প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,২৪,২৫

0
916

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,২৪,২৫
#আফসানা_মিমি
|চব্বিশ তম পর্ব |

চাঁদনি রাতে গ্রামের পথ ঘাট দূর দূরান্ত পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। পুকুরের পানি যেন চিকচিক করে চাঁদের আলোতে।
রুপ নাদিফ বসে আছে বাহিরে। একজনের হাতে অপরজনের হাত শক্তভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে। রুপের গান গাওয়ার পর থেকেই নাদিফ শক্ত করে রুপের হাত ধরে রেখেছে। এদিকে মায়া রাগে-দুঃখে কষ্টে, অপমান সইতে না পেরে ঘরে চলে গিয়েছে সাথে নাবিল ফাহিমা রাইসা আকাশে চলে গিয়েছে রুপ নাদিফকে একা ফেলে। একাকী বসে আছে রুপ নাদিফ। রুপ চোখ বন্ধ করে বৃথা চেষ্টা করছে বাতাস এসে যেন গা ছুঁয়ে দেয়। নাদিফ অপলক দৃষ্টিতে চাঁদনি রাতে পাশে বসে থাকা চাঁদকে দেখছে। যার চেহারার মায়াতে নাদিফ ফেঁসে গিয়েছে। আচমকা নাদিফ রুপের হাতের পিঠে শব্দ করে চুমু খেয়ে বসলো। রুপ হতবাক। যখন কেউ আনন্দে থাকে কোন বিষয় নিয়ে তখন আনন্দে আনমনে কেউ এমন কাজ করে বসে। নাদিফের বেলায়ও তাই।

” কি হলো এটা?”

রুপের কথায় নাদিফ মুচকি হেসে বলে,

” আদর করা হলো।”

রুপ হতাশ দৃষ্টিতে নাদিফের পানে তাকিয়ে আছে। রুপ ভাবছে, এমন একজনকেই রুপের ভাগ্যে আসতে হলো! যে কি না ঠোঁট কাঁ’টা স্বভাবের!

” এই যে হাত শক্ত করে হাত ধরে রেখেছি। দেখো কতো সুন্দর দেখাচ্ছে আমাদের আবদ্ধ হাত! কথা দিচ্ছি; সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উল্লাসে যে কোন পরিস্থিতিতে এই হাতের বন্ধন কখনও ছুটে যাবে না। সারাজীবন এভাবেই ভালোবেসে যাবো।”

রুপের দৃষ্টি জমিনে নিবদ্ধ। মুখে তৃপ্তির হাসি। প্রতিটা মেয়ের স্বপ্ন থাকে একজন ভালো মনের মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে। নিঃসেন্দহে নাদিফ একজন ভালো মনের মানুষ। যে কি না রুপকে আঘাত ভালোবাসে। রুপ আস্তে করে নাদিফের কাঁধে মাথা রাখলো। এ যেন আলাদা প্রশান্তি। নাদিফের কাছাকাছি থাকলে সবকিছুই ভালো লাগে। নাদিফ রুপের পিছনে হাত দিয়ে রুপকে আগলে নিলো। নাদিফের মুখশ্রীতে ছিলো তখন জয়ী হাসি।
—————-

চাঁদময় রাতের পর উজ্জ্বল দিবসের আগমন ঘটেছে ধরণীতে। গ্রামের সকাল যেন সুমধুর সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙে রুপের। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে উওর প্রান্তের জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় রুপ। বিছানায় রাইসা এখনও ঘুমে নিমগ্ন। রুপ আলগোছে মাথায় খোঁপা করে দরজা খুলে বাহিলে যাবার জন্য পা বাড়ায়। দরজা খুলতেই রুপের চোখ ছানাবড়া। উস্কখুস্ক অবস্থায় নাদিফ দাঁড়ানো দরজার সামনে। নাদিফের দৃষ্টি শান্ত। রুপের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক পর নাদিফ রুপের উদ্দেশ্যে বলল,

” তৈরি হয়ে নাও অপরুপ! একটু পর আমরা প্রেম নীড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।”

নাদিফ কথা শেষ করে মলিন হেসে রুপের গালে হাত রাখলো। গভীরভাবে রুপের মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলো। এদিকে রুপ নির্বিকার নাদিফের কান্ড দেখে। নাদিফ চলে যেতেই রুপ রাইসাকে ডেকে তুলে তৈরি হওয়ার জন্য।

প্রিয় নিবাসে গতকালের ন্যায় কোন হৈ-হুল্লোর নেই। একদম স্তব্ধ পরিবেশ। শেফালি বেগম মুখে আঁচল দিয়ে রেখেছেন, চোখে মুখে বিষন্নতা বিদ্যমান।
মায়া বাবা-মায়ের সাথে মাঝে বসে আছে এক প্রকার বিধ্বস্ত অবস্থায়। রুপ সাইসা মাত্র বসার রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ার এই অবস্থা দেখে রুপ ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে। রুপকে দেখা মাত্রই মায়া বসা থেকে উঠে রুপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রুপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে কিছুক্ষণ। হাত বাড়িয়ে রুপের মুখশ্রী ছুঁয়ে দেয় মায়া। পরক্ষণে কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলে,

” আমিও কি বড়ো হলে তোমার মতো সুন্দর, বুঝবান হবো? ভাইয়া তো বলল আমি নাকি বোকা। এখনও অনেক ছোট। তাই ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে না। তোমাকে পছন্দ করে।”

রুপ সকলের সামনে মায়ার এসব কথায় অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মায়ার এসব কথার উওরে এগিয়ে আসেন আজাদ সাহেব। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

” তোর জন্য আমি নিজে পাত্র খুঁজে বের করবো। যেমনভাবে আমার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজেছি। তোর জন্য যে পাত্র থাকবে সে একদম রাজকুমারের মতো হবে। তখন দেখবি এই রুপ, রাইসা হিংসে করছে তোর রাজকুমারকে দেখে।”

আজাদ সাহেবের কথায় মায়া হেসে উঠে। এদিকে রুপের মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না। কিছুক্ষণ আগে নাদিফ তৈরি হতে বলল আর এখন মায়ার এসব কথা।
রুপ ভাবছে এখন চুপ থাকাই ভালো হবে। পরে না হয় ফাহিমা ভাবির নিকট শুনে নিবে কি হয়েছে।

সকলের মাঝে এক জোড়া প্রেমিক যুগলের মনও খারাপ হয়ে আছে। সকলের অগোচরে প্রেমিক যুগল প্রিয় নিবাস থেখে বের হয়ে যায়। প্রেমিক যুগল জোড়া হলো রাইসা এবং আকাশ।

” তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো আকাশ?”

রাইসা তো রুপের মতোই এতিম। পার্থিব জীবনের চাকচিক্যে মগ্ন রাইসা। পৃথিবীতে কত সংগ্রাম করে যে বাঁচতে হয় তা রাইসা দেখেছে। কিছুদিন আগেও রাইসার নিকট কিছুই ছিলো না। পরিধান করার জন্য কাপড় ছিলো না। রুপের জন্য রাইসা এতো ভালো পরিবারের সাথে থাকতে পারছে। মাস শেষে ভালো খাবার পাচ্ছে। পরিধানের কাপড় কিনতে পেরেছে নিজের টাকায়। এই কয়েকদিনে রাইসা যেন সব ভুলে গিয়েছিলো। মত্ত হয়েছিলো একজন সুদর্শন পুরুষের ব্যবহারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতিম বলে কি আকাশ সময় কা’টাচ্ছে রাইসার সাথে? রাইসার চোখে অস্থিরতা, ভয় পাচ্ছে অনেক। রাইসার অবুঝ মনে ভালোবাসা জন্মিয়েছে আকাশের জন্য। রাইসার প্রশ্নে আকাশ উওর দিতে সময় নেয় নি। রাইসার কথার প্রত্যুওরে বলে,

” তুমি বুঝো না?”
” আমি বুঝি না। সরাসরি বলো।”
” হ্যাঁ তোমাকে ভালোবাসি।”
” বিয়ে করবে আমায় এই প্রতিশ্রুতি দাও তাহলে?”

আকাশ মুচকি হাসলো রাইসার কথা শুনে। রাইসার হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে উওর দেয়,

” কথা দিচ্ছি রাইসা, আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন পর ঢাক ঢোল বাজিয়ে তোমাকে বউ রুপে নিজের ঘরে উঠাবো।”

” আর আমরা দূর আত্মীয়দের মতো দূরে বসে বসে দেখবো।”

রাইসা লজ্জায় শেষ। নাদিফ রুপ যে এসে উপস্থিত হয়েছে। রুপ হাসছে রাইসার লজ্জা দেখে। নাদিফের ঠোঁটে দুষ্টুমি ভরা হাসি। নাদিফের কথায় আকাশ মাথা চুলকে উওর দিলো,

” তোর জন্যই তো রাইসাকে পেয়েছি আমি। তোকে তো আমার বাম পাশে বসিয়ে রাখবো পাহাড়া দেয়ার জন্য।”

যেভাবে গতকাল সকলে আসলামপুরে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই সকলে রওনা হয়েছে। আজাদ সাহেব চোখ বন্ধ করে বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়েছেন। শরীরটা কেন যেন আজ ভার ভার লাগছে। ফাহিমা আজ নির্ঘুমে থাকবে বলে পন করেছে। রাইসার মন ফুরফুরে আকাশের সাথে বসে জমিয়ে গল্প করছে।

রুপ আজ বাসের মাঝ বরাবর বসেছে। নাদিফ পিছনে বসেছে। নাদিফ আজ চুপচাপ। রুপের সাথে কোন কথা বলছে না। রুপ একটু পর পর নাদিফের পানে তাকাচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করছে নাদিফের ভাবভঙ্গি। রুপের যেন আজ সব কিছু অসহ্য লাগছে। আসার সময় মায়া অনেক কান্না করেছে। নাদিফের কাছে ক্ষমা চেয়েছে অজ্ঞাত কারণে।

রুপের এখন খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে নাদিফের মনের কথা। রুপ এবার নাদিফের কাছে এসে পাশে বসলো। নাদিফের হাত ধরে বলে,

” হেই জান! কি ভাবছো?”

নাদিফ যেন আকাশ থেকে টপকে জমিনে পড়লো। চোখ বড়ো করে রুপের পানে তাকালো। রুপ এসেছিলো নাদিফের মন ভালো করতে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রুপ একটু বেশিই করে ফেলেছে। রুপ জিহ্বা কেঁটে নাদিফের পাশ থেকে উঠে যেতে উদ্যোগ নিতেই নাদিফ রুপের হাত শক্ত করে ধরে ফেলে।

” এভাবে যন্ত্রণা না দিয়ে ভালোবাসি বলতে পারো না? তোমার হুটহাট কথায়, আচরণে আমি নিঃশেষ হয়ে যাই তা কি তুমি জানো? এসেছো আমার কাছে নিজ ইচ্ছায় যাবে আমার ইচ্ছায়।”

নাদিফ কথা শেষ করে রুপের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। রুপ স্তব্ধ নাদিফের কাজে। রুপের এখন নিজের বোকামির জন্য নাদিফের কবলে বন্দী হয়ে গিয়েছে।

” রুপ মাথাটা চুলকে দাও তো! মনে হয় উকুন হয়েছে। গতরাতে তোমার সাথে বসে থাকার পর থেকেই মাথা চুলকাচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমার মাথার সব উকুন দৌঁড়ে আমার কাছে চলে এসেছে।”

নাদিফের কথা শেষ হতেই রুপ রাগে জোরে নাদিফের মাথা চুলকে দিতে শুরু করলো। এতে নাদিফ হেসে উঁচু আওয়াজে বলল,

” আরে পাগল হলে নাকি! আমি তো দুষ্টুমি করেছি। কোন উকুন নেই মাথায়। মা বলে উকুন সাত বাড়ি ঘুরে একজনের মাথা থেকে অপরজনের মাথায় আসে। আমার মনে হচ্ছে মাথায় মাথা থেকে এসেছে। মেয়েটা গতকাল রাতে দেখলে না পাশে বসেছিলো!”

রুপ যেন এবার অগ্নিরুপ ধারণ করেছে। নাদিফের মাথা চুলকে দেয়ার বিপরীতে কেশব টেনে ধরেছে। রুপের কান্ডে নাদিফ আরো জোরে হাসছে।

” আরে কি করছো কি অপরুপ! বিয়ে হওয়ার আগেই কি আমাকে টাক বানিয়ে দিবে! পরে তো তোমার ই সমস্যা হবে অপরুপ! লোকে তোমাকে টাক ব্যাটার বউ ডাকবে।”
রুপ এতক্ষণে মুখ খুলল। রাগে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে নাদিফ মাথার কেশব শক্ত করে টেনে ধরে নাদিফের মুখের কাছাকাছি নিজের মুখ নিয়ে এসে উওর দিলো,
” আপনার বউ হতে আমার বয়েই গেছে! আপনার জন্য মায়া আছে তো। তাছাড়া একজন বেকার অকর্মঠ পুরুষকে বিয়ে করবো না আমি।”

নাদিফ যেন এবার রেগে গিয়েছে রুপের কথায়। এক হাতে রুপের গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

” এভাবে না রাগালে হতো না অপরুপ! তুমি কি ভেবেছো, এই নিবরাজ নাদিফ অকর্মঠ! তুমি তো এই নাদিফকে এখনও চিনতেই পারো নি। চিনবেই বা কি করে, কখনও তো ভালোই বাসো নি। আমার মতো যদি ভালোবাসতে তবে বুঝতে।”

রুপ অপরাধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাদিফের পানে। রুপের এভাবে বলা ঠিক হয়নি কিন্তু রাগের বশে বলে ফেলেছে। রুপের চোখে পানি চলে এসেছে। কয়েকফোটা পানি নাদিফের মুখশ্রীতে ঝড়েও পরেছে।

” কেঁদো না অপরুপ! আমি রাগ করিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, ঘুমাবো। আগামীকাল থেকে কাজের সন্ধানে নামবো।”
————

আয়েশা আজাদ প্রেম নীড়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাসে কোথাও বসেনি। এটা সেটা কাজ করেই যাচ্ছে। ফাহিমা বাসে বমি করতে করতে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ছোট ছেলের যেন কি হয়েছে। মুখ ভার করে ছাদে বসে আছে। আয়েশা আজাদের এমন ব্যস্ততা দেখে রুপ এগিয়ে আসে সাহায্য করতে।

” ভালো করেছিস মা। একা সবকিছু গোছগাছ করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।”
রুপ মুচকি হাসে আয়েশা আজাদের কথায়। পরক্ষণে কিছু ভেবে আয়েশা আজাদকে প্রশ্ন করল,

” আমরা এভাবে হঠাৎ চলে এসেছি কেন? সবকিছু তো ঠিকঠাক ছিলো।”

আয়েশা আজাদের মুখের হাসি মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। রুপের প্রশ্নের প্রত্যুওর দেয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে,

” মায়ার জন্য চলে এসেছি।”

” কেন?”

” তোমরা শেষ রাতে যখন যার যার ঘরে চলে আসো, মায়া তখন নাদিফের ঘরে শুয়ে ছিলো বিবস্ত্র অবস্থায়। নাদিফ ঘরে ঢোকা মাত্রই মায়াকে এই অবস্থায় দেখে সরাসরি আমার কাছে চলে আসে। আমাকে পুরো ঘটনা বলার পর আমি মায়ার কাছে যাই। বোকা মায়া তখন ঘুমে ছিলো। খারাপ নিয়তে এসে নিজেই ধরা পড়ে গেলো। সজাগ হয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। উঁকিঝুঁকি মেরে কাউখে খুঁজতে থাকে। আমি তখন এতোটাই রেগে ছিলাম যে, মায়ার গিলে পর পর দুইটা থাপ্পড় বসাই। মায়া তখন কান্না করতে বলে, সে নাদিফের বউ হতে এমন নিকৃষ্ট কাজ করতেও ভয় পাই নি। নাদিফের কানে কথাটা পৌঁছাতেই নাদিফ চলে আসার জন্য পাগলামি শুরু করে। মায়াকে দুই চারটে কথাও শুনিয়ে আসে। তোমাকে ডেকে তৈরি হতে বলে।”

রুপ স্তব্ধ, নির্বিকার। ছোট একটা মেয়ের মাথায় এতো কু-বুদ্ধি আসে কোথায় থেকে ভাবছে রুপ! আয়েশা আজাদ আর কিছু বললেন না। লেবু শরবত বানিয়ে ফাহিমার ঘরের দিকে চলে গেলো।

রুপের মনে নাদিফের জন্য আরো সম্মান জন্মালো। রুপ মনে মনে কিছু ভেবে বাঁকা হাসলো। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,

” সময় এসেছে মনের কথা জানাবার,
দুই মনের কথন আদান-প্রদান করবার।
অপেক্ষার অবসান হবে যে এবার,
ভালোবাসি বলবো শতবার।”

চলবে……..

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|পঁচিশ তম পর্ব |

বৈশাখীর শেষ মৌসুম বড়োই আজব। ক্ষণে ঝুমঝুম করে মেঘের আগমন তো ক্ষণে রোদের উত্তাপ। মধ্যাহ্নের সময়ে সূর্য ঠিক মাথার এক হাত উপরে যেন চলে আসে। কড়া রোদের উত্তাপে শরীর থেকে ঘামের সহিত পানি বের হয়ে যায় এই রোদে।
রুপ আজ একটু বেলা করে প্রেম নীড় থেকে বের হয়েছে। এই সময়ে রুপের বাহিরে কোন কাজ নেই। তবে প্রিয় মানুষটিকে চমকে দিবে রুপ এজন্য শত কষ্টের মধ্যেও বের হয়ে এসেছে।
কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগখানা আজ ছুঁয়ে দিতেও শান্তি লাগছে রুপের কাছে। আজ রুপ হেঁটে প্রেম নীড়ে ফিরছে। যতটা পথ হেঁটে এসেছে, কতবার যে ব্যাগ ছুঁয়ে দিয়েছে হিসেব নেই।
রুপের মুখশ্রী আজ চিকচিক করছে খুশিতে। অবশেষে যে নাদিফের মনের বাসনা পূর্ণ হবে। রুপ বর্তমানে ব্লক এ তে অবস্থান করছে। প্রেম নীড় ব্লক সি তে। আরো পনেরো মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। মধ্যাহ্নের এআ সময়টা স্কুল কলেজের ছাত্রদের ক্লাসের সময়। এই সময়ে কোন স্কুল বা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বাহিরে দেখা মানে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুরছে।

ব্লক এ-তে এসেই রুপের চোখের সামনে এক জোড়া পরিচিত মুখশ্রী ভাসমান হলো। ফাল্গুনী আর ফয়সাল। ফয়সাল ফাল্গুনীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ফাল্গুনী অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে হাত ছাড়ানোর।
রুপ কঠিন মুখে ফয়সাল ফাল্গুনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ রুপ অনেক বকে দিবে ছাত্র-ছাত্রীদের। রুপ ফাল্গুনীর নিকট আসতেই শুনতে পেলো ফয়সালের রাগান্বিত স্বর,

” দেখ ফাল্গুনী, আমি এবার সিরিয়াস। তোকে আর প্রস্তাব মানতেই হবে। নয়তো তোর খবর আছে।”

ফয়সালের কথার প্রত্যুওরে ফাল্গুনী বলছে,

” ছেড়ে দে আমায় ফয়সাল! তুই আমার মন তো দূরের কথা আমার মুখ থেকে কথাও বের করতে পারবি না।”

” এই যে কথা বলছিস! এভাবেই আমি যা শুনতে চাইছি তা বলে ফেল।”

” কখনোই না কু’ত্তা। তুই সব ছেড়ে এখন আমার পিছনে লেগেছিস কেন?”

” কেননা সে তোমাকে ভালোবাসে।”

রুপের কন্ঠস্বর শুনে ফয়সাল ফাল্গুনীর হাতে ছেড়ে দেয়। ফয়সালের দৃষ্টি জমিনে নিবদ্ধ ভুলেও রুপের দিকে তাকাচ্ছে না। ফাল্গুনী ভয়ার্ত চোখে রুপের পানে তাকিয়ে আছে। রুপের কথার প্রত্যুওরে ফাল্গুনী বলল,

” মিথ্যা বলে এই ছেলে। আমাকে কখনও ভালোবাসে নাই। কিছুদিন আগেও আপনার পিছু ঘুরেছে এরপর যেই না নাদিফ ভাইয়ার হাতে উওম মাধ্যম খেয়েছে তারপর লাইনে আসছে।”

” তুমি সত্যি বলছো? এসব কি শুনি ফয়সাল? তোমার মায়ের নাম্বার দাও। এক্ষুনি উনার ছেলের কু কর্মের কথা জানাচ্ছি।”
” আমি বলছি ম্যাডাম। শূন্য, এক, ছয়,,,,,,

ফাল্গুনীর কথা শেষ হতে দিলো না ফয়সাল। ফাল্গুনীর মুখ চেপে ধরলো যেন কোন কথা বলতে না পারে।
রুপ আর ঘাটলো না। স্কুল ফাঁকি দেয়ার জন্য শক্ত কয়েকটা কথা বলবে রুপ এদের,

” এই সময়ে স্কুলে না গিয়ে এখানে কি করছো?”

” ওরা প্রেম করছে স্কুল ফাঁকি দিয়ে। চলো তুমিও একই কাজ করবে ওদের বকা বাদ দিয়ে।”

রুপের রাগ মাটির সাথে মিশে গিয়েছে নাদিফের আগমনে। নাদিফের মুখে দুষ্টু হাসির রেখা। মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে হয়তো! মাথার কেশব অগোছালো মুখে ঘুমঘুম ভাব বিদ্যমান। রুপ শুকনো ঢুক গিললো নাদিফের এরুপ দেখে। এক মিনিটের চেয়ে বেশি সময় তাকাতে পারলো না রুপ দৃষ্টি নত করে ফেলল,

” তা বাচ্চারা এখানে কি তোমাদের?”

নাদিফকে দেখা মাত্রই ফয়সাল ভয় পেয়ে যায়। ফাল্গুনী আশার আলো যেন দেখতে পায়। বিনা সংকোচে ফয়সালের নামে নালিশ করে বসে নাদিফের কাছে,

” ভাইয়া এই ফোর টোয়েন্টি এখন আমার পিছু লেগেছে। দুনিয়ার সব মেয়েদের পিছনে ঘুরে পাত্তা না পেয়ে আমাকে মনে পড়েছে। আমি এই বাদরকে ভালোবাসি না। আপনি বলে দিন আমি এক মিনিটের জন্যও ভালোবাসবো না।”

ফাল্গুনীর কথায় রুপের চোখ বড়ো হয়ে গেলো। নাদিফ বাঁকা হেসে রুপের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাল্গুনীর উদ্দেশ্যে বলে,

” এটা তো খুবই খারাপ হচ্ছে তোমার সাথে। তা তুমি কি চাও? দূরে সরে যেতে চাও? তাহলে পাত্তা দিও না। বন্ধুত্ব নষ্ট করে দাও।”

ফাল্গুনী নিশ্চুপ হয়ে আছে। নাদিফ ফাল্গুনীর নিস্তব্ধতা দেখে হাসে। ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলে,

” কি মিয়া! এবার কি সত্যি সত্যিই? নাকি ক্ষণিকের মোহ?”

ফয়সাল এবার মাথা উঁচু করলো। বুকে সাহস এনে বলল,

” আমি বাঁচতে চাই তাকে নিয়ে, সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে চাই তাঁর সাথে। আজীবন ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসা শিখাতে চাই এই মেয়েটাকে।”

রুপ হা করে নিজের ছাত্রছাত্রীদের দেখছে। এদের মনে এতো প্রেম কীভাবে আসে কে জানে! রুপের কর্ণধারে ক্ষণিকের জন্য কান্নার আওয়াজ চলে আসে। ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে দেখে ফাল্গুনী কান্না করছে। রুপ কপালে আঘাত করে উঠে। একদিকে প্রেম নীড়ের সকলের ড্রামা আর অপরদিকে ছাত্রছাত্রীদের প্রেমলীলা। রুপ যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।

” এই মেয়ে কান্না করছো কেন? তুমিও তো ফয়সালকে পছন্দ করো। এখন এতো অজুহাত দেখাচ্ছো কেন? স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসব করছো বলে কি কান্না করছো?”

” আমি সেই বাচ্চা কাল থেকে এই বাদরকে পছন্দ করি। কিন্তু এই বজ্জাত এতো দেরি করলো কেন? আমি রাজি হবো না ম্যাডাম।”

ফাল্গুনীর কান্না বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনি। ফয়সাল চোরা চোখে ফাল্গুনীর দিকে তাকাচ্ছে। ফাল্গুনী যে ফয়সালকে পছন্দ করে তা অনেক আগে থেকেই জানতো সে। ফাল্গুনীর নিষেধাজ্ঞা, যত্ন, আদেশ,নিষেধ সবকিছুতে যে কখন ফয়সালের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা ফয়সাল জানে না। তবে এখন যে সঠিক সময় হয় নি তা ফয়সাল জানে কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই। ক্লাস থেকে দুইজন’ই ছুটি নিয়ে চলে আসে।
ফাল্গুনীকে মা’রতে ফায়সাল অনেক আনন্দ পায়। এজন্য সুন্দরভাবে উওম পরিবেশে মনের কথা ফাল্গুনীকে না বলে এমন চৌরাস্তায মোড়ে ধমকে, হু’ম’কি দিয়ে মপের কথা বলেছে। ফাল্গুনী শোনার পর থেকেই এক প্রকার চিৎকার করে বলে যাচ্ছে যে সে রাজি না। কিন্তু ফয়সাল নাছোড় বান্দার মতো মে’রে ফাল্গুনীকে রাজি করাচ্ছিলো।

” বাসায় যাও তোমরা। তোমাদের ম্যাডামকে ঘু’ষ খাওয়াচ্ছি আমি।”

ফয়সাল ফাল্গুনীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে। রুপ নাদিফের আড়াল হতেই ফয়সাল ফাল্গুনীকে একটি দালানের দেয়ালে আটকে নেয়। ফাল্গুনীর মুখে ফুঁ দিয়ে বলে,

” ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যা। নয়তো রুপ ম্যাডামের কাছে নালিশ করবো যে তুই আমাকে ফাঁসিয়েছিস, তোর প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিস।”

ফাল্গুনীর চোখ বড়ো করে তাকায়। ফয়সালের চোখে অগাধ ভালোবাসা দেখতে পায়। ফাল্গুনী মুচকি হেসে অপর পাশে ফিরে বলে,

” যাহ মিথ্যাবাদী।”

————
প্রেম নীড়ে মানুষজনের দৌঁড়ঝাপ দেখা যাচ্ছে অনবরত। নতুন মুখশ্রী দেখে রুপ নাদিফ উভয়েই চমকে যায়। এক ঘন্টার ভিতরে বাড়ির চেহারাই যেন পাল্টে গিয়েছে। খাবারের টেবিলের উপর নানান প্রজাতির মিষ্টান্নে ভরপুর। রুপ কিছু একটা আন্দাজ করতে পায়। রান্না ঘরে চলে যায় আসল কথা জানতে।

” আমার এই অবস্থায় যদি আব্বা আপনাকে বলি যে টাক হয়ে যান, তাহলে কি তাই করবেন?”

প্রেম নীড়ে খুশির আমেজ। আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ আজ ভীষণ খুশি। দুজনেই অবস্থান করছেন বড়ো ছেলের ঘরে। ফাহিমা বিছানায় শায়িত, চোখে মুখে ক্লান্তি। অনিমেষে তাকিয়ে আছে শ্বশুরের পানে উওরের আশায়। আজাদ সাহেব পুত্রবধূর কথা শুনে কেশে উঠে। আস্তে করে উওর দেয়,

“মারে! এসব বাজে ভাবিস না। তোর জন্যই ক্ষতি হবে। ভালো কিছু ভাব। যেমন: ফুল, ফল, পাখি।”

আজাদ সাহেবের কথায় ফাহিমা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বলতে শুরু করল,

” আব্বা টাক হয়ে যান। আমার মনের ইচ্ছে পূরণ করে দিন। এই সময়ে আমার এই ইচ্ছে হচ্ছে।”

আয়েশা আজাদ পাশে দাঁড়ানো ছিলো। স্বামীর অসহায়ত্বতা দেখে ফাহিমার উদ্দেশ্যে বলে,

” এমনিতেই ছিলি ভাঙ্গা হাড়ি, তার মধ্যে এখন শুরু ঢোলের বারি। বলি কি! তোর বাচ্চা পেটে তাই বলে যে তুই খাওয়ার পরিবর্তে আমাদের দৌঁড় করাবি তা ডাক্তার বলেনি।”

ফাহিমা শাশুড়ির কথায় একমত না। কিছুক্ষণ আগেই স্বাস্থ্য ক্লিনিক থেকে একজন সেবিকা এসেছিলেন। ফাহিমার বমি, মাথা ঘোরানোর কথা শুনে ঘরে বসেই গর্ভাবস্থার সারন্জম এনে পরীক্ষা করায়। চূড়ান্ত ফলাফল পেয়ে সকলকে জানায় এবং বলে অতি শীঘ্রই হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিয়ে আসতে। ফাহিমাকে বলে যায় যে, এই সময়ে যা খেতে ইচ্ছে করবে তাই খেতে দিতে। যা মনে চাইবে তাই খেতে। কিন্তু বোকা ফাহিমা ভেবে নিয়েছে যে তার মনের সুপ্ত সকল ইচ্ছে এই সুযোগে পূর্ণ করবে। তাই তো শ্বশুরকে বলে টাক হয়ে আসতে। কিন্তু বরাবরের মতোই শাশুড়ি মা এসে ফাহিমাকে ধমকে দেয়। এথে ফাহিমা মিথ্যা কান্না শুরু করে।

ফাহিমার কান্নার মাঝেই রুপ নাদিফের আগমন ঘটে।
ভাবির কান্না দেখে নাদিফ প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে ভাবির? কান্না করছে কেন?”

আয়েশা আজাদের মুখশ্রী খুশিতে চিকচিক করছে। নাদিফের কথার প্রত্যুওরে বলে,

” তুই চাচ্চু হবি, বাবা। আমাদের পরিবারে নতুন অতিথি আসবে।”

রুপ ভীষণ খুশি হয় সু-সংবাদ পেয়ে। নাদিফ ফোন করে বড়ো ভাইকে অফিস থেকে বাসায় আসতে বলে।
নাদিফ এতোটাই খুশি হয় যে উপস্থিত সকলের কথা ভুলে যায়। রুপের উদ্দেশ্যে জোড়ালো কন্ঠস্বরে বলে,

” আমি কবে বাবা হবো অপরুপ?”

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here