প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৮,১৯

0
1019

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৮,১৯
#আফসানা_মিমি
|আঠারো তম পর্ব |

” তোমরা দেখো গো আসিয়া,
আব্বা-আম্মায় আমায় কাইজ্জা করে
ধমকিয়া ধমকিয়া।”

সোফার ঘরে ফাহিমা ছাড়া সকলেই উপস্থিত। আলোচনা হচ্ছে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে। ফাহিমাকে শাস্তি স্বরূপ আজ সারাদিন রান্নাঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সেই সকালের কান্ডের পর থেকে ফাহিমা রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে সকলের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চাইছে আর বিলাপ সুরে গান গাইছে।
ফাহিমার বিলাপ আপাতত কেউ শুনছে না।
আজাদ সাহেব কানে তুলো গুঁজে খাতায় লিস্ট করছেন। আয়েশা আজাদ পাশে বসে ফোনে জায়গা খুঁজে চলছেন। রাইসা আয়েশা আজাদের পাশে বসে আপাতত শীতে কাঁপছে। আজকের কাদায় গোসল করে যেন রাইসার একশত তিন ডিগ্রি জ্বর এসে গিয়েছে এজন্য শপের মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে।
নাদিফ সোফায় বসে আড়চোখে রুপকে দেখেছে। রুপ মাত্র গোসল সেরে এসেছে। মাথার লম্বা কেশব ভালোভাবে মুছতেও সময় পায়নি। মাথায় কোনরকম ঘোমটা টেনে চলে আসে। নাদিফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অপরুপকে দেখছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। মাথায় লম্বাটে ঘোমটা দেয়া, চোখে চশমা। ঘোমটা হয়তো ভেজা চুল ডেকে রাখার জন্য দিয়েছে রুপ কিন্তু এই বেশেও নাদিফের কাছে পৃথিবীর সেরা অপরুপ মনে হচ্ছে। রুপ চশমার আড়ালে নাদিফের চাহনি লক্ষ্য করছে। কিছুক্ষণ পর পর নাদিফের মুচকি হাসি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না রুপের। রুপ নিজেকে সংযত করে নাদিফের নজর থেকে আড়ালে চলে যায়। অন্যদিকে ফিরে মুচকি হাসে।

রুপ জরুরি তলবে নিচে এসেছে। আজাদ সাহেব ডেকেছেন কিন্তু এখন উনার কোন সাড়া শব্দ নেই।

” বাবা-মা, চলে যাবো কি? তোমাদের ড্রামা কি আরো বাকী আছে?”

নাদিফের কথায় সকলে নড়েচড়ে বসেছে। ইতিমধ্যে আজাদ সাহেব কান থেকে তুলা বের করে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। আজাদ সাহেবের হাসির রহস্য উদঘাটন করতে পারছে না কেউ। অবশেষে আয়েশা আজাদ স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,

” কি হয়েছে তোমার? আরো কাদায় শরীর মাখাতে ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে হলে চলো। কাদায় এবার শরীর না মাখিয়ে, কাদা পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিবো।”

আয়েশা আজাদেরকথা শুনে আজাদ সাহেবের ভাবগতির কোন পরিবর্তন হলো না। উল্টো দাঁত কেলিয়ে বললেন,

” ভাবছি চব্বিশ নাম্বার হানিমুনটা সেড়ে ফেলি এই সুযোগে। চলো কক্সবাজার যাই সকলে।”

আজাদ সাহেবের কথা শুনে নাদিফ খুক খুক করে কাশি দিতে শুরু করে। রুপ নাদিফের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে দৌঁড়ে খাবারের টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে আসে নাদিফের জন্য। নাদিফের মাথার পেছনে হাত দিয়ে নিজে পান করিয়ে দেয় পানি। এদিকে নাদিফ পানি পান করা অবস্থায় রুপকে দেখছে। রুপ নাদিফের জন্য এতটা চিন্তিত ছিল যে দৌঁড়ে আসার জন্য রুপের মাথা থেকে ওড়না পড়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই রুপের। যার ফলে রুপের ভিজে থাকা মাথার চুল ললাটের উপর এসে পড়ে।

নাদিফের নিঃশ্বাস যেন ভারী হয়ে আসছে রুপকে এতটা কাছে দেখে। নিজেকে সংযত করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,

” এদিকে আমি নিজের প্রেয়সীকে ভালোবাসা বুঝাতে অক্ষম ঐদিকে আমার বাবা-মা হানিমুন করতে এখনও প্রস্তুত এই বয়সে। কবে বুঝবে তুমি অপরুপ! আমারও তো ইচ্ছে হয় বিয়ের পর হানি,,,,,,

রুপ পরের লাইন আর শুনতে ইচ্ছুক না। এজন্য নাদিফের ঠোঁটে হাত দিয়ে বসলো যেন লাগামহীন নাদিফ আর কিছু বলতে না পারে।
রূপের এমন কাজে নাদিফ হাসে এবং রুপকে লজ্জায় ফেলার জন্য আরেকটা কাজ করে বসে। রুপের হাতে নিজের অধর ছুঁয়ে দেয় সকলের অগোচরে। রুপকে আরো লজ্জায় ফেলে দেয়। রুপ লজ্জা পেয়েছে, ভীষণ লজ্জা। কিন্তু তবুও রুপ অটল নাদিফের ঠোঁট থেকে নিজের হাত সরালো না। সরালে নয়তো দেখা যাবে সকলের সামনে লাগামহীন, নির্লজ্জ নাদিফ বাকি কথা বলে বসেছে, এই ভয়ে।

এদিকে ফাহিমা রান্না ঘর থেকে বাহিরে কাশির শব্দ শুনে দৌঁড়ে আসে। নাদিফের ঠোঁটের উপর রুপের হাত খানা দেখে ফাহিমা নিজের মস্তিষ্কে নিজ বানানো ভাবনা বসায়। ফাহিমা ভাবে নাদিফের হয়তো কিছু হয়েছে। তাই বিচলিত হয়ে দৌঁড়ে সকলের সামনে এসে বলে,

” ইয়া আল্লাহ! ছোট ভাইয়ের তো বমি হবে মনে হচ্ছে! বমি তো হয় শুধু একটা কারণেই, পেট খারাপ হলে বা পেটে গ্যাস হলে। ভাইয়ার কি পেট খারাপ হয়েছে? এই রুপ তুমি ভাইয়ার মুখের সামনে থেকে হাত সরাবে না। নয়তো দেখা যাবে ছোট ভাইয়া এখানেই ওয়াক ওয়াক করে ভাসিয়ে দিচ্ছে।”

ফাহিমার কথা শুনে সকলে ফাহিমার দিকে রক্তিম চোখে তাকায়। এতে ফাহিমা ভয় পেয়ে যায়। সকলের উদ্দেশ্যে মিনমিন করে বলে,

“এবার আমি কোন কাজের কথা বলিনি। যা সত্যি তাই বলেছি। তবুও সকলে রেগে আছে কেন আমার উপর?”

আজাদ সাহেব এবার এগিয়ে আসলেন বোকা পুত্রবধূর দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” মা রে! আমার ঘরে গিয়ে দেখ, বুকশেল্ফের দ্বিতীয় তাকে হরলিক্সেরর বয়াম রাখা আছে। সেখান থেকে তিন চামচ হরলিক্স একসাথে মুখে পুড়বি তারপর সেটা পানি দিয়ে গিলে খাবি। তাহলে তোর মাথায় একটু বুদ্ধি সুদ্ধি হবে। যা মা! এখানে যদি আর এক মিনিট থাকিস! তাহলে তোর ক’ল্লা কাঁ’টা যাবে।”

আল্লাহ জানে ফাহিমা কি বুঝেছে। শশুরের কথা শুনে হাসি মুখে চলে গেল উপরে।

এদিকে রুপ সেই কখন নাদিফের ঠোঁটের উপর থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ফাহিমার কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছে রুপ এমনকি নাদিফের করা কাজেও বেশ লজ্জা পেয়েছে রুপ।
সকালে যখন ফাহিমাকে দিকে তাকাতে ব্যস্ত ঠিক তখন নাদিফ আরেকটা কাজ করে বসে। সকলের অগোচরে রুপের হাতের পিঠের অংশ চুমু খেয়ে বসে। এত রুপ আরো লজ্জা পায়। ছিটকে দূরে সরে যায় অনেকটা। নাদিফের দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে আয়েশা আজাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আড়চোখে দুষ্টু নাদিফের দিকে নজর রেখেই।

পরিবেশ থমথমে। কারোর মনের মধ্যে এখন ঘন্টা বাজছে, তো কারোর মনের মধ্যে সংশয়,আবার কারো মনে দুষ্টু বুদ্ধি। আজাদ সাহেব সকলকে স্বাভাবিক করার জন্য খানিকটা কেশে বলতে শুরু করলেন,

” আমি কখনো কথা দিয়ে কথার খেলাফ করিনি। আজও তাই। রাইসাকে বলেছিলাম ঘুরতে নিয়ে যাবো পরিবারের সকলের সাথে সুতরাং আমি আমার কথা রাখছি। আমরা আগামীকাল সারাদিন ঘুরবো, অনেক আনন্দ করবো, আগামীকাল শুধু পারিবারিক সময়; অফিস-আদালত, পড়াশোনা, ঘোরাঘুরি সব কিছু বাদ। বুঝেছ তোমরা দুজন?”
আজিদ সাহেব রুপ নাদিফের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। যখন নাদিফ রুপকে চোখে চোখে জ্বালাতন করে যাচ্ছিলো। আয়েশা আজাদের পাশে এসে রুপের সাথে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলছিলো। রুপ এবং নাদিফের কথাগুলো এমন ছিল,

” তুমি এত সুন্দর কেন অপরুপ?”

” আপনার নজর নিচে রাখুন। নজর লাগবে আমার উপর।”

” আমি তো আমার অপরুপের উপর নজর দিতে প্রস্তুত। যেন অন্য কেউ নজর দিতে না পারে।”

” আপনার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে, অন্ধ হয়ে যাবেন অতি শীঘ্রই। তারপর চৌমাথায় বসে থালা নিয়ে ভিক্ষা করবেন।”

নাদিফ তখন হেসে উঠে। নাদিফের হাসি দেখে রুপও হেসে ওঠে। এর মাঝে আজাদ সাহেবের কথা দুইজনের কর্ণধারের পৌঁছায় না। এতক্ষণ আজাদ সাহেবের বলা কথা একটাও এই দুইজন মানব-মানবী কানে পৌঁছেনি। রুপ অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে আজাদ সাহেবের দিকে। রুপ বিড়বিড় করে বলছে,

” নিজেতো কেস খাবে খাবে, আমাকেও সাথে খাওয়াবে। বজ্জাত লোক একটা।”

রুপের অবস্থা দেখেন নাদিফ মুচকি হাসে। বাবার উদ্দেশ্যে বলে,

” পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য নাদিফ সব সময় হাজির থাকবে। চিন্তা করো না গতকাল তোমার আগে আমি রেডি থাকবো। শুধু বলে দাও কোথায় যাবে।”

” আসলামপুর যাবো। তোর দাদার বাড়ি, চলবে?”

আজাদ সাহেবের কথা শোনে নাদিফ কিছু একটা ভেবে নিলো তারপর রুপের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বলল,

” তোমার বাসার শিক্ষিকাকে বলে দাও, এক সপ্তাহের জন্য যেন কোচিং থেকে ছুটি নেয়। কারণ দাদা বাড়ি গেলে এক সপ্তাহ আগে ফিরবো না আমরা। এখন আমার প্রস্তাব যদি তোমাদের ভালো থাকা লাগে তাহলে ভেবে দেখতে পারো।”

নাদিফ রূপের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে চলে যায়।
আজাদ সাহেব ছেলের কথায় ভীষণ খুশি। অনেকদিন হয় গ্রামে যাওয়া হয় না। আসলামপুরে আজাদ সাহেবের আপন কেউ বেঁচে নেই। শুধুমাত্র চাচাতো ভাই সন্তান স্ত্রী রয়েছে সেখানে। আসলামপুরের বাড়িতে দুইজন মানব মানবি থাকে দেখাশোনা করার জন্য।

ফাহিমা সকলের সামনে আসে মন খারাপ করে। ফাহিমা আড় পেতে সকলের কথা শুনেছে এতক্ষণ।

” মানছি আমি ভুল করেছি। তাই বলে আমাকে রেখে দাদা বাড়ি যাবেন বাবা?”

আজাদ সাহেবের খুব মায়া হলো ফাহিমার উপর। ফাহিমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে অনে।

” ব্যাগ গুছিয়ে নাও মা। তুমি সহ আমরা সবাই যাবো আসলাম পুরে। সুন্দর করে সাজবে কিন্তু মা! আমি আমার এই মাকে যেন সকলের আগে তৈরি দেখি।”

ফাহিমা বাবার কথায় খুব খুশি হয়। আয়েশা আজাদের দিকে তাকাতে আয়েশা আজাদও সায় জানায়।
——–
ঘরে এসে রাইসা টাকা গুনে যাচ্ছে । বিছানার উপর এক হাজার টাকার তিন চারটে নোট বিছিয়ে রাখে। রাইসার কান্ড দেখে রুপ প্রশ্ন করে,

” কি ব্যাপার রাইসা? টাকা এভাবে বিছিয়ে রেখেছো কেন? তোমার কি টাকা বেশি হয়েছে! বেশি হলে আমাকে দিয়ে দাও। এই মাসে আমি খুব অভাবে আছি।”

প্রতুত্তরে রাইসা বলে,

” গত মাসে দুইটা জামা কিনেছিলাম। এই মাসে ফোন। ভাবছি হাতে যেই টাকা আছে সেই টাকা দিয়ে আরো দুইটা জামা কিনবো। এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি। ভালো জামা না থাকলে কিভাবে হবে!”

রাইসার প্রফুল্লতা দেখে রুপ মলিন হাসে। রুপের এত ইচ্ছে নেই সাজগোজের, বিলাসিতা জীবন যাপনের। রুপের যা আছে তা নিয়েই রুপ সন্তুষ্ট। রুপ কিছু না বলে বাহিরে চলে আসে। প্রেম নীড়ের বাগানের পাশে দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে দৃষ্টিপাত করে,

” অপরূপ একটা কথা রাখবে?”

রুপ বাহিরের দিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ। নাদিফের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। পিছনে ফিরে তাকায়।

“কি কথা?”

” এভাবে’ই মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখবে সবসময় আমার সামনে। তোমাকে দারুন লাগে। ইচ্ছা করে সর্বক্ষণ সামনে বসিয়ে তোমাকে দেখি।”

চলবে…….

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ঊনিশ তম পর্ব |

গাড়ি চাকা যেন আজ থামার নাম মাত্র নেই, অনবরত চলছেই। রাস্তার দুই ধারে কৃষকেরা আমন ধান মাঠে উঠিয়েছে মাত্র। কয়েকদিনের মধ্যেই ধান গাছ থেকে ধান আলাদা করা হবে। ধানের ঘ্রাণে প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন। গ্রামের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এ সময়ে। আম, কাঁঠালের এই সময়ে গাছে ঝুঁকে আছে আম।

আজাদ সাহেব মনের সুখে গান গাইছেন,

“ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”

আজাদ সাহেবের পরিবারের সকল সদস্য রওনা হয়েছেন আসলামপুরের উদ্দেশ্যে। আর কিছু পথ বাকি আজাদ সাহেবের বাবা-দাদার বাড়ি। গ্রামের মেঠো পথ দেখা যাচ্ছে ইটের রাস্তা থেকে। আনন্দ করার জন্য ছোট বাস নিয়েছেন। যেখানে আরামে যে যেখানে ইচ্ছে বাসে চড়ে বসে যেতে পারবে। বাসের সামনের সিটে বসেছেন আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ। খোলা জানালায় বাতাস প্রবেশ করছে। গ্রামের গাছ-গাছালি যেন সবাইকে পাতা নাড়িয়ে মিষ্টি বাতাস ছড়াচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে। আয়েশা আজাদ লাজুক হেসে স্বামীর গা ঘেঁষে বসে গান শুনছেন।

ফাহিমা পুরো রাস্তায় স্বামী নাবিলের কাঁধে পড়ে ঘুমোচ্ছে। এটা ফাহিমার অভ্যাস। এতে অবশ্য নাবিলের কোন সমস্যা হচ্ছে না বরঞ্চ সপ্তাহের শেষে স্ত্রীকে পাশে পেয়ে আনন্দ লাগছে। এই অগোছালো ফাহিমাকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে নাবিল। ফাহিমা সকলের সামনে যেমন হোক না কেন নাবিলের ক্ষেত্রে খুবই রাশভারী। একমাত্র নাবিলের সামনে যেন বড়ো সেজে যায়। স্বামীর সকল কিছুর দিকে সুন্দরভাবে খেয়াল রাখে।

আজাদ সাহেবের পরিবারের বাহিরে একজন সদস্য আছে বাসে। আর সে হচ্ছে নাদিফের বন্ধু আকাশ। আকাশ বর্তমানে উঁকি ঝুঁকি মারছে রাইসার দিকে। রাইসার সাথে এই দুইদিনে আকাশের ভীষণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। অনলাইনে দুজনের আলাপ আলোচনা ভালোই চলে এখন। গতকাল সকালে আকাশের ফোনে রাইসার ফোন থেকে কিউট একটা ছবি আসে যেখানে রাইসা ব্যাঙের ন্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। ছবিখানা দেখে আকাশ হাসতে হাসতে অজ্ঞান। প্রায় পাঁচ মিনিট ছবিখানা সেভাবেই ছিলো এরপর মুছে ফেলে রাইসা কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। আকাশ ছবিখানা নিজের ফোনে সংরক্ষিত করে রেখেছে রাইসাকে ক্ষেপাবে বলে। রাইসাকে যখন ছবির বিষয়ে ক্ষেপানো হয় তখন থেকেই রাইসার আকাশের সহিত কথা বলা বন্ধ। আকাশ নিজ ইচ্ছায় নাদিফের সাথে এসেছে রাইসার মান ভাঙবে বলে।

” এই লাল পরী, কি করছো একা বসে?”

চোখ বন্ধ অবস্থায় কাঁচা আমের ঘ্রাণ নিচ্ছিলো রুপ। সকালে অভ্যাস মোতাবেক ছাদে হেঁটে এসে নিজের ঘরে বিছানার উপর দুই সেট কাপড় দেখতে পায় রুপ, যেগুলোর একটার উপর রুপের নাম লিখা ছিলো আরেকটার উপর রাইসার। রুপ প্রথমে ভেবেছিলো এই কাজ আজাদ সাহেব বা আয়েশা আজাদের। কাপড় দুটো ফেরত দিতে গিয়েও দেয়নি বয়স্ক মানুষ কষ্ট পাবে বলে।
মাথায় ঘোমটি টেনে বাসের ঠিক পিছনের সিটে বসেছে রুপ। রাইসা রুপের সামনের সিটে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে। কারোর কথার আওয়াজে রুপ চোখ খুলে তাকায়। প্রকৃতির সতেজ বাতাস সাড়া মুখে স্পর্শ করতে চোখের চশমা খুলে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো রুপ। চশমা চোখে পড়তেই পাশে বসা মানুষটা রুপের হাত আটকে নেয়।

” চশমা পরতে হবে না। এভাবেই থাকো। চশমাবিহীন তোমাকে মায়াবী লাগে অনেক।”

” এই কাপড়টা আপনি দিয়েছেন তাই না?”

” অপরুপকে কল্পনায় সাজাতে ভালো লাগে। রাতে অপরুপকে লাল পরী সাজাতে ইচ্ছে করছিলত খুব। কিন্তু কল্পনায় সাজাতে পারছিলাম না। তাই আর কি। ছোট শালিকা হিসেবে রাইসাও পেয়ে গেলো।”

রুপ হেসে ফেললো নাদিফের কথায়। রুপের অবাক লাগে একটা কথা ভেবে, এই রাগী মানুষটা রুপকে অপমান করতে পিছপা হতো না কখনও। এখন সে রুপের পাগল।
রুপের পাশে নাদিফ বসা। নাদিফ অনেক আগেই রুপের কাছাকাছি বসতে চেয়েছিলো। কিন্তু হারামি বন্ধু আকাশের জন্য পারেনি। আকাশ বাসে উঠে নদিফের হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়, কি কাজ তা অজানা’ই থাক। পাঁচ মিনিট হয়েছে কাজ শেষ করেছে নাদিফ। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে পুরো বাসে নজর বুলায় নাদিফ। কাঙ্খিত মানুষকে একদম পিছনের সিটে বসতে থাকতে দেখে খুশি হয়। নাদিফ রুপের পাশে এসে বসে কিছুক্ষণ রুপকে দেখে নেয়। মলিন মুখশ্রী, ফ্যাকাসে ঠোঁট, কোন সাজসজ্জা নেই। নাদিফের আগমনের আভাস রুপ পায়নি। মন ভরে রুপকে দেখে নাদিফ রুপের উদ্দেশ্যে বলে।

রুপ চশমাবিহীন চোখে নাদিফকে দেখতে পাচ্ছে না। তবুও কেন যেন নাদিফের কথা মানতে ইচ্ছে করছে রুপের। বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস নিলো রুপ। আনমনে বলে উঠলো,

” কাঁচা আমের সুগন্ধিতে মন উতলা হয়ে যাচ্ছে। বাসের ছাদে বসে সকলে হৈ-হুল্লোর করে আম খেলে আনন্দ হবে অনেক।”

” তোমার কি এই ইচ্ছে’ই অপরুপ?”

রুপ নাদিফের কথায় কি বলবে বুঝতে পারছে না। কন্ঠনালী দিয়ে আপনা আপনি চলে এসেছে কথাগুলো।
এদিকে নাদিফ রুপের ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখতে চায় না। তাই রুপের পাশ থেকে উঠে চলতি বাসের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাতের মুঠোয় পরপর দুটি ডাল আম সহ ভেঙে ফেলে। নাদিফের কান্ড দেখে আকাশও দাঁড়িয়ে যায়। জানালা দিয়ে গাছের নিচে ঝুলে থাকা আমগুলো ছিড়ে নেয়। চলন্ত বাসে আম পাড়ার মজা’ই আলাদা। বাসের ড্রাইভার আয়না দিয়ে নাদিফ, আকাশের কার্য দেখে নেয়। রাস্তার পাশে যেই আম গাছে আম আছে সেই জায়গায় গাড়ি দাঁড় করায়।

” সাব্বাস বেটা, এই না হলে আমার ছেলে! আমিও জোয়ান বয়সে এমন করতাম তোর মাকে খুশি করার জন্য। এখন তোমার এমন বিচ্ছুপনা দেখে মনে হচ্ছে সেই জোয়ান বয়সে চলে গিয়েছি। কি গো ললিতা! হবে কি আবার আগের মতো! তুমি বসে কাঁচা রসযুক্ত আম খাবে আর আমি তা দেখে জিভ ভিজাবো?”

আজিদ সাহেবের কথায় সকলে হেসে উঠেন। আয়েশা আজাদ লজ্জায় মুখ ঢাকেন। রুপ মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে নাদিফের দিকে। নাদিফের কান্ড দেখে রুপ মনে মনে খুবই আনন্দিত। ছোটবেলা থেকেই কষ্টে বড়ো হওয়া রুপ হঠাৎ আনন্দে ভরপুর পরিবারে চলে এসেছে। যেখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। একসাথে মিলেমিশে থাকা আর অসীম ভালোবাসা রয়েছে। রুপের এখন বড্ড লোভ পাচ্ছে সারাজীবন এই পরিবারের সাথে থেকে যেতে।

” ওমা কত আম ভাইয়া! এগুলো কি এখানে খাবো নাকি বাসায় গিয়ে খাবো? আমারতো এখনি সব সাভার করতে ইচ্ছে করছে। জানেন ভাইয়া রুপ আর আমার কাঁচা আম খুবই পছন্দের। আমরা যখন এতিম খানায় ছিলাম, বৃষ্টি বাদলের দিন তো আম গাছের নিচে চলে যেতাম আম কুড়াতে। এরপর সেই আম লবন মরিচ দিয়ে মেখে খেতাম। আহা কি স্বাদ!”

” এখন আর চুরি করে খেতে হবে না পিচ্ছি বাবু? তোমার জন্য আম জীবন বাজি রেখে আম পেরে এনেছি।”

আকাশের কথায় রাইম মুখ ভেংচি কাঁ’টে। কোন কথা না বলে অন্যদিকে তাকায়। এদিকে আকাশ পিচ্ছির অভিমান দেখে ব্যথিত হয়। আকাশ মনপ্রাণ দিয়ে পিচ্ছির রাগ ভাঙাবে বলে পন করে নেয়।

রাইসার কথা শুনে নাদিফ চোরা চোখে রুপের দিকে তাকায়। রুপের নজর জমিনে নিবদ্ধ। দুইহাত ঘসে যাচ্ছে অনবরত। রুপের অবস্থা দেখে নাদিফ রুপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রুপের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে নিজের কাছে।

” যত ইচ্ছে আম খাও। এখানে তোমাকে বাঁধা দেওয়ার মত কেউ নেই। তোমার জন্য সবকিছু।”
————–
গাড়ি থেমেছে অনেক আগেই। কাঙ্খিত জায়গায় চলে এসেছে সবাই। এবার দু’কদম এগোলেই হবে।
বিশাল বড়ো আম বাগানের ঠিক মধ্যিখানে নাদিফের দাদার বাড়ি।
আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ হিতে হাত ধরে চলে গিয়েছেন বাড়ির আম বাগানের দিকে। সেখানে একটা কূপ আছে। কথিত আছে, সেই কূপে নাকি হাজার বছর আগে এক জোড়া প্রেমিক যুগলের বিয়ে হয়। আজাদ সাহেবের মানা! এই কূপের কাছে বসে আয়েশা আজাদকে নিয়ে ভাবতেন সবসময় তাই আয়েশা আজাদকে পেয়েছেন তিনি। প্রতিবার এখানে আসলে কূপের কাছে যেতে ভুলেন না।

নাদিফের দাদার বাড়ির নাম ‘ প্রিয় নিবাস’ এই বাড়িটা সকলের অনেক পছন্দের ছিলো। বর্তমানে কেউ থাকে না। নাদিপের দাদা দাদী মারা যাবার পর যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় আর পাড়ি জমায় শহরে।

” আরে নাদু বাবাজি যে! কখন আইলেন? এতোদিন পর এই আদুভাইয়ের কথা মনে পড়ছে? একখান ফোন দিয়া আইলেও তো সব ফিটফাট করে রাখতাম।”

আদুভাই এবং উনার স্ত্রী শেফালী নাদিফের দাদার বাড়ির দেখাশোনা করেন।

” বলে আসলে তোমার মুখের এই হাসি দেখতাম কীভাবে?”

রুপ, রাইসা চারপাশ দেখছে। রাইসা ফোন বের করে গাছ-পালার ছবি তুলছে। এই সুযোগে আকাশ রাইসার পিছু চলে গেলো অভিমান আঙাতে।
প্রিয় নিবাসের সদর দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। নাবিল ফাহিমাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়েছে। সদর দরজার সামনে রুপ, নাদিফ দাঁড়ানো। শেফালী বেগম কথায় থেকে এসে চিৎকার দিয়ে উঠলো,

” হায় রে নাদু, বিয়ে করে ফেলেছো আমাদের না জানিয়ে! মাশাআল্লাহ, বউ তো খুব সুন্দরী! তোমাদের মানিয়েছে খুব।”

শেফালী বেগমের কথায় রুপ কাশতে শুরু করলো। এদিকে নাদিফ খুব খুশি ইচ্ছে করছে শেফালী বেগমকে ধরে নাচতে।

” এখনও বউ হয়নি ভাবি। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। সুসময়ের অপেক্ষায় আছি।”

রুপ এসে নাদিফের পিঠে এক কিল বসিয়ে দেয়। রেগে তেড়ে এসে নাদিফের গলা টিপে ধরে,

” বিয়ে তো আপনাকে করবোই না। ঐ রাস্তার কালা মানিককে বিয়ে করবো। আপনার ঠোঁট কাঁ’টা স্বভাবের জন্য কবে যেন আপনাকে মে’রে’ই ফেলি।”

শেফালী,নাদিফ হতভম্ব। রুপের মতো লাজুক,চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে কি কান্ড করে বসলো! একদম নাদিফের গলা চেপে ধরলো! মুহূর্তেই কথাটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে গেলো। শেফালী বেগম যে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে যাচ্ছেন। রুপ নাদিফকে ছেড়ে জিহ্বায় কামড় কাঁ’টে। নাদিফের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। নাদিফ রুপের অবস্থা দেখে মাথা চুলকে মুচকি হেসে বলে,

” পাগলি রাজি, এখনই ডাকবো কাজি।”

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here