোলন পড়ার টেবিলে বসে চুইংগাম চিবোচ্ছে।মনে মনে ফন্দি আঁটছে স্যার যেপাশে বসবে সে পাশেই টেবিলের নিচে চুইংগাম লাগিয়ে রাখবে।যাতে স্যার বসলে উনার হাটুতে চুইংগাম আটকে যায়।পরিকল্পনা মতে দোলন টেবিলের নিচে চুইংগাম লাগিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বসে আছে।স্যার আসার পর উনাকে সালাম দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।স্যার বই বের করতে বললেন।দোলন স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,স্যার পরিচয় দিবেন না?
স্যার একপলক দোলনের দিকে তাকিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,পরিচয় পরে ও দেওয়া যাবে সবার আগে ইম্পরট্যান্ট হলো পড়া।
স্যারের অগোচরে দোলন একটা মুখ ভেংচি দিলো।বেটা খারুশ যে আপনাকে ঠিক করেছে সে একটা খারুশ আপনি আরেকটা খারুশ।
বই বের করে প্রথম পত্রের প্রথম চ্যাপ্টার থেকে স্যার দোলনকে কিছু প্রশ্ন করলো।দোলন কয়েকটা পেরেছে কয়েটা পারেনি।তাই স্যার প্রথম চ্যাপ্টার থেকেই পড়ানো শুরু করলেন।পড়ানো শেষে স্যার উঠতে গেলেন কিন্তু টেবিলের নিচ থেকে হাটু বের করতে পারছেন না কিছুর সাথে হাটু বেজে আছে।স্যারের অবস্থা দেখে দোলন মুখ টিপে হাসছে।
জোর করে পা টেনে বের করে দেখেন প্যান্টের হাটুর দিক বরাবর চুইংগাম লেগে আছে।নাক সিটকে স্যার দোলনের দিকে তাকালেন।দোলন মাথা উঁচিয়ে বলছে,কি হয়েছে স্যার?
স্যার দোলনের দিকে তাকিয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,মিঃতাহিম আমাকে তোমার ব্যাপারে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে।কিন্তু তুমি যে চূড়ান্ত লেবেলে বাঁদর সেটা আমি এখন বুঝতে পারলাম।তবে তুমি ভেবোনা আমি তোমার বাঁদরামিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ানো ছেড়ে দেবো।আমিও জানি বাঁদর কিভাবে মানুষ করতে হয়।
দোলন চোরের মতো দৃষ্টি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।তাহিমকে হাজার খানেক গালি দিতে ইচ্ছে করছে।
স্যার দেলোয়ার হোসেনের সাথে কথা বলে চলে গেলেন।
দোলন ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে চলে গেলো।সেখান থেকে তাহিমের একটা ফরমাল ড্রেসআপ পরা ছবি বের করে।এই ছবিটা দুমাস আগে দূর থেকে জুম করে তুলেছিলো দোলন।তাহিমকে সব রকম ড্রেসেই ভালো লাগে ফরমাল ড্রেসে দোলনের কাছে একটু বেশিই ভালো লাগে।সেদিন একরাশ মুগ্ধতানিয়ে তাহিমকে দেখেছিলো দোলন আর সেই সময়টাকে ক্যামেরা বন্ধিকরে নেয়।ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে তাহিম বামহাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।ছবিটির দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসে দোলন।হঠাৎ মনে একটা ভাবনা এসে কড়া নাড়ে আচ্ছা আমিতো উনাকে পছন্দ করি কিন্তু উনিতো আমাকে একটু ও সহ্য করতে পারেনা।তাহলে আমাদের বিয়েটা কি যুক্তিযুক্ত?কোনো মানে আছে এই বিয়ের?উনিতো বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছেন তাহলে আমার কি করা উচিত?আমি কি উনাকে বলবো বিয়েটা না করতে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পাশে রেখে দেয় দোলন।
তাহিম দোলনের স্যারেকে কল দিয়ে পড়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,আপনি যা বলেছেন মেয়েটা তার থেকে ও ফাজিল।তারপর চুইংগাম লাগানোর কথা বলতেই তাহিম বলল,সরি স্যার!আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি পড়ানো বাদ দেবেন না।
স্যার তাহিমকে আশ্বস্ত করে বললেন,সমস্যা নেই এরচেয়ে ফাজিল স্টুডেন্টকে পিটিয়ে সোজা করে ফেলেছি ওকেও সোজা করে ফেলবো আপনি কোনো টেনশন করবেন না।
তাহিম চোখ দুটো কিঞ্চিৎ বড় করে বলল,না না মারতে হবে না।দু’একটা ধমক দিয়ে দিলেই হবে।বাবার একমাত্র মেয়ে কিনা পরে আপনাকেই বাদ দিয়ে দিবে ওর বাবা।
স্যারের সাথে কথা শেষ করে নিজের খুটিনাটি কিছু কাজ নিয়ে বসে পড়ে তাহিম।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে দোলন ভাবলো তাহিমকে বলে দেওয়া উচিত ও না চাইলে জোর করে বিয়েটা করার দরকার নেই।তাহিমকে এখন কল দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে অবশেষে ফোন হাতে নিয়ে কল দিয়ে বসে।রিং হয়ে কল কেটে যাচ্ছে কিন্তু তাহিম ফোন তুলছেনা।আরো একবার ট্রাই করে যখন দোলন ব্যর্থ হলো তখন ফোনটা পাশে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো।
তাহিম সোফায় বসে কাজ করছে।ফোন সাইলেন্ট মুডে খাটের উপর পড়ে ছিলো তাই আর বুঝতে পারে নি কল এসেছে।
নিজের হাতের কাজ শেষ করে রাত বারোটায় ফোন হাতে নিয়ে আলো জ্বালাতেই স্ক্রিনে দোলন নামটি জ্বলজ্বল কীরে ওঠে।দোলনের নাম্বার থেকে কয়েকবার কল আসাতে তাহিম কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে থাকে দোলন কেন কল দিলো?ওতো এরকম হুটহাট কল দেয় না।
কোনো কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই দোলনের নাম্বারে ডায়াল করে।
প্রথমবারে ফোন বেজে কল কেটে যায়।ফোনের আওয়াজে দোলনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতেই বিরক্ত হয় দোলন।কল কেটে যেতেই দোলন আবারো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।দ্বিতীয়বার ফোন বেজে উঠতেই দোলন হাতড়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,হ্যালো!
দোলনের ঘুম জড়ানো কন্ঠ কানে আসতেই তাহিম চোখদুটো বন্ধ করে নেয়।কেমন একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে এই কন্ঠে।যা তাহিমের মতো শক্ত মানুষের ভেতরের নরম খোলসটাকে বের করে আনার ক্ষমতা রাখে।
চোখ বন্ধ করে লম্বা দুটো শ্বাস নিয়ে তাহিম ভরাট কন্ঠে বলে ওঠে,তখন কেন কল দিয়েছিলে?দোলনতো হ্যালো বলেই আবার ঘুমে বিভোর হয়ে গেছে।
দোলনকে চুপ থাকতে দেখে তাহিম কয়েকবার গলার স্বর উঁচু করে দোলন বলে ডাক দেয়।শেষের ডাক একটু জোরে হওয়ায় দোলন ধড়ফড়িয়ে উঠে বল,হ্যাঁ!কি হয়েছে?চোর চোর চোর এসেছে।কই গেলো কেউ চোরটাকে ধরো।আস্তে আস্তে দোলনের কন্ঠস্বর ছোট হতে লাগলো।আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাহিম কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো।তারপর কল কেটে দিয়ে পেট চেপে ধরে দমফাটা হাসি হাসতে লাগলো।ঘুমালে এই মেয়ের মাথা ঠিক থাকেনা।
মুচকি হেসে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলে ওঠে দোলনচাপা।
পরেরদিন যথারীতি দোলন প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে।এখন একটু সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।কখন কে কি করে বসে বলা যায় না।প্রাইভেট শেষ করে দোলন বাসায় চলে আসে।তাহিমের অফিসে দুদিনপর পার্টি রেখেছেন শায়েখ চৌধুরী।শায়েখ চৌধুরী তাহিমকে বলে দিয়েছেন যাতে তাহিম তার ফ্যামিলিকে নিয়ে আসে সাথে দোলনকেও নিয়ে আসতে বলেছে।
কি উপলক্ষে পার্টি রাখা হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই শায়েখ চৌধুরী তাহিমকে জবাব দিলেন সেটা নাহয় পার্টির দিনই জানবে।
তাহিম নাথা নেড়ে শায়েখ চৌধুরীর কথায় সম্মতি জানিয়ে নিজের কেবিনে চলে আসে।
দুপুরের খাবার খেয়ে দোলন তাহিমের বাসায় চলে আসে।নিজের বাসায় একা একা ভালো লাগেনা।এখানে এলে তানজুর সাথে আড্ডা দেওয়া যায়।দোলন তাহিমের বাসায় আসতেই দেখলো নাজমা বেগম মুখ কালো করে বসে আছেন।দোলন তানজুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজ নাকি সিরিয়ালের কোন নায়িকার সংসারে ভাঙ্গন ধরেছে।সিরিয়ালটা দেখার পর থেকেই নাজমা বেগম মুখ কালো করে বসে আছেন।দুপুরেও ঠিক করে খায়নি।
দোলন ঠোঁট চেপে হাসলো।নাজমা বেগমকে কোনোরকম শান্তনা দিয়ে তানজুকে নিয়ে ছাদে চলে গেলো।তানজু কয়েকবার না করেছে এখন ছাদে রোদ থাকবে।এই রোদের মধ্যে কোন পাগলে ছাদে যায়?কিন্তু দোলন জোর করেই তানজুকে ছাদে টেনে নিয়ে যায়।
বিকালের পর সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে তাহিম বাসায় ফিরলো।ড্রইংরুমে সবার সাথে দোলনকে একনজর দেখে নিজের ঘরে চলে গেলো।একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলো।দোলন তাহিমকে আসতে দেখে মিনিট পাঁচেক পর তাহিমের রুমে গেলো।আর দেরি করা ঠিক হবে না তাহিমকে বলে দেওয়া উচিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলে যাতে বিয়েটা না করে।তাহিমের বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে দোলন।তাহিম শাওয়ার নিয়ে খালি গায়ে রুমে ঢুকে।পরনে শুধু একটা ট্রাউজার আর কিছু নেই।ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজে দোলন সামনে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে।
কি একটা লজ্জাজনক ব্যাপার।দোলন কখনো তাহিমকে এরকম খালি গায়ে দেখেনি।
নিজের খাটের উপর দোলনকে বসে থাকতে দেখে তাহিম কপট রাগ নিয়ে বলল,তুমি এখানে কি করছো?দোলন অন্যদিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,আসলে আমার কিছু ককথা ছছিলো।আমি এখন যযাই পপরে আসবো।দোলন চলে আসতে নিলেই তাহিম পেছন থেকে দোলনের হাত টেনে দোলনের পিঠের সাথে বুক ঠেকিয়ে দাঁড়ায়।দোলনের কানের কাছে মুখ নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,যা বলতে এসেছো সেটা বলা শেষ করে তারপর যাবে।দোলনের ঘাড়ে তাহিমের প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে।
দোলনের শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে।শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেছে,চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল,আমি পরে আসবো আগে আপনি কিছু একটা পড়ে নিন।
তাহিম এক ভ্রু উঁচু করে বলল,তুমি কি বলতে চাইছো আমি কিছু না পড়েই তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি?
দোলন নাক সিটকে বলল,ছিঃ!আমি কি এই কথা বলেছি আপনাকে?আমি বলেছি টিশার্ট পড়ে নিন।
তাহিম নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দোলনকে ছেড়ে দেয়।টিশার্ট পড়তে পড়তে বলে,কি বলতে এসেছো বলে তাড়াতাড়ি যাও।
দোলন কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে এমন সময় নিচ থেকে নাজমা বেগমের ডাকে তড়িঘড়ি করে নিচে চলে যায়।তাহিমকে আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না।
#চলবে……।