#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,সমাপ্তি পর্ব
#আফসানা_মিমি
আজ বিয়ে। দুই জোড়া দম্পতিদের বিয়ে। ফুল, ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রেম নীড়কে। কাঁচা ফুলের সুগন্ধিতে ভরপুর সারা বাড়ি কিন্তু জনমানবশূন্য। গতকাল রাতের ন্যায় মানুষজন নেই। কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে সকলে। পরিচিত কোন মুখ দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে।
ফাল্গুনী, ফয়সাল প্রেম নীড়ে পৌঁছাতে সকাল দশটা বাজিয়ে ফেলে। প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকের সামনে আসতেই ফয়সাল ফাল্গুনী অবাক হয়ে যায়। আজ দারোয়ান কুদ্দুস মোল্লার হাত সাফাইয়ের কাজ করেনি। বরং চেহারায় ছিলো দুঃখ জর্জরিত। প্রেম নীড়ের ভিতরে প্রবেশ করে আরো বিস্ময়কর পরিস্থিতিতে পড়ে ফয়সাল ফাল্গুনী। আলোকসজ্জায় সজ্জিত বাড়ি খানা নিস্তেজ হয়ে আছে। যেন কিছু একটা ঘটেছে এ বাড়িতে। ফাল্গুনী ভয় পেয়ে যায় আঁকড়ে ধরে ফয়সালের হাত। আশেপাশে লোকজনের খোঁজ করি কিছু জানার উদ্দেশ্যে।
মায়া মাত্র পরিধানের কাপড় পরিবর্তন করে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়েছে। ফাল্গুনী ফয়সালকে দেখে প্রশ্ন করে,
” কাকে চাচ্ছেন? বাসায় তো কেউ নেই। মেহমানরা বিদায় নিয়েছে অনেক আগে।”
” রুপ ম্যাডাম নাদিফ ভাইয়া আর বাকি সবাই কোথায়?”
মায়া এবার যা বলল তা শুনে ফয়সাল ফাল্গুনী কেঁপে উঠলো। কোন রকম নিজেকে সামলে চলে গেলো। তাঁদের দু’জনের’ই উদ্দেশ্য গ্রীন ল্যান্ড হাসপাতাল (কাল্পনিক হাসপাতাল)
———-
গ্রীন ল্যান্ড হাসপাতালের পঞ্চম তলায় অপারেশন থিয়েটারে ঘন্টা খানিক হয়েছে অপারেশনের কার্যক্রম চলছে। বাহিরে বারন্দায় পেতে রাখা বসে আছে রুপ। দু’হাত ভরা মেহেদীর উপর টুপটুপ করে চোখের জল পড়ছে। রুপের পাশেই আকাশ বসে আছে। আকাশের কাঁধে মাথা রেখে রাইসা চুপটি করে বসে আছে। প্রেম নীড়ে আসার পর থেকে এই প্রথম রুপের কাছে মনে হচ্ছে, রুপ একা।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে শব্দ করে চলছে। সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। যত সময় বাড়ছে আতঙ্ক বিরাজ করছে রুপের মনে।
ক্লান্ত শরীরে গ্রীন ল্যান্ড হাসপাতালের পঞ্চম তলায় প্রবেশ করে নাদিফ। হাতে র’ক্তে’র ব্যাগ। ও পজিটিভ রক্ত অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছে নাদিফ। টলমল পায়ে সম্মুখ পানে এগিয়ে আসে নাদিফ। অপারেশন থিয়েটারের এক পাশে রিসিপশন সেখানে রক্তের ব্যাগ জমা দিয়ে নাদিফ আমার পাশে এসে বসলো।
” কিছু খেয়েছো?”
” বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?”
নাদিফের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। আঁখি জোড়া রক্তিম কান্না সংবরণে প্রচেষ্টা করছে খুব। রুপের কথা শুনে নাদিফ এবার কান্না শুরু করে দিলো। নাদিফ আজ অসহায়। বাড়ির সুখময় পরিবেশ এক মুহূর্তের মধ্যেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
” এমন কেন হলো রুপ? খুব তো আনন্দিত ছিলাম।”
” মা কেমন আছেন এখন?”
” আলোর পর আঁধার’ই তো আসে। হয়তো আঁধারময় রজনীর পর ভালো কিছু আসবে! দোয়া করো।”
রুপ নাদিফের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। এতদিন নাদিফ রুপের হাত আঁকড়ে ধরতো, ভরসার হাতে। আজ রুপ নাদিফকে ভরসা দিচ্ছে। চোখে চোখে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
—————–
“লাল শাড়ি পরিয়া বঁধু কই যায় রে!”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার খোঁপা দেখছেন আয়েশা আজাদ। লাল শাড়ি পরিধান করেছেন। শাড়িটা পছন্দ করেছেন প্রিয়তম স্বামী। অবশ্য এই শাড়ি নেয়াতে অমত করেছিলেন কিন্তু পর মুহূর্তে ছেলেদের জোর করায় নিতে বাধ্য হলেন।
স্বামীর মুখে গান শুনে আয়েশা আজাদ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বলে,
” ধ্যাত কি যে বলো না! আমি কি নতুন বঁধূ নাকি?”
” চাঁদের সাথে আমি দেবো না, ললিতার তুলনা!”
আয়েশা আজাদ মুখ লুকালেন স্বামীর কথায়।
স্বামীর সাথে নিচে নেমে আসলেন আয়েশা আজাদ। আজ বাড়ির সকলের ছুটি। সকলেই আনন্দ মস্তি করবে। আত্মীয়স্বজনের সাথে খোশ গল্প করবে।
ফাহিমা আজ সাজেনি। সাজতে ইচ্ছে হয় নি। শরীর ভালো যাচ্ছে না যে। সবসময় বিরক্তি ভাব থাকেই ফাহিভার মধ্যে। বাড়িতে এখনও ডেকোরেশনের কাজ চলছে। সকাল থেকে ফাহিমার মাথা গোল গোল করে ঘুরছে। যেখানে সেখানে পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নাবিল গোসল করছে এই সুযোগে ফাহিমা এসেছে বাহিরে। বিয়ে বাড়িতে সবাইকে দেখবে বলে।
সিঁড়ির নিকট এক পা দুই পা আগাতেই অঘটন ঘটে গেলো। ফাহিমা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলো। আজাদ সাহেব তখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো। ফাহিমার পড়ে যাওয়া দেখে দুই পা এগিয়ে আসে। ফাহিমাকে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচায় কিন্তু নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারে নি। ভারসাম্য হারিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে পড়ে যান। এদিকে পাশেই লোহা দিয়ে তৈরি ফুলদানি ছিলো বিয়ের সাজানোর উপলক্ষে। আজাদ সাহেব নিচে পড়ে যায় সাথে লোহার ফুলদানি আজাদ সাহেবের হাতে পড়ে যায়। রক্তের স্রোত বয়ে যায় খানিকের মধ্যেই।
কিছু সময়ের মধ্যে যেন সমস্ত কিছু উলট পালট হয়ে গেলো। আজাদ সাহেব সাথে সাথে জ্ঞান হারালেন। স্বামীর এহেন অবস্থা দেখে আয়েশা আজাদও নেতিয়ে পড়লেন জমিনে। ফাহিমা মাথা ধরে সেখানেই বসে রইলো। দাঁড়ানোর শক্তি যে অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে।
——-
ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে আয়েশা আজাদ চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ফাল্গুনী ফয়সাল বসে ছিলো আয়েশা আজাদের পাশে। চিৎকার শুনে কাছে আসলো ফাল্গুনী।
” আঙ্কেল ঠিক আছেন, আন্টি। আপনি উত্তেজিত হবে না। আমি সবাইকে বলে আসছি।”
দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়ে আবারও। বিড়বিড় করে বলে,
” আপনিহীনা আমি অসহায় প্রিয়!”
বাবা সমেত শ্বশুরের কেবিনে বসে আছে রুপ। টলমল আঁখিতে ফ্যাকাশে মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। চনচল মানুষটা আজ বিছানায় শায়িত আছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। রুপ ভাবছে সকালের কথা,
নতুন ভোরের আগমন ঘটেছে ধরণীতে। মিষ্টি সকাল উপভোগ করছে নব দম্পতি। নতুন জীবনের নতুন সূর্যোদয় দেখছে একসাথে।
” তোমার বাবা-মার কথা মনে পড়ে না?”
নাদিফের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে রুপ। আজ রুপের জীবনের বিশেষ দিন। নাদিফের কথায় রুপ চুপ করে আছে। নাদিফ রুপকে বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করে নিজেই আফসোস করছে, কেননা একজন মেয়ের জীবনে বাবা-মার গুরুত্বটা অনেক বেশি।
” মা-বাবার কথা কার ই বা ভনে না হয় বলুন! আমারও খুব মনে পড়ে। মা-বাবা দেখতে কেমন তা জানতে খুব ইচ্ছে করে। মা-বাবার আদর কেমন, পেতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নে তো অনেকবার দেখি মা-বাবা মামনি বলে ডাকে কিন্তু যখন কাছে যাই তখন ছুঁয়ে দিতে পারি না। আমার তো খুব করে কাছে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি পারি না কারণ আমি জানি না আমার মা-বাবা কে। আজকের এই দিনে আমার বাবা-মার থাকার কথা ছিল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আমাকে এতিম করে যে তারা কোথায় চলে গিয়েছেন তা জানি না।”
” সুখ সবসময় ধরা দেয় না। সুখ যখনই আসবে, আঁকড়ে ধরে রাখবে। তোমার সকল দুঃখ গ্লানি মুছে দেয়ার দায়িত্ব নিলাম অপরুপ!”
রুপ নাদিফের কথার মাঝেই বিকট শব্দ কানে অসে। তাৎক্ষণিক রুপ নাদিফ শব্দের উৎসের দিকে ছুটে যায় কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তিন প্রান্তে তিনজন আপনজন শায়িত। আজাদ সাহেবের অবস্থা করুণ। রুপ আলগোছে ফাহিমাকে আঁকড়ে ধরলো। চিৎকার করে নাদিফকে বলল, বাবাকে হাসাপাতালে নিয়ে যেতে।
তিনজনকে একসাথে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। জরুরী বিভাগে আজাদ সাহেবকে নেয়া হয়। আর আয়েশা আজাদ এবং ফাহিমাকে ভর্তি করা হয়। ফাহিমার শরীর দুর্বল। সেলাইন দিয়ে রাখা হয়। আয়েশা আজাদকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। মাথায় চাপ পড়ায় জ্ঞান হারায়।
নাবিল, নাদিফ এক মিনিটের জন্যও বসে থাকে নি। নাদিফ হাসপাতালে পরিবারকে নিয়ে এসে রক্তের সন্ধানে নাভে আর নাবিল হাসপাতালে থেকে সকল ফর্মালিটি পূরণ করে।
” মা, তোমার শাশুড়ি কোথায়? ঠিক আছে তো ললিতা?”
বাবার পাশে বসে রুপ সকালের কথা ভাবছিল। আজাদ সাহেবের কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়। আজাদ সাহেবের কণ্ঠস্বর খুবই দুর্বল শোনা যাচ্ছে। রুপ খুব আনন্দিত হয় আজাদ সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে দেখে। আজাদ সাহেবের মাথায় আঘাত পেয়েছেন যার কারণে মাথার সামনে কিছু অংশে ব্যান্ডেজ করা। আর হাত ভেঙে গিয়েছে, হাত ব্যান্ডেজ করা।
” কিছু বলবে বাবা? এখন কেমন লাগছে বাবা! মাথা ব্যথা করছে? কিছু খাবেন? পানি আনবো?
” সুখের পর যে এভাবে দুঃখ চলে আসবে তা জানা ছিল না মা! অন্তরে প্রশান্তি নে,ই পেটে খাবার পরে কি হবে!”
রূপ নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে। কতটা কষ্টের পর যে শ্বশুর বাবা কথাটা বলেছেন তা রুপ বুঝতে পারে।
আয়েশা আজাদ প্রবেশ করেন স্বামীর কেবিনে। স্বামীর বুকের উপর আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।
নাদিফ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ রক্তিম। বাবার অবস্থা জানতে ইচ্ছে করছে। নাবিল এখনও ফাহিমার কাছে। ফাহিমার শরীর অনেক দুর্বল। নাদিফকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ইশারায় আজাদ সাহেব কাছে ডাকেন। এক হাত ভাঙ্গা। অপর হাত দিয়ে আয়েশা আজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নাদিফ বাবার হাতের ইশারা পেয়ে ছুটে চলে আসে বাবার কাছে। বাবার পায়ের কাছে বসে মাথা নত করে কাঁদতে থাকে,
” তোমাকে বারবার বলি সাবধানে থাকতে। আমার কথা শুনতে ইচ্ছে হয়না তোমার তাই না বাবা! আজ যদি তোমার বড় কিছু হয়ে যেত তাহলে! আমরা তো এতিম হয়ে যেতাম।”
” আল্লাহ সহায় ছিলেন এজন্য ফিরে আসতে পেরেছি তোমাদের মাঝে। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার মেয়েকে কিছু হতে দেইনি। আমার মেয়েটা কি সুস্থ আছে। কোথায় সে? দেখতে পাচ্ছি না যে?”
” সবাই সুস্থ আছে। তোমাকে আরও কিছুদিন এখানে থাকতে হবে।”
আয়েশা আজাদ এখনো স্বামীর বুক থেকে মাথা তুলে নি। রুপ ভাবছে শ্বশুর-শাশুড়িকে এখন একা সময় দেয়া জরুরি। তাই রুপ আস্তে করে নাদিফের মাথায় হাত রাখে। মাথা নিচু করে রাখা নাদিফ মুখ তুলে তাকায় রুপের দিকে। চোখের ইশারায় নাদিফকে বোঝায় বাবা-মাকে একে ছেড়ে দিতে। নিঃশব্দে বেরিয়ে আছে দুজনে।
ফাল্গুনী ফয়সাল দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। এতক্ষণ আয়েশা আজাদের সাথে ছিলো। রুপ নাদিফকে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ফাল্গুনী ফয়সাল এগিয়ে আসে। আজাদ সাহেবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আঙ্কেল ঠিক আছে তো!”
” সবাই আমরা ঠিক আছি। তোমরা বাড়ি চলে যাও, সন্ধ্যা নেমে আসছে।”
ফাল্গুনী ফয়সাল তাৎক্ষণিক বিদায় নিলো এবং আফসোস করতে লাগলো আজকের দিনটার জন্য।
” খেয়েছো কিছু?”
” স্বামী যদি সারাদিন মুখে অন্ন না তুলে তাহলে স্ত্রী কীভাবে খাবে? অভুক্ত থাকবো সর্বক্ষণ, আপনি তো কিছু খাবেন না।”
নিরব পরিবেশ উপরতলায় এই দিকটা কেউ আসে না। নাদিফ রুপকে জড়িয়ে ধরল গভীরভাবে। মাথায় ভালোবাসার পরশ এঁকে বলল,
” আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া অপরুপ! তোমার মনের জীবনসঙ্গিনীকে পেয়ে। যে সর্বক্ষণ আমার পাশে আছে। সঠিক সময়ের অপেক্ষা। কষ্ট পেতে দিবো না তোমায়।”
———–
” দয়াল তর লাইগা রে
ফয়েজি তর লাইগা রে
আমার অঙ্গ ঝরঝর
মনে লয় উড়িয়া যাইতাম
ছাইরা বাড়ি ঘর
ফয়েজি তর লাইগা রে
দয়ালবাবা…
সকাল সকাল কাকের কন্ঠস্বরে কোকিলের গান শুনে আয়েশা আজাদের মাথা শেষ। আয়েশা আজাদ ভাবছে তাঁর আগের স্বামী’ই ভালো ছিলো। কত সুন্দর রোমান্টিক গান গাইতো! মিষ্টি কথা বলতো। আর এখন! গলা ফাটিয়ে দয়াল বাবা গান গাইছে যেই গান আয়েশা আজাদের অপছন্দনীয়।
” থামো তুমি। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। এখন গান গাইলে মাথায় ব্যথা পাবে।”
কে শুনে কার কথা, আমার যে করছে মাথা ব্যথা।
আজাদ সাহেব নিজের মতো গান গাইছেন। আজ তিনদিন হাসপাতালে তারা। আজাদ সাহেব আর থাকবেন না এখানে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠান করবেন জিদ ধরেছেন। আজাদ সাহেব আজ প্রিয়তমা স্ত্রীর কথায় কান দিলেন না। আবারও গান ধরলেন,
” ও মুরশিদ ও ও ও ও
সাত সকালে সপরিবার হাজির হাসপাতালে। উপরে ছয় তলায় কেবিনে আজাদ সাহেবকে রাখা হয়েছে। আজাদ সাহেবের গানের গলা পুরো ছয় তলায় শোনা যাচ্ছে। কেবিনে সবাই প্রবেশ করে। রুপের হাতে খাবারের বক্স। করুণ চোখে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ির হাতে সপে দেয় রুপ।
” বাবাকে খাজা বাবার রোগে ধরেছে। ঝাড় ফুক করতে হবে। আমার কাছে আক্কেল আলী বাবার নাম্বার আছে, দিবো?”
ফাহিমার কথা শুনে আজাদ সাহেবের গান এমনি বন্ধ হয়ে গেলো। এই মেয়ে কবে যেন আজাদ সাহেবকে জীবন্ত মে’রে ফেলে কথার মাধ্যমে।
আয়েশা আছাদ শব্দ করে খাবার প্লেটে পরিবেশন করছেন যেন সমস্ত রাগ প্লেটের উপরে ঝাড়ছেন।
কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীতে আজাদ সাহেব সকলের পানে দৃষ্টিপাত করে আছেন। পুরোনো খাবার,জীবনের দুশমন, কুখাদ্য খাবার দেখে। যা ভাবছেন তাই, পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা খাবার প্লেটে। আয়েশা আজাদ ইচ্ছে করেই স্বামীর জন্য রান্না করিয়ে এনেছেন।
” এসব খাবার আমি গলাধ:করণ করতে পারবো। কিন্তু আমার কথা মানতে হবে। আমি বাসায় যাবো। প্রেম নীড়ের প্রতিটা যুবতী রমণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে যে।”
পর পর ভাঙা হাতে টোকা পড়লো আজাদ সাহেবের। যন্ত্রণায় চিৎকার করলেন সাথে সাথে।
” একজন রমণীর দিকে তাকাবে আর সে হচ্ছে তোমার বাচ্চার মা।”
বুড়ো বুড়ির খুনসুটির মাঝে বাচ্চারা যেন ভুলেই গেলো তারা কে!
দুপুরে জোর করে হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসে আজাদ সাহেব। ঘোষণা করেন আগামীকাল বিয়ের কার্জ সম্পন্ন হবে ঘরোয়াভাবে।
————-
সাদা লেহেঙ্গা পরিহিত অবস্থায় বসে আছে রুপ নিজের ঘরে। হাতের মেহেদীর রং চলে গিয়েছে সেটাই দেখে যাচ্ছে। রাইসা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আকাশকে দেখছে। আকাশ মাত্র প্রবেশ করেছে প্রেম নীড়ে।
” অপরুপ! তোমার হিরোকে যা সুন্দর লাগছে না! চলো হিরো পরিবর্তন করি।”
নাদিফের কথা ভনে হতেই রুপের গাল লাল বর্ণ ধারণ করে। রুপ লজ্জায় নত হয়ে যায়। নাদিফকে কেমন দেখাচ্ছে বর বেশে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে রুপের। এগিয়ে আসে জানালার কাছে। রুপ আসাতে রাইসা চলে যায় জানালার পাশ থেকে। নিচে উঁকি দেয় রুপ। আকাশের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে নাদিফ। এক মিনিট দুই মিনিট করে পর পর কয়েক মিনিট নাদিফকে দেখে যাচ্ছে রুপ। সাদা শেরওয়ানিতে রাজপুত্র লাগছে। নাদিফ সাজগোজ অবস্থায় রুপকে এখনও দেখেনি আকস্মিক জানালার দিকে নজর যেতেই নাদিফ স্তব্ধ বনে যায়। বক্ষঃস্থলের বাম পাশে হেত রেখে আকাশের উপর এক প্রকার ঢলে পড়ে।
রুপ হেসে জানালার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। নাদিফের পাগলামি দেখে মুখ ঢেকে নেয় লজ্জায়। রুপ মনে মনে বলে,
” অপেক্ষার অবসান হবে বুঝি আজ,
মনে মিলনে হবে নাহি কোন লাজ!”
নিকটবর্তী আত্মীয়রা এখনও আছে বাড়িতে। ছোট বাচ্চাদের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে, একপাশে বুড়ো দাদীদের গীত শোনা যাচ্ছে।
প্রেম নীড়ের সোফার ঘরেই বিয়ের ছোট্ট আয়োজন করা হয়েছে। দেয়াল ঘেঁষে লাইট ক্যামেরার আয়োজন করা হয়েছে। আজাদ সাহেবের মুখে হাসি। প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে পর পর শ খানেক ছবি তুলেছেন। সব অভিমান ভুলে আয়েশা আজাদ ও স্বামীর সাথে মিশে আনন্দ উপভোগ করছেন। আকাশের পরিবার খুব খুশি রাইসাকে দেখে। রাইসাকে অনেক আগেই নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। লিরা শেখ আজ গোলাপি শাড়ি পরিধান করে এসেছেন। লাল টুকটুকে পুতুল সাজে রাইসাকে দেখে গর্ব করছেন।
সকলের মধ্যে আগমন ঘটে রুপ নাদিফের। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে নব দম্পতি। একে অপরের হাতে হাত রেখে, মুখে হাসির রেখা টেনে কথা বলতে বলতে নিচে নামছে।
” অপরুপ! মায়াবী কন্যাকে চিনো! কাজল কালো আঁখির মায়াতে প্রেমে পড়েছি আজ নতুন করে। অপরাধী হতে চাই মায়াবী কন্যাকে ভালোবেসে।”
রুপ মুচকি হাসছে নাদিফের কথা শুনে। এই বুঝি সুখ মিলবে রুপের। সামনে তাকিয়ে সকলকে দেখে নিলো একবার রুপ। সুখী পরিবার রুপের। পরিবারের প্রতিটি সদস্য রুপের শত বছরের আপন।
রুপ নাদিফকে একসাথে বসানো হয়েছে। রাইসা আকাশকে একসাথে। সকলের অগোচরে নাদিফ রুপের হাত শক্ত করে ধরে রাখে।
বিয়ে সম্পন্ন হয় যথা সময়ে। রুপ এখানেই থাকবে রাইসা বিদায় নিবে। বিদায়ের সময় রাইসা রুপকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে। আপনজন বলতে রুপ’ই রাইসার সব। বিদায় বেলা খুবই কষ্টের। একজন মেয়ের কাছে বাবা-মাকে ছেড়ে পরের বাড়ি পাড়ি জমাতে হয়। অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানানসই করে নিতে হয়। আপন করে নিতে হয়। তারপর একসময় নিজের বাড়িটাই পরের বাড়ি হয়ে যায়।
রুপ নাদিফের ঘরে বসে আছে। ফাহিমা কিছুক্ষণ আগে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ফুলে সজ্জিত গোলাপের ঘরে ।
রুপ গুন গুন করে গান গাইছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে দেখছে। ভারি মেকাপের আড়ালে রুপের আসল সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে গিয়েছে। রুপের এখন ইচ্ছে করছে সবগুলো ঘষে ঘষে ওঠাতে কিন্তু নাদিফ পই পই করে বলেছে যে সে রুপকে দেখবে, কাছ থেকে দেখবে মন ভরে দেখবে। রুপের আজ মেজাজ খুব খারাপ হচ্ছে। নাদিফ এখনো আসছে না কেন তাই ভাবছে। নাদিফের দেখা মিললেই রুপ এসব ভারী লেহেঙ্গা গহনা সবকিছু থেকে মুক্তি পাবে।
মিনিট পাঁচেক পর নাদিফ আসে। নাদিফকে দেখা মাত্রই রুপের কেন যেন রাগ হয়। পিছনে ফিরে কোমরে হাত রেখে নাদিফের উদ্দেশ্য বলে,
‘ এত দেরি করলেন কেন? কতক্ষণ যাবত আমি আপনার অপেক্ষা করছি।”
বউয়ের রণচণ্ডী অবস্থা দেখে নাদিফ মুচকি হাসল। একদম পাশাপাশি এসে আয়নাতে নিজের চুল ঠিক করতে করতে উত্তর দিল,
“সবুরে মেওয়া ফলে।”
কিছুক্ষণ সময় লাগলো রুপের নাদিফের কথার মর্মার্থ বুঝতে। যখন বুঝতে পারলো ততক্ষণে রুপের রাগ সপ্তম আকাশে। রুপ নাদিফের বাহুতে কিল বসিয়ে বলল,
” এ জীবন আপনি ভালো হবেন না তাই না! ঠোঁট কা’টা বদ লোক। আমি কি বলেছি যে আমার তর সইছে না! আমি বলছি মেকআপ আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি মেকআপ ওঠাবো। আপনার জন্য এখনো এরকম ভাবে বসে আছি। নয়তো কখন ধুয়ে ফেলতাম!”
” চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।”
মাত্র ঘরে প্রবেশ কর এখনই আবার টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে নাদিফ। রুপ খেয়াল করছে নাদিফ ছাদের দিকে এগোচ্ছে। নাদিফ কিছু বলবে না দেখে নাদিফকে অনুসরণ করে চলতে লাগল পিছু পিছু। ছাদে প্রবেশ করে নাদিফ ছাদের দরজা আটকে দেয় আর প্রবেশ করে চিলেকোঠার ঘরে।
পুরো চিলেকোঠার ঘরে মোমবাতি দিয়ে সাজানো। একটা-দুইটা মোমবাতি না, শ’খানেক মোমবাতি দিয়ে পুরো চিলেকোঠা ঘর সাজানো হয়েছে। আর মধ্যেখানে সুন্দর করে গাঁদা ফুল দিয়ে আঁকা ‘ভালোবাসি বউ’।
রুপ মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কিছুর প্রত্যাশা করে নি রুপ। নাদিফের কাছ এসে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে।
” আপনাকে পেয়ে আমি পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছি প্রিয়! জীবনে আর কিছু চাইনা। একজন ভালো মনের মানুষ পেয়েছি। আর কিছু চায়না জীবনে, এভাবে আজীবন থাকতে চাই।”
————–
অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে অনেক সময়। মাস পেরিয়ে বছর। প্রেম নীড় আগের মতোই। আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের ভালোবাসাও আগের মতো। কিন্তু যখন আজাদ সাহেব উল্টাপাল্টা কাজ করে বসেন তখন আয়েশা আজাদের স্পেশাল রেসিপি পাট শাক এবং শুটকি ভর্তা খেতে দেন এটা যেন পরিবর্তন হয়নি। এভাবেই চলছে প্রেম নীড়ের প্রশান্তির ভেলা।
ফাহিমা এবং নাবিলের ঘরে আলো করে এসেছে কন্যা সন্তান যার নাম রেখেছে রুপ, আদরি।
সকাল থেকে রুপ নাদিফের পেছনে ঘুরঘুর করছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাচ্ছে অনেকবার নাদিফকে কিন্তু বলতে পারছনা। নাদিফ এখন বাবার অফিসেই হাত দিয়েছে। এখন আর আগের মতো পাড়া টইটই করে ঘুরে বেড়ায় না।
সকালবেলা নাদিফ তৈরি হচ্ছিল অফিসে যাবে বলে। ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি পরছিল নাদিফ। তখনই রুপ হাজির হয়। নাদিফের পিঠে আঁকিবুকি করে বলতে থাকে,
” এই যে শুনেন না! আম খেতে ইচ্ছে করছে। কাঁচা টক আম এনে দিবেন?”
” পরের বছর আসলামপুরে নিয়ে যাবো। তখন মন, পেট ভরে খেয়ে নিও।”
” আমি আম খাবো, তেঁতুল খাবো, যত টক সব খাবো, এনে দিবেন?
নাদিফের মনে সন্দেহ জাগে এবার। কপাল কুঁচকে রুপের পানে তাকায়। রুপ দাঁত কেলিয়ে হাসে। ন্যাকা বউয়ের মত শাড়ির আঁচলের গিট দিচ্ছে তো খুলছে। নাদিফের চাহনি দেখে আচল দিয়ে মুখ ঢাকে। নাদিফ যা বুঝার বুঝে ফেলে। রুপের মাথায় অধর ছুঁয়ে বলে,
” আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু যা চাও সব পাবে। আমার যে কি খুশি লাগছে না! বাবা মাকে বলেছো? চলো বাবা মাকে বলে আসি।”
আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ একমাত্র নাতনিকে নিয়ে নিচে বসে খেলেছিলেন। নাদিফ, রুপের আগমন দেখে আজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করেন,
” কি হয়েছে? তুমি অফিসের জন্য তৈরি হওনি? আজকে যাবে না না কি! খবরদার নাদিফ, অফিস কামাই করা যাবে না।অফিসের যেতেই হবে। তোমার কোনো বাহানা আমি শুনবো না। এমনিতেই মাসে দশদিনে পাঁচ দিন অফিসে যাও। আর বাকি দিন বউকে নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াও। এসব আর চলবেনা যা, অফিসে যাও।”
” আজ আমাকে মে’রে ফেললেও অফিসে যাবো না। আজ আমার আনন্দের দিন, খুশির দিন। আজ সারাদিন আমি নাচবো, গাইবো ঘুরব ফিরব।”
” এই ললিতা! তোমার ছেলের মাথার মধ্যে কি হয়েছে দেখো তো! আমি কিন্তু এখন মুখ খুললে তোমার ছেলেকে বকা শুরু করব।”
” তুমি দাদা হবে বাবা! এখন আমি যাই ঘুরতে গেলাম বউকে নিয়ে। ঘরে বসে বসে তুমি আনন্দ করো একা একা। আমি আর আমার বউ চললাম।”
আজাদ সাহেব চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন ছেলের পানে। যেন ভুল কিছু শুনেছেন তিনি। নাতনিকে নিচে রেখে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন।
রুপ মিটমিট করে হাসছে। আজাদ সাহেব খুশির সংবাদ শুনে ফাহিমাকে বললেন রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে আসতে। আয়েশা আজাদ মিষ্টি নিয়ে আসেন।
সকলের আনন্দের মাঝে ফাল্গুনী ফয়সালের আগমন ঘটে।
ফয়সাল আসার সাথে সাথেই নাদিফ ফয়সালের মুখে রসগোল্লা ঢুকিয়ে দেয়। ফয়সাল ঢোক গিলে বলে,
” মিষ্টি তো আমরা নিয়ে এসেছি আপনাদের খাওয়াবো বলে। উল্টো আমাদের খাওয়াচ্ছেন!
এই নিন ভাই মিষ্টি খান, আমি আর ফাল্গুনী বিয়ে করেছি গতকাল। পালিয়ে বিয়ে। কেউ জানে না। অবশ্য জোর করেই করেছি, এটা আমার স্টাইল।”
” আমি রাজি না, আমি মানি না বিয়ে। আমি এখানেই থাকব ম্যাডা।ম কিছু বলুন এই পাগলকে। সবাইকে ফেলে এখন আমাকে ধরেছে।”
ফাল্গুনীর কথায় সবাই হাসছে প্রাণখুলে। রুপ সকলের হাসি দেখছে। ফাহিমা ইতোমধ্যে এসে হাজির হয় হাতে রসগোল্লার বাঁটি হাতে নিয়ে। অথচ শাশুড়ি মা সেই কখন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়েছে।
” আমি সবসময়ের মতো দেরি করে ফেললাম। সব শ্বশুর বাবার দোষ। একা আমাকে ডেকে বললেই তো হতো! ফ্রিজের সব মিষ্টি নিয়ে হাজির হতাম।”
ফাহিমার কথা শুনে আরেকদফায় হাসির রোল পড়ে যায়।
রুপ এভাবেই হাসি খুশি জীবন পালন করতে চায়। নাদিফের কাছে গিয়ে আলতো হাতে নাদিফের হাত আঁকড়ে ধরে। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। রুপ নাদিফের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছে। রুপ প্রেম নগরের প্রশান্তির ভেলায় ভাসতে চায় সর্বদা। যেখানে রয়েছে প্রশান্তি আর প্রশান্তি। রুপ বিড়বিড় করে বলে
প্রেম নগরে ঘুমিয়ে দেখেছো কভু!
মনে প্রশান্তির ভেলা যে ভাসে।
অপ্রিয়রাও প্রিয় হয়ে আসে
প্রেম নীড় ফিরে আসে।
সমাপ্ত