প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১০,১১

0
1071

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১০,১১
#আফসানা_মিমি
|দশম পর্ব | বোনাস পর্ব

মধ্যাহ্নের সময় মনে হয় সূর্য্যিমামা মাথার এক হাত উপরে চলে এসেছে। রোদে পুড়ে শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমালে হয়তো বালতির পর বালতি জমানো যাবে।
বাগানের পরিবেশ খুব গরম। ছায়াদার ছাউনির নিচে বসে আছে নাদিফ। দারোয়ানকে দিয়ে কোকাকোলা আনিয়েছে মাত্র। যা গরম পড়েছে! তৃষ্ণায় মরি মরি অবস্থা।
তীব্র গরমে কাঠফাটা রোদে এক পা উঠিয়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। আর সেই পায়ের উপর ক্যাকটাস গাছের ছোট্ট টব। শুকনো শরীর থেকে দশ বালতি পানি চলে গিয়েছে আপাতত। ললাটের বিন্দু ঘাম ঝড়ে পড়ছে নাক মুখ বেয়ে।

” তা কি যেন বলছিলে ছোট ভাই?”

ঢকঢক করে কোকাকোলা পান করছে নাদিফ ফয়সালের সামনে বসে। বেচারা ফয়সালের অবস্থা করুন। বলে না যে,” মুখের সামনে থেকে যখন কোন খাবার ক্ষুধার্ত প্রাণীদের থেকে কেড়ে নেয়া হয় তখন সেই প্রাণী হিংস্ররুপ ধারণ করে” ব্যাপারটা তেমন। ফয়সালের তৃষ্ণায় ইচ্ছে করছে আস্তো পুকুরের পানি পান করে ফেলতে। কিন্তু এখানে ফয়সালের ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা আছে। ফয়সালের সম্মুখে যে এখন দাঁড়িয়ে পিপাসা মেটাচ্ছে তাঁকেই এখন প্রকৃত হিংস্র প্রাণী মনে হচ্ছে। কোকাকোলার বোতল পুরোটা খালি করে অদূরে গাছের গোড়ায় নিক্ষেপ করলো নাদিফ। মাথার কেশবে হাত বুলিয়ে আবার বলল,

” মুখে কি লাগাম লাগিয়ে রেখেছো? ঘরে বসে তো অনেক কথা ই বললে। তা এখন কি হলো! রংধনুর কয়টা রং দেখতে পেলে এখন পর্যন্ত?

ফয়সালের মুখ চুপসে গেলো। প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকে নজর ফয়সালের। দারোয়ান বসা গেটের সামনে। গেট পুরোটা উন্মুক্ত। রাস্তার পথচারীরা ফয়সালের মত বড়ো ছেলেকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মজা নিচ্ছে।

” আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমি আর জীবনেও আপনার বাড়িতে বিনা অনুমতিতে আসবো না।”

নাদিফ আবারও চেয়ারে আসন পেতে বসলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল,

” তোমার অপরাধ টা কি জানো?”

ফয়সালের সাথে সাথে না উওর।

” রুপকে অসম্মান করা। দ্বিতীয় কারণটা কি জানো?”
ফয়সালের এবারও না উওর।

” রুপকে নিজের প্রেমিকা বলা।”

ফয়সালের চোখ এবার কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। পুরো কথা না বলতেই লোকটা জেনে গেলো! ফয়সাল করুণ চোখে নাদিফের পানে তাকায়। এতে নাদিফের মুখের কাঠিন্যতা বিন্দু পরিমানেরও কমে নি।

” অপরুপ আমার। শুধুই আমার। অপরুপের দিকে যে ফিরে তাকাবে তাঁর অবস্থা খুবই ভয়ানক হবে। ভাবতে পারবে না আমি আমার জিনিসের জন্য কতটুকু করতে পারি। আজ থেকে তুমি অপরুপের প্রধার দেহরক্ষী। অপরুপের গায়ে যদি এক ফোঁটা আঘাত লাগে আর আমি শুনতে পাই, তাহলে সর্বপ্রথম আমি তোমাকে ধরবো। মনে থাকবে?”

” মনে থাকবে স্যার। আর জীবনেও ম্যাডামের দিকে চোগ তুলেই তাকাবো না। ম্যাডামকে মায়ের চোখে দেখবো। এবারের মত আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

নাদিফ এবার হাসলো। আগের ন্যায় ফয়সালের কাঁধে হাত রেখে প্রেম নীড় ভবনে প্রবেশ করলো।

” কোথায় গিয়েছিলি তোরা? মেহমান এসেছে, চা নাস্তা নিয়ে এসে দেখি কেউ নেই। রুপের রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছি। তা বাবা তুমি কি উপরে যাবে? নাকি এখানে নাস্তা নিয়ে আসবো?”

আয়েশা আজাদ সোফায় বসে থাকা শান্ত, ভদ্র বাচ্চা ফয়সালকে কথাগুলো বলছিলেন। আয়েশা আজাদের কথা শুনে ফয়সাল দ্রুতগতিতে মাথা নাড়ানো শুরু করল, যার অর্থ ‘না’ সে উপরে যাবে না। অগত্যা আয়েশা আজাদ রান্নাঘরের দিকে চলে যান নাস্তা দিবে বলে।

খাবারের টেবিলের উপর ফলের ঝুড়িতে রাখা ফলসমূহের মধ্য থেকে একটা আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে ফয়সালের অপর পাশে বসলো নাদিফ। আপেলে একের পর এক কামড় বসাচ্ছে আর ফয়সালের দিকে তাকাচ্ছে। ফয়সাল নাদিফের তাকানো তে শুকনো ঢুক গিলে। ফয়সালের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ফয়সাল ইচ্ছে করছে এখন প্রেম নীড় থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু তা করতে পারছেনা না। নাদিফের অনুমতি না পেলে কিছুই করতে পারবে না।

” রংধনুর কয়টি রং দেখতে পেলে?”

“অনেকগুলো স্যার! আর জীবনেও দেখতে চাই। উচিত শিক্ষা হয়েছে আমার। আমি কি এখন ঘরের বাহিরে যেতে পারি?”

” হ্যাঁ যেতে পারো। কিন্তু একা না। এসেছো দু’জন যাবেও দু’জন। অপেক্ষা করো তোমার বন্ধুর জন্য। আরেকটা কথা, অপরুপকে যদি আজকের বিষয় কিছু বলেছ তো,,,,,,

” জীবনে বলবো না। আমি তো কোনদিন কথা’ই বলবো না। একদম চুপ করে থাকবো। কোন মেয়ের দিকে কোনদিনও তাকাবো না। আর অপরুপ থুক্কু রুপ ম্যাডামের দিকে তো কোনদিনও না। আমাকে এবারের মত ছেড়ে দিন ভাই! নাহলে আমি এখনই এক নম্বর করে দিব ভয়ে।”

নাদিফ হাসছে মন খুলে হাসছে। ফয়সাল যেমন বয়সের দিক দিয়ে ছোট তেমন আচার-আচরণের দিকেও ছোট। ফয়সালের চোখে কিছুটা ভালোলাগা কাজ করেছিল রূপের জন্য যা আজকের পর থেকে থাকবে না বলে মনে করে নাদিফ।

সিঁড়ি বেয়ে ফাল্গুনী,রুপ টুকটাক কথা বলতে বলতে নেমে আসছে। রুপের দৃষ্টি হাস্যজ্বল নাদিফের দিকে। রুপ মনে মনে ভাবছে,” লোকটা হাসতেও জানে! বাহ লোকটার হাসিটা তো খুব সুন্দর! রুপের এই প্রথম লোকটার হাস্যজ্বল চেহারা দেখা।”

ফয়সালের কাছাকাছি রুপ ফাল্গুনী চলে আসে। ফয়সাল রুপের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। অন্য সময় হলে দেখা যেতো ফয়সাল বেহায়ার মতো রুপের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আজ আর তাকালো না। ফয়সাল নাদিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ফাল্গুনীর হাত ধরে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে প্রেম নীড় থেকে বের হয়ে যায়।

” শুনো মেয়ে! বন্ধুকে বাসায় নিয়ে এক বালতি লেবুর শরবত পান করতে দিও। বেচারা আজ রংধনুর হাজারো রং দেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।”

ফাল্গুনী হা করে নাদিফের কথা শুনলো কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেলো না ফয়সালের জন্য।

এদিকে রুপ ফয়সালের কান্ড দেখে হতবাক বৃষ্টিতে প্রেম নীড়ের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুট নিজের ঘরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলে নাদিফ বলে উঠে,

” ছোট বাচ্চাদের পড়াতে যাও নাকি নিজের রুপ দেখাতে যাও শুনি? আজকাল যেখানে-সেখানে দেখি ছোট বাচ্চারা ম্যাডামের প্রেমে পড়ছে। বুঝলাম না ছোট ছোট বাচ্চাদের এতে দোষ দিবো! নাকি ম্যাডামদের!”

রুপ রেগে কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকালো। রুপের এখন ইচ্ছে করছে ইচ্ছামত রাগী লোকটাকে বকে দিতে। লোকটা আসলেই খুব খারাপ। এই লোকের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখানো ঠিক হবেনা রুপের। রুপ কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলি নাদিফ আবার বলে উঠে,

” খবরদার কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না। আমি যদি দেখি কোন ছেলের সাথে কথা বলছো তো সেখানেই জিন্দা কবর দিয়ে দিবো।”

রুপ অবাক,বিমূঢ়। রাগী লোকটা মাত্র কি বলল ভেবেই মাথা ভনভন করে ঘুরছে। জিন্দা কবর দিবে মানে? আমি কি তার প্রপার্টি নাকি! যে আমার উপর অধিকার দেখাচ্ছে? রুপ আর সামনে আগালো না। পিছনে ফিরে নাদিফের উদ্দেশ্যে বলল,

” আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। আপনার কি? আপনি না বলেছেন আমার সামনে আসবেন না?”

নাদিফ এতক্ষণ সোফায় এক প্রকার শুয়ে রুপের সাথে কথা বলছিলো। রুপের কথা শেষ হতেই দ্রুতগতিতে শোয়া থেকে উঠে রুপের একদম কাছে চলে আসে। রুপ আকস্মিক নাদিফের কান্ডে ভয় পেয়ে যায়। নাদিফের কাছ থেকে দুই কদম দূরে চলে যায়। কিন্তু নাদিফ এতে সন্তুষ্ট হলো না রুপের দিকে আরো দুই কদম কাছে চলে এসে দাঁড়ায়। রুপের একদম কাছাকাছি এসে কিছুটা ঝুকে বলে,

” আমি গতকাল কি বলেছিলাম মনে নেই! বলেছিলাম আমি তোমার কাছে আসবো না
কিন্তু তুমি যদি আমার কাছে আসো তাহলে প্রেমের জে’লে বন্দি করে রাখবো। এখন তুমি নিয়ম ভঙ্গ করেছো সাজা তো তোমায় পেতেই হবে, তাই না! আজ দুপুরে আমার কাছে এসে নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলেছো অপরুপ! শাস্তিস্বরূপ সারা জীবন এই লোকটার চোখের সামনে তোমার থাকতে হবে। আর অধিকারের কথা বলছো! খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবে অধিকারবোধ কি।”

নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। গুনগুন গান গেয়ে উপরে চলে গেলো। এদিকে রুপ নাদিফের কথা হজম করতে চেষ্টা করছে। রুপ কাঁদো কাঁদো মুখে বিড়বিড় করে বলল,

” এই কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি! না খেতে পারি, না ঘুমাতে পারি। সবকিছুতেই তাঁর আমদানি রপ্তানি। সত্যিই কি আদৌও বেঁচে আছি! তা নিয়ে সংশয়ে আমি।”

চলবে……..

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|এগারো তম পর্ব|

অতিবাহিত হয়েছে কয়েক রজনী।
আজকাল আজাদ সাহেবের পেটের অবস্থা তেমন একটা ভালো যায় না। ভ্যাপসা গরমে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে পেটের ভেতর গুরমুর শব্দ করে শুধু। ফলে যে কোন স্থানে বায়ু দূষণ করে বসে আজাদ সাহেব। ইহা খুবই লজ্জা জনক প্রতিস্থিতি। আজ তো সকল কিছুর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। হাম্মামখানা যেন আজাদ সাহেবের শয়নকক্ষ হয়ে গিয়েছে। হাম্মামখানা থেকে বের হতে না হতেই আবারও চলে যেতে হয় সেখানেই। আজাদ সাহেব নিজেকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। পড়শু ছোট ছেলের জন্মদিন আর এখন আজাদ সাহেবের ডায়েরিয়া হতে হলো! এই নিয়ে সাতবার হাম্মামখানায় আসা যাওয়া হলো। চেয়ারে বসে পেটে চাপ দিয়ে বসে আছে আজাদ সাহেব। বলাবহুল্য হাম্মামখানার দরজার সামনে চেয়ার পাতা।
আয়েশা আজাদ হাতে ইয়া বড়ো পানির জগ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। প্রিয়তম স্বামীর এমন মর্মান্ত অবস্থা থেকে ব্যথিত হলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বললেন না। কেননা আয়েশা আজাদ জানেন উনার স্বামী এক নাম্বার মুখোশধারী। যেকোন সময় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুখোশ পড়ে বসে থাকে। আয়েশা আজাদ মুখে কাঠিন্যতা ভাব এনে বললেন,

” সত্যি করে বলো, কি খেয়েছিলে?”

আজাদ সাহেব চেয়ারে বসে পেটে হাত দিয়ে নুয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

” তোমার হাতে পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা।”

আয়েশা আজাদ তেতে গেলেন। আবারও স্বামী যে মিথ্যা বলছেন তা দেখে।

” সত্যি করে বলো। নয়তো এবার কাঁচা পাট শাক আর রান্না ছাড়া কাঁচা শুঁটকি খাওয়াবো।”

এমনিতেই আজাদ সাহেবের পেটে সমস্যা তাঁর উপর স্ত্রীর কু-খাদ্যের কথা শোনা। চেয়ার থেকে উঠে আবারও দৌঁড় লাগালেন হাম্মামখানায়।

এদিকে ফাহিমা আজ দৌঁড়ে দৌঁড়ে কাজ করছে। শাশুড়ি নেই যে তাই। ফাহিমার শাশুড়ি আজ আর রান্না ঘরে পা দিবেন না শ্বশুরের অসুখ হয়েছে যে তাই। দুই চুলায় বড়ো বড়ো দুইটা পাতিল বসিয়েছে ফাহিমা। যার একটার মধ্যে চাল সিদ্ধ হচ্ছে আর অপরটার মধ্যে আলু,কাঁচ কলা সিদ্ধ হচ্ছে। এটা নতুন কিছু না প্রেম নীড়ে কয়েকদিন পর পর’ই এই মেন্যু থাকে তিনদিনের জন্য। ফাহিমা চুলার আঁচ কিছুটা কমিয়ে আরেক কাজে মন দেয়।

দূর থেকে ফাহিমার কার্যকলাপ এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিলো রুপ। আজ প্রায় এক মাস হয়েছে রুপ প্রেম নীড়ে। প্রেম নীড়ের সকলের সাথে রুপ এবং রাইসার সখ্যতা হয়েছে একমাত্র নাদিফ ছাড়া। রুপ নাদিফের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে।

” দৌঁড়াচ্ছেন কেন ভাবি?”

আজাদ সাহেবের অসুখ সম্পর্কে রুপ অজ্ঞাত। হাতে মাঝারি আকারের স্টিলের বোলে ফাহিমাকে একবার রান্না ঘরে তো একবার খাবারের টেবিলে আসতে দেখে প্রশ্ন করলো রুপ।
রূপকে দেখে ফাহিমার কলিজায় পানি এসে গেলো। এতক্ষণ ফাহিমার নিজেকে মনে হচ্ছিল এতিম এতিম। প্রতিদিন আয়েশা আজাদের সাথে কথা বলতে বলতে কাজকর্ম শেষ করতো ফাহিমা কিন্তু আজ আয়েশা আজাদ নেই। রুপকে দেখে ফাহিমা তোড়জোড় করে করে উত্তর দেয়,

” একি সর্বনাশ এর কথাবার্তা রুপ! তুমি জানো না আজ বাসায় কি হয়েছে?”

রুপ ঘাবড়ে গেলো ফাহিমার কথা শুনে। ফাহিমার পিছু পিছু একপ্রকার দৌঁড়াতে শুরু করলো রুপ।

” কি হয়েছে ভাবি! আমি তো কিছুই জানিনা। কিছু চুরি হয়েছে কি! নাকি কেউ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে? আর বলুন তো ভাবি কি হয়েছে?”

ফাহিমা এবার হাতের কাজ শেষ করে স্টিলের বোল হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ফাহিমার পিছু পিছু রুপও উঠে যাচ্ছে। রুপের একের পর এক প্রশ্নে ফাহিমা আহত হয়।আগের ন্যায় হন্তদন্ত হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে রুপ যেন দম ফেলবার পাত্রী নয় ফাহিমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে,

“কি হয়েছে ভাবি বলেন না?”

ফাহিমা সবে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ালো। এতক্ষণ তাড়াহুড়ায় রুপের কথার উত্তর দিতে পারছিলো না। কিন্তু এখন যেহেতু কাঙ্খিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাই পিছনে ফিরে রুপের কথার উত্তর দিল,

” তুমি কি জানো না, শ্বশুর আব্বা ডাইরেক হয়েছে?”

আজাদ সাহেব হাম্মামখানা থেকে বের হলেন মাত্র। বাহির থেকে ডাইরেক কথা শুনে আজাদ সাহেবের পেটে আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। আজাদ সাহেব পেটে চেপে ধরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,

” এই মেয়েটার কবে আক্কেল জ্ঞান হবে বলো তো! ডাইরেক না বলে পাতলা পায়খানা বললেও তো পারতো অথবা ডায়রিয়া বলতো। একেবারে ডাইরেক বলা কি ঠিক? তাও আবার হবু বউমার সামনে! আমার আর ইজ্জত থাকলো না।”

আয়েশা আজাদ কটমট চোখের স্বামীর পানে তাকালেন। আয়েশা আজাদ এর নিকট এখনো পরিষ্কার না যে কিভাবে আজাদ সাহেবের এই অবস্থা হয়েছে।
রুপ ফাহিমা একসাথে ঘরে প্রবেশ করে। ফাহিমার হাতে স্টিলের বাটিতে চিড়া মুড়ি ভেজানো খাবার। যা শ্বশুর বাবার জন্য নিয়ে এসেছে ফাহিমা। চিড়া মুড়ি ভিজিয়ে হালকা চিনি দিয়ে খেলে পেট টাইড হয়।

“আঙ্কেল এখন ঠিক আছেন?”

রুপের ব্যাথাতুর কণ্ঠস্বর।

” আর ঠিক রে মা! হাম্মামখানায় যেতে যেতে জীবন অর্ধেক শেষ। আমার তো এখনো ইচ্ছে করছে বালিশ কাঁথা নিয়ে হাম্মামখানায় শুয়ে থাকতে। যেন কষ্ট করে এই টুকু পথ আর হাঁটতে না হয়।”

আজাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে নাদিফ। নাদিফের চেহারায় স্পষ্ট চিন্তার রেখা বিদ্যমান। নাদিফ বিচলিত হয়ে আজাদ সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো। আজাদ সাহেবকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” কখন থেকে হচ্ছে? আমাকে খবর দিলে না কেন? ডাক্তার ডাকবো? না ডাক্তার দেখার প্রয়োজন নেই। চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সেলাইন দিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে।”

ছেলের কথা শুনে আয়েশা আজাদ তেতে উঠেন। একপ্রকার চিৎকার করে বলেন,

” আগে তোর বাবাকে স্বীকার করতে বল কি এমন খেয়েছিল যার কারণে এই অবস্থা হয়েছে। নয়তো এক পাও ঘর থেকে বের হতে দিবো না বলে দিলাম। আগে জিজ্ঞেস কর?”

নাদিফ এবার শান্তস্বরে বাবা কে প্রশ্ন করে,

” সত্যি করে বলো বাবা কি খেয়েছিলে?”

আজাদ সাহেব চোরা চোখে সকালের পানে তাকালেন। নিচের দিকে তাকিয়ে নীচুস্বরে বলা শুরু করলেন,

” মোড়ের ধারে টাকলু মামার দোকান। দোকানের সামনে দিয়ে রোজ তিনবেলা আসা-যাওয়া করি। মামার হাতের বানানো পুরি সিঙ্গারার ঘ্রাণ নাকে আসে প্রতিবেলা। একটা বিষয় কি জানিস? জীবনের সবকিছু সংযত করা যায় কিন্তু রুচিকে সংযত করা যায় না। ব্যস ইচ্ছে হলো সেখান থেকে কিছু খাবো তাই খেয়ে নিলাম। তোর মায়ের জন্য তো কিছুই খেতে পারি না বাহিরের খাবার। তাই দারোয়ানকে দিয়ে লুকিয়ে আনিয়েছিলাম পুরি সিঙ্গারা। পেট ভরে, মন ভরে খেয়েছিলাম ইচ্ছামত। তারপর এই অবস্থা।”

আয়েশা আজাদ স্বামীর দিকে এক প্রকার তেড়ে আসছেন। আজ সত্যি সত্যি আয়েশা আজাদের ইচ্ছে হচ্ছে কাঁচা পাট শাক আর কাঁচা শুঁটকি খাওয়াতে স্বামীকে। আয়েশা আজাদকে অনেক কষ্টে রুপ আটকে রাখে এবং বিছানায় বসিয়ে দেয়।

” আন্টি হয়েছে তো! আর অস্থির হবেন না। আংকেল এখন অসুস্থ। আঙ্কেলকে সুস্থ করে তুলতে হবে। এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না! ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”

নাদিফ এতক্ষণ রুপকে খেয়াল করেনি। রূপের কণ্ঠস্বর শুনে নাদিফ রুপির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আজ পনেরো দিন পর নাদিফ রুপকে দেখছে। মেয়েটা রুপের কাছ থেকে শুধু পালিয়ে বেড়ায়। রুপকে দেখে এতদিন অন্তরে পুষে রাখা রাগ প্রকাশ করল নাদিফ। রুপের উদ্দেশ্যে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তা নিয়ে যাবে তুমি! এক কাজ করি আমি বসে থাকি হাত দুটো গুটিয়ে আর তুমি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। তা এতো যেহেতু বুঝো বসে ছিলে কেন? আঙ্কেলের প্রতি একটা দায়িত্ব কর্তব্য আছে না তোমার! ছেলেদের কাজ তুমি মেয়ে হয়ে করে নিতে।”

রুপ বুঝতে পারছে এই পনেরো দিনের হিসাব নিকাশ আজ এক দিনে উসুল করবে নাদিফ। রুপ কিছু বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুপ ভাবছে যদি রুপ এখন আরো কিছু বলে তো এই ঘাড়ত্যাঁড়া আর ঠোঁট কাঁটা লোকটা দেখা যাবে এখন সবার সামনে রুপকে অপমান করা শুরু করছে।

রুপের চুপ থাকা দেখে নাদিফ আরো রেগে যায়। নাদিফের এখন ইচ্ছে করছে রুপকে আস্তো গিলে ফেলতে।
এদিকে রুপের প্রতি নাদিফের এরূপ আচরণে সকলেই স্তব্ধ বনে যায়। আয়েশা আজাদ ছেলেকে ধমকে উঠে,

” নাদিফ এটা কেমন ব্যবহার! মেয়েটাকে বকছিস কেন?”

নাদিফ কিছু বলল না। কটমট চোখে রুপের পানে তাকিয়ে রইলো। এদিকে আজাদ সাহেব বসে বসে ফাহিমার নিয়ে আসা চিড়া মুড়ি খাচ্ছে। আয়েশা আজাদ মায়া ভরা চোখে স্বামীকে দেখছেন। আয়েশা আজাদ যতোই স্বামীকে বকুক না কেন! ভালোবাসে প্রচুর।

” চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

আয়েশা আজাদ স্বামীর পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন। আজাদ সাহেব মুখে শেষ চামচ চিড়া মুড়ি ঢুকিয়ে চুপ করে রইলেন। স্ত্রীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

” আর কখনও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাবো না।”
আয়েশা আজাদ এবার হাসিমুখে বললেন,

” যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে। বাসায় বানিয়ে খাওয়াবো।”

নাদিফ বাবা-মার মিষ্টি প্রেমালাপে ব্যাঘাত ঘটায়।

” চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

আজাদ সাহেব এবার হাসিমুখে বললেন,

” তা আর যেতে হবে না। বউয়ের সেবা পেয়ে আজকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবো।”

নাদিফ আর কিছু বলল না। এখন নাদিফের বাবার মনে প্রেম জেগেছে। নাদিফ কোন পাত্তা পাবে না এখানে। ফাহিমা অনেক আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছে চুলার উপর পাতিলের কথা মনে পড়ায়।
রুপ হা করে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের প্রেমময় আলাপ শুনছে। এদিকে রুপের কান্ডে নাদিফ হাসে। রুপের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। রুপ অবাক, এই রাগী লোকটা রুপের হাত ধরেছে! কত বড়ো সাহস?

” ছাড়ুন হাত!”

” আজ কোন ছাড়াছাড়ি নাই। তৈরি হয়ে আসো। পনেরো দিন অনেক লুকোচুরি খেলেছো। আজ তোমাকে বুঝাবো লুকোচুরি করার প্রতিফল কতটা ভয়াবহ।”

আজাদ সাহেবের জন্য দোয়া করেন সবাই। যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। রুপের জন্যও করবেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here