#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,২০,২১
#আফসানা_মিমি
|বিশ তম পর্ব|
” আমার শ্বশুর তোমাকে খুব পছন্দ করে রুপ?”
কাঁচা আম লবন, মরিচ দিয়ে মেখে মাত্র মুখে পুড়তে যাচ্ছিলো রুপ। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে হা করেছিল মাত্র। ফলস্বরূপ কাঁচা আম মুখে ঢুকলো না ঠিকই কিন্তু লবন,মরিচ মাখানোটা নাকে ঢুকেছে ঠিকই। ফাহিমা রুপকে আম কেঁটে দিচ্ছিলো। আম কাঁটতে কাঁটতে ফাহিমার কথন। এদিকে ফাহিমার কথা শুনে রুপের করুণ অবস্থা । কাশতে কাশতে চোখে, নাকে পানি বের হয়ে এসেছে।
” কি বলছেন ভাবি? আঙ্কেলকে আমি বাবার মতো ভাবি।”
” তো কি হয়েছে! বাবা ও তো তোমাকে পছন্দ করে, আপন ভাবে।”
রুপের আম খাওয়া আর হলো না। হাতের মধ্যে আম থাকা সত্ত্বেও খাওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়েছে যেন। ফাহিমার কথা যেন রুপের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রুপ ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” ভাবি, আমি কিন্তু এসব ভাবি না। এমন কিছু হলে আমি প্রেম নীড় থেকে চলে যাবো। এখানেও আর থাকবো না।”
রুপ চলে গেলো। পড়ে রইলো অবুঝ ফাহিমা, যে কিনা আম কাঁটা বাদ দিয়ে রুপের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। ফাহিমা আপন মনে বলছে,
” আমি এমন কি বললাম, যার জন্য রুপ প্রেম নীড় ছেড়ে চলে যাবে? আমি তো ভালো কিছুই বললাম, বোকা মেয়ে বুঝলো না।”
আয়েশা আজাদ এদিকে এসেছিলো শেফালীকে খুঁজতে। বাজার থেকে পাঁচফোড়ন আনাবে বলে। কচি কচি আমের আচার বানিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে। ফাহিমাকে বসে থাকতে দেখে আয়েশা আজাদ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। আরাম করে ফাহিমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,
” কি ব্যাপার, এভাবে বসে আছিস কেন? আম কাঁ’ট’তে কষ্ট লাগছে বুঝি?”
ফাহিমা শাশুড়িকে পেয়ে বোকা বোকা চোখে তাকালো। শাশুড়ির হাত ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
” মা গো! ছোট ভাইয়ার কি হবে গো? রুপ তো চলে যাবে বলল। এবার রুপকে আটকে রাখবো কীভাবে?”
আয়েশা আজাদ ফাহিমার কথায় ভরকে গেলেন। বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালেন। বিচলিত কন্ঠস্বরে বললেন,
” চলে যাবে মানে? এই তো হাসি, খুশি ছিলো। সকলের সাথে আনন্দ করছিলো। নাদিফের সাথেও যেন মিশে গিয়েছিলো। হঠাৎ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন?”
আয়েশা আজাদের কথায় ফাহিমার সরল মনে উওর,
” মাত্র গল্প করছিলাম রুপের সাথে। বলেছিলাম যে বাবা রুপকে পছন্দ করে। তারপ,,,,,
আয়েশা আজাদ ফাহিমাকে থামিয়ে দেয়। কোমড়ে হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” ঠিক কি বলেছিলে রুপকে, বউমা?”
ফাহিমা বুঝতে পারে শাশুড়ির ভাবগতি ভালো না। যে কোন সময় ফাহিমার পিঠে দুরুম দারুম পড়তে পারে। তাই মিনমিন কন্ঠস্বরে জবাব দিলো,
“আমার শ্বশুর তোমাকে খুব পছন্দ করে রুপ, এই কথা বলেছিলাম।”
আয়েশা আজাদ এবার ফাহিমার কান মলে দিলেন,
” কি কারণে পছন্দ করে তা বলবি না, গাঁধী?
ফাহিমা কানে হাত দিয়ে শাশুড়ির কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে খুব। দুঃখি দুঃখি কন্ঠস্বরে উওর দেয়,
” আরো কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সময় নিয়ে। তা আর পারলাম কই মা! রুপ তো চলে গেলো। বলেছে আজ এখান থেকেও চলে যাবে।”
রুপের চলে যাওয়ার কথা শুনে আয়েশা আজাদ ফাহিমার কান ছেড়ে দিলো। বড়ো বড়ো পা ফেলিয়ে রুপকে যেই কামরা দেয়া হয়েছে সেদিকে পা বাড়লো। এদিকে ফাহিমা যেন চরমভাবে বেঁচে গেলো এই যাত্রায়। মনে মনে পন করলো স্বামা ব্যতীত অন্য কারোর সামনে মুখ খুলবে না।
——-
” এভাবে চরম রেগে,গাল ফুলিয়ে, মুখটাকে শাকচুন্নীর মতো করে গোছগাছ করছো যে? কোথায় যাবে? নাদিফ ভাইয়াকে বিয়ে করতে বুঝি?”
রাইসার মন ফুরফুরে। বসে বসে পটেটো চিপস এবং কোকাকোলা গোগ্রাসে গিলছে। রুপের এমন ব্যবস্থাও রাইসার অর মধ্যে ব্যাঘাত ঘটতে পারছে না। এই চিপস, কোকাকোলা সহ আরো অনেক চকোলেট আকাশ রাইসাকে উপহার স্বরূপ প্রদান করেছে। আকাশ রাইসার নিকট ক্ষমা চেয়েছে নিজ কর্মের জন্য। রুপ রাইসার প্রশ্নের উওর দিচ্ছে না। নিজের কাপড় গুছিয়ে এখন রাইসার কাপড়ে হাত দিয়েছে মাত্র। রাইসা রুপের প্রত্যুওর না পেয়ে বিরক্ত হলো। রুপের নিকটে এসে কিছুটা জোরে বলল,
” কি এমন হয়েছে তোমার? ভূত দেখেছো? নাকি পেত্নি? কেউ কি কিছু বলেছে?”
রুপ ব্যস্ততার সহিত উওর দিলো,
” ফাহিমা ভাবির কাছ থেকে আসলাম। আজাদ আঙ্কেল নাকি আমায় পছন্দ করেন। এটা কোন কথা রাইসা তুমিই বলো? আজাদ আঙ্কেল আন্টিকে কতো ভালোবাসেন। প্রেম নীড়ে মানুষজনের ভেতর কোন ঝগড়া নেই। আমি চাইনা আমার জন্য আন্টি কষ্ট পাক। মনোমালিন্য শুরু হোক।”
” তুমি চলে গেলে অনেক কষ্ট পাবো মা!”
রুপ তাড়াহুড়ো করে সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলো। আয়েশা আজাদের কথা শুনে রুপের হাত বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনি। রুপ অপরাধীর ন্যায় আয়েশা আজাদের দিকে ফিরে তাকায়। অনুনয়ের সহিত বলে,
” বিশ্বাস করুন আন্টি! আমি এতকিছু জানতাম না।”
” আমি কিন্তু সব জানতাম।”
রুপ এবার আয়েশা আজাদের কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেলো। এমন পরিস্থিতিতে রুপ আগে কখনও পড়ে নি। রুপ কিছু বলবে তার আগেই আয়েশা আজাদ রুপের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিলো। একে একে ব্যাগ থেকে কাপড় নামাতে নামাতে বলতে শুরু করল,
” আমার স্বামী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী। যিনি অমাকে খুব ভালোবাসেন। যাই কিছু হোক না কেন আমার জন্য তাঁর ভালোবাসার কমতি নেই, বরঞ্চ দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার পর যদি আমার স্বামী কাকে ভালোবাসেন সে হচ্ছে আমার ছোট ছেলে নিবরাজ নাদিফ। আমার ছোট ছেলেটা একটু বেপরোয়া স্বভাবের। আদরের ছেলেকে কিছু বলা মানে নিজের কলিজায় আঘাত করা। ছেলেকে আমার স্বামী খুব ভালোবাসেন, চিন্তা করেন ছেলের ভালো-মন্দের ব্যাপারে। তোমাকে আমার ছোট ছেলের জন্য পছন্দ করেছে আমার স্বামী, মা! ফাহিমার বলতে ভুল হয়েছে। আমিও চাই তুমি আমার ঘরের পুত্রবধূ হিসেবে। তোমাকে জোর করবো না। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেও যাবো না। তুমি এতদিনে বুঝেছো, জেনেছো আমাদের। আমরা জানি তোমার সম্পর্কে। আমার দুইজন ছেলে আরেকজন মেয়ে আছে। আরো দুইটা মেয়েকে আমি আদর ভালোবাসা দিতে পারবো, কমতি পড়বে না।”
আয়েশা আজাদের কথা শেষ হতেই রাইসা আয়েশা আজাদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। রুপ স্তব্ধ বনে আছে অপাতত। মস্তিষ্কে আয়েশা আজাদের বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। আয়েশা আজাদ মনে করলেন রুপকে একা সময় দেয়া উচিত। রাইসাকে সঙ্গে করে চলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাওয়ার আগে রুপকে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলেননি,
“বাহিরে কাঁচা আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা করবো ভাবছি। যদি রাজি থাকো তাহলে চলে এসো, আমাকে হারাতে।”
আয়েশা আজাদ রাইসাকে নিয়ে চলে গেলেন। রুপ বিছানায় বসে পড়লো নিশ্চুপে। রুপের এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে এতো ভালো পরিবার পেয়ে। এই মুহূর্তে রুপের নাদিফকে পাশে লাগবে। যেন মনের সকল কষ্টের কথা নাদিফকে বলতে পারে রুপ।
নাদিফ বাজারে গিয়েছিল কিছু আনতে। রুপের ঘরের পাশের ঘর নাদিফকে দেয়া হয়েছে। রুপের কান্না নাদিফের কর্ণধারে পৌঁছাতেই নাদিফ হন্তদন্ত করে রূপের ঘরে প্রবেশ করে।
নাদিফকে দেখা মাত্রই রুপ যেন আপনজনকে ফিরে পেয়েছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নাদিফকে দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। রুপ কান্না করছে। অনেক কান্না করছে । এদিকে নাদিফ পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিফের বিশ্বাস হচ্ছে না রুপ নিজ ইচ্ছেয় নাদিফকে জড়িয়ে ধরেছে।
” কি হয়েছে আমার অপরুপার? কেউ কি বকেছে?”
রুপ নিরুত্তর। কান্না ছাড়া আর কোন কিছু শোনা যাচ্ছে না আপাতত। নাদিফ আর কিছু বলছে না। রুপকে কান্না করতে দিচ্ছে মন মতো। এই সুযোগে রুপের কাছাকাছি থাকতে পারছে নাদিফ এটাই কম কিসের।
মিনিট পাঁচেক পর রুপের কান্না থামে। নাদিফের নিকট থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চশমার অভ্যন্তরে চোখ জোড়া মুছে নিয়ে বলে,
” আপনার পরিবারের সবাই এতো ভালো কেন?”
” তাঁরা যে নাদিফের পরিবার এজন্য।”
নাদিফের হেঁয়ালি কথায় রুপ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। মুখ ভার করে অন্যত্রে ফিরে তাকায়, আর বলে
” আপনি ব্যতীত সবাই ভালো, বুঝলেন?”
নাদিফ রুপের নিকটে এসে বলে,
” তাই বুঝি! তা কি করেছি আমি? এভাবে তোমার নাকে কামড় বসিয়েছি? নাকি তোমাকে খুশি করার জন্য কাতুকুতু দিয়েছি।”
পরপর রুপের নাকে কামড় বসিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। রুপ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সুড়সুড়ির তালে তালে হেসে যাচ্ছে অনবরত। রুপ হেসে হেসে বলছে,
” থামুন দয়া করে। আমি আর আপনাকে খারাপ বলবো না।”
নাদিফ,রুপ দুজনেই হাপাচ্ছে। বিছানার উপর পাশাপাশি বসে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করছে। রুপ নাদিফের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি তোমার সকল রোগের ঔষুধী হতে চাই অপরুপ! তোমার হাসি,কান্নার মালিক হতে চাই।”
রুপ এবার লজ্জা পেলো খুব। নাদিফকে মনে মনে সেই কবে ভালোবেসেছে রুপ। প্রেম নীড়ের সকলের শংকায় এতোদিন মনের ভিতর পুষে রেখেছিলো। এখন আর কোন বাঁধা নেই। কিন্তু রুপের কাছে নাদিফের এমন অস্থিরতা বেশ লাগে। রুপ ভাবছে নাদিফকে ভালোবাসি প্রেম নীড়ে ফিরে বলবে।
রুপ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নাদিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
” এতো সহজে উওর পাবেন না তৃষ্ণার্ত পুরুষ! সবুর করুন। জানেন না, সবুরে মেওয়া ফলে!”
রুপ আর দাঁড়ালো না। হবু শাশুড়ির সাথে আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা করতে চলে গেলো রুপ। এদিকে নাদিফের নিকট রুপের সকল কিছু পরিষ্কার। রুপ যে নাদিফকে পছন্দ করে তা নাদিফের অজানা না। নাদিফ হাতে থাকা শপিং ব্যাগের দিকে তাকায়। মাথা চুলকে হেসে চলে যায় নিজ ঘরে।
————
কাঁচা আমের জবরদস্ত প্রতিযোগিতা চলছে। রুপ, আয়েশা আজাদ মাঝারি আকারের দুই বোলে আম কেঁ’টে রাখা হয়েছে। লবন,মরিচ কাঁচা আমে মিশিয়ে খাচ্ছে রুপ। আয়েশা আজাদ লবন,মরিচে আম ভরিয়ে খাচ্ছেন। বিচারকের দায়িত্বে আছেন আজাদ সাহেব আর রাইসা। ফাহিমা আপাতত মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ গিয়েছে নাদিফকে ডাকতে। মহিলাদের প্রতিযোগিতা দেখে আকাশের জিভে জল এসে গিয়েছে। এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকলে জিভ দিয়ে লালা বের হয়ে যাবে। পরে রাইসার সামনে নিজের মান সম্মান নষ্ট হবে।
নাদিফ সামনে আকাশ পিছনে। আকাশ নিজের মুখে হাত দিয়ে রেখেছে যেন জল না পড়ে যায়। রুপ চোখ বন্ধ করে আমের স্বাদ নিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কোন খবর নেই। এদিকে আয়েশা আজাদ হার মেনে নিলেন। এই বয়সে এতো আম খাওয়া মানে পেটে সমস্যা হওয়া।
নাদিফ রুপের আম খাওয়া দেখে হা করে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা খাওয়া দেখে নিজের’ই লোভ জেগেছে আম খাওয়ার। রুপের কাছে এসে আমের বোল নিজের কাছে নিয়ে আম খেতে শুরু করলো। আহা কি স্বাদ! নাদিফের নিকট অমৃত মনে হচ্ছে। এদিকে রুপের আম নিয়ে যাওয়াতে রুপ রেগে যায়। রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” এই রাক্ষস নাদু, আমার আম দে।”
আপনি থেকে সরাসরি তুই! নাদিফের সাথে সাথে সকলেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রুপের দিকে। এদিকে রুপ মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। পর পর দুইবার নাদিফকে উল্টা পাল্টা কথা বলে। রুপ নিজেকে নিজেই বকে যাচ্ছে,
” লাগাম দে রুপ নিজের মুখে,
বলতে হয়না সব কথা জোরে জোরে।
এবার তোর কি হবে,
প্রেম নীড়ের সকলে যে আজ ভীষণ রেগে।”
চলবে………
#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
| একুশ তম পর্ব |
সুখের পর কষ্ট আসে,
রাতের পর দিন
আনন্দে উল্লাসে ভরা,
সুখ দুঃখের মিল।
প্রিয় নিবাসের চারপাশের আমগাছের সকল কাঁচা আম এখন খাঁচায় খাঁচায়। দশটা খাঁচা ভর্তি আমের সামনে রুপকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। রুপ অসহায় দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকাচ্ছে। রুপের এই বেহাল দশা করেছে সকলের প্রিয় নাদিফ।
নাদিফের সবচেয়ে অপছন্দনীয় সম্বোধন ‘তুই’ ডাকা। রুপ তো অবুঝ মনে তুই ডেকেছে কিন্তু পরবর্তীতে তুই ডাকার ফলাফল যে এতো ভ’য়া’ন’ক হবে তা রুপ কল্পনাও করেনি।
” ছোট ভাইয়ের যেই রাগ! দেখেছি অনেক রেগে আছে। কখন না যেন রুপকে মাথার উপর তুলে জমিনে আছাড় দিয়ে দেয়। তখন না হয় আমরা আমের আচারের পরিবর্তে রুপের আচার খাবো, কি বলো মা!”
আয়েশা আজাদ দুঃখী মনে রুপের অসহায় মুখশ্রী দেখছিলেন। ফাহিমার কঠিন কথা শুনে আয়েশা আজাদের বর্তমানে ইচ্ছে হচ্ছে ফাহিমার মাথায় আমের খাঁচা বোঝাই করে দাঁড় করিয়ে রাখতে তাহলে যদি ফাহিমার একটু আক্কেল হয়।
” তোমরা এখানে কি করছো? দোষ তো তোমরা করোনি যে এখানে অপরাধীদের মতো দাঁড়িয়ে আছো। দোষ যে করেছে সে আজ এই সকল আম সাবারও করবে সে। এটা তুই বলার শাস্তি।”
নাদিফের কথা শুনে আয়েশা আজাদ করুণ চোখে ছেলের পানে তাকায়। কিন্তু পাষান নাদিফের হৃদয় তো পাষান’ই। রুপের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত চোখে ইশারা করে আয়েশা আজাদ চলে যান স্বামীকে ডাকবে বলে। যাওয়ার সময় কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকা ফাহিমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে ভুলেন নি।
রাইসা আকাশের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। বর্তমানে দুই একজন কাজের লোক আছে। যাদেরকেও নাদিফ চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে।
মাথার উপর বড়ো বড়ো আম গাছ দণ্ডায়মান হয়ে আছে। যেদিকে তাকাবে সেদিকেই আম বাগান। এই জায়গায় আসলামপুর নাম না হয়ে আমপুর হলে ভালো হতো বলে মনে করে রুপ। রুপ বর্তমানে আম বাগানের মধ্যেই বসে আছে। রুপের সামনে নাদিফ চেয়ার পেতে বসে আছে ঠিক দ্বিতীয় দিনের মতো যেদিন রুপ প্রেম নগরে এসেছিলো তার পরের দিন আর কি।
” কি ভাবছেন আমখোর? আম খান! আপনি আম খেতে না পেরে মানুষকে তুই বলেও সম্বোধন করতে ভাবেন না। তো আম খাওয়া শুরু করুন।”
রুপ অসহায় দৃষ্টিতে নাদিফকে দেখছে। নাদিফের গাম্ভীর্যভাব রুপকে আহত করছে। রুপ মিনমিন কন্ঠস্বরে প্রত্যুওর দেয়,
” আমি অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। মনের সকল আনন্দ যেন বের হয়ে আসছিলো। ভুলে আপনাকে তুই বলে ফেলেছি। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”
নাদিফ যেন এই কথার অপেক্ষায় ছিলো। রুপের ক্ষমা চাওয়া দেখে নাদিফের মুখে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠে, যা রুপের নজর এড়ালো না। নাদিফ চেয়ার নিয়ে একদম রুপের কাছাকাছি গিয়ে বসে। এতে রুপ কিছুটা পিছনে ঝুঁকে যায়। নাদিফ রুপের কাছে এসে বলে,
” এত সহজে ক্ষমা পাবে না রুপ! আমার কিছু শর্ত আছে। রাজি হলে ক্ষমা পাবে, নয়তো যা বলবো তা করতে হবে।”
রুপ নাদিফকে বর্তমানে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই। রুপের এখন একটুও ইচ্ছে নেই আম খাওয়ার। নাদিফ যেমন রাগী আর ত্যাড়াবাঁকা স্বভাবের। রুপ যদি নাদিফের শর্তে রাজি না হয় তাহলে দেখা যাবে এই সব আম নাদিফ রুপের পেটে ঢুকিয়ে ই ছাড়বে।
” কঠিন শর্ত দিবেন না। সহজ, সহজ, ভালো, ভালো শর্ত দিবেন।”
রুপের কথায় নাদিফ হাসলো। হাত দ্বারা মাথার চুল পিছনের দিকে টেনে ধরলো। এরপর রুপের দিকে কিছুটি ঝুঁকে বলল,
” আমাকে ভালোবাসো তা স্বীকার করতে হবে। নয়তো আজ আমাকে বিয়ে করতে হবে। অথবা এই সবগুলো আম এখন খেতে হবে।”
রুপ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। নাদিফির তিনটা শর্তের একটা শর্তও পালন করা সম্ভব নয়। রুপ কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকায়। নাদিফ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নাদিফের এই হাসি দেখে রুপের গা জ্বলে যাচ্ছে। রুপ মনে মনে দোয়া করছে যেন মিরাকেল কিছু হয়ে যায়। কিন্তু রুপ জানে এটা বাস্তবতা, মিরাকেল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রুপ রাগান্বিত কন্ঠস্বরে নাদিফের উদ্দেশ্যে বলে,
” আপনি জানেন! পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পুরুষ আপনি? এতো লোভ কেন আপনার? আপনার এক শর্তেও আমি রাজি না।”
নাদিফ এবার হো হো করে হেসে উঠলো। প্রত্যুত্তর করল,
” এই তিন শর্ত ছাড়া আরেকটা শর্ত তোমার জন্য যোগ করে দিলাম। অতি সহজ শর্ত। এখন, এই মুহূর্তে আমাকে নাম ধরে ডাকতে হবে আর ভালোবাসি বলতে হবে।”
রুপের এখন ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে কোথাও পালিয়ে যেথে তাহলে নাদিফের কঠিন শর্ত থেকে বেঁচে যাবে। রুপের এই সিদ্ধান্তই আপাতত পালন করবে রুপ। আস্তে আস্তে পিছনে পা বাড়াচ্ছিলো রুপ পালিয়ে যাওয়ার জন্য। নাদিফ রুপের চালাকি বুঝে যায়। ধরে ফেলে রুপের হাত টেনে নিয়ে আসে রুপকে নিজের কাছে।
” একবার ভালোবাসি বললে তোমার কন্ঠনালীতে পোকা ধরবে না। তুমি বুঝতে পারছো না কতটা ছটফট করছি এই শব্দটা শোনার জন্য?”
রুপ নাদিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলকে। নাদিফের চোখে রুপেয জন্য আঘাত ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে রুপ। নাদিফের চোখে রুপকে পাবার আকুলতা। রুপকে যেন এক অন্য রাজ্যে নিয়ে চলে যাচ্ছে। রুপের হাত আপনা আপনি নাদিফের গালে চলে গেলো। নাদিফের চোখে চোখ রেখে রুপ বলতে শুরু করল,
” ভালোবাসা কি সবসময় মুখে’ই স্বীকার করতে হয়, বুঝে নেওয়া যায় না! ভালোবাসা কি প্রকাশ্যে দেখাতে হয়, অনুভব করা যায় না? ভালোবাসা তো অন্তরের অভ্যন্তর থেকে আসে, প্রকাশ করতে যে দ্বিধা নেই। কিন্তু কীভাবে বলি আপনাকে ভালোবা,,,,,
রুপ নিশ্চুপ। নাদিফের নিশ্বাস যেন আটকে আসছে রুপের শেষোক্ত কথা শ্রবণ করার জন্য। নাদিফের গালে রাখা রুপের হাত শক্ত করে ধরে হাতের উল্টো পিঠে অধর ছুঁয়ে দিলো নাদিফ। বিচলিত কন্ঠস্বরে বলল,
” থামলে কেন অপরুপ! বলো, সম্পূর্ণ করো তোমার অসম্পূর্ণ কথা। আমার অস্থিরতা যে বেড়ে যাচ্ছে।”
রুপ এবার খুব লজ্জা পাচ্ছে। নাদিফের বাহুবলে রুপ আবদ্ধ। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।
” ছাড়ুন দয়া করে! কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”
” নাদিফ ভাইয়া?”
কোন মেয়ের কন্ঠস্বর শুনে নাদিফ রুপকে ছেড়ে দিলো। রুপ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেলো। নাদিফ, রুপ পিছনে ফিরে তাকালো। লাল সুতি শাড়ি গায়ে পেঁচিয়ে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স সতেরো কি আঠারো হবে। মুখে হাসির রেখা। চোখে পানি চিকচিক করছে। যেন এই মুহূর্তে চোখের পানি ঝড়ে যাবে। অদূরে দেখা যাচ্ছে আজাদ সাহেবকে একজন লোকের সাথে কথা বলতে বলতে আসছেন। মেয়েটি এবার নাদিফের কাছে এসে দাঁড়ালো। একদম কাছে। যেন মেয়েটা নাদিফের প্রেমিকা হয়। নাদিফ কিছুটা পিছনে চলে খেলো মনে করতে চেষ্টা করলো কে এই মেয়ে। অবশেষে স্বরণে আসে নাদিফের। চোখ বড় বড় করে তাকায় মেয়েটির পানে নাদিফ। নাদিফের ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছে রুপ। নাদিফের বিস্ময়কর দৃষ্টি রুপের দৃষ্টিতে এড়ালো না। নাদিফ অবাক হয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি মায়া না? হামিদ চাচার ছোট মেয়ে? কতো বড়ো হয়ে গিয়েছো। আমি তো চিনতেই পারিনি।”
” হ্যাঁ বড়ো হয়ে গিয়েছি। মা বলেছে বিয়ের বয়স হয়েছে। শাড়ি পরিধান করা শিখেছি তোমার জন্য। তুমি না শাড়ি পছন্দ করো! দেখো, আজ শাড়ি পরে এসেছি। এবার আমাকে বিয়ে করো।”
রুপ কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছিলো। বউ হবার আগেই সতিন এসে হানা দিচ্ছে রুপের জীবনে। নাদিফের কথা শুনে বুঝতে পারলো মেয়েটা চাচাতো বোন হবে। ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করলো রুপ। কিন্তু পরমুহূর্তে মেয়েটির কথা কর্ণধারে আসতেই চোখ জোড়া বড়ো হয়ে যায় রুপের।
নাদিফ ভয়ার্ত চোখে রুপের পানে তাকায়। এই দুই ফুট মেয়ের কথা নাদিফের মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে না সঠিকভাবে। না জানে রুপ কি ভেবে নিয়েছে। এমনিতেই মেয়েদের মনে জিলাপির প্যাঁচ থাকে। প্রেম এখনও শুরু হলো না এমনিই প্যাঁচ লাগানোর জন্য এই মেয়ে চলে এসেছে!
রুপ হনহন করে প্রিয় নিবাসে ফিরে গেলো। পড়ে রইলো নাদিফ আর পিচ্ছি মায়া। যার দিকে আপাতত নাদিফ মায়াহীন চোখে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার দুই কথার জন্য রুপ চলে গিয়েছে রাগ করে। নাদিফের এখন মায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” কেন এলি রে মায়া আমার জীবনে,
ঝড় তুফান সব নিয়ে। চলে যা মায়া চলে যা।”
প্রিয় আবাসের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” যেয়ো না সাথী,
ওওওওওও
যেয়ো না সাথী
ছেড়ে আমাকে একা পথেএএএএ
যেয়ো না সাথী।”
চলবে………