প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,২৮,২৯

0
1003

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,২৮,২৯
#আফসানা_মিমি
| আটাশতম পর্ব |

সকালে তৈলাক্ত খাবার খেতে খেতে আজাদ সাহেব তিক্ত হয়ে গিয়েছেন। গতকাল রাতে এজন্য প্রিয়তমা স্ত্রীকে বলে রেখেছেন যেন ভাত রান্না হয়।
রোজকারের ন্যায় সকালে হেঁটে এসে পত্রিকা নিয়ে বসলেন সোফায়। পিনপতন নীরবতায় ঘেরা প্রেম নীড়। আজ রান্নাঘর থেকেও বউ-শাশুড়ির কোন আওয়াজ আসছে না। আজাদ সাহেব চিন্তিত হলেন। এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। রান্নাঘরে নজর বুলিয়ে হতাশ হলেন। পুরো রান্নাঘর চকচকে করে বউ শাশুড়ি কোথায় যেন চলে গিয়েছে। রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে পর কয়েকবার রুপ, ফাহিমা,রাইসার নাম ধরে হাঁক ছাড়লেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য, কারোর কোন খোঁজখবর নেই।
আজাদ সাহেবের কথা শুনে দুই ছেলে তৈরি হয়ে উপর থেকে নিচে নেমে আসে। দুইজনের উদ্দেশ্য অফিস। একজন নিজের অফিসে যাবে তো অপরজন নতুন অফিসে যাবে। আজাদ সাহেব পায়চারি করছেন এদিক সেদিক। ছেলেদের নিচে নামতে দেখে প্রশ্ন করেন,

” কোথায় সবাই?”

আজাদ সাহেবের কথার প্রত্যুওর দিলো না কেউ। বরঞ্চ উল্টো নাবিল বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

” কি হয়েছে বাবা? এভাবে চিৎকার করছো কেন? ক্ষুধা পেয়েছে? মাকে ডাকো না! আমাদের বউদের এভাবে ডাকছো কেন?”

আজাদ সাহেব ঢুক গিললেন ছেলের এমন কথা শুনে
আজাদ সাহেবের কল্পনার বাইরে ছিল তার বড়ো ছেলে এমন কথা বলবে। ছোট ছেলে বললে একটা কথা ছিল কেননা ছোট ছেলে আজাদ সাহেবের কার্বন কপি। কিন্তু বড়ো ছেলেও যে এমন ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের তা জানা ছিল না। নিজেকে স্বাভাবিক করে আজাদ সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

” তোদের বউ সহ আমার বউ আর বাড়ির মেয়ে সব কোথায়? একজনেরও তো কোন সাড়া শব্দ নেই। সবাই কি একসাথে ঘুমোচ্ছে! এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটের ভিতরে বাঘ দৌঁড়াচ্ছে তার কি খবর আছে কারোর?”

বাবার কথা শুনে নাবিল উচ্চ স্বরে হেসে বলল,

” আমাদের বউ সহ তোমার বউ এমনকি বাড়ির সকল মেয়েরা শপিং করতে গিয়েছে সাতসকালে। নিজের ঘরে এখনও প্রবেশ করোনি! গেলে বুঝতে টেবিলের উপর সুন্দর করে কালো অক্ষরের কালি দিয়ে লিখে গিয়েছে,’ আজ সারা দিন আমাদের হয়ে রান্না করতে হবে। নয়তো উপোস থাকতে হবে। আর সকালের নাস্তা বানিয়ে রেখে গিয়েছি, ভালোই ভালোই সব নাস্তা শেষ করবে।”

আজাদ সাহেব ফুস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এ আর নতুন কিছু না। মাঝেমধ্যে আজাদ সাহেবের বউ রাগ করে বা অভিমান করে সারাদিনের জন্য শপিং করতে চলে যায়। শাশুড়ি বউ মিলে সারাদিন শপিং করে খেয়ে দেয়ে একদম রাত করে ঘরে ফিরে। কিন্তু আজ যে এমন একটা কাজ করবে তা জানা ছিল না আজাদ সাহেবের।

নাদিফ, নাবিল ইতিমধ্যে খাবার টেবিলে বসে পড়েছে। যেহেতু বাড়ির মধ্যে কোন মেয়ে উপস্থিত নেই তাই ছেলেদের নিজের খাবার নিজেই নিয়ে খেতে হবে।

খাবারের টেবিলের উপর খুব সুন্দরভাবে খাবার ঢেকে রেখে দিয়েছেন বাড়ির রমণীরা। তা দেখে আজাদ সাহেব ভীষণ সন্তুষ্ট। প্রিয়তমা স্ত্রী যে বলার আগেই সব বুঝে যায়। যেহেতু বাড়িতে মেয়েরা নেই তাই আজাদ সাহেব ইচ্ছে পোষণ করলেন আজ নিজ হাতে ছেলেদের খাইয়ে দিবেন।
নাবিল নাদিফ মাত্র প্লেট ঠিক করছিলো খাবার বাড়বে বলে। এমন সময় আজাদ সাহেব বলে উঠেন,

” আজ আমার ছেলেদেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবো। ছেলেরা কি খাবে বাবার হাতে?”

নাবিল, নাদিফ দুজনে হতবাক। তাঁদের বাবা ঠিক ছোটবেলার মতো দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে বলছে। খুশিতে দুই ছেলে হ্যাঁ বলে উঠে।

আজাদ সাহেব খুশি হন ছেলেদের হ্যাঁ শুনে। খাবারের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে খাবারের প্লেটে প্রথমে ভাত নিয়ে নেয়। এরপর ঢেকে রাখা এক পাত্রের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দেয়। ঢাকনা সরানোর সাথে সাথে আজাদ সাহেব ভাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠে,

“আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক, লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোলিমিন!”

বাবার এমন ভয় পাওয়া দেখে দুই ছেলে দাঁড়িয়ে যায়। উঁকি দিয়ে দেখে খাবার পাত্রে কি রাখা আছে। পাত্রে রাখা খাবার দেখে দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকায়। পরপর আরো দুই পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে দুই জনেই উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। কেননা আজাদ সাহেব যে পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে নিয়েছিলো সেখানে রাখা ছিল পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা। আর তিন নাম্বার পাত্রে ছিল কচু শাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রান্না তরকারি। যা নাদিফ, নাবিল দুজনেরই খুবই পছন্দ।
আজাদ সাহেব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। প্রিয়তমা স্ত্রী যে সাত সকালে এমন একটা সারপ্রাইজ দিবে তা আজাদ সাহেব ভাবতে পারেনি। আজও মনে করেছিল তার স্ত্রী একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন আর কথায় কথায় ব্ল্যাকমেইল করবে না। কিন্তু না, বলে না! ‘কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।’ তেমনি আজাদ সাহেবের প্রিয়তমা স্ত্রী কোনদিনও ভালো হবে না। কিন্তু আজ যে দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে আজাদ সাহেব বলেছেন! এখন তো খাইয়ে দিতেই হবে!
আজাদ সাহেব চোখ খুললেন। নিজেকে অনেক শক্ত পোক্ত করে উঠে বসলেন দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে বলে। কিন্তু দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আজাদ সাহেবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। কেননা আজাদ সাহেবের দুই ছেলে রাক্ষসের মত গবগব করে গিলে খাচ্ছে ভাত দিয়ে কচুর তরকারি।
আজাদ সাহেব এই তিন পদের তরকারি অপছন্দ করেন। আর পাট শাক শুটকি ভর্তার নাম শুনলেই বমি করে দেন। আজাদ সাহেব বসে অবাক চোখে দুই ছেলের খাওয়া দেখছেন। বাবার তাকানো দেখে নাবিল বলে উঠে,

” আরে বাবা! কচুশাক যা মজা হয়েছে না! একবার খেয়ে দেখো জীবনে আর পানি খেতে চাইবে না। যেন স্বাদ না চলে যায়।”

নাদিফ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে বাবার উদ্দেশ্যে কিছুই বলছেন না। কেননা নাদিফ খুব ভালো করেই জানে তার বাবা এই তিনটার একটাও পছন্দ করেন না এখন কিছু বললে উল্টো দেখা যাবে না খেয়ে আছে।

” তোরা এতটা পাষণ্ড কবে থেকে হলি রে! তোদের সামনে বুড়ো বাবা বসে আছে আর তোরা কিভাবে গবগব করে খাচ্ছিস! তোদের মনে কি একটুও মায়া দয়া নেই! আমি কি খাব তা তোরা ভাবছিস একবারও?”

” কি খাবে মানে? আমরা যা খাচ্ছি তাই খাবে। এই নাও তোমার পাতে পাট শাক আর শুটকি ভর্তা উঠিয়ে দিলাম। খাও নাহলে মায়ের কাছে বিচার দিবো।”

ছলছল চোখে আজাদ সাহেব ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। এরা যে আজাদ সাহেবের সন্তান তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আজাদ সাহেবের কাছে। অগত্যা ভাতের লোকমার ভেতর পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা ঢুকিয়ে লোকমা করে প্লেটে সাজালেন। এক গ্লাস পানি এক হাতে নিলেন। এখন এক লোকমা মুখে দিবেন আর পানি পান পারবেন। এভাবেই পুরো খাবার শেষ করবেন।

এদিকে আজাদ সাহেবের খাওয়া দেখে নাদিফ ছোট্ট করে মেসেজ লিখে,” বাবা খেয়ে নিয়েছে।”

———–
দিবসের শেষ ভাগ। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসেছে সকল রমণীরা। সকলের হাতে চার-পাঁচটা করে শপিং ব্যাগ। সকলের মুখে চমৎকার হাসি। সারা দিনের ক্লান্তির পর সকলে এসে ধপাস করে পড়ল সোফার উপরে।

” আজ অনেক মজা হয়েছে ,মা। আজ সারাদিনে কোন উল্টা পাল্টা কাজ করি নাই।”

ফাহিমার ক্লান্ত মাখা কন্ঠস্বর। আয়েশা আজাদ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলেন। সাড়া বাড়ি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কোথাও স্বামী বা ছেলেদের পেলেন না।

” বুড়ো টা কোথায় রে? ”

শাশুড়ি মায়ের মুখে বুড়ো ডাক শুনে ফাহিমা রুপ অবাক। ফাহিমা মুখ ফসকে বলে,

” মা কি বলছো গো! বুড়ে টা আবার কে?”

” তোর শ্বশুর গাঁধী। কোথায় সে? সকালের কাজের জন্য আবার কোন গন্ডগোল বাঁধায় নি তো?”

ফাহিমা,আয়েশা আজাদ ভাবনায় ব্যস্ত। এদিকে রুপ লাজুক হেসে নতুন কেনা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে ভিডিও কলে নাদিফকে দেখা যাচ্ছে। নাদিফ বর্তমানে নতুন অফিসে অবস্থান করছে। রুপের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যাসেজের মাধ্যমে কথা হচ্ছে। রুপের ফোন নাদিফ বলিয়ে কিনে দিয়েছে। আর সে ফোন দিয়ে এখন অপরুপকে দেখছে।
সকলের অগোচরে রুপ নাদিফকে বলল,

” আপনার আঁখিদ্বয় খুব খারাপ, বুঝলেন! আলাদা মাদকতা আছে এই চোখে। আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। অথচ দেখুন! আপনি নির্লজ্জের মতো কীভাবে তাকিয়ে আছেন!”

নাদিফ হাসে রুপের কথা শুনে। নাদিফ রুপকে লজ্জা দিতে প্রত্যুত্তরে বলল,

” ভালোবাসি বলো একবার, দ্রুত!”

রুপ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। নাদিফের মুখের দুষ্টু সাসির রেখা দেখে তেত যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” আপনি খুব খুব খুব অসভ্য ঠোঁট কাঁটা বদ স্বামী। রাখুন ফোন।”

নাদিফ হাসছে। নির্লজ্জের মতো রুপকে দেখেই যাচ্ছে। রুপ আর ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। ফোন বন্ধ করে দিবে তার আগেই নাদিফের কথা রুপের কর্ণধারে আসে,

” শুনো মেয়ে! আসছি আমি। অনেক কথা আছে আজ। অপেক্ষা করবে, গভীর রাত হলেও।”

রুপ মুচকি হেসে কল কেঁটে দিলো।

আয়েশা আজাদ ভীষণ চিন্তিত হলেন স্বামীর জন্য। আজাদ সাহেব প্রেম নীড়ের কোথাও নেই। অভিমান করে কোথায় যেন চলে গিয়েছেন। আয়েশা আজাদ এবার কান্না মাখা কন্ঠস্বরে বিলাপ করতে শুরু করলেন,

” কোথায় চলে গেলি তুমি সোয়ামি গো!
এইবারের মতো ফিরে আসো গো!
আর জীবনেও যাবো না বাহিরে গো!
ও স্বামী, চলে আসো না গো!”

কোথায় চলে গেলো আজাদ সাহেব?
আপনারা কি জানেন?

চলবে………

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ঊনত্রিশতম পর্ব |

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। অদূরে আকাশে গুরুম গুরুম মেঘের শব্দ হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পর পর। কিছুক্ষণ পর মুষলধারে বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করলো।

আয়েশা আজাদ থম মেরে বসে আছে প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকের সামনে। আয়েশা আজাদ বর্তমানে রেগে আছে নাকি স্বাভাবিক আছেন দেখে বুঝা যাচ্ছে না। সময় এখন সন্ধ্যার শুরু সময়। মেঘের কারণে গভীর রাত মনে হচ্ছে। এই মেঘের মধ্যে নাবিল, নাদিফ বের হয়েছে বাবাকে খুঁজতে। আয়েশা আজাদ উৎসুক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছেন। এই বুঝি স্বামী আসবে বলে। বলে না, অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর! স্বামীর পথ চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনে মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। রুপ, রাইসা, ফাহিমা তিনজন আয়েশা আজাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

” মা, তুমি আজ সকালে পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা না বানালে আব্বা আজ আমাদের সাথে থাকতো। আমার নাদুসনুদুস শ্বশুর আব্বা যে কই চলে গেলো! কি করেছিল বাবা?”

আয়েশা আজাদ নিশ্চুপ। পিছনে ফিরে খুব করে চাইছেন বোকা পুত্রবধূর সাহসী মুখখানা অবলোকন করতে কিন্তু আপাতত চুপ করে রইলেন।
আজকের সকালের তেতো খাবারের রান্নার কারণ ভেবে চললেন। গতকাল রাতে ঘুমের ঘোরে আজাদ সাহেব কোথাকার সুনয়নার খুবই প্রশংসা করেছিলেন। ভাগ্যিস আয়েশা আজাদ তখন সজাগ ছিলো নয়তো স্বামীর মনের খবর কীভাবে জানতো! তাৎক্ষণিক’ই আয়েশা আজাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন আজকের দিনটার জন্য। কিন্তু এক সিদ্ধান্তে যে তাঁর স্বামী লাপাত্তা হয়ে যাবে তা কখনোই ভাবেননি।

সকলের দুশ্চিন্তার মাঝে নাবিল,নাদিফ প্রেম নীড়ের সদর দরজার সামনে উপস্থিত হয়। সর্বপ্রথম রুপের নজরে আসে। রুপ শাশুড়ি মায়ের কাছে এসে বলে,

” মা, উনারা চলে এসেছেন।”

আয়েশা আজাদ উৎসুক দৃষ্টিতে ছেলেদের পানে তাকালেন। দুই ছেলের ঠিক পিছনে চোরের মতো লুকিয়ে আছেন আজাদ সাহেব। চোখে মুখে বিষন্নতা বিদ্যমান। সারাদিন আজাদ সাহেবের দিনটা যে খুব খারাপ কেটেছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মুখশ্রী দেখে।

” কোথায় ছিলেন?”

আয়েশা আজাদের বিচলিত কন্ঠস্বর। নাদিফের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। প্রথমদিন অফিসে কাজ বুঝে নিতে সময় লেগেছে অনেক। তার মধ্যে নব বঁধূ রুপে অপরুপের কথা স্বরণ হয় বারবার। বাসায় এসে বাবা নিরুদ্দেশ শুনে দুনিয়া যেন ঘুরে গিয়েছিল নাদিফের কাছে। অথচ তার বাবা রেস্টুরেন্টে বসে আরামে চা পান করছিলো তখন। যা নাদিফের এক বন্ধু নাদিফকে জানায়। মায়ের কথা প্রত্যুওরে নাদিফ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,

” বুঝলে মা! তোমার হাতের পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা আজ একটু কম হয়ে গিয়েছিল। তাই তো পাশের রেস্টুরেন্টে নিজের আবাস্থল বানিয়ে রেখেছিলো আজ সারাদিন। চা পান করা অবস্থায় পেয়েছি বাবাকে। আজ থেকে তোমার আরেকটা চাকরি শুরু। তোমার হাতের স্পেশাল চা পান করবে বাবাকে প্রতিদিন। যেন পরবর্তীতে রেস্টুরেন্টের চায়ের স্বাদ মুখে না থাকে।”

নাদিফ উপরে চলে গেলো। আজাদ সাহেব শুকনো ঢুক গিলছেন প্রিয়তমা স্ত্রীর অগ্নিরুপ দেখে। ছেলেকে সারা পথে এই পড়িয়ে নিয়ে আসলেন তিনি? সারা রাস্তায় দুই ছেলেকে পড়িয়ে নিয়ে এসেছেন যে বাসায় গিয়ে বলবি, “বাবা রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে ফেলেছে তাই ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণ আগেই খেতে গিয়েছে রেস্টুরেন্টে।” কিন্তু আজাদ সাহেবের আদরের ছেলে করলো কি! বলল তো বলল সত্য মিথ্যা সব বলল।

আজাদ সাহেব অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাইসা নখ কামড়চ্ছে পরবর্তীতে কি হবে তা ভেবে। ফাহিমা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না কেননা সামনে নাবিল দাঁড়িয়ে। এখন উল্টা পাল্টা কিছু বললে ফাহিমার খবর তেরোটা বাজাবে।

” ভিতরে আসো। বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখে ধরবে।”

আয়েশা আজাদের শান্ত কন্ঠস্বরে সকলেই হতবাক। স্বামীর দিকে অভিমানী নজরে তাকিয়ে চলে গেলেন উপরে। আজাদ সাহেব স্ত্রীর অভিমান বুঝতে পেরে ছুটলেন পিছু পিছু।
——–

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটা কাঁচের জানালায় বাড়ি খাচ্ছে। রুপ ঘাপটি মেরে বসে আছে বিছানার উপর। হাতে নতুন ফোন যা এখন জ্বল জ্বল করে আলো জ্বলছে, রুপকে জানান দিচ্ছে ফোনে কল এসেছে। আর কেউ অতিব আগ্রহে অপেক্ষা করছে রুপের জন্য। কিন্তু রুপ সাহস পাচ্ছে না।
এখন সময় রাত এগারোটা বিশ মিনিট। প্রায় পাঁচ মিনিট পূর্বে কল করেছিলো নাদিফ। রুপের ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে নাদিফ কি যেন জরুরি কথা আছে। সেই থেকে রুপ বসে আছে ঘরে ঘাপটি মেরে।
আবারো রুপের মুঠোফোন জ্বলে উঠে। রুপ ধীরে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। হাত সামনে এগিয়েও আগাচ্ছে না রুপ। লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হওয়ার পর সামনাসামনি হয়নি রুপ, নাদিফ।
রুপ দরজা খুলে দেয়। রুপের দৃষ্টি জমিনে নিবদ্ধ যেখানে নাদিফের পা দুটোই দেখা যাচ্ছে শুধু। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ওড়না ধরে আছে। কিছু সময় পেরিয়ে যায়। নাদিফ নিশ্চুপ সাথে লজ্জাবতী রুপও। নাদিফ নীরবতা ভেঙে আস্তে করে বলে,

” তাকাও আমার দিকে।”

নাদিফের কথায় ও রুপ তাকালো না উল্টো অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।

” এসো আমার সাথে।”

রুপের হাত ধরে নাদিফের ঘরে নিয়ে আসে নাদিফ। কোন কথা না বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুপকে। মাথায় স্নেহমাখা অধর ছুঁয়ে দেয় কয়েকবার।

” আমার বউ। ভালোবাসি।”

বউ শব্দটা রুপের কর্ণধারে আসতেই রুপ খানিকঠা কেঁপে উঠে। সারা শরীরে আলাদা শিহরণ বইয়ে যায় রুপের। রুপও নাদিফের বক্ষঃস্থলে মাথা এলিয়ে দেয়। আজ এই বক্ষঃস্থলে মিশে থাকতে কোন বাঁধা নেই না আছে সংশয়। আছে শুধু পবিত্রতা।

” আমিও ভালোবাসি আপনাকে। ”

কিছু সময় অতিবাহিত হয়। নাদিফ রুপের হাত ধরে বিছানার উপর বসায়। এরপর নিজে রুপের পাশে বসে বলে,

” বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে। তো এত দুরত্ব কিসের? ভয় পাও আমাকে নাকি লজ্জা?”

রুপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আকস্মিক বলে উঠে,

” আপনি সিংহের নানা, জলহস্তীর খালু। আপনাকে ভয় পাবো না তো ভাল্লুককে ভয় পাবো?”

একে তো রাত, তার উপর নাদিফের লাগামহীন কথার ভয়। রুপের মাথা যেন আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। নাদিফের কোন কথার উওরে কি বলছে নিজেই জানে না।

” কি বললে তুমি? মাথা ঠিক আছে? নাকি ফাহিমা ভাবির সাথে থেকে থেকে ভাবির রোগে ধরেছে।”

রুপ নাদিফের কথা শুনে মিনমিন করে বলল,

” আপনাকে দেখতে পটেটো চিপ্সের মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে চেটে টেস্ট করি।”

নাদিফের এবার কাশি উঠে গেলো রুপের কথা শুনে। রুপ কি আজ নেশা করেছে? নাদিফ রুপের দিকে ভালোভাবে ফিরে তাকালো। রুপ বরাবরের মতোই নাদিফকে না দেখে আশেপাশে দেখছে। নাদিফ রুপের থুতনিতে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরায়। শক্ত কন্ঠস্বরে বলে,
” কি হয়েছে তোমার অপরুপ?”

প্রত্যুওরে রুপে বলে,

” আপনি এতো সুন্দর কেন?”

নাদিফের যেন এবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। নাদিফ ভাবছে,
“হয়েছে কি মেয়েটার? ভূতে ধরেছে? নাকি পেত্নি। এই মেয়ে রুপ তো! রুপ তো এভাবে কথা বলে না! তাহলে কে এই রুপের বেশে ছদ্মবেশী?”

” আমি আপনাকে চুমু খাই?”

সহ্যের সীমা যেন শেষ হয়ে গিয়েছে নাদিফের। রুপের উদ্ভট কথাতে নাদিফের মনে হচ্ছে নাদিফ মেয়ে আর রুপ ছেলে যা খুবই লজ্জাজনক।
রুপ হাসছে নাদিফের অগোচরে। নাদিফ রুপের পাশ থেকে উঠে যায়। টেবিলের উপর রাখা পানির পাত্র হতে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে নেয়। রুপ নাদিফকে আরো একটু বাজিয়ে দিতে বলে,
” কই গো! চলে গেলেন কেন? এখানে আসুন, পাশে বসুন। আপনার ঠোঁট টা অনেক সুন্দর। ইচ্ছে করছে,,,,,

রুপের কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই নাদিফ রুপের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দেয়। নাদিফ মাথায় হাত রেখে ব্যাথাতুর অভিনয়ে বলে,

” মাথা খুব ব্যাথা করছে, অপরুপ! আগামীকাল কথা হবে।”
রুপ জানে নাদিফের অভিনয়ের কারণ। রুপও পাল্টা মুখশ্রীতে বচলিত ভাব এনে বলে,

” কি বলছেন কি? এতো ব্যাথা করছে? আমি কি টিপে দিবো! মাথা!”

রুপকে ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে নাদিফ দরজা আঁটকে দিলো। ফ্যান আরেকটু বাড়িয়ে পর্দা জানালা সব খুলে দিলো।
এদিকে রুপ নাদিফের ঘরেট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে হাসছে। নিজেকে কয়েকশত বার বাহবাও দিয়েছে।
ফোন কানে ধরে ফোনের ঐপাড়ে থাকা ফাহিমাকে তিনবার ধন্যবাদ দিলো রুপ। কেননা ফাহিমার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আজ রুপ নাদিফের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে।
————

” চুমকি হাঁটছে বারান্দাতে,
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে!
রাগ করে না
ললিতা গো!
রাগলে তোমায় লাগে ভুতের মতো!!”

আয়েশা আজাদ রাগ করে বারান্দায় হাঁটছে। গভীর রাত হয়েছে ঘরে আসার নাম নিশানা নেই। আজাদ সাহেব একা ঘুমাতে পারেন না। কখন থেকে প্রিয়তমা স্ত্রীর নিকট ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ললিতা যে আজ অনেক রেগে।

” ললিতা, ক্ষমা পাবো কি করলে! পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা একসাথে মাখিয়ে খেলে? নাকি নাকে ধরে উঠা বসা করলে। তুমি যদি চাও তো এই বয়সে নাক ধরে উঠা বসা করতে পারি।”

আয়েশা আজাদ এবার ঘরে ফিরে আসলেন। স্বামীর দিকে দৃষ্টিপাত করে রাগান্বিত কন্ঠস্বরে বললেন,

” সুনয়না কে? যাকে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখো। ভালোবাসি বলো। কই আমাকে তো এই জীবনে ভালোবাসি বলো নি?”

আজাদ সাহেব পড়লেন মহা বিপদে। সুনয়না যে কে! তা নিজেই ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু এখন তো অগ্নিরুপ হয়ে থাকা ললিতাকে সামলাতে হবে কিছু একটা বলে। তাই আজাদ সাহেব ফিচেল হেসে বললেন,

” আরে আর বলিও না, গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম তো সেখানে ললিতার জায়গায় তোমাকে সুনয়না বলে ডেকে ফেলেছি। এরপর নামটা এতই ভালো লেগেছে যে তোমাকে এই নামে ডাকতে ইচ্ছে করছিল বারবার, কিন্তু বিশ্বাস করো! চোখের সামনে শুধু তুমি ছিলে আর কেউ না। আজ থেকে তো আমি তোমাকে সুনয়না বলে ডাকবো। আর কাউকে বলব না। এই যে দেখো তোমার আঁখি, কি সুন্দর টানাটানা! একদম পবিত্র। এই পবিত্র আঁখি দেখে সুনয়নাই বলে সম্বোধন করা যায়, অন্য কিছু না।”

আয়েশা আজাদ এবারে গলে মোমের ন্যায় হয়ে গেলেন। স্বামীর কাছে এসে স্বামীর বুকের বাম পাশে মাথা রেখে বললেন,

” সকালে খাবার খেতে অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝি! আসলে রেগে গিয়ে মাথা ঠিক ছিল না তাই তো এসব অখাদ্য রান্না করে গিয়েছি। আর এমন হবে না। এখন থেকে তোমার পছন্দমত খাবার রান্না করবো। আর তোমার মুখে সুনয়না ডাক টা খুবই মানায়। ঘরে বসে আমাকে সুনয়না বলেই ডাকবে বলে দিলাম।”

আজাদ সাহেব স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। আর একহাতে ললাটে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বিড়বিড় করে বললেন,

” এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম।”

———–

ভোর ছয়টায় নাদিফের বন্ধু আকাশের ডাকে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। সকালে চোখ ডলতে ডলতে নিচে নেমে আসে। আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব আজ সকালে বেরিয়েছেন হাঁটতে একসাথে সুতরাং বাসায় এখন বাচ্চারা রয়েছে। চারজন একসাথে নিচে নেমে আসে। রাইসা ম’রা’র মতো ঘুমে। নাদিফ এত সকালে আকাশের চিল্লানো দেখে বুঝে গিয়েছে কেন এসেছে। আকাশের কাছে এসে পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয় এবং বলে,

” তোর ঘরে কি বিছানা নেই! বালিশ নেই মথা ঠেকবার? বাসায় না ঘুমিয়ে এখানে এসেছে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিস কেন? সকাল সকাল আমার আরামের ঘুমও কি সহ্য হচ্ছে না তোর? শা’লা বাড়িতে বউ আছে তাও বউয়ের সাথে দুই মিনিট কথা বলতে পারিনা আর এইদিকে তোর জ্বালায় সকালে ঘুমাতে পারছি না, কি চাস তোরা?”

” আমি বিয়ে করতে চাই বন্ধু!”

নাদিফ বিরক্তিভাব মুখে টেনে এনে আরেকটা কিল বসাবে আকাশের পিঠে তখন আকাশ আবার বলে উঠে,

” বিয়ে করিয়ে দে না দোস্ত? তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমি এখনও সিঙ্গেল আছি। এটা মানা যায়?

নাদিফের মুখে এবার বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। আকাশের কানে ফিহফিস করে বলে,

” বিয়ে তোর কপালে নেই রে আকাশ! তোর ললনা অন্য কারোর হয়ে গিয়েছে।”

নাদিফের কথা শেষ হতেই বেচারা আকাশ ‘না’ বলে স্টার জলসা সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো চেঁচিয়ে উঠে এবং সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়।

আকাশ রাইসার বিয়ের দাওয়াত রইলো সকলের জন্য। আনারস আর দুধ নিয়ে আসবেন সবাই।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here