প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৮,০৯

0
1109

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৮,০৯
#আফসানা_মিমি
|অষ্টম পর্ব |

গভীর রজনী। ব্যাস্তময় শহর যেন নিশ্চুপ। অদূরে গলির কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রুপ শীতে কাঁপছে। অন্তরের গহীনে তীব্র অনুভূতি জন্মাচ্ছে রাগী লোকটাকে নিয়ে। রুপ তো এমন চাচ্ছে না। রুপ রাগী লোকটার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে। রাগী লোকটা তো বলেছে’ই রুপকে নিজের মতো চলতে। তাহলে সমস্যা কোথায়! রুপের কামরার সকল আসবাবপত্র আজাদ সাহেবদের। রুপ তো শুধু কাপড় বোঝাই ব্যাগ বহন করে নিয়ে এসেছে মাত্র।
আলমারি থেকে মোটা কম্বল বের করে শুয়ে পড়লো আরামদায়ক বিছানায়।
রুপ ভাবছে রাগী লোকটার কথা। কি সাঙ্ঘাতিক লোকটা। রুপের তো কোন দোষ ছিলো না! সে তো আপনমনে বৃষ্টি বিলাস করছিলো তাহলে কেন লোকটার এতো জ্বলে? রুপ একটা কথা ভেবে খুব খুশি। লোকটা আর সামনে আসবে না। এই রাগী লোকটা সামনে আসলে’ই উল্টা পাল্টা কাণ্ড ঘটে যায়। রুপের সারারাত পাড় হয়ে যায় রাগী লোকটার কথা ভেবে।

এদিকে নাদিফ বারান্দায় বসে পর পর নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু চিন্তা, কিছু ভয়, কিছু আবেগ, কিছু সংশয় নিয়ে সময় পাড় করছে।
নাদিফের অন্তরে যে অপরুপ গেঁথে গিয়েছে খুব গভীরভাবে তা বুঝছে পারছে নাদিফ। কিন্তু নাদিফ যে তাঁর অপরুপকে নিষেধ করে এসেছে নাদিফের সামনে না আসতে। নাদিফ কি পারবে! অপরুপ কে না দেখে থাকতে! নাদিফ মনে মনে ভাবছে,” অপরুপকে না দেখে থাকতেই হবে। নয়তো মেয়েটা যে চলে যাবে প্রেম নীড় ছেড়ে।”
আলগোছে নাদিফ বিছানায় শুয়ে পড়ে। অন্তরে খুব পীড়া হচ্ছে। জীবনের প্রথম নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে সব এলোমেলো লাগছে নাদিফের।
———

আজ সূর্য্যিমামা যেন খুব জলদিই পৃথিবীতে নিজের আলোর কিরণ দিচ্ছে। রুপের ঘুম ভাঙে সকাল সাতটায়। অভ্যাস মোতাবেক রুপ ঘুম ঘুম চোখে পাশে রাইসাকে ডেকে তুলতে উদ্যোগ নিলো কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো রাইসা তো শপে, ফিরবে নয়টায়। ফ্রেস হয়ে একদম তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসলো। আট টায় পড়াতে যেতে হবে।

ফাহিমা আজ বেজায় খুশি। শ্বশুর সকল সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। মনের মধ্যে আর কোন সংশয় নেই। ফাহিমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে ছোট ভাই সমেত দেবরের জন্য রুপের মত লক্ষি মেয়েকে পছন্দ করেছে তাঁর শ্বশুর। ফাহিমা আজ আলুর পরোটা বানাচ্ছে। নাদিফ, নাবিলের খুব পছন্দ আলুর পরোটা। আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব বাগানে ব্যায়াম করতে ব্যস্ত। রুপকে তৈরি হয়ে নিচে নামতে দেখে ফাহিমা খুব খুশি হয়।

” এতো সকালে তৈরি হয়ে কোথায় যাচ্ছো রুপ?”

ফাহিমার কথায় রুপ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রুপ যে টাকা বাঁচাতে এত সকালে বের হয়েছে। রিক্সা দিয়ে দশ মিনিটের রাস্তায় হেঁটে যেতে যে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।

” প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছি।”
ফাহিমা অবাক। বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুপের দিকে।

” তোমার প্রাইভেট তো আটটায়। এতো সকালে কি হেঁটে গিয়ে আটটা বাজাবে?”
রুপ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে ফাহিমার উদ্দেশ্যে বলল,

” আঙ্কেল আন্টি কোথায়?
ফাহিমা চায়ের কাপে চা ঢালছিলো। রুপের কথার প্রত্যুওরে বলল,

” বাগানে আছে। তুমি একটা কাজ করো তো! মা-বাবাকে চা দিয়ে আসো।”

রুপ হাসি মুখে চায়ের ট্রে নিয়ে বাগানে চলে গেলো।
——-
” তুমি মোর জীবনের ভাবনা,
হৃদয়ের সুখের দোলা!
নিজেকে আমি ভুলতে পারি,
তোমাকে যাবে না ভোলা!”

প্রেম নীড়ে প্রেম হবে না তা তো হবে না। বাগানে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন ব্যায়াম করতে কিন্তু আবহাওয়া গরম দেখে বাগানে চেয়ার পেতে মনের সুখে গান গাইছেন আজাদ সাহেব।

” বুঝলে ললিতা! আমার ছোট ছেলেকে ট্রেনিং দেয়া উচিত প্রেম সম্পর্কে। দেখলে না! কেমন মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। আমি যদি তোমার ছেলের জায়গায় থাকতাম তাহলে একশত টা প্রেম করে বেড়াতাম। অবশ্য এখন আমাকে দেখে যে কোন মেয়ে পাগল হয়ে যাবে।”

আয়েশা আজাদ রেগে একাকার। স্বামীর মুখে শুধু প্রেম প্রেম বার্তা। এখন তো সীমা অতিক্রম করে ছেড়েছে। এই বয়সে বলে কি না মেয়েরা পাগল হবে!
আয়েশা আজাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” দুইদিন হয় পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা করি না। ভাবছি আজ রান্না করবো।”

আজাদ সাহেব নাক কুঁচকালেন। এই পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা আজাদ সাহেবের জন্মের শত্রু। তাই প্রিয়তমা স্ত্রী সুযোগে সৎ ব্যবহার করে সর্বদা।

স্বামী স্ত্রীর কথার মাঝে রুপে আগমন ঘটে। আয়েশা আজাদ পূর্বের ন্যায় কল্পনা করছেন যে,” রুপ শাড়ি পরিধান করে হাতে মোটা বালাজোড়া পরে আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেবকে চা নাস্তা দিচ্ছে। চা পান করে খুশি হয়ে আয়েশা আজাদ নিজের গলার মোটা চেইন খানা রুপকে উপহার স্বরূপ প্রদান করছে।”

আয়েশা আজাদের সপ্নের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে রুপের কথার আওয়াজে। চায়ের ট্রেতে তিনটে পেয়ালা। দুইটাতে চা আরেকটাতে কফি বিদ্যমান।

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব হাসিমুখে চা হাতে নিলেন। পর পর চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,

” মাশাআল্লাহ বউমা! চা টা ভীষণ স্বাদের হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন আমার ছেলের বউয়ের হাতের চা পেলে দিনটা’ই সুন্দর যাবে।”

রুপের চোখ আজও কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। বউমা কাকে বলছে আজাদ সাহেব?

” আমি রুপ আঙ্কেল! আপনার বউমা রান্না করছে।”

আয়েশা আজাদ স্বামীকে চিমটি কাঁটেন। রুপকে চা হাতে দেখে অনেকটা ইমোশনাল হয়ে পড়েন তিনি তাইতো মুখ ফসকে সবসময়ের মতো সত্য কথা বলে ফেলেছেন। আজাদ সাহেব জিহ্বা কাঁটেন। রুপের দিকে করুণ স্বরে তাকিয়ে বলেন,

” আজও চশমা আনতে ভুলে গিয়েছি মা! আমি ভেবেছি আমার ছেলের বউ এসেছে।”

রুপ এবার হেসে দিলো আজাদ সাহেবের কথা শুনে। আজাদ সাহেবের কাছে গিয়ে মাথায় সেট করে রাখা চশমা চোখে লাগিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,

” চশমা আনতে আজ ভুলেন নি আঙ্কেল! বরঞ্চ সঠিক জায়গায় বসাতে ভুলে গিয়েছেন।”

রুপের কথা শুনে তিন জন একসাথে হেসে উঠলো। আয়েশা আজাদের নিকট মনে হচ্ছে রুপ’ই সঠিক পাত্রী নাদিফের জন্য এবং প্রেম নীড়ের জন্য।
রুপ হাসিমুখে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে পড়লো। আজ প্রাইভেটে যাবে না রুপ। বাবা-মা সমেত আঙ্কেল আন্টির সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবে।

” একটা প্রশ্ন ছিলো আঙ্কেল?”

আজাদ সাহেব রুপকে নিয়ে চিন্তা করছিলো। রুপের কথায় স্তম্ভিত ফিরে আসে। হাসিমুখে বলে,

” কি প্রশ্ন?”

“আপনাদের ছোট ছেলে কোথায়? তাকে দেখছি না যে?”

আজাদ সাহেব আর আয়েশা আজাদ একজন অপরজনের দিকে তাকাচ্ছেন। দু’জনের মনে’ই লাড্ডু ফুটেছে। ঐ যে ইন্ডিয়ান বিজ্ঞাপনে বলে না! ‘দিল ম্যা লাড্ডু ফুটা!’ ঠিক তেমন। রুপ যে ইচ্ছে করে নাদিফের কথা জিজ্ঞেস করছে! আজাদ সাহেব ভাবছে,’ রুপের হয়তো নাদিফকে মনে ধরেছে।’ অপরদিকে আয়েশা আজাদ ভাবছে,’ আমার ছেলের বউ হতে রাজি!’
কিন্তু দুজনের এক জনও জানে না যে রুপ কোন ছোট ছেলের কথা বলছে। দেখা যাক কি হয়!

আয়েশা আজাদ এবার হাসিমুখে ছেলের গুনগান শুরু করলেন,

” আর বলিও না মা! আমার ছোট ছেলেটা যা পরিশ্রমী! সারারাত ল্যাপটপে মোবাইলে কাজ করে সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। এই যে দেখো এখনও ঘুমাচ্ছে।”

আয়েশা আজাদেরকথা শেষ হতে’ই আজাদ সাহেব এবার ছেলের গুনগান শুরু করেন,

” দুই বছর হয়েছে পড়াশোনা শেষ করেছে আমার ছেলেটা। সে তো চায় বড়ো ভাইয়ের সাথে অফিসে জয়েন হতে। কিন্তু আমি বলি কি! আগে বাসায় বসে কাজ শিখে নে তারপর জয়েন হবি।”

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেবের কথা শুনে রুপ মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে। এই দুই বাবা-মা এতো ড্রামাবাজ যা বলার মতো না।

” আমি আপনাদের দামড়া মেজো ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছি না। জিজ্ঞেস করছি আপনাদের ছোট ছেলে প্রেমের কথা! যার নাম অনুসারে ‘প্রেম নীড়’নাম রেখেছেন। ঐ যে আঙ্কেল আমাকে প্রথম দিন বলেছিলেন।”

আজাদ সাহেব এবার শুকনো ঢুক গিললেন। আড়চোখে প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আয়েশা আজাদ খুবই বিরক্ত স্বামীর এই মিথ্যা বলাতে। এখন কি উওর দিবে মেয়েটাকে! আজাদ সাহেব এবার ফট করে বলে উঠলেন,

” প্রেম তো আমার নাদিফের নাম মা! গোপন নাম। এই নামে আমি আর তুমি ডাকবো, আচ্ছা!”

————–

মধ্যাহ্নের সময় ক্লান্তির সময়। এই অসময়ে ক্লান্তিরা দলে দলে দল পাকিয়ে আসে। এই অসময়ে ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খুব’ই খারাপের। রুপ রাইসার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করলো। রুপের সামনে শক্ত কাঠের দরজা বিদ্যমান। রুপের দৃষ্টি বর্তমানে ভীত। কাঠের দরজার জন্য নয়। বরঞ্চ কাঠের দরজার ঐপাড়ের রাগী লোকটার জন্য। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন সকলে। রুপ বর্তমানে নাদিফের কামরার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গরম ধোঁয়া উড়ানো কফি। আয়েশা আজাদ রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় জোর করে রুপকে দিয়ে কফি পাঠিয়েছে। আয়েশা আজাদের কথায় হু হা মিলিয়েছে রাইসা। এজন্যই রুপ রাইসার উপর ক্ষিপ্ত। রুপ মনে মনে রাইসাকে চরম অভিশাপ দিলো, ” দোয়া করে দিলাম যেন তোর জামাই বউ পাগলা হয়। দিনে রাতে চব্বিশ ঘন্টা যেন তোকে জ্বালিয়ে মা’রে বজ্জাত মাইয়া।”

রাইসা হয়তো রুপের মনের কথা বুঝে গিয়েছে তাই তো দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

পরপর দুই তিনবার দরজায় কড়াঘাত করায় অপর পাশ থেকে চোখ বন্ধ অবস্থায় নাদিফ দরজা খুলে দেয়। দরজার অপরপাশে দণ্ডায়মান ব্যক্তিকে না দেখে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ে। এদিকে রুপ পড়েছে মহা বিপদে। রুপ ভেবেছিলো লোকটা দরজা খুললে কফি লোকটার হাতে দিয়ে চলে আসবে সে কিন্তু তা আর হলো কই। রুপ ভয়ে গুটি গুটি পা ফেলে কামরায় প্রবেশ করে। পুরো কামরায় চোখ বুলিয়ে রুপের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ চলে আসে। রুপ ভাবছে,’ এটা কি মানুষের ঘর! নাকি গোয়াল ঘর?’ উওরটা রুপের অজানা। কেননা আমাদের অগোছালো নাদিফের ঘর তাঁর মতোই অগোছালো।
কফির কাপ টেবিলের উপর থেকে চলে আসতেই নাদিফের আদুরে কন্ঠস্বর রুপের কর্ণধারে ভেসে আসে,

” মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে, একটু হাত বুলিয়ে দিবে?”

চলবে…….

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|নবম পর্ব |

কোন একটা নাটকে দেখা। সেখানে অভিনেতা বলেন কোন একজন মানুষকে ঘুম থেকে জাগ্রত করার সময়ে, “আমি ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে জাগ্রত করতে পারি কিন্তু জাগ্রত মানুষকে শত ডেকেও জাগ্রত করতে পারব না।
রুপ এই নিয়ে পাঁচ বার নাদিফকে ডেকেছে। নাদিফের কোন হেলদোল নেই। রুপের কোলে শুয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে নাদিফ। রুপের কাঁপা কাঁপা হাত বিরাজ করছে নাদিফের ঘন কালো কেশবে। প্রায় দশ মিনিট হয়েছে রুপ নাদিফের কামরায়। নাদিফ বর্তমানে রুপের কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। একটা মানুষ কীভাবে এতো ঘুমাতে পারে! রুপ ভাবছে,”নাদিফ হয়তো রুপকে আয়েশা আজাদ ভেবেছে এজন্যই সহজেই কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। নয়তো আমাকে স্বচক্ষে এখানে দেখলে পানি ছাড়া আস্তো গিলে ফেলতো। যা তেজ এই ছেলের।”

আরো কিছু সময় অতিবাহিত হলো। রুপ আস্তে করে নাদিফের মাথা নিজের কোল থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রাখে। নাদিফ নড়েচড়ে উঠে অপরপাশে ফিরে আবারও ঘুমিয়ে যায়। নাদিফের নড়াচড়া দেখে রুপ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। এক প্রকার দৌঁড়ে কামরা থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে রুপের ওড়নার সাথে বেঁধে দরজার পাশে টেবিলের উপর রাখা কাঁচের শো-পিস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রুপ আবারও ফিরে আসতে চেয়েও আসেনি। বর্তমানে এখান থেকে পাড়াপাড় হলে’ই বাঁচে রুপ।

এদিকে রুপ চলে যেতেই নাদিফের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। অপরপাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে ফিরে চোখ খুলে। জমিনে পড়ে থাকা টুকরো কাঁচগুলো দেখে বলে উঠে,

” এমন হাজারো কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হোক। এমন হাজারো সময় যেন আমার ঘুমের ঘোরে আসে। আমি এমনভাবে হাজারবার নিদ্রাহীনতার অভিনয় করতে প্রস্তুত অপরুপ!”

———

প্রেম নীড়ের সদর দরজার কলিং বেল অনবরত বেজে চলছে। এমনটা কোন সময় হয় না। পরিচিত সকলের নিকট সদর দরজার তালার চাবি আছে। আর অপরিচিত কেউ হলে দারোয়ান অবশ্যই আগে জানাবে আজাদ সাহেবকে।
সোফায় বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছিলেন আজাদ সাহেব। বার কয়েকবার কলিং বেলের আওয়াজে বিরক্ত হলেন খুব। রান্নাঘরে, সিঁড়ি দিকে কিয়ৎক্ষণ উঁকি ঝুঁকি মেরে কোন কাজ হলো না আজাদ সাহেবের। টেবিলের উপর শব্দ করে খবরের কাগজ ফেলে দরজা খুলে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলো। আজাদ সাহেবের বর্তমান মেজাজ এতোটাই বিরক্ত যে দরজার অপরপাশে যে আছে তাকে কয়েকটা বকে দিয়ে দিবে।
সদর দরজা খুলতেই দুইজন তরুন-তরুণীর হাস্যজ্বল মুখশ্রী ভেসে আসে। আজাদ সাহেব মনে করতে চেষ্টা করছেন এরা আজাদ সাহেবের কোন ভাই-বোনের বাচ্চা-কাচ্চা কিন্তু মনে করতে পারেননি। কেননা এদের একজনের চেহারার সাথে আজাদ সাহেবের ভাই-বোনের চেহারার সাথে এদের মিল নেই।

” কাকে চাই বাচ্চারা? আমার তো কোন স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে নেই। তোমরা কি চাঁদা নিতে এসেছো?”

প্রেম নীড়ের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল এবং ফাল্গুনী। ফয়সালের গণিতে সমস্যা হয়েছে তাই দর্পণ কোচিং সেন্টার থেকে রুপের বর্তমান ঠিকানা নিয়ে ফাল্গুনীকে শতক হু’ম’কি দিয়ে এখানে নিয়ে আসা। ফয়সালদের সামনে আজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে মুখে কিছুক্ষণ আগের করা প্রশ্নের উওর পাবার আশা।

” রুপ ম্যাডামের নিকট এসেছি। পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করতে। আমরা ভদ্র বাচ্চা চাঁদা নেই না।”

আজাদ সাহেব জিহ্বা কাটলেন। মনে মনে নিজেকে শ’খানেক বকা দিলেন মুখ বেশি চলার কারণে।
ফাল্গুনী ফয়সালের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ফয়সাল আজ রুপকে প্রপোজ করবে এজন্য ফাল্গুনীকে নিয়ে এসেছে। আজাদ সাহেব ফয়সাল, ফাল্গুনীকে সোফায় বসতে বলে চলে গিয়েছেন। ফয়সাল ফিসফিস করে ফাল্গুনীর সাথে কথা বলছে,

” আজ আমি সফল হবো দেখিস। ইতিহাসে আমার আর রুপ ম্যাডামকে নিয়ে লিখা হবে। লাইলি, মজনুর বদলে ফয়সাল,রুপকে নিয়ে লিখা হবে।”

ফাল্গুনীর কান শুনছে ফয়সালের কথা কিন্তু আঁখি জোড়া ঘুরছে পুরো বাড়িতে। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ফাল্গুনী অবাক হয়ে যায়। লাল ঢিলেঢালা টি শার্ট পরিহিত সুদর্শন পুরুষকে দেখে। ফাল্গুনী মনে মনে ভাবছে,
” এত সুন্দর ছেলে রুপ ম্যাডামের বাড়িতে থাকে। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কিছু কানেকশন আছে! ওরে ফয়সাল রে! তোর কপাল পুড়েছে। তোর কপালে মনে হচ্ছে আমার মত অবলা নারীই রয়েছে।”

নাদিফ এসে সোফায় ফয়সাল, ফাল্গুনীর অপরপাশে বসলো। শব্দ করে আয়েশা আজাদের নিকট কফি চাইলো।
ফয়সাল একবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার নাদিফের দিকে তাকাচ্ছে। চিকন গড়নের ফয়সালকে দেখে রোগা পাতলা একজন ক্যান্সারের রোগী মনে হচ্ছে। আর ফয়সালের সম্মুখে বসারত লম্বা, স্বাস্থ্যবান নাদিফকে সুদর্শন সুপুরুষ মনে হচ্ছে।

আয়েশা আজাদ অবগত ছিলেন না রুপের ছাত্র-ছাত্রীর ব্যপারে। নাদিফের জন্য কফি নিয়ে এসে চোখ যায় ফয়সাল ফাল্গুনীর দিকে।

” তোর কফি বাবা! এরা কারা? তোর বন্ধু নাকি?”

নাদিফ মায়ের কথায় বিরক্ত হয়। ফয়সাল, ফাল্গুনীর মতো হাঁটুর বয়সী বাচ্চারা নাকি নাদিফের বন্ধু হবে! ইহা হাস্যকর।
” দেখো তোমার নাতি-পুতি হবে হয়তো।”

নাদিফ কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। নাদিফের সামনে যে দুইটা এলিয়েন বসা সেদিকে তার খেয়াল মাত্র নেই। আয়েশা আজাদ ছেলের বেপরোয়া স্বভাবে রেগে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তোর বাবার তো প্রেম নীড় ছাড়াও আরো ইট্টু,গিট্টু নীড় রয়েছে। যেখানে হালি হালি বাচ্চা পালে। একদম বাজে কথা বলবি না নাদিফ। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

” তো যাও, নিষেধ করেছে কে?”

আয়েশা আজাদ হতাশ। ছেলে যে বাবার পাগল তা আয়েশা আজাদের জানা। পৃথিবীতে ছেলেরা নাকি মায়েদের ভালোবাসে, আর মেয়েথা বাবাদের। কিন্তু নাদিফের বেলায় ভিন্ন। তামিল চলচিত্রের মতো নাদিফ বাবার পাগল। বাবাকে নিয়ে কিছু বললে যেন তার কলিজায় লাগে। অগত্যা আয়েশা আজাদ ই হাসিমুখে ফয়সাল, ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করলেন,

” কার কাছে এসেছো তোমরা?”
ফয়সাল,ফাল্গুনী এতক্ষণ মা ছেলের কাহিনী দেখছিলো। আয়েশা আজাদের কথা শুনে ফয়সাল ফট করে বলে উঠে,

” আপনাদের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া রুপ! তার কাছে এসেছি।”

নাদিফ ফয়সালেরকথা শুনে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। নাদিফের সম্মুখে বসে থাকা ছেলেটা রুপের থেকে কম হলেও চার পাঁচ বচরের ছোট হবে। রুপকে নাম ধরে ডাকছে!

” সম্পর্কে তোমরা কি হও?”

নাদিফের থমথমে প্রশ্ন।
ফাল্গুনী এবার দাঁত দ্বারা নোখ কেঁটে যাচ্ছে। এবার ফয়সাল কি উওর দিবে ভেবেই কলিজায় পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।

” আমার প্রেমি,,,,

ফয়সালের কথার মাঝেই রুপের আগমন ঘটে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই ফাল্গুনীর উদ্দেশ্যে বলে,

” তোমরা হঠাৎ বাড়ি এলে যে? আমি তো বিকালে পড়াতে যাবো। কোন বিশেষ প্রয়োজন ছিলো কি?”

রুপ এতক্ষণ নাদিফকে দেখেনি। রুপ উদ্বিগ্ন হয়ে কথা বলছিলো। নাদিফকে দেখে আগের মত চুপ হয়ে গেলো। এদিকে নাদিফ ফয়সালের আধো কথা বুঝতে পারে। রুপের প্রেমিক হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করছে ছেলেটা ভেবেই রাগ লাগছে নাদিফের।

” এরা তোমার ছাত্র-ছাত্রী?”

নাদিফ রুপের চোখাচোখি হলো। রুপ ভীত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। নাদিফ রূপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। লতার ন্যায় কেশব পেঁচিয়ে ঢিলেঢালা খোঁপা করে রেখেছে কলম দ্বারা। তারমানে রুপ এতক্ষণ পড়ছিলো। দুষ্টু কেশব পড়ায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য শাস্তি স্বরূপ কলম দিয়েই আটকে রেখেখে রুপ। রুপের চোখে চশমা, ললাটের উপরও কিছু অবাধ্য কেশব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

ফয়সালও হা করে রুপকে দেখছে। হঠাৎ চোখ যায় নাদিফের দিকে। নাদিফ যে রুপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বুঝতে পেরে খানিকটা কেশে উঠে।
এদিকে রুপ কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কথা ভাবছে আর লজ্জা পাচ্ছে। নাদিফকে কি উওর দিবে ভাবছে,

” হ্যাঁ বিকেলে ওদের পড়াই।”

নাদিফ এবার একটু জোরেই ‘আচ্ছা’ বলল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে তাকালো।

” তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের উপরে নিয়ে যাও। আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি।”

আয়েশা আজাদের কথায় সকলে নড়েচড়ে উঠে। রুপ মাথায় সায় জানিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। পিছনে ফয়সাল, ফাল্গুনীও রওনা হয় রুপের সাথে।

” তোমার ছাত্রটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। এখানে থাকুক। আমি একা বসে বোর হয়ে যাচ্ছি। আমাকে সময় দিক। তুমি তোমার ছাত্রীকে নিয়ে উপরে যাও। চিন্তা করিও না, তোমার ছাত্রের সাথে দু চারটে কথা বলবো মাত্র।

নাদিফ শুরুর কথাগুলো হেসে খেলে বললেও শেষের কথাগুলো ফয়সালের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে। এদিকে ফয়সাল শুকনো ঢোক গিলে নাদিফের কথা শুনে। পিছনে ফিরে ফাল্গুনীর দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। ফাল্গুনী মাথা নাড়িয়ে ঠোঁটে বিড়বিড় করে বলে,

“চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আমি এখন আর কিছুই করতে পারব না। তুই আমাকে নিয়ে এসেছিস, তুই ঝামেলা পাকিয়েছিস, এবার তুই ঠিক কর।

রুপ, ফাল্গুনী চলে গেলো। বসে রইলো ফয়সাল, নাদিফ। নাদিফ কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে। উঠে দাঁড়ালো। নাদিফের দাঁড়ানো দেখে ফয়সালও আপনা আপনি দাঁড়িয়ে গেলো। নাদিফের ঠোঁটে বাঁকা হাসি রেখা বিদ্যমান। ফয়সালের কাঁধে হাত রেখে একপ্রকার জোর করে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।

” চলো তোমাকে রংধনু দেখাই। বাহারি রংয়ের রংধনু। যেদিকে তাকাবে সেদিকেই লাল, নীল,কালো,সবুজ রং দেখতে পারবে।”

কেমন রংধনু হবে নিশ্চয়ই সকলে বুঝতে পারছেন! দোয়া করেন সবাই ফয়সালের জন্য।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here