প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১২,১৩

0
1082

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১২,১৩
#আফসানা_মিমি
#বারো তম পর্ব

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। কালো রংয়ের গাড়িটাতে যত স্পিড আছে সবটুকুই প্রয়োগ করা হয়েছে যেন এই মুহূর্তে। আরোহী রুপ ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে সিট বেল্ট শক্ত করে ধরে। নাদিফের মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। রুপের এমন জর্জরিত অবস্থা দেখেও পাষান নাদিফের হৃদয় গলছে না।

” আস্তে চালান দয়া করে, ভয় পাচ্ছি।”

নাদিফ নিশ্চুপ। কোন কথা না বলে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলো শুধু।

” ইগনোর করছিলে কেন আমাকে?”

রুপ কি বলবে লোকটাকে ভেবে পাচ্ছে না। রুপের এখনও অজানা এই রাগী লোকটা কি চায় রুপের কাছে। আর রুপও অজ্ঞাত কেন পালিয়ে বেড়িয়েছে এতদিন লোকটার কাছ থেকে। শুধুই কি লোকটার হু’ম’কি জন্য নাকি অন্য কিছু।

” কথা বলছো না কেন? কসম যদি এখন কথা না বলো তাহলে এই যে পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে না! সেখানে গাড়ি ছেড়ে দিবো। তারপর দুইজনে মরে ভুত হয়ে থাকবো আর তোমার মুখ থেকে কথা শোনার জন্য তোমার ঘাড় মটকে দিবো।”

নাদিফ যেন নিজের মধ্যে আজ নেই। চশমা ওয়ালা ভীতু,বোকা মেয়েটাকে এতদিন দেখতে না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে যেন। নাদিফের কান যেন ব্যাকুল হয়ে আছে অপরুপের কথা শ্রবণ করার জন্য, অন্তর তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে একটিবার অপরুপকে বক্ষঃস্থলে আবদ্ধ করার জন্য।

” কথা বলবে না?”

রুপ এবার মুখ খুললো। রুপির ভীত কন্ঠস্বর,

” আপনাকে দেখতে অনেক ভ’য়ং’ক’র দেখাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি।”

ব্যস রুপের একটা কথায় গাড়ি থেমে গেলো। নাদিফ গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। টায়ারে সজোরে লা’থি মেরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নেয়। রুপ স্তব্ধ বনে আছে নাদিফের কান্ডে। রাগী লোকটা এতোটা রেগে যাবে জানলে কখনোই লুকিয়ে থাকতো না রুপ। রুপ এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। রুপের একবার ইচ্ছে করছে লোকটির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে পরক্ষণে লোকটার রাগান্বিত অবস্থা দেখে ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে।
পরপর তিনটে সিগারেট শেষ করে নাদিফ পুনরায় গাড়িতে এসে বসলো। নাদিফ নিজেকে অনেকটা শান্ত করে রোপের সামনে এসেছে। রুপের ভয় পাওয়া চেহারা দেখে নাদিফ ব্যথিত হয়।

” কি খাবে?”

রুপ নাদিফের শান্ত কন্ঠস্বর শুনে বলে,

” বাসায় যাবো। বিকেলে পড়াতে যেতে হবে।”

নাদিফ ব্যথিত হৃদয়ে চুপ করে রইলো। নাদিফ না পারছে মনের কথা রুপকে বুঝাতে না পারছে সহ্য করতে। মনে কথা ব্যক্ত করতে এতো কেন কষ্ট হচ্ছে তা নাদিফের অজানা।

” প্রেমে পড়েছো কখনও?”

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে নাদিফের প্রশ্ন। রুপ নির্বাক দৃষ্টিতে নাদিফের পানে তাকিয়ে। রুপের বোকা চাহনিতে নাদিফ মুচকি হাসে। ফুলে থাকা গাল টেনে নেয় নিঃশব্দে।

” প্রেম খুবই ভয়াবহ রোগ। যাকে ধরে তাকে একদম নিস্তেজ করে দেয়। প্রিয়জনকে মনের কথা ব্যক্ত করতে না পারায় ধুকে ধুকে মরতে হয় অনিমেষে’ই। এই রোগের ঔষুধি জানা আছে কি তোমার অপরুপ!”

রুপ অনুভব করছে! রুপের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মনে ভয়ানক বিপদের বার্তা জানাচ্ছে। রুপ খুব করে চাইছে যেন ভয়ানক বার্তা রুপের জীবনে না আসে। রূপ যে এই বার্তা বহন করতে পারবে না।
রুপের মৌনতা নাদিফকে খুব পোড়াচ্ছে। কোন কথা না বলে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় নাদিফ।
————

খাবার টেবিলে আজ মনমরা পরিবেশ। সিদ্ধ ভাত, আলু ভর্তা, কাচ কলা ভর্তা দেখে সকলেরই মন বিষন্ন। এই রেসিপি তিনদিন চলবে। প্রায় সময় আজাদ সাহেবের পেটের সমস্যা হয় তখন সকলের খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায় প্রায়।
আয়েশা আজাদ আলাদা বাটিতে পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা রেখে দিয়েছেন স্বামীকে ভয় দেখাবে বলে। আয়েশা আজাদ অবগত যে তাঁর স্বামী নিশ্চয়ই কোন বাহানা করবেন এসব ভর্তা না খাওয়ার জন্য। এজন্য আয়েশা আজাদ আগে থেকেই তৈরি।
ফাহিমা গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছে কিছু। আয়েশা আজাদ সেই কখন থেকে বলছে খাবার দিতে তা কানেই যাচ্ছে না ফাহিমার। অগত্যা আয়েশা আজাদ ফাহিমার মাথায় চাঁটি মারলেন।

” উফ মা মারছো কেন? আমি জেগে জেগে ছোট ভাইয়ের আর রুপের রোম্যান্স চিন্তা করছিলাম।”

আয়েশা আজাদ ফাহিমার কথা শুনে এবার মাথায় আরেকটা চাঁটি মারলেন।
” খবরদার ফাহিমা আমার ছোট ছেলে বউমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা ভাববি না। এমনিতেই আমার ছেলেটার এতদিন পর আক্কেল হলো।”

আয়েশা আজাদের মুখের কথা শেষ হলো না তাঁর আগেই ফাহিমা বলে উঠলো,

” যেভাবে রুপকে টেনে নিয়ে গেলো! দেখে বুঝা’ই যাচ্ছিলো রুপকে মনে ধরেছে।”

বউ শাশুড়ির কথার ব্যস্ততায় আজাদ সাহেব এই মুহূর্তে কেঁ’টে পড়তে চাইছেন। এসব কু-খাদ্য আজাদ সাহেবর গলা দিয়ে ঢুকবে না। আজাদ সাহেবের এখন ইচ্ছে করছে কিছু একটা বলে বউ শাশুড়ির মাঝখানে ঝগড়া বাজাতে। তাহলে আর দুজনের একজনেরও আজাদ সাহেবের দিকে ধ্যান থাকবে না। এই ফাঁকে আজাদ সাহেব পালাতে পারবে। চেয়ার থেকে উঠে পা টিপে টিপে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে আজাদ সাহেব ঠিক তখনই আয়েশা আজাদের কণ্ঠস্বর আজাদ সাহেবের কর্ণধারা প্রবেশ করে,

” এই তুমি কোথায় যাচ্ছো? এদিকে আসো খাবার খেয়ে তবে এখান থেকে উঠবে। বাহিরের খাবার খাওয়ার সময় খেয়াল থাকে না! এখন এই খাদ্য তোমার গিলতে হবে সাথে আমরাও গিলবো।

আজাদ সাহেব করুণ চোখে আয়েশা আজাদের দিকে তাকালেন কিন্তু লাভ হল না উল্টো আয়েশা আজাদ টেবিলের মাঝখানে পাট শাক আর শুটকি ভর্তা রেখে দিলেন। তা দেখে আর আজাদ সাহেব কি আর চলে যেতে পারে! অগত্যা চেয়ারে বসে শুকনো মুখে ভাতের সাথে আলু ভর্তা মাখতে শুরু করেন।

খাবার খাওয়ার মাঝেই রুপ নাদিফ প্রবেশ করে প্রেম নীড়ে। নাদিফের হাতে খাবারের প্যাকেট।

” দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেতে আসবে। আর তোমরা খাবার খাওয়া শুরু করিও না। অপেক্ষা করো আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সকলের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। রুপ লজ্জায় চলে গিয়েছে উপরে। নিদিফ সকলের সামনে রুপের সাথে কথা বলছে দেখে আজাদ সাহেব মনে মনে বেজায় খুশি। ছেলের এত পরিবর্তন দেখে এখন নিজেকে অনেক গর্ববতী মনে হচ্ছে।

নিজের ঘরে এসে রুপ পায়চারি করতে শুরু করলো। রুপের মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে আছে। গাড়িতে নাদিফের বলা কথাগুলো রুপকে ভীষণ ভাবাচ্ছে। রুপ বুঝতে পারছে নাদিফ তাঁকে পছন্দ করে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! এই অল্প কয়েকদিনে কীভাবে রুপ কে পছন্দ করবে নাদিফ? নাদিফ তো এমন একজন মানুষ যে পদে সপদে রুপকে অপমান করতে প্রস্তুত থাকে। নাহ রুপ আর ভাবতে পারছে না। রুপ নিজের জীবনে এভাবে কাউকে প্রবেশ করতে দিবে না। রুপের জীবনটা খুবই কষ্টের। রুপ চাচ্ছে না নাদিফ নিজের অনুভূতির প্রতি আরো গুরুত্ব দিক।

” কি হয়েছে রুপ? তুমি কি কোথাও গিয়েছিলে?
একবার চোখ খুলে দেখলাম তুমি তৈরি হচ্ছো। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেলাম। আবার চোখ খুলে দেখলাম কেউ নেই ঘরে, আবারো চোখ বন্ধ করলাম। আবার চোখ খুললাম দেখি সামনে তুমি। দেখলে কতবার আমার ঘুম ভাঙল? এবার বলো কি হয়েছে তোমার?”

” আমার মনে হয় কি রাইসা! রাগী লোকটা আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।”

রাইসা সকাল থেকে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। আজাদ সাহেবের ডায়রিয়ার কথা, ফাহিমার দৌঁড়োদৌড়ির কথা, এমনকি রুপের ঘুরে আসার কথা কোন কিছুই রাইসার জানা নেই। কেননা সে তো ঘুমে ছিল। বিভোর ঘুমে! রুপের কথা শুনে রাআসার ঘুম উধাও। শোয়া থেকে চটজলদি উঠে বিছানার উপর বসে হা করে তাকিয়ে আছে। রুপ রাইসার কাণ্ডে খুবই বিরক্ত হয়। কাঁধের ব্যাগ খানা রাইসার দিকে ছুড়ে মেরে বলতে শুরু করে,
W
” আমি কিছু বলছি রাইসা। তোমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে বলছি না। দোয়া করো আমার এই কথা যেন সত্য না হয়।”

” তারমানে তুমি এতক্ষণ নাদিফ ভাইয়ের সাথে ছিলে! ও মাই গড! আমি যে কি খুশি হয়েছি! তুমি জানো না রুপ! অবশেষে, অবশেষে আমার রুপের রূপে মুগ্ধ হয়েছে কেউ একজন।”

রুপ রাইসার কথা শুনে হতাশ। রুপ খুবই চিন্তিত আজকের ঘটনা নিয়ে। এরমধ্যে রাইসার হেঁয়ালি কথায় রুপকে আরো চিন্তিত করে তুলছে।

” আমি এমন সম্পর্কে আগাতে চাইনা। তুমি দেখেছো রাইসা! প্রেম নীড়ের মানুষজন কত ভালো! আজাদ আঙ্কেল, উনার স্ত্রী, ভাবি সবাই কত ভালো। এখন রাগী লোকটা যদি আমাকে ভালবেসে বসে তাহলে পুরো পরিবারের মধ্যে যে হাসিখুশি আছে তা বিলীন হয়ে যাবে। আমি চাইনা এমন কিছু হোক।”

রাইসা এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রুপের কাছাকাছি এসে বলে,

” তুমি এতো ভাবছো কেন রুপ? যা হচ্ছে তা হতে দাও না! উপর ওয়ালা যদি নাদিফ ভাইয়ার ভাগ্যে তোমাকে রাখে তাহলে তুমি যতই আপত্তি করো না কেন কিছুই করতে পারবে না।

রাইসার কথা শুনে রুপ চুপ হয়ে যায়। রুপ কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। রুপের ভাবনার মাঝে রুপদের ঘরের দরজায় করাঘাত করে কেউ। রাইসাকে ফ্রেস হতে বলে রুপ অমনোযোগী হয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ঐপাশে নাদিফ দাঁড়ানো। নাদিফের চোখগুলো বড়ো বড়ো মার্বেলের মতো হয়ে আছে।

এদিকে রুপ নাদিফকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো। নাদিফের উদ্দেশ্যে মিনমিন করে বলে,

” আমি এখনই চলে যেতাম। রাইসাকে ডেকে তুলতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনি নিচে যান।”

নাদিফের হৃদকম্পণ যেন শতগুণে বেড়ে গেলো রুপকে এই অবস্থায় দেখে। নাদিফ কোনরকম নিজেকে সংযত করে বলে,

” গায়ে ওড়না নিয়ে আসবে তো রুপ! তুমি জানো না, লজ্জা নারীর ভূষণ!”

চলবে………

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|তেরো তম পর্ব |

আমাদের দেশে শহুরে বাসকৃত কর্মরত বাসিন্দারা একমাত্র বলতে পারবেন দৈনন্দিন ব্যস্ত শহুরের যানজটের কথা। ঘন্টার পর ঘন্টা গরমে বসে থাকতে হয় কখনো। এ যেন নিত্যদিনের রুটিন। ভ্যাপসা গরমে একেক জনের জান যায় যায় অবস্থা।

রুপ, রাইসা যাচ্ছে শপিং মলে; সাথে যাচ্ছে প্রেম নীড়ের সকল মানুষজন। ছোট্ট প্রাইভেট কারে মানুষজনের সংখ্যা বেশি। প্রাইভেট কারের সামনের সিটে নাবিল এবং আজাদ সাহেব বসে আছেন। আর পিছনের সিটে চার রমণী অর্থাৎ রুপ,রাইসা, ফাহিমা,আয়েশা আজাদ। চারজন মহিলা একসাথে বসা মানে তো বুঝাই যাচ্ছে কি একটা অবস্থা! রাইসা তো এক প্রকার রুপের কোলে চড়ে বসে রয়েছে। রুপ অস্বস্তি অনুভব করছে সকলের সাথে শপিং মলে যেতে।
আজাদ সাহেব আজ সুস্থবোধ করছেন। সকাল সকাল স্ত্রী,ছেলেদের তাগিদ দেন শপিংয়ে যাবে বলে। রুপ, রাইসাকে বলতে ভুলেনি। কেননা আজাদ সাহেবের নিকট এখন রুপ,রাইসাও প্রেম নীড়ের সদস্যদের মধ্যে দুই জন মনে করেন। রুপ প্রথমে অমত করেছিলো কিন্তু আজাদ সাহেবের একটা’ই কথা,” শপিং মলে গেলে দুই মেয়ে সহ প্রেম নীড়ের সকলে যাবে।” অগত্যা রুপ রাজি হয়ে যায়। রাইসা তো শপিংয়ের কথা শুনে একদম রেডি হয়ে যায়।
সকলের আনন্দের মাঝে একজন নিরুদ্দেশ আর সে হলো নাদিফ। নাদিফ বাসায় থাকলে আর এত কষ্ট হতো না। গাড়িতে গাদাগাদি করে বসতে হতো না। নাদিফের সহিত একজন চলে যেতো।

রুপ ভাবছে নাদিফের কথা। রুপরা মূলত শপিং মলে যাচ্ছে নাদিফের জন্মদিন উপলক্ষে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। রুপ হাতের ছোট্ট ব্যাগে টাকা দেখে নেয়। রুপের কাছে বর্তমানে ছয় হাজার তিনশত টাকা আছে। সেখান থেকে অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দিবে আর বাকিগুলো টাকা দিয়ে পুরো মাস চলবে। কিন্তু নাদিফের তো আগামীকাল জন্মদিন। বাড়ির মানুষের জন্মদিন আর কোন উপহার দিবে না এটা খারাপ দেখায়।
রুপের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ বাহিরের দিকে নজর যায়। নাদিফের মতো দেখতে একজন মোটরবাইক চড়ে রুপদের গাড়ির পাশাপাশি আগাচ্ছে। রূপ ভালো করে খেয়াল করে দেখলো মানুষটা সত্যিই নাদিফ। চোখে কালো সানগ্লাস পরে সম্মুখে তাকিয়ে প্রাইভেট কারের গতির সাথে তাল মিলিয়ে আগাচ্ছে। রুপের মনে হচ্ছে নাদিফ ইচ্ছে করেই এমন করছে রুপকে দেখার আশায়। রুপ নিজের ভাবনাতে লজ্জা পায়।

” কি ব্যাপার রুপ! তোমার গাল এমন লালচে হলো কেন? রোমান্টিক কিছু দেখেছো নাকি?”

রুপ ভাবছে! আদৌও কি রাইসা রুপের ছোট? এই মেয়েটা রুপকে সবসময় উল্টা পাল্টা কথা বলে লজ্জায় ফেলে।

” আজকাল তোমার মুখ একটু বেশিই চলে। মুখে লাগাম দাও, নয়তো খসে পড়বে।”

রাইসা হাসে রুপের কথা শুনে। এদিকে রুপ চোরা চোখে নাদিফকে দেখে যাচ্ছে। গরমে নাদিফের শরীরে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। রুপ শুকনো ঢোক গিলে। চোখ দ্বারা কোন পর পুরুষকে এভাবে ধ’র্ষ’ণ করায় আসতাগফিরুল্লাহ পড়ে।
এদিকে নাদিফ সানগ্লাসের আড়ালে রুপের অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে। চোখ থেকে সানগ্লাস নাকের ডগায় এনে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,

” চোখ দ্বারা’ই আমাকে শেষ করে দিলে! তোমার কি একটুও দয়া মায়া নেই! এখন কে আমাকে বিয়ে করবে? তোমার নজর পড়াতে যে আমি কালো হয়ে যাবো।”

রুপ সাথে সাথে গাড়ির জানালার কাঁচ আটকে দিলো। কি ভয়ানক কথা বার্তা। রুপ কেন নজর দিতে যাবে লোকটার উপর! লোকটা না চোখে কালা পট্টি বেঁধে রেখেছিলো? তাহলে রুপকে দেখলো কীভাবে?
রুপের ভাবনার মাঝেই শপিং মলে পৌঁছে যায় সবাই।

শপিং মলের সামনে মোটরবাইকে হেলান দিয়ে আপনমনে ফোনে কি যেন করছে নাদিফ। যেন সে অনেকক্ষণ হয় অপেক্ষা করছে পরিবারের জন্য।
আয়েশা আজাদ নাদিফকে দেখে অবাক। কেননা নাদিফ এই প্রথম মেয়েদের সহিত শপিং মলে এসেছে।

” কিরে নাদিফ! তুই এখানে কি করছিস?”

” তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরি করলে কেন?”

আজাদ সাহেবের মতো নাদিফকেও অভিনেতার খেতাব প্রদান করা যায়। রুপ একপ্রকার হা করে তাকিয়ে আছে নাদিফের পানে।

সকলে শপিং মলে প্রবেশ করেছে, রুপ ব্যতীত। যখন রুপ হা করে নাদিফের মিথ্যা কথা হজম করছিল তখন। এদিকে নাদিফ মুচকি হেসে রুপের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,

“মুখ বন্ধ করো অপরুপ! মশা-মাছি সহ তেলাপোকারা আশ্রয় নিতে পারবে তোমার মুখের গহ্বরে।”

তাৎক্ষণিক রুপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। রুপ কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকায়। নাদিফ চোখ টিপে সানগ্লাস পরে চলে যায় শপিং মলে। যাওয়ার আগে অবশ্য রুপকে সাবধান করতে ভুলেনি,

” চলে এসো রূপসী, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ভাববে ফুলটুসী। পাবে না আমাকে যেখানে সেখানে, বাঁচতে পারবে কোন খানে।”

রুপ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। নাদিফের পিছু পিছু এক প্রকার দৌঁড়ে প্রবেশ করে শপিং মলে।
——–

আজাদ সাহেব খুব ভাবের সহিত শপিং মলে হাঁটা চলা করছেন। যেন তিনি একজন যুবক আর উনার আশেপাশে অনেক যুবতীরা ঘুরঘুর করছে। আজাদ সাহেব আজ পাওয়ার যুক্ত চশমার বদলে কালো কুচকুচে সানগ্লাস ব্যবহার করেছেন চোখে। যার দরুন চোখের সামনে সমাতল রাস্তা উঁচু-নীচু মনে হচ্ছে। আজাদ সাহেব তবুও অনড়। মানুষের সামনে দেখাতে হবে তো! যে আজাদ সাহেব এখনও শক্তিশালী যুবক।

মহিলারা দোকানে দোকানে ঘুরছে। নাদিফ বাবার মত লিফ্টের পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ফোনে কাজ করছে। দূর থেকে বাবাকে হেলেদুলে চলাচল দেখে মুচকি হাসে। নাদিফের বাবা যে এখন মেয়েদের ইম্প্রেস করার জন্য কানা মামা থেকে ভালা মামা সেজেছে তা নাদিফের জানা।
আজাদ সাহেব ছেলেকে এখানে দেখে মনে সাহস পায় । ধীরে পায়ে ছেলের দিকে এগিয়ে বলে,

” আজকাল জোয়ান ছেলেদের চোখে বেশি সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যেখানে তাকাই সেখানে’ই ছেলেরা এক কোখ বন্ধ রেখে এক চোখ খোলা রাখে। কারণটা কি?”

বাবার কথায় নাদিফের মুখের ভাবভঙ্গি কোন পরিবর্তন হলো না। ফোনের দিকে তাকিয়ে নাদিফ উওর দেয়,

” আজকাল বুড়োরা সাদা চশমা ছেড়ে কালা চশমা পরে ঘুরে বেড়ায়। সামনে দিয়ে কোন আন্টি খালাম্মারা হেঁটে গেলে গলা ছেড়েগান ধরে, ‘গোরে গোরে মুখরেপে কালা কালা চশমা।’

আজাদ সাহেব আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। এসেছিলো ছেলেকে শায়েস্তা করতে এখন ছেলেই আজাদ সাহেবকে শায়েস্তা করে দিলো। সকলের অগোচরে আজাদ সাহেব নাদিফকে চোখে চোখে রাখছিলো। বাহিরে রুপের সাথে করা সকল কিছু আজাদ সাহেব দেখে নেয় এবং বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে। কেননা আজাদ সাহেবের ধারণা, ছেলে বাবার মতো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
——-

আয়েশা আজাদ অনেক কিছু কিনেছেন সকলের জন্য। রুপ, রাইসার জন্যও কিনেছেন কিন্তু তা রুপ, রাইসার অগোচরে। এখন সবাই পুরো শপিং মল ঘুরে ঘুরে দেখছেন। রাইসা রুপকে বলে অনেক আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছে। আয়েশা আজাদ এবং ফাহিমা এটা সেটা বলে সামনে আগাচ্ছেন। পিছনে রুপ একা একা লাল নীল সাদা রং দিয়ে সাজানো দোকানপাট দেখে যাচ্ছে। আচমকা একটা বলিষ্ঠ হাত রুপের নরম তুলতুলে হাতকে টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। রুপের এক হাত দিয়ে বলিষ্ঠ হাতের বন্ধন হতে মুখ হতে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এক ফোঁটাও ছুটতে পারেনি রুপ।

” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

” আমার প্রেমিকাকে দেখাতে।”

” আমি কাউকে দেখবো না।”

” আমাকে রাগিও না অপরুপ! অনেক ভালো মুডে আছি এখন।”

রুপ ভীত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। খুব করে দোয়া করছে যেন পরিচিত কাউকে দেখতে পায়। কিন্তু আফসোস শপিং মলের পিছনের অংশে পরিচিত-অপরিচিত কাউকে দেখতে পায়নি রুপ।
শপিং মলের এই অংশে একদম জনমানবশূন্য প্রায়। বারান্দার মত কিছু অংশে রেলিংয়ের ধারে রুপ এবং নাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস রুপের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। নাদিফ এক ধ্যানে চশমা ওয়ালা অপরুপাকে দেখে যাচ্ছে। পলক ফেলছে না নাদিফ। নাদিফের চাহনিতে রুপ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হেলানো বাতাসে রুপের মাথার কাপড় পরে যায়। রুপ যেন এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। আলগোছে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিতে বাঁধা প্রদান করে নাদিফ।

” ছেড়ে দাও না কেশবগুলো! মাতাল প্রেমিকের মতো মুগ্ধ নয়নে দেখবো তোমায়!”

রুপ স্তব্ধ হয়ে নাদিফের কথায়। রুপকে অবাক করে দিয়ে নাদিফ নিজেই রুপের মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। ললাটে গাঢ় করে অধর ছুঁয়ে বলে,

” ভালোবাসা বুঝি এমন! মনের কথা বলতে সময় নিবে আর কতক্ষণ। আমি তো পুষে রাখতে পারছি না অন্তরের জ্বালাতন। ভালোবাসি অপরুপ তোমাকে সর্বক্ষণ।”

রুপের গা কাঁপছে। মনে হচ্ছে ভীষণ অসুখ বেঁধেছে শরীরে। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে যেন। রুপের চোখের সামনে সব ঘোলাটে লাগছে। রুপ যেই ভালোবাসার ভয়ে ছিলো সেটাই হলো। এমন জনমানবহীন স্থানে এসে এমন এলাহী কাণ্ড করবে জানলে রুপ অনেক আগেই চিৎকার করতো। রুপের এখন ইচ্ছে করছে বলতে,

” ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। রুপ পড়েছে নাদিফের কবলে!”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here