প্রেমনগর পর্বঃ৫ +৬

0
2622

প্রেমনগর
পর্বঃ৫ +৬
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
ওড়নাটা ভালোভাবেই দরজার সাথে আটকে গেছে। টানাটানি করতেই কিছুটা ছিড়ে গেলো। রৌদ্র দরজার কাছে এগিয়ে আসতেই ওড়না ফেলেই তুলি দৌড় দেয়। ওড়নাটা দরজার সাথেই আটকে থাকে। রৌদ্র দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। ভিতরে মেঘ এখনো গানের তালে তালে নাচতে ব্যস্ত।
রৌদ্রঃ মেয়েটার সমস্যা কি! আমাদের ঘরে উঁকি মারছিলো কেন?
রৌদ্র দরজটা লাগিয়ে দিল। দৌড়ে রুমে এসে তুলি হাপাচ্ছে। ভয়ে শরীর ঘেমে গেছে। ওড়নাটা ওখানেই ফেলে এসেছে। ছি ছি আর একটু হলেই ওই বেশরমটা এই অবস্থায় দেখে ফেলতো। ওড়নার চিন্তায় তুলির সারারাত ঘুম হলো না। ভোর বেলা কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই ওড়নাটা উদ্ধার করতে হবে। না হলে ওই রুমে তুলির ওড়না রয়েছে এটা কেউ দেখে ফেললে বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে সে মেঘ আর রৌদ্রের ঘরের দরজায় সামনে এসে দাঁড়ালো। ভয়ে হাত পা জমে যাচ্ছে। হালকা করে দরজাটা ঢাক্কা দিতেই বুঝলো দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো। ভয়ে তুলির মুখ শুকিয়ে একদম শুকনো আমসি হয়ে গেল।
.
ভোরের আলো ভালো ভাবেই ফুটেছে। রৌদ্রউজ্জ্বল অত্যন্ত সুন্দর একটি সকাল। রান্না ঘরে সকালের নাস্তা বানানো হচ্ছে। কেউ কেউ ডাইনিং রুমে বসে নাস্তা করছে। মোটামুটি বাড়ির সকলেই ঘুম থেকে উঠে গেছে৷ শুধু মেঘ আর রৌদ্রই ঘুম থেকে ওঠে নি। অনেকবার ডাকা হলেও তারা কোনো রকম সাড়া দেয় নি৷
.
এদিকে অহনার ভেজা বড় চুল গুলো দেখে আকাশ লোভ সামলাতে না পেরে অহনাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
বুঝতে পেরে অহনা সাথে সাথে চেচিয়ে ওঠে, এ্যাই এ্যাই এসব কি করছো ছাড়ো!
আকাশঃ তুমি সব সময় এমন ছাড়ো ছাড়ো করো কেন! একটু থাকতে দাও না?
আকাশ অহনাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অহনা গা ঝারা দিয়ে দিয়ে তা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে অহনার হাত পা ছোড়াছুড়ি তে আকাশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। আকাশের সাথে জোরাজুরি করার সময় অহনার শাড়ি এলোমেলো হয়ে গেছে। আয়নার দিকে তাকিয়েই অহনা নিজের এই অবস্থা দেখে চিল্লিয়ে উঠল, একি এটা কি অবস্থা করেছো তুমি আমার!
রাগে অহনা বেডের ওপর পরে থাকা বালিশটা নিয়ে আকাশকে মারতে শুরু করে। আকাশ অহনাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ধস্তাধস্তি করতেই এক পর্যায়ে দুজনে বেডের ওপর উল্টে পরে গেল। অহনা নিচে আর অহনার ওপরে আকাশ। আকাশ অহনার হাত দুটো চেপে ধরে ফেলেছে।
আকাশঃ এখন কি করবে হ্যা!
অহনার মুখের আকৃতি বদলে গেছে। রাগের বদলে এখন রয়েছে ভয়ের ছাপ৷
হাত দুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সে বললো, ছাড়ো! ইস ছাড়ো!
আকাশ অহনার গালের সাথে নিজের গাল ঘসছে। অহনা চিৎকার দিলো বলে। তখনই অহনার ঠোঁটে আকাশ নিজের ঠোঁট দিয়ে দেয়৷
.
অনেক ডাকাডাকির পর কাজের মেয়ে এবার দরজায় জোরে জোরে বারি আর লাথি দিতে শুরু করে।
শরিফাঃ পোলা গুলা কি! কি করুম৷ দেখছোনি এহনো উঠে না? হেগোর লিগা খালাম্মা আমারে ঝাড়তাছে। আমার মুখ দিয়া নাহি কথা বাইর হয় না! আমি হেগো ডাকবার পারি নাই। হেরা আমার কতা হুনে নাই তাই উঠে নাই। আরে এই শরিফার গলা আমগোর গ্রামের মাতাত থেইকা হুনা যায়!
.
কাজের মেয়ের জোরে জোরে দরজা ঢাক্কনোতে মেঘ উঠে এসে দরজা খুলে দেয়।
শরিফাঃ ভাইজান আহেন আফনাগোরে ডাকতাছে। ব্রিক ফাস্ট করবার লাইগা।
মেঘঃ ওমমমম্ম!
মেঘ ভালো ভাবে চোখেই খোলে নি। ঘুমের ঘোরে মেঘ কিছুই বুঝলো না। আবার বেডে গিয়ে রৌদ্রের পাশে শুয়ে পরলো।
সেটা দেখে কাজের মেয়ে শরিফা বলে উঠল, দেখছোনি কান্ড! আমি আর কিচ্ছু জানিনা। এরপর খালাম্মা আইয়া হেগো দেখবো!
.
এদিকে তুলি কিছুক্ষণ পর পরই দরজার কাছে এসে ঘুরঘুর করছে। কখন দরজা খোলা হবে সেই অপেক্ষায়। এখন দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে উঁকি দিলো। দেখলো মেঘ আর রৌদ্র উল্টে পাল্টে ঘুমাচ্ছে। ওড়নাটা দরজার সাথে নেই। রুমের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে খেয়াল করলো ওড়নাটা রয়েছে একদম কর্নারের টেবিলে। ওটা আনতে গেলে তো রুমের ভিতরে ঢুকতে হবে। যদি এরমধ্যে ওরা জেগে যায় তাহলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাছাড়া কাজের মেয়ে বার বার আসছে ওদের ডাকার জন্য। কাজের মেয়ে এখন কোথায় কি করছে তার গতিবিধি দেখার জন্য তুলি নিচে নেমে এলো।
কাজের মেয়ে শরিফা নিচে এসে ঘটনার সবটা বর্ননা দেয়।
অহনার মাঃ ঠিকাছে,তাহলে ওদের খাবার রুমেই দিয়ে আয়।
তখনই তুলি চট করে বলে উঠলো, আ আ আমি দিয়ে আইতেছি! আমি দেই?
সাথে সাথে তুলির মা বলে ওঠে, তুই পোলা গো রুমে যাইবি ক্যান! শরম নাই তোর! শরিফা কইলো তুই নাকি পোলাগো রুমে উঁকি ঝুঁকি মারতাছোস! কি হইছে তোর! লজ্জাশরম খাইয়াআলছোস!!
তুলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে সে ও যে ওই রুমে ওড়না ফেলে এসেছে। এটা শুনলে তো ওর মা ওকে মেরেই ফেলবে।
অহনার মাঃ আহা আপা! ছোট মানুষ, যাক না, এমন করছো কেন। তুলি তুই যা।
তুলি খাবার হাতে নিয়ে উপরে চলে গেল।
অহনার মাঃ শরিফা এই কফিটা অহনার রুমে দিয়ে আয় তো৷ এটা জামাইবাবার।
শরিফাঃ জি আইচ্ছা।
.
আকাশ অহনার হাত দুটো এমন ভাবে চেপে ধরে ওকে কিস করছে,অহনা না পারছে হাত ছাড়িয়ে নড়তে আর না পারছে চিল্লাতে। আকাশের শরীরের ভরও পরেছে অহনার ওপর। অহনা নড়তে পারছে না । আকাশ অহনার ঠোঁট কামড়ে ধরে চুমুর পর চুমু দিয়েই যাচ্ছে। দরজা ছিলো খোলা। তখনই কাজের মেয়ে শরিফা রুমে ঢুকে পরলো।
কফি হাতে নিয়ে সামনে আকাশ আর অহনার এই দৃশ্যটা দেখার সাথেই চোখ বন্ধ করে ছোট করে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে।
সাথে সাথে আকাশ অহনার ঠোঁট ছেড়ে অহনার ওপর থেকে উঠে পরলো। অহনাও উঠে বসে। রাগে অহনা ফুলে আছে। কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়েই বিছানায় পরে থাকা বালিশটা তার দিকে ছুড়ে দিলো। বালিশ ছুড়ে মারায় কফির মগটা শরিফার হাত থেকে ফ্লোরে পরে ভেঙে যায়। ভয়ে শরিফা রুম থেকে দৌড় দিলো।
.
আকাশঃ তুমি এমন করছো কেন! ওর কি দোষ ছিলো! আমার কফিটা তো পরে গেল।
রেগে অহনা আকাশের সাথে আবারও মারামারি শুরু করে দেয়। রুমে থাকা বইপত্র গুলো সে আকাশের দিকে ছুড়ে ছুড়ে মারছে।
আকাশঃ আরে আরে কি করছো!
.
নিচে এসে শরিফা আমতা আমতা করে বললো,খালাম্মা আমারে আরেক মগ কফি দেন।
অহনার মাঃ কেন,ওটা দিস নি?
শরিফাঃ আফা ফালায় দিছে।
অহনার মাঃ ও ফেলে দিয়েছে নাকি তুই ফেলে দিয়েছিস। একটা কাজও যদি তুই ঠিক ভাবে করতে পারিস! যা নিয়ে যা।
.
আবার কফি নিয়ে শরিফা সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছে,কি ‌যে পাগলের বাড়িত আইছি কাম করবার! বেমাগডি পাগল! হেরা পাগল তা আমি কি করতাম। আমি পরছি বেপদে!
.
আকাশ অহনাকে ধরে ফেলেছে। অহনার হাত ধরে অহনার গলায় চুমু দিচ্ছিলো। তখনই শরিফা ভিতরে আসতে আসতে চোখ বন্ধ করে বললো, আফা লন!
সাথে সাথে আকাশ চমকে উঠে আবারও অহনাকে ছেড়ে দিলো। অহনা এবার শরিফার দিকে বই ছুড়ে দেয়। সাথে সাথে শরিফার হাত থেকে আবারও কফির মগটা ফ্লোরে পরে ভেঙে গেল। ভয়ে শরিফা দৌড় দেয়। মারাত্মক গাল শোনার ভয়ে শরিফা এবার রান্নাঘরে যাওয়ার সাহস না পেয়ে ছাদে চলে গেল।
আকাশঃ কি করলে এটা! তোমাকে না বলেছি এরকম পাগলামো আর করবে না। ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে।
অহনা রেগে উত্তর দেয়, ঠিকাছে। আমি আনছি তোমার কফি!!
অহনা রুম থেকে বের হয়ে গেল।
.
আকাশ ফ্লোরে পরে থাকা বই গুলো তুলতে থাকে। বই আর জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করে রুমটা একেবারে বিধস্ত করে ফেলেছে অহনা। আকাশ আনমনেই অহনার কান্ড দেখে হাসতে থাকে। মেয়েটা উড়ে এসে জুরে বসার মতো করেই আকাশের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
.
বই গুলো গোছাতে গোছাতেই হঠাৎ করে একটা বই থেকে কিছু ছবি বেড়িয়ে এলো। ছবি গুলো ফ্লোর থেকে ওঠাতে ওঠাতে আকাশ দেখতে পায়, একটা সুন্দরমত ছেলের সাথে অহনা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব গুলো ছবিতেই এই একই ছেলের ছবি। বাকি গুলোতে অবশ্য অহনা নেই। শুধু ছেলেটির বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তোলা। বই আর ছবি গুলো টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে টেবিলের আরও কিছু বইয়ে হাত দিতেই আরও কিছু ছবি বেড়িয়ে এলো। সেই একই ব্যাক্তির ছবি। এই ছবি গুলোর ওপর আবার রঙিন কালি দিয়ে লেখা ,”আই লাভ উ”। আরেকটা ছবির ওপর ঠোঁটের চিহ্নও রয়েছে গাড়ো লাল রঙের। সম্ভবত ছবিতে কিস করা হয়েছিলো।
.
এগুলো দেখে আকাশের মাথা ঘুরে গেলো। আকাশ একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাকি বইগুলো তেও হাত দিয়ে সেগুলো থেকেও অনেক গুলো ছবি পাওয়া গেল৷ সেই একই ছেলের ছবি। এই ছবি গুলোর ওপরেও “আই লাভ উ” লেখা। অহনার সাথে এই ছেলের ছবি দেখে আকাশের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
অহনার বইয়ের ভেতর এই ছেলের এতো ছবি কেন! ও তো বলেছিলো ওর কোনো বয় ফ্রেন্ড ছিল না। তাহলে এটা কে! সত্যি সত্যি অহনা কি আমায় ঠকালো! আমি কি তাড়াহুড়ো করে কোনো ভূল করে ফেললাম? ওহ নো! এটা হতে পারেনা!
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ অহনার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, এই নেও তোমার কফি!
.
আকাশ অহনার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। আকাশের হাতে ছবি গুলো দেখে অহনাও এবার থমকে গেলো। রুমে নীরবতা বিরাজ করছে।
আকাশ অহনার দিকে তাকিয়ে থেকেই নিরবতা ভেঙে হঠাৎ গম্ভীর ভাবে বলে উঠলো, কে সে?
অহনা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আকাশঃ কি হলো, আমি কিছু জিগাসা করছি!
অহনা আকাশের হাত থেকে ছবি গুলো কেড়ে নিয়ে ছবিতে চুমু দিতে দিতে এবার বলে উঠলো,আমার ভালোবাসা! আমি তাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি!
বলেই ছবি গুলো হাতে নিয়েই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
.
অহনার মুখে এই কথা শুনে আকাশের মাথায় যেন বাজ পড়লো। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আকাশের। ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়।
.
খাবার টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে তুলি ওড়নাটা নেওয়ার সময়ই হঠাৎ করে রৌদ্রের ঘুমে ভেঙে যায়। চোখ খুলে রুমের ভিতর তুলিকে দেখেই এবার চেচিয়ে উঠলো, এ্যাই মেয়ে এ্যাই তোমার সমস্যাটা কি! সব সময় আমাদের রুমে এভাবে উঁকি ঝুঁকি মারো কেন! এই ভাইয়া ওঠ একে আজ হাতে নাতে ধরেছি দ্যাখ!
রৌদ্র মেঘের গায়ে হাত দিয়ে ওকে ঠেলছে। মেঘও চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো,
তুলিঃ আমি উঁকি ঝুঁকি মারি নাকি আফনাগোর শরম নাই! রাতে আমার ওড়না টাইনা ধরছিলেন ক্যান!
রৌদ্র এবার চোখ গরম করে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে।
.
চলবে….
#প্রেমনগর ( It’s So funny and Romantic Story)
পর্বঃ৬
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
আকাশ অহনাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে এসেছে। অহনা ছাদের একপাশে দোলনায় বসে কান্না করছিলো। আকাশ অহনার পাশে এসে দাঁড়ালো। আকাশকে দেখে অহনা চোখের পানি মুছলো।
অহনার কান্না করা দেখে আকাশ ওর ওপর ক্ষিপ্ত না হয়ে নরম গলায় বললো, তুমি যখন ওকেই ভালোবাসো তাহলে আমায় বিয়ে করলে কেন? কি দরকার ছিল আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করার! আর ভালোবাসার মানুষকেই বা তুমি বিয়ে করলে না কেন? যাকে এতো ভালোবাসো তাকে হারালে কেন! আমার ধারণা এতোটাও অবুঝ তুমি নও।
অহনার ভেতর থেকে এবার ঠেলে কান্না বেড়িয়ে এলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, কি করে বিয়ে করবো তাকে? তাকে কোথায় পাব আমি? সে কি এই পৃথিবীতে আর আছে! সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে। অনেক!
.
আকাশ কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলে উঠলো, মানে?
হাতে থাকা ছবিটার দিকে ইশারা করে অহনা বললো, ওর নাম মোহন সেন। আমাদের ধর্ম ছিলো আলাদা। এক সঙ্গে পড়তাম। খুব কাছের বন্ধু ছিলো আমার। ধীরে ধীরে কখন যে বন্ধুর থেকে বেশি কিছুতে পরিণত হয়েছিল বুঝতেই পারি নি। দুজনে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি। আমাদের বন্ধুদের গ্রুপ ওকে ছাড়া কিছু বুঝতোই না৷ সবার মধ্যমণি ছিলো ও। সব সময় সবাইকে হাসাতো। সেও মনে মনে আমায় পছন্দ করতো। আমিও তা বুঝতে পারতাম। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ধর্ম। একজন হিন্দু ছেলে হয়ে কোনো মুসলিম মেয়েকে প্রেমের প্রপোজাল দিতে তার মন শায় দিচ্ছিলো না। সে ছিলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ততোদিনে আমি তাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছি। আমরা একে অপরের মনের কথা অবদি বুঝে ফেলতাম। মুখে কিছু বলতেই হতো না। ওকে ছাড়া কখনো কোনো ভালো খাবার আমি খেতাম না। সেও খেতো না। যা করতাম সব কিছু ওকে সাথে নিয়েই। এই ছবি গুলো ভার্সিটি থেকে পিকনিং এ গিয়ে তোলা। ওকে ছাড়া এক মুহুর্তও যেন ভাবতে পারতাম না আমি অথচ কোনো দিন তাকে বলাই হয় নি, আমি তোকে ভালোবাসি মোহন, খুব ভালোবাসি। তুই কি আমার সারাজীবনের সঙ্গী হবি!
অহনা কাঁদতে কাঁদতে আবারও বললো, শুধুমাত্র বন্ধু হয়েই ছিলো। আমার কষ্ট সে কখনো সহ্য করতে পারতো না। আমার চোখে পানি দেখলে তার মাথা খারাপ হয়ে যেত। ধর্ম আলাদা হওয়ার কারণে আমাকে তার ভালোবাসার কথা জানাতে পর্যন্ত সাহস পায় নি। জানার পর যদি আমি কোনো ভাবে কষ্ট পাই! মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারতাম, তার চোখে ছিলো আমাকে পাওয়ার প্রবল আকুলতা। আর মনে মনে আমিও চেয়েছিলাম তাকে।
আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,তারপর?
.
অহনা আবারও বলতে শুরু করলো, আমাদের এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি আরও কিছু চাইছিলাম। চেয়েছিলাম তাকে সারাজীবনের জন্য পেতে। কিন্তু সে তো তার মনের কথা জানাচ্ছিলো না। তাই আমার পাগলামো গুলোও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিলো। ওর সাথে অন্য কোনো মেয়েকে সহ্যই হতো না আমার,ইচ্ছে হতো তার চুলের মুটি ধরে আছাড় দেই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো।
মোহন সব বুঝতে পারতো যে আমি তাকে খুব করে চাইছি। তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আমাকে প্রপোজ করার। কিন্তু ঘটনাটা ঘটলো সেইদিনই।
.
আমি ভার্সির গেটে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। সেই দিন কেন যেন সবাই মুচকি মুচকি হাসছিলো।হয়তো ওরা আগে থেকেই জানতো মোহন আজ আমায় প্রপোজ করতে চলেছে। হঠাৎ মোহনকে দেখা গেল। ও হেটে আসছে। মোহন রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে দেখলাম অনেক গুলো গোলাপ ফুল। আজ ওকে অন্য রকম সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে সেও মুচকি মুচকি হাসছিলো। মায়া ভরা সেই হাসি। আমার মনের মধ্যে অজানা অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিলো।
.
মোহন এগিয়ে আসছে ভেবেছিলাম আমিও আজ ওকে আমার ভালোবাসার কথা বলে দিব। কিন্তু রাস্তা পার হতেই হঠাৎ একটা বাস এসে ওকে পিসে দিয়ে গেল। এটা দেখার সাথেই আমি ওখানেই জ্ঞান হারালাম। তিন দিন আমার জ্ঞান ছিলো না। যেদিন জ্ঞান ফিরলো তখন জানতে পারলাম মোহনকে ওই দিনই তার দেশের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সমাধি করা হয়েছে। মোহনের বাবা ছিলো না। মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলো মোহন । বন্ধুদের কাছে জানতে পারলাম ঘটনার আগের দিন মোহন নাকি তার বাড়িতে আমার কথা বলে ওর মাকে রাজিয়েও করিয়েছিলো। সব শুনে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। সব কিছু পাওয়ার মুহুর্তে যেন সব হারিয়ে ফেললাম। মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কখনো কখনো মনে হয় মোহনের মৃত্যুর কারণ আমি ৷ ভুলে থাকার শত রকম চেষ্টা চালালাম। কেটে গেল দু বছর। আস্তে আস্তে মোহনের স্মৃতি মুছে গেলেও আমার মনের কোণে সে ঠিকই রয়ে গেছে।
.
আকাশের চোখে পানি চলে এসেছে। তা দেখে অহনা বলে উঠলো,একি তুমি কাঁদছো কেন?
আকাশ চোখের কোনার পানিটা মুছে তারপর বললো, কই না তো, চোখে কি যেন পরেছিল আরকি।
অহনাও তার গাল বেয়ে পরা পানি গুলো মুছে বলে উঠলো, জানো আকাশ, মোহনের একটা কথাই আমার বার বার মনে হয়, অহনা তুই সব সময় হাসি খুশি থাকবি। তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না রে । তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। এখন আমার মনে হয়, হয়তো মোহন কোথাও থেকে দেখছে, আমি ভালো আছি! খুব সুখে আছি! হাসিখুশি আছি! এটাই তো চেয়েছিলো মোহন। আমার মুখের হাসি!
.
আকাশ চুপ করে রয়েছে। বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছে। অহনা হঠাৎ করে বলে উঠলো, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে আকাশ! আমারও বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছে।
আকাশ চমকে উঠলো। থমকে দাঁড়িয়ে আছে সে।
অহনা চোখে পানি নিয়ে আবারও বলছে, কি হলো! আমাকে নেবে না?
আকাশ এবার এগিয়ে এসে অহনাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।
অহনা আকাশের বুকে মাথা রাখতে রাখতে বললো, আরো শক্ত করে!
আকাশ অহনাকে আরও শক্ত করে দুই হাতের বাহুতে আবদ্ধ করে ফেললো।
অহনাঃ তুমি আমায় ছেড়ে কোনোদিন যাবে না ডক্টর আকাশ!
পরিস্থিতি গম্ভীর হয়ে গেছে। তাই আকাশ এবার অহনাকে হাসানোর জন্য বলে উঠলো,আরে নাহ! তোমার বাবাকে কথা দিয়েছি না? তোমাকে সুস্থ করার দায়িত্ব পুরোপুরি আমার! হাহাহা…
অহনাও আকাশের কথা শুনে এবার হেসে ফেললো।
.
এদিকে রুমের ভিতর তুলির সাথে রৌদ্রের ঝগড়া লেগে গেছে। মেঘ বললো, আরে বাদ দে না ভাই! এতো রেগে যাচ্ছিস কেন!
রৌদ্রঃ ওয়াট রাবিশ! একটা ক্ষ্যাত মেয়ে কিনা আমায় বলে আমি তার ওড়না টেনে ধরেছি। এই মিথ্যা অপবাদ আমি কেন মেনে নেব হ্যাঁ! কত কত সুন্দরী মেয়েরা আমার পিছনে ঘুর ঘুর করে। কোনো ধারণা আছে ওর!!
অহনার মা এসে বললেন, ছাড়ো না বাবা! ওর কথায় কিছু মনে করো না। গ্রামের সহজ সরল মেয়ে। এসব বোঝে না।
অহনার মা তুলিকে এখান থেকে নিয়ে গেলেন। তুলি চলে যাওয়ার পর মেঘ বললো, তুই একটু বেশি বেশি বলে ফেললি, দেখতেই পাচ্ছিস মেয়েটা কতোটা সহজ সরল! যা সরি বলে আয়!
রৌদ্রঃ কোনো ইচ্ছে নেই ওই মাথা খারাপ মেয়েটার সাথে কথা বলার!
মেঘঃ আবার!! যা গিয়ে সরি বল। ভুলে গেছিস এটা ভাইয়ার শশুড়বাড়ি!
বলতে বলেই মেঘের ফোনের রিংটন বাজতে শুরু করে। শ্রাবনী ফোন করেছে। মেঘ কলটা রিসিভ করলো৷
মেঘঃ হ্যাঁ বলো!
শ্রাবনী হাফাতে হাফাতে বলছে, কি আর বলবো! নীলা তো অনেক গুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলেছে। তুমি জলদি ওদের বাড়ি যাও!
মেঘঃ ওয়াট! কি বলছো এসব!
শ্রাবনীঃ নিশ্চয়ই তোমার ওপর রাগ করেই সে এমনটা করে ফেলেছে।
মেঘঃ মানে আমি এখন ওদের বাড়ি যাব? ওর বাবা মা আমাকে আবার ফাঁসিয়ে দেবে না তো!
শ্রাবনীঃ আশ্চর্য মানুষ তো তুমি! একটা মেয়ে মরতে বসেছে আর তুমি এই সময় এমন কথা বলছে?
মেঘঃ হাহাহা..আমাকে এতো মেয়ের মাঝে একা রেখে ও মরবে। ওর সহ্য হবে?
রাগে শ্রাবনী কলটা কেটে দেয়। আর মেঘ তাড়াহুড়ো করে কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল।
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here