প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৪,১৫

0
1008

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৪,১৫
#আফসানা_মিমি
| চৌদ্দ তম পর্ব |

কথিত আছে, “খালি কলস বাজে বেশি।” আজাদ সাহেবের বেলায় তেমন।
প্রেম নীড়ে আজ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আদরের ছোট ছেলের জন্মদিন বলে কথা! সকাল সকাল লোকজনের আসা যাওয়া হচ্ছে প্রেম নীড়ে। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে কাঁচা ফুল সহ বিভিন্ন অর্কিড ফুল দিয়ে। প্রেম নীড় যেন আজ ফুলের বাগান হয়ে উঠেছে। আজাদ সাহেব সকাল থেকে এক স্থানে চেয়ারে বসা। বসে বসে চয়ের পর চা পান করে যাচ্ছেন আর সকলকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আজাদ সাহেবের কন্ঠস্বর আজ অট্ট শোনা যাচ্ছে। নিজে কোন কাজ করছে না কিন্তু সকলকে খাটাচ্ছেন। বাদ রাখেননি প্রিয়তমা স্ত্রীকেও। চায়ের পর চা নিয়ে আসার হুকুম দিচ্ছেন পরপর। এজন্য আয়েশা আজাদ আজ চরম ক্ষিপ্ত। ক্ষিপ্ত হওয়ার’ই কথা! সকাল থেকে আয়েশা আজাদ রান্না ঘরে। সকালের চা নাস্তা পর্যন্ত করতে সময় পায়নি এর মধ্যে চা-খোর স্বামীর পর পর হুকুম। আয়েশা আজাদ আরো একটা কারণে ক্ষেপে আছে। আর সেটা হচ্ছে প্রিয় অদুরের পুত্রবধূকে নিয়ে। সাত সকালে আয়েশা আজাদকে পটিয়ে চলে গিয়েছে পার্লারে। আয়েশা আজাদ দ্যা ইমোশনাল শাশুড়ি মা বউমার কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে অনুমতি দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আয়েশা আজাদ ভরকে যায় কেননা আয়েশা আজাদের ভোলা ভালা পুত্রবধূ নিখুঁত অভিনয় করে শাশুড়িকে সালাম করে চলে যায়। তখন থেকেই এক হাতে সব সামলে নিচ্ছেন। আয়েশা আজাদ ফাহিমাকে ব্যঙ্গ করে বকছেন,
” মাগো মা! ও আমার মা জননী। আজকে না তোমার ছেলের জন্মদিন! আজ আমাকে সকলের সিমনে সুন্দর না দেখালে তুমি পড়শিদের সামনে মুখ দেখাবে কি করে। আমি যাই! ইয়েহ আমি যাই! কত সুন্দর করে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চলে গেলো। পড়ে রইলাম আমি।”
ফাহিমাকে বকার মধ্যেই আজাদ সাহেবের ফের হুকুম আসে এক কাপ চা পাঠানোর জন্য। সংবাদটা নিয়ে আসে আজকের কাজ করা লোকজনের মধ্যে একজন। আয়েশা আজাদ এবার তেতে গেলেন। চিনির স্থানে দ্বিগুণ পরিমাণ লবন মিশিয়ে চা তৈরি করে দিলেন। কাজের লোকটির হাতে চায়ের কাপ, হা করে আয়েশা আজাদকে দেখছে লোকটি।

” যদি মহাজনকে বলে দাও আমার কুকাজের কথা, তাহলে টাকা কেঁটে রেখে দিবো। মনে থাকবে তো!”

কাজের লোকটা আয়েশা আজাদের হুমকি শুনে ভয় পায়। হুড়মুড় করে চলে যায় মালিককে চা দিতে।
আয়েশা আজাদ আদরের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে মিষ্টান্ন তৈরী করছেন। পায়েস,সেমাই, মিষ্টি, দই সকল কিছু তৈরি করেছেন এক হাতে।
এখন রান্না করবেন মোরগ পোলাও। মুরগির মধ্যে লেবু, টেস্টি লবন মিশিয়ে ঢেকে দিলেন আয়েশা আজাদ। এর মধ্যেই আজাদ সাহেবের চিৎকার শোনা যায়। আয়েশা আজাদ হাতের কাজ ফেলে বের হয়ে আসেন রান্না ঘর থেকে।

” আমাকে এত কষ্ট দিয়ে তুমি কি শান্তি পাও ললিতা? আমি আরামে থাকলেই কি তোমার বুকে আগুন জ্বলে?”

বেসিনে ওয়াক ওয়াক করে সকাল থেকে এই পর্যন্ত পেটে পরা চা পানীয় বের করলেন। মুখ মুছে অসহায় হয়ে বললেন জল্লাদ বউকে।

” আগুন জ্বলে কি! তোমার আরাম দেখলে মনে হয় কেউ আমার বুকে পেট্রল ঢেলে দিয়েছে।”

” সেটা তো তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এখন বলো কি কাজ করতে হবে?”

আয়েশা আজাদ কথা বাড়ালেন না। স্বামী যে পরাজয় বরণ করেছেন তাতেই অনেক।
———-
সকাল সকালে প্রেম নীড়ের সকলে কাজে লেগে থাকলেও ঘুমিয়ে আছে নবাব নাদিফ। রান্নাঘর থেকে সুগন্ধি বের হচ্ছে খাবারের। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় নাদিফ লম্বা শ্বাস নেয়। মুখে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। নাদিফ এবার চোখ খুলল। সকাল সকাল পোলাওয়ের সুগন্ধি’ই জানান দিচ্ছে আজ নাদিফের জন্মদিন। ছোট বেলা থেকেই নাদিফের মা এই দিনে মোরগ পোলাও করেন। নাদিফকে সকালে খাবার টেবিলে বসিয়ে আয়েশা আজাদ নিজ হাতে খাইয়ে দেন। নাদিফের মন আজ খুবই খুশি। পছন্দ করা মানুষ যে নাদিফের আশেপাশে। নাদিফ আজ মন ভরে দেখবে অপরুপকে।

রান্না ঘরে খুব মনোযোগ সহকারে শসা,টমেটো কেঁটে স্পেশাল সালাদ তৈরি করছে রুপ আর কিছুক্ষণ পর পর পোলাও নেড়ে ঢেকে দিচ্ছে। আয়েশা আজাদ রুপের আগমনে আনন্দিত হোন। রুপকে বলে বলে মোরগ পোলাও রান্না করতে দেন। রুপও মায়ের সমেত আন্টির কথায় খুশি হয়।
সালাদ তৈরি করতে করতে রুপের মনে পড়ে প্রথম দিন আজাদ সাহেবের সাথে দেখা হওয়ায় কথা।

” আমার ছেলে অনেক হট কি বলি গরম তাই তো শসা খায়।”
আজাদ সাহেবের কথা মনে করে রুপ হাসে। রপ মনে মনে বলে, সত্যি আঙ্কেল আপনার ছেলে খুব গরম! এজন্যই আজ শুধু শসা’ই খাওয়াবো। যেন মাথা ঠান্ডা হয়।
রুপের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে কানের কাছে কারো ফিসফিস কথার আওয়াজে,

” হাসছো কেন অপরুপ! আমার কথা চিন্তা করে? তুমি কি খেয়াল করেছো! তোমার হাসিতে গালে গর্ত হয়ে আসে! যাকে বলে টুল পড়া হাসি! উফ পাগল করা হাসি।”

রুপ কেঁপে উঠে কথার আওয়াজে। তাড়াহুড়ো করে নড়তে গেলে আবদ্ধ হয় নাদিফের সুঠাম বক্ষঃস্থলে। রুপ নাদিফের বক্ষঃস্থল বরাবর। নাদিফ এক প্রকার রূপকে দুই হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে রেখেছে। রুপের পিছনে আগুনের উত্তাপ,চুলা।

” তুমি রান্না করছো?”

রুপের দৃষ্টি জমিনে। নাদিফ রুপের একদম কাছাকাছি। পিছনের চুলার আঁচে রুপের পিঠ যেন উত্তাপে জ্বলে যাচ্ছে। রুপ নাদিফের কথার প্রত্যুওরে মাথা উপর নিচ করে তা দেখে নাদিফ মুচকি হাসে।
” তুভি জানো কি! আজকের একটা রীতি আছে। যেই রীতি তোমার পালন করতে হবে?”

” সরে দাঁড়ান।”
” আমাকে উপহার দিবে না?”

” আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।”

রুপের কথায় নাদিফ রুপের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,

” আছে তো! আমার ভালোবাসায় ডুব দেয়া।”

কারোর আগমনের আভাস পেয়ে নাদিফ রুপের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক গলায় ঢালে।

” রুপ! পোলাও রান্না শেষ হয়েছে রে?”

” জ্বি আন্টি।”

আয়েশা আজাদ রান্নাঘরে এসে ছেলেকে দেখতে পেয়ে অবাক হোন পরমুহূর্তে পানি পান করতে দেখে কিছু মনে করেন না।

” আজ পোলাও রুপ রান্না করেছে?”

নাদিফ যে এতক্ষণ রুপের কাছাকাছি ছিলো সেটা যেন স্বপ্ন। নাদিফ না জানান ভান করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে কথাগুলো। আয়েশা আজাদ ছেলের কথায় মুচকি হাসেন। রুপের কাছে গিয়ে রুপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

” আজ তোর পছন্দের মোরগ পোলাও আমার ছোট মেয়েটা করেছে। দেখিস না কি সুন্দর সুগন্ধি বের হয়েছে! দেখবি খেতেও মজাদার হবে।”

নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। আজ নাদিফ রুপের লজ্জা আরো বাড়াবে বলে মনে মনে ছক কশে।

” খাবার খাবো মা! টেবিলে খাবার দাও।”

রুপের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে নাদিফ চলে যায়। রুপ পড়ে মহা ফ্যাসাদে। এই নাদিফ যে কোন একটা কাণ্ড আজ ঘটাবে তার আভাস রুপ পাচ্ছে।

খাবার টেবিল যেন আজ মিষ্টান্নময়। হরেক রকমের মিষ্টান্ন দিয়ে ভরপুর। সাথে রয়েছে নাদিফের মোরগ পোলাও। খাবার টেবিলে আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ, রাইসা, রুপও রয়েছে। নাবিল ফাহিমাকে নিয়ে পার্লারে। আজাদ সাহেব পর পর পাঁচটা মিষ্টি সাবার করেছেন আয়েশা আজাদের অগোচরে। আজকের দিনের একটা কঠোর নিয়ম রয়েছে। নাদিফের আহারের পূর্বে কেউ আহার করতে পারবে না। পানীয় দ্রব্য পান করে থাকতে হবে। কিন্তু আজাদ সাহেব আজ মহা খুশি। পাঁচটা মিষ্টি সাবার করে পেট ভরে টমেটো হয়ে আছে আর তা আজাদ সাহেবের প্রাণ প্রিয় স্ত্রী জানেন না।
রাইসা আজাদ সাহেবের পাশে বসেছে। আজাদ সাহেবের সকল কিছু ফোনে রেকর্ড করে রেখেছে আয়েশা আজাদের কথায়।

” আঙ্কেল! বিলাই মিষ্টি খায়।”

ফোনের দিকে তাকিয়ে রাইসা আজাদ সাহেবকে বলে। আজাদ সাহেব সত্যি সত্যি বিড়াল ভেবে বসলেন। খাবারের টেবিলের উপর নিচ পর্যবেক্ষণ করে বিড়াল না পেয়ে রাইসার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকান। রাইসা দাঁত কেলিয়ে আজাদ সাহেবের দিকে ফোন তাক করে যেখানে স্পষ্ট আজাদ সাহেবের টুপটুপ করে মিষ্টি গেলা দেখাচ্ছে। আজাদ সাহেবের মুখ একটুখানি হয়ে যায়। রাইসার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

” কি চাই?”

” ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। রুপ সহ।”

আজাদ সাহেব কিছু একটা ভেবে প্রত্যুওরে বলেন,

” ছেলে বউ সন্তান সব যাবো। চলবে?”
রাইসা আজাদ সাহেবের কথায় খুশিতে গদগদ ভাব। আজাদ সাহেবকে আচ্ছা বলে দেয়।

এদিকে নাদিফ চুপচাপ বসে আছে। আয়েশা আজাদ এটা সেটা খাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছেন ছেলেকে। কিন্তু ছেলে তাঁর মুখে কস্টিপ এঁটে বসে আছেন।

” কি হয়েছে আমার বাবাটার? খাবার কি আজ মন মতো হয়নি?”

নাদিফ মায়ের কথা শুনে কোণা চোখে রুপের দিকে তাকায় যেখানে রুপ আপাতত ব্যস্ত টেবিলের নিচের নাদিফের হাতের মুঠোয় বন্দি নিজের হাত ছুটাতে। রুপ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাদিফের দিকে। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

” প্রতি বছর যেই হাতে মোরগ পোলাও রান্না হয় সেই হাত দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিতে হয়। আমি ভাবছি এ বছর কি হবে!”

নাদিফের কথা শেষ হতেই আজাদ সাহেব বলে উঠে,

” এই বছর’ও একই হবে। যেই হাতে প্রতি বছর মোরগ পোলাও রান্না হয় সেই হাতে’ই আমার ছেলের মুখে অন্ন উঠবে।”

আজাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই রুপ ভীষম খায়। এ কেমন কঠিন বার্তা রুপের কর্ণধারে আসলো তা ভেবেই রুপের কান্না চলে আসে। এদিকে আয়েশা আজাদ মনে মনে খুশিতে আটখানা। আয়েশা আজাদ’ই তো ছেলেকে সুযোগ করে দিলেন। আয়েশা আজাদও স্বামীর কথায় তাল মিলালেন,

” হ্যাঁ হ্যাঁ! পূর্বের রীতি তো পালন করতেই হবে। রুপ মা! তোমার কোন আপত্তি আছে নাদিফকে খাইয়ে দিতে?”

রুপের যেন আজ মৃত্যুর দিন। সকলের সামনে নাদিফকে খাইয়ে দেয়ার চেয়ে মরে যাওয়া’ই ভালো রুপের জন্য। নাদিফের হাতের মুঠোয় এখনও রুপের হাত। নাদিফ রুপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

” কি অপরুপ! তৈরি তো?”

নাদিফের কথা শেষ হতেই রাইসা বলে,

” আমি তৈরি আজকের দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করতে।”
রুপ রাইসার কথা শনে কটমট চোখে তাকায়। তা দেখে রাইসা বিড়বিড় করে বলে,

” পাগলি ক্ষেপেছে।”

রুপ অবস্থা নাজেহাল। আয়েশা আজাদ নাদিফের খাবারের পাত্রে খাবার পরিবেশন করলেন। রুপ পারছে না দৌঁড়ে চলে যেতে। নাদিফ হা করে বসে আছে রুপের হাতে খাবে বলে। পর মুহূর্তে নাদিফের মুখে দুষ্টু হাসির রেখা বিদ্যমান হয়ে আসে। নাদিফ স্বর একটু টেনে বলল,

” কই গো! খাইয়ে দাও?”

চলবে……….

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|পনেরো তম পর্ব |

আমরা বাঙালিরা বিশেষ করে নারীরা শাড়ি পরিধান করতে পছন্দ করি। বর্তমানে শাড়ি পরিধান করা যেন এক প্রকার ফ্যাশন। যেখানে পূর্বে নারীদের প্রধান পোষাক ছিলো শাড়ি। নিজ হাতে কারুকার্য খচিত শাড়ি পরিধান করতেন তাঁরা। উঠতি বয়সী থেকে শরু করে বয়স্কদের সকলের প্রধান পোষাক ছিলো শাড়ি। কিন্তু আজকাল যেন সেই সোনালী দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
রুপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। রুপ বর্তমানে আয়েশা আজাদের ঘরে অবস্থান করছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কাঁচের চুড়ি রাখা আছে। শাড়িটির রং সোনালী যার মধ্যে শামুকের আকৃতি কারুকাজ করা। হালকা গোলাপি রং আছে বলা যায়। রুপ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চুড়িগুলো হাতে নিয়ে পরতে থাকে। চুড়ি পরতে পরতে এক সময় চোখ যায় ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের দিকে। লালচে রং ধারণ করা আঙ্গুলের দিকে নজর পড়তেই রুপ লজ্জায় নুয়ে যায়। ভাবতে থাকে সকালের নাদিফের করা কাণ্ডের কথা,

সকালে রুপ সকলের সামনে লজ্জায় রাঙা হয়ে রাজি হয় নাদিফকে খাইয়ে দিতে। রুপ লোকমা করে হাত উপরে তোলার আগেই নাদিফ নীচু হয়ে রুপের হাত থেকে খেয়ে নেয়। যেন নাদিফের তর সইছে না। মুখে খাবার রেখে চোখ বন্ধ করে খেয়ে বলে,

” অনেক মজার খাবার।” পরমুহূর্তে সকলের অগোচরে রুপের সামনে নিচু কন্ঠস্বরে বলে,
” ঠিক তোমার মতো।”
রুপ যেন এবার স্তব্ধ বনে গেল নাদিফের কথায়। নাদিফ যে এত ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের তা রুপ পূর্বে টের পায়নি। রুপ একপ্রকার অন্যমনস্ক হয়ে’ই নাদিফের মুখে আরেক লোকমা তুলে দেয় সাথে সাথে রুপ আর্তনাদ করে উঠে। কেননা দুষ্টু নাদিফ রুপের আঙ্গুল চিকেন মনে করে কামড়ে দিয়েছে। রুপ আড়চোখে খাবারের টেলিবের উপস্থিত সবার দিকে নজর ঘুরালো। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সকলে যার যার কাজে ব্যস্ত। রুপ এবার সাহস করে নাদিফকে বলে,

” রাক্ষস একটা। কামড়ে খেলে ফেলবেন নাকি? আমি মানুষ; গরু, ছাগল না।”

” তুমি তো আমার অপরুপ, যার প্রমত্তে বুদ হয়ে যাচ্ছি বারংবার। কি করতে কি করে ফেলি নিজের’ই অজানা।”

রুপ যেন গলিত মোমের ন্যায় গলে যাচ্ছে নাদিফের এক একটা জাদুকরী কথায়। পুরো এক প্লেট ভাত শেষ করে তবেই রুপ ছাড়া পায় নাদিফের কবল থেকে। নাদিফ যাওয়ার আগে রুপকে বকশিস দিতে ভুলে নি। সকলের সামনে রুপের হাতে মোটা দুটো পাথরের বালা উপহার স্বরূপ প্রদান করে। এসব কিছু ক্যামেরাবন্দী করে রাখে রাইসা সেই শুরু থেকেই।

কারো আগমনের আভাস পেয়ে রুপের চেতনা ফিরে আসে। এক এক করে রেশমি চুড়ি পরে নেয় কোমল হাতে।

” আমার দেয়া চুড়ি দুটো পরবে না অপরুপ?”

হঠাৎ নাদিফের কন্ঠস্বরে চমকে উঠে রুপ। আয়নায় স্পষ্ট নাদিফের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সোনালী পাঞ্জাবীতে রাজপুত্র লাগছে। রুপের রাজপুত্র। রুপ ভাবছে, রুপের রাজপুত্র নাম দেয়াটা এই রাগী লোকটার জন্য ভুল হয়নি। সত্যিই লোকটা রাজপুত্র। রুপ আয়নাতে দেখতে পাচ্ছে নাদিফ আস্তেধীরে এগিয়ে আসছে রুপের দিকে। রুপ এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে ভয় পেয়ে যায়। মনের ভেতর আলাদা নিষিদ্ধ অনুভূতি তৈরীর ব্যপারে খুব করে বকে দেয়। নাদিফ রুপের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। নাদিফের আগমনে রুপও বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। লতার ন্যায় লম্বা কেশবে আঙুল ছুঁয়ে দেয়। রুপ নাদিফের এহেন কাজে চোখ বন্ধ করে নেয়।
কিছুক্ষণ পর রুপ অনুভব করে লতানো কেশব কেউ খুব যত্ন করে গুছিয়ে দিচ্ছে। রুপ আস্তে করে চোখ খুলে নেয়। নাদিফ খুব যত্নে রুপের মাথার কেশব গুছিয়ে দিচ্ছে। নাদিফের মুখে উজ্জ্বল হাসি। নাদিফের হাসিতে রুপও হেসে ফেলে আনমনে।

” কি ম্যাডাম! সারাক্ষণ মাথায় উল্টা-পাল্টা ভাবনা ঘোরাফেরা করে হুম! আপনার এই প্রেমিক পুরুষ যেমন লাগামহীন তেমন যত্নবান। আপনাকে যেমন ভালোবাসবে, তেমন যত্নও করবে। এখন শুধু শুভ সময়ের অপেক্ষা। আপনি রাজি তো ডাকবো কাজি!”

রুপ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে নাদিফের কথা শুনে। রুপ ভেবেছিলো, রুপ শুধুমাত্র নাদিফের মোহ। হঠাৎ দেখায় ভালো লেগেছে, কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রুপের ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হলো।

” আপনি ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। যার কোন অস্তিত্ব নেই, তার পিছনে সময় অপচয় করছেন। একজন এতিম মেয়ের জন্য ভালোবাসা জন্মানো সঠিক না। আমি শুধুমাত্র মোহ, কয়েকদিন পর আপনার মোহ কেঁটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

রুপ এই প্রথম নাদিফের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলল। দর্পণে নাদিফের রক্তিম চোখ জোড়া দেখে রুপ আবারও নিজের চোখ জোড়া নিচে নামিয়ে নেয়। পরমুহূর্তে অনুভব করে লতানো কেশবে বলিষ্ঠ হাতের টান। নাদিফ রুপের কেশব হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে যার ফলে ব্যাথায় কাতর হয়ে যাওয়া রুপ চোখ বন্ধ করে আল্লাহ বলে উঠে।

” ব্যাথা পাচ্ছি।”

” আমার অনুভূতিকে নিচু মনে করেছো, অপমান করেছো আমার প্রথম ভালোবাসার অনুভবকে। আজ থেকে তোমার কাছে আমি আর আসবো না। দূরে দূরে থাকবো। তবে মনে রেখো, ভালো কিন্তু তোমাকেই বাসবো।”

নাদিফ হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রুপ সেখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলো রুপের আঁখি অশ্রুতে ভর্তি। কাঁপা কাঁপা হাতে রুপ চোখের জল ছুঁয়ে দিলো। রুপ ভাবছে এটা কিসের অশ্রু! কিছুক্ষণ আগে নাদিফের দেয়া আঘাতের অশ্রু? নাকি নাদিফ মনে যে আঘাত পেয়েছে সে ব্যথার অশ্রু। রুপ বুঝতে পারছে না কি করবে নাদিফের ভালোবাসায় সায় দিবে! নাকি নিজের মনের কথা শুনবে।
রুপ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের মুহূর্ত মনে করতে চেষ্টা করলো। রুপ যেন এক নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে দিন দিন। নাদিফের দুষ্টু কথা, রাগী চাহনি, ভালোবাসাময় পাগলামি; সবকিছু যেন রূপকে নিষিদ্ধ অনুভূতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রুপ চোখের পানি মুছে নিলো। আজকের একটি শুভদিনে রুপ চাচ্ছে না রুপের জন্য নাদিফ কষ্ট পাক। টেবিলের উপরে রাখা পাথরের বালা দুটো হাতে পরে চলে গেল ঘরের বাহিরে।
————

আয়েশা আজাদ হাতে পাঞ্জাবি টুপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সদর দরজার সামনে। রাগে গজগজ করছেন আপাতত। গতকাল রাতে পাঞ্জাবি খানা আয়রন করে রেখেছেন স্বামীর জন্য কিন্তু হলো কি! প্রিয় স্বামী আয়েশা আজাদকে হেনস্তা করার জন্য পাঞ্জাবি খানা কুঁচকে আলমারিতে রেখে দেন আয়েশা আজাদের অগোচরে। ঘরে রুপকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে চলে আসেন সেই পাঞ্জাবি হাতে স্বামীকে দু’চারটে কথা শুনানোর জন্য। কিন্তু আয়েশা আজাদের স্বামী নিরুদ্দেশ, কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। এতক্ষণ সদর দরজার কাছে চেয়ারে বসে কাজের তদারকি করছিলেন কিন্তু এখন কোথায় গেলো? আয়েশা আজাদের ছটফটের মাঝে ফয়সাল এবং ফাল্গুনী প্রবেশ করে প্রেম নীড়ে। ফাল্গুনীর মুখ হাসিখুশি কিন্তু ফয়সালের মুখ বেজার যেন কেউ ফয়সালের মুখে তিতা করল্লার রস জোড়পূর্বক ঢুকিয়ে দিয়েছে।

” এসো তোমরা। ভালো আছো তো! সেদিন ভালোভাবে কথা হয়নি তোমাদের সাথে।”

আয়েশা আজাদ হাসিমুখে ফাল্গুনী ফয়সালকে স্বাগতম জানাচ্ছে।

” এজন্যই তো ভাইয়া আজ আমাদের আসতে বললো আপনার সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য।”
ফাল্গুনীর হাসিমুখে জবাব। এদিকে ফয়সাল এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে মিনমিন কন্ঠস্বরে বলল,

” দেখা হয়ে গিয়েছে, কথাও হয়েছে, এবার চল ফাল্গুনী বাসায় যাই। যমের বাড়ি যে তিতার হাড়ি। একবার কবলে পড়তে পারলে রক্ষে নেই।”

ফাল্গুনীর এখন ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে হাসতে। নাদিফ ভাইয়া যে ফয়সালকে আচ্ছা সবক শিখিয়েছে সেটা দেখে।
” জন্মদিনের দাওয়াত খেতে এসেছি। কেক না খেয়ে যাচ্ছি না।”
ফয়সাল যেন পড়েছে মহা বিপদে। মনে মনে ফাল্গুনীকে শ’খানেক কঠিন গালি দিতে ইচ্ছে করছে।

” ফাল্গুন! বান্ধবী আমার। আমার হাত খরচের যত টাকা জমিয়েছি সব টাকা দিয়ে তোকে কেক খাওয়াবো, ঘুরতে নিয়ে যাবো, শপিং করিয়ে দিবো। আর কি করতে হবে বল সব করবো।”
ফাল্গুনী এই সুযোগ মিস করতে চাচ্ছে না। ফয়সালের উদ্দেশ্যে দুষ্টু হেসে বলে,

” এখনই প্রপোজ কর।”

ফয়সাল ফাল্গুনীকে সেখানে রেখে আয়েশা আজাদ সেই কখন চলে আসে বাগানে স্বামীকে খুঁজতে। এক সময় পেয়েও যায়। কিন্তু কাজের বাহানায় আবারও ছুটে যায় অন্য পাশে। আয়েশা আজাদের চোখ যায় প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকে। যেখানে গাড়ি থেকে নামছে শেওড়া গাছির পেত্নি অর্থাৎ ফাহিমা। অতিরিক্ত মেক আপে অপ্সরীর উপরেরটা মনে হচ্ছে ফাহিমাকে। ফাহিমা এসেই শাশুড়ির হাত ধরে কান্না শুরু করে দেয়,

” মা তোমার কথা না শুনে আমার কি হলো গো! আমাকে ঐ মহিলারা পরী সাজাইতে গিয়া কিরিম আপা সাজাইয়া দিছে। আমার সুন্দর মাথার চুলকে বাউলের বাসা করে দিয়েছে।”

আয়েশা আজাদ পুত্রবধূকে বকবেন কীভাবে ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েটাকে সত্যিই অদ্ভূত সাজিয়ে দিয়েছে মহিলারা। আয়েশা আজাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করে ফাহিমাকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন। উদ্দেশ্যে নিজের ঘর, সেখানে ঘষেমেজে ফাহিমাকে মানুষ বানাবেন।
———-

যথা সময়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। নাদিফ গম্ভীর মুখে বসে আছে সোফায়। পুরো প্রেম নীড়ে মানুষজন ভর্তি। রুপের দেখা পাওয়া মুশকিল। নাদিফ জানে রুপ আসবে নাদিফের মান ভাঙাতে কিন্তু নাদিফের মন গলবে না বলে পন করেছে। হলোও তাই! নাদিফের ধারণা সঠিক। হাতের চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজে রুপের আগমন ঘটে। নাদিফ অনুভব করছে রুপ নাদিফের আশেপাশে’ই। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, রুপ রাইসার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কিন্তু দৃষ্টি নাদিফের দিকেই। নিদিফ বাঁকা হাসলো। সোফা থেকে উঠে নাদিফের বন্ধু মহলের দিকে এগিয়ে গেলো।

জন্মদিনের রীতি অনুযায়ী কেক কাটার ব্যাবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু নাদিফ প্রতিবারের মতো কেক কাটবে না। কেকের উপর কিছু একটা লিখে দুজন লোক ডেকে পাঠিয়ে দেয় নিদ্দির্ষ্ট স্থানে।

বন্ধুমহলের কেন্দ্রবিন্দু নাদিফ। বর্তমানে আলোচনা হচ্ছে রুপ নামক অপরুপকে নিয়ে।

” তুই শিউর, তুই মেয়েটিকে ভালোবাসিস!”

” একশত পার্সেন্ট শিউর। তাহলে এত দুরত্ব কেন?”
” সে চায় না আমাকে।”

” তোর মাথা ঠিক আছে তো! তোর মতো ছেলেকে ঐ মেয়ে চায় না, অবিশ্বাস্যকর।”

আকাশ, নাদিফের মধ্যে কথা হচ্ছে। আকাশ বন্ধুর জন্য খুবই খুশি। কিন্তু পরমুহূর্তে আহত হলো রুপৃর অবস্থা শুনে। আকাশের কথায় নাদিফ বলে,

” সে সবার চেয়ে আলাদা, অপরুপ।”

আকাশ হাসে বন্ধুর কথা শুনে। প্রেমে পড়লে কি সত্যিই চোখে যা দেখে তাই ভালো লাগে! আকাশ ভাবছে।
আকাশ, নাদিফের কথোপকথনের মাঝে রুপ নাদিফের নিকটে আসে। চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলে,

” আমি’ই পরাজিত হয়েছি। চলে এসেছি স্ব-শরীরে আপনার কাছে।”

চলবে……………..

[গতকাল একটা বাক্য ভুল লিখেছিলাম, ‘ভাঙা কলস বাজে বেশি’ বাক্যটি ভুল। সঠিক হবে,’খালি কলস বাজে বেশি’। ক্ষমা করবেন ভুলত্রুটির জন্য।
আসসালামু আলাইকুম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here