#গল্পঃ প্রেমকাব্য
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
শোনো মেয়ে!আমার মায়ের তোমাকে পছন্দ হয়েছে বলেই আমি তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি এর বেশি কিছুই না।
আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ হয়েছে বলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন?আপনার আমাকে পছন্দ না?
চোখ-মুখ কুচকে বিরক্তি সূচক শব্দ করে তাহিম বলল,এই জন্য তুমি আমাকে মাঝরাস্তায় থামিয়েছো?আমার কথা আমি আগেই বলে দিয়েছি এখন আমার পথ ছাড়ো ডিজগাস্টিং!
দোলন ভ্রু নাচিয়ে বলল,আপনার মা আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আপনি পছন্দ করেন না।সংসার কি আপনি করবেন নাকি আপনার মা?পূনরায় ভ্রু শিথিল করে হাত নাড়িয়ে বলে,আমি বাপু এরকম ছেলেকে বিয়ে করতে পারবোনা।কিছুদিন পরে দেখা যাবে আমাকে রেখে বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে এসেছেন তখন আমার কি হবে?
দোলনের ননস্টপ বকবকানি শুনে রাগে তাহিমের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।চোখ বন্ধ করে চোয়াল শক্ত করে তাহিম একটা ধমক দিলো,স্টপ!
তাহিমের ধমকে কেঁপে উঠে দু’পা পিছিয়ে যায় দোলন।এই ফাঁকে তাহিম বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।
দোলন চোখ বন্ধ করে দাঁত কিড়মিড় করে তাহিমকে গালি দিতে দিতে রিকশায় উঠে কলেজের পথে রওনা হয়।
দোলন কলেজে যাওয়ার পথে তাহিমকে বাইকে করে অফিসে যেতে দেখে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দেয়।গতকাল তাহিম দোলনের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াতে আজকে দোলন তাহিমকে জিজ্ঞেস করলো কেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো?তাহিম কি দোলনকে পছন্দ করে?কিন্তু তাহিমের কাছ থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে দোলন মুখটা ভার করে কলেজে যাচ্ছে।
দোলনের মা নেই।বাবার চাকরি সূত্রে তাহিমের বাসার পাশেই একটা বাসায় থাকে।তাহিমের বাসা থেকে দোলনের বাসা তিন মিনিটের পথ।দুটো বিল্ডিং পরপর ওদের একে অপরের বাসা কিন্তু একটা গলি ঘুরে যেতে হয়।দোলন গতবছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো।দুর্ভাগ্য বশত প্রথম পরীক্ষার দিনই তাহিমের বাইকের নিচে পড়ে ডানহাত ডান পা ভেঙে যায়।তাই গতবছর পরীক্ষা দিতে পারেনি।এই বছর পরীক্ষা দিবে।কলেজের স্যারের কাছে জুনিয়রদের সাথে প্রাইভেট পড়ে।দোলন এক্সিডেন্ট হওয়ার পর ওর ফুফু এসে ওদের বাসায় ছিলো যতদিন না দোলন সুস্থ হয়।তাছাড়া তাহিমের মা ও সকাল বিকাল দুবেলা এসে দোলনকে দেখে যেতেন।তখন থেকেই দোলনের সাথে উনার একটা গভীর ভাব হয়ে যায় আর এখন তাহিমের বউ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন।
দোলনের বাবা ও এই বিয়েতে মত দিয়েছেন।উনার অনুপস্থিততে তাহিমের মাই দোলনকে দেখে রাখেন।দোলনের বাবা দেলোয়ার হোসেন তো চাকরির জন্য সারাদিনই বাসার বাইরে থাকেন।রাতের বেলায় মেয়েকে একটু সময় দেন।
কলেজের সামনে এসে রিকশা থামতেই দোলন গেইটের ভিতর চলে যায়।ওর বান্ধবীরা সব এখন অনার্সের ছাত্রী।এখন যারা দোলনের সাথে পড়ে তাদের সাথে দোলনের খুব একটা ভাব নেই পড়ালেখা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া।তাই সোজা ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে পড়ে।স্যার আসলেই প্রাইভেট শুরু হবে।
সন্ধ্যার আগে কারো ডাকে চোখ মেলে তাকায় দোলন।ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে তানজুকে দেখে সোজা হয়ে উঠে বসে।হাই তুলতে তুলতে দোলন বলল,তুমি কখন এলে?
তানজু দোলনের ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলল,সেই কখন এসে তোমাকে ডেকে চলেছি তোমারতো খবরই নেই।এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো আম্মু তোমাকে বাসায় যেতে বলেছে।তোমার আর ভাইয়ার ফেভারিট বিরিয়ানি রান্না করেছে আম্মু।
দোলন এতক্ষণ ঝিমাচ্ছিলো বিরিয়ানির কথা শুনতেই দৌঁড়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,তুমি একটু দাঁড়াও আমি যাস্ট দু’মিনিটে ফ্রেশ হয়ে আসছি।ফ্রেশ হয়ে এসে খাটের উপর থেকে ওড়না নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে তানজুর সাথে বেরিয়ে পড়লো।
দোলন পেছন থেকে নাজমা বেগমের চোখ চেপে ধরতেই উনি মুচকি হেসে বললেন,আর চোখ ধরতে হবেনা ডাইনিং এ গিয়ে বসে পড় আমি তোর ফেভারিট বিরিয়ানি নিয়ে আসছি।দোলন দুহাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলে,তাড়াতাড়ি দাও আমার আর তর সইছেনা।সাথে তোমার হাতে বানানো টক আচারটাও দিবা।নাজমা বেগম হাসতে হাসতে বললেন,আচ্ছা ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।
দোলন একটা চেয়ার টেনে বসতেই তাহিম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।দেখে বুঝা যাচ্ছে মাত্র শাওয়ার নিয়েছে।শ্যামবর্ণের সুঠাম দেহের অধিকারী।সামনের চুলথেকে এখনো কিছু পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।গায়ের টিশার্ট হালকা ভেজা।এক কথায় অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী এই ছেলে।নিচে নেমে একটা চেয়ার টেনে বসে মোবাইলের দিকে মগ্ন হয়ে পড়ে।যেন আশেপাশে কেউ নেই।দোলন যে সেই কখন থেকে তাকিয়ে ওকে দেখছে সে পাত্তাও দিচ্ছেনা।
দোলন মুখ ভেংচি কেটে চোখ সরিয়ে নিলো তাহিমের উপর থেকে।ব্যাটা গোমড়ামুখো ভাব দেখলে বাঁচিনা হুহ।
তানজু ও একটা চেয়ার টেনে দোলনের পাশে বসে পড়ে।নাজমা বেগম বিরিয়ানি এনে সবাইকে সার্ভ করে দিতেই তাহিম আর দোলন কোনো দিকে না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করে।তানজু এক লোকমা মুখে দিয়ে ভাবছে এরা এমনভাবে খাচ্ছে যেন বিরিয়ানিই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ খাবার।
তাহিম আর দোলনের চোখের পলকেই খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।দুজনেরই আরেকটু বিরিয়ানি খেতে মনটা আকুপাকু করছে।সামনে প্লেটে রাখা বাড়তি বিরিয়ানির দিকে তাকিয়ে দুজনে দুপাশ থেকে টান দিলো।দোলন টানছে তারদিকে তাহিম টানছে তার নিজের দিকে।
দোলন চোখ বড় করে বলল,এটা আমার ভাগের অংশ তাই এটা আমি খাবো।তাহিম কিছুনা বলে চুপচাপ প্লেটটা নিজের দিকে টান দিয়ে নিয়ে নিলো।নিজের প্লেটে সবগুলো বিরিয়ানি ঢেলে খেতে লাগলো।দোলন কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছে তাহিমের দিকে।আমার সাধের বিরিয়ানি খেয়ে নিচ্ছেন আল্লাহ এই অবিচার সইবেনা।
তানজু এদের কান্ডে মিটিমিটি হাসছে।
তাহিম বিরিয়ানি শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিজের ঘরে চলে যায়।দোলন অসহায়ের মতো তাহিমের যাওয়া দেখছে।মানুষ এতো নিষ্ঠুট কিভাবে হতে পারে?এরকম একটা অবলা বাচ্চার থেকে বিরিয়ানি কেড়ে নিলো?এই ছেলেকে জীবনেও আমি বিয়ে করবো না।তাহলে এজীবনে আমার আর বিরিয়ানি খাওয়া লাগবেনা।সব এই ছেলে নিজের পেটে চালান করে দেবে।তবে চান্দু আমার থেকে বিরিয়ানি কেড়ে নেওয়া দেখো তোমাকে কি করে মজা দেখাই।মনে মনে বুদ্ধি এঁটে ঠোঁট বাঁকা করে হাসে দোলন।
তাহিম ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে অফিসের কিছু কাজ করবে বলে।কিন্তু তার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পাশের রুমে খুব জোরে জোরে গান চালিয়ে নাচছে দোলন।তানজুকে বললে সে ভয়ে না করে দেয়।তাহিম এসে দেখলে খবর আছে।ভাইয়ের চোখ রাঙানোতেই তানজু কুপোকাত হয়ে যায়।তাই দোলন একা একাই নাচছে।তাহিম বিরক্তিতে কানে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে।তারপরেও গানের আওয়াজ কানের পর্দা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে।রাগে গজগজ করতে করতে তাহিম তানজুর রুমে গিয়ে দেখে দোলন উরাধুরা নাচছে।এমনিতেও দোলন অনেক ভালো নাচতে জানে।নতুন একটা গান রিলিজ হলেই তার সাথে মিলিয়ে নাচ প্র্যাকটিস শুরু করে দেয়।
তাহিম এসে গান বন্ধ করে দিতেই দোলন থেমে যায়।তাহিমকে গান বন্ধ করতে দেখে তেড়ে এসে বলল,সমস্যা কি আপনার গান বন্ধ করলেন কেন?
তাহিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,ফুল সাউন্ডে এসব থার্ড ক্লাস গান চালিয়ে তুমি আমার কাজের বিঘ্ন ঘটাচ্ছো।আর এই বাসায়
এতক্ষণ কি তোমার?এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।পড়ালেখা নেই তোমার?যাও বাসায় যাও গো!
দোলন ত্যাড়া হয়ে বলল,বাসায় না গেলে কি করবেন?যাবো না আমি বাসায়।আজকে এখানেই থাকবো সারারাত গান বাজাবো,নাচবো,শুয়ে থাকবো তাতে আপনার কি?
তাহিম ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ও সোজা কথা শুনার মতো মেয়ে না।চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দেয়।দোলন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে আসে।হাতে ব্যাথা পেয়ে দোলন হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তাহিম হাত না ছেড়ে দরজা পর্যন্ত এনে দোলনকে বের করে দিয়ে বলে,এখনই বাসায় যাবে তুমি।গিয়ে পড়তে সবে গো ফাস্ট!
দোলন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,আপনি এটা ঠিক করলেন না ঘোর অপমান করলেন আমায়।আমি আর এই বাসায় আসবোনা।আপনার সাথে ব্রেকআপ আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর সাথে ব্রেকআপ।তাহিম দোলনের কথায় পাত্তা না দিয়ে দোলনের মুখের উপরে সপাটে দরজা লাগিয়ে দিলো।এই মেয়ে এখন কি বলেছে এসব ভুলে কাল সকালে আবারো এই বাসায় এসে উঠবে সেটা তাহিম ভালো করেই জানে।
দোলনকে বের করে দিয়ে শান্তি মতো ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।
নাজমা বেগম সারাবাড়িতে দোলনকে খুজে না পেয়ে তানজুকে দোলনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তানজু বলল,আমার ঘরেই ছিলো গান চালিয়ে দেখলাম নাচতেছে।আমি পাশের রুমে গেলাম সুমুর সাথে কথা বলতে ও কল দিয়েছিলো।তারপর রুমে এসে আর দেখলাম না ভাইয়ার ঘরে আছে কিনা দেখো।
নাজমা বেগম তাহিমের রুমে গিয়ে দোলন এই রুমে আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই তাহিম ল্যাপটপে চোখ রেখে স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো বাসায় চলে গেছে।
নাজমা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন,সেকি?বাসায় চলে গেছে অথচ আমাকে বলে যায়নি?দোলন বাসায় গেছে আমাকে বলে যায় নি এটাতো হতে পারেনা।সত্যি করে বলতো তুই কি করেছিস?নিশ্চয়ই তুই মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিস।
তাহিম মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে বলল,ওর সারাদিন এই বাসায় পড়ে থাকলে চলবে?পড়ালেখা করা লাগবেনা?এমনিতেই একবছর গ্যাপ গিয়েছে।
সেটাতো তোর কারনেই হয়েছে বলে নাজমা বেগম গটগট পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাহিম ওর মায়ের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ল্যাপটপে মনযোগ দিলো।
পরেরদিন সকালে তাহিম অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বাইক বের করতেই দোলন হুড়মুড়িয়ে এসে বাইকের পেছনের সিটে বসে পড়ে।আলিফ সরুচোখে দোলনের দিকে তাকাতেই দোলন বলল,আমি প্রতিদিন যার রিকশায় করে যাই আজকে সেই রিকশাওয়ালা মামা অসুস্থ উনি আসতে পারবেন না।আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।আপনার অফিসতো আমার কলেজের পরেই আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আপনি অফিসে চলে যাবেন।
তাহিম রুক্ষ কন্ঠে বলল,নামো বাইক থেকে কুইক।দোলন চোখ ছোট করে বলল,এরকম করছেন কেনো?
তাহিম দোলনের হাত চেপে ধরে বাইক থেকে নামিয়ে দিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেলো।
দোলন বাইক যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাহিমকে গালি দিতে লাগলো,ব্যাটা খারুশ,অসভ্য কোথাকার।
#চলবে….।