প্রেমবিভ্রাট ০২ তানভীর তুহিন

0
1200

প্রেমবিভ্রাট
০২
তানভীর তুহিন

সকাল আটটা। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তুহিন এবং দীপ্তি। দরজা ধাক্কানোর বিরক্তিকর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তির। এখনো ঘুমের তৃষ্ণা মেটেনি তার। দরজা ধাক্কার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই বিরক্তির অন্তিম সীমানা অতিক্রম করল সে। দীপ্তি তুহিনকে বাহু ধরে নাড়ছে। তুহিন নড়ছে। দীপ্তি নাড়াচ্ছে, তুহিন নড়ছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠছে না। দীপ্তি চরম বিরক্ত হয়ে মুখ খুলল। ” এই! উঠে দেখুন না কে এসেছে। ” তুহিনের কোন হেলদোল নেই।

দীপ্তি আবার গুঙিয়ে বলল, ” উফফ! উঠুন না.. ” এবারও তুহিনের কোন হেলদোল নেই। দরজা ধাক্কানোর শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল দীপ্তি। আড়মোড়া ভেঙে খাট ছেড়ে নামল। হাই তুলতে তুলতে গিয়ে দরজা খুলে দেখল দরজার বাইরে আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে। আয়েশাও চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে মাতাল হাই তুলছে। আয়েশার হাই তোলা অস্পষ্ট গলা, ” কিরে কান কোথায় রেখে ঘুমোস? হাত ব্যাথা হয়ে গেছে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে। ”
– ” আরে ওনাকে জাগাচ্ছিলাম দরজা খোলার জন্য। জাগেনি। ” কথা বলতে বলতে দীপ্তি গিয়ে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে আয়েশার কাধে মাথা রাখল। একটা ছোট হাই তুলে আহ্লাদি গলায় যোগ করল, ” রাতে কত দেরি করে ঘুমিয়েছি। আমার এখন ঘুমে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে রে। ”

আয়েশা হাই বিয়োগ করে বলল, ” আমারও একই অবস্থা। শোন, ফ্রেশ হয়ে ভাইয়াকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আয়। আম্মু ডাকছে। বিকেলের রিসেপশনের ব্যাপারে কী নাকি আলাপ করবে। ”

দীপ্তি ন্যাকা কান্না জুড়ে দিল। ” উঁহু! উঁহহু! ঘুম পাচ্ছে আমার। ”
– ” আমি দাড়াতে পারছি না ঘুমের তাড়নায়। রিসেপশন তোদের। আর সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়েছে আমাকে। অসহ্যকর একদম। তাড়াতাড়ি আসিস, আমি গেলাম। ”

চোখ বন্ধ করে ঢুলতে ঢুলতে রুমে ঢুকল দীপ্তি। রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চোখজোড়া বড় করে মেলে ধরে ঘুম তাড়িয়ে নিল। বারান্দার পর্দা তুলে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে ব্রাশ করা শুরু করল সে। তুহিনের ব্রাশে পেষ্ট মাখিয়ে ব্রাশ হাতে বাথরুম ছেড়ে রুমে এলো দীপ্তি। রাগে গতর জ্বলে যাচ্ছে তার। ঘুম থেকে উঠে দরজাটা খুললে কী হতো? লাটসাহেবের একার চোখেই ঘুম আছে না-কি শুধু? দরজাটা খুলে দিলেই হতো। আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারতাম। এসব ভাবতে না ভাবতেই দীপ্তি তুহিনের মুখ চেপে ব্রাশটা সোজা তুহিনের মুখে গুজে দিল। আচানক অস্বাভাবিকতায় ঘুম ভেঙে গেল তুহিনের। সে হকচকিয়ে উঠে বসল। ভীষণ বাজেভাবে শুরু হলো তার সংসারজীবনের প্রথম সকাল। ব্রাশটা মুখ থেকে ফেলে, মাথা ঝেড়ে, চোখ ডলে, নিজেকে ধাতস্থ করল তুহিন। তুহিন বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে তার মুখে আস্ত একটা পেস্টসুদ্ধ ব্রাশ ঢুকে গেল কীভাবে? তুহিন মাথা মুড়িয়েই দেখতে পেল দীপ্তিকে। ধানী লঙ্কা বনে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তি। দীপ্তির মুখে ব্রাশ। ব্যাপারটা অনায়াসে খেলে গেল তুহিনের মাথায়। কেউ তুহিনের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাক সেটা চরম অপছন্দ তুহিনের। তুহিন কাঠ বিরক্ত গলা ধরল, ” এটা কোন ধরনের অভদ্রতা দীপ্তি? ”

আল্লাহ! আল্লাহ! সকাল সকাল উঠেই অভদ্র বলে দিল? এই মাল তো অপমান করার কোন সুযোগই ছাড় দেবে না, দেখছি। দীপ্তি চোখ সরু করে মুখটা তুহিনের দিকে এগিয়ে বলল, ” আপনার ব্রাশ আপনার মুখে পেষ্ট লাগিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি এটা কোনপ্রকার অভদ্রতা নয়। অভদ্রতা তখন হতো যখন আমি আমার ব্রাশটা আপনার মুখে ঢুকিয়ে দিতাম। ”

তুহিন ক্রোধ সংবরণ লক্ষ্যে শ্বাস বিয়োগ করল। ” আমি ঘুমোচ্ছিলাম। আমি কী তোমায় বলেছি যে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগে আমার মুখে পেষ্ট লাগিয়ে ব্রাশ ঢুকিয়ে দেবে? ”
– ” উহু বলেননি। প্রতিশোধ নিলাম। ”
– ” কী.. কিসের প্রতিশোধ? ” তুহিনের চেহারায় সহস্র ভাঁজ।
– ” একটু আগে আশু ডাকতে এসেছিল। আমি আপনাকে কয়বার ধাক্কা দিয়েছি, উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতে বলেছি, খুলেছিলেন? খোলেননি। তারপর আমার ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে হয়েছে। আপনি জানেন? আমি ঘুম নিয়ে কতটা সেন্সিটিভ? ”
– ” আশ্চর্য! আমি ঘুমোচ্ছিলাম তাই শুনতে পাইনি। তাই বলে এরকম অদ্ভুত পদ্ধতিতে ঘুম ভাঙাবে নাকি তুমি? ”
– ” আম্মু ডাকছে। কথা না পেচিয়ে ব্রাশ করে ড্রয়িং এ চলুন। ” বলেই দীপ্তি আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তুহিন খিটখিটে মেজাজ নিয়ে খাট ছেড়ে নামল। ব্রাশটা মুখে পুরে এপাশ-ওপাশ করতে করতে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল সে। বাইরে হিম চাদুরে বাতাস। তুহিন আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলে বুক ভরে শ্বাস নিল। তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে চলে এলো।

প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ দাঁত ব্রাশ করে ইতিহাস গড়ছে তুহিন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ব্রাশটাকে দাঁতে ঘষতে হচ্ছে তার। আধাঘন্টা যাবৎ দীপ্তি বাথরুমে। দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? তাই দাঁতে ব্রাশ ঘষছে। প্রায় আরো দশ মিনিট পর তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বাথরুম ছেড়ে বেরোল দীপ্তি। দীপ্তিকে দেখেই প্রশ্ন ছুড়ল তুহিন। ” তোমার কী সকালে গোসলের অভ্যাস? ”
– ” না। তবে যেদিন ভার্সিটিতে যাই সেদিন সকালে করি। ”
– ” আজ কী ভার্সিটিতে যাবে? ”
– ” আজ ভার্সিটিতে কেন যেতে যাব? ”
– ” তাহলে সকালবেলা গোসল করলে যে? ”
– ” বাসররাতের পরের দিন সকালে গোসল করে ঘর থেকে বেরোতে হয়। এক দূরসম্পর্কের ভাবি বলেছিল, তাই..”
– ” কী বিপদ! যখন গোসল করার কোনো কারণই ঘটেনি তখন গোসল কেন করতে হবে? ” তুহিনের ঘোরপ্যাঁচহীন সাপ্টা কথায় লজ্বায় পড়ে গেল দীপ্তি। তুহিনকে সেটা বুঝতে না দিয়ে সে বলল, ” এখানে উকিলের মতো ব্যাখ্যা না দিয়ে ফ্রেশ হতে যান। আর আপনিও গোসল করে নিয়েন। ”
– ” আমি এই সকালবেলা অকারণে গোসল করতে পারব না। দুপুরে করব। ”

লোকটা একচুলও তর্কে ছাড় দেয়না। প্রত্যেকটা কথার পিঠে তর্ক বসাতে হবে তার। দীপ্তি খানিক রেগে গেল। ” কোন কারণ ঘটেনি বলে সকালে গোসল করছেন না। তা আপনার কী মনে হচ্ছে যে দুপুরের আগে কোন কারণ ঘটবে? আর সে কারণ ঘটার পর আপনি গোসল করবেন? ”

দীপ্তির কথায় আহাম্মক বনে গেল তুহিন। সে একথা কখন বলল? অগত্যা কাপড় নিয়ে গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকতে হলো তুহিনের। দীপ্তি ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিছানা গোছাতে। মিনিট পাচেক বাদে গোসল সেরে বেরোল তুহিন। তুহিন বেরিয়ে তৈরী হয়ে দীপ্তিকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। ড্রয়িংরুমে যেতেই তুহিনের বাবা আসাদ সাহেব বললেন, ” সন্ধ্যায় তো রিসেপশন। ক্লিনিক থেকে ডাক্তার বোস জানাল, তুই নাকি সার্জারি করছিস আজকে? ”
– ” হ্যা বাবা। ছোটখাটো একটা সার্জারি। বারোটায় গিয়ে তিনটায় চলে আসব। ”
– ” কী দরকার ছিল শুধু শুধু? ক্লিনিকে তো আরো জুনিয়র সার্জন ছিল। নেক্সট পনের দিন তুই আর কোন কেস নিস না। অন্য সার্জনরা দেখে নেবে। ”
– ” পনের দিন.. মানে? পনের দিন কী করছি আমি? পনের দিন তো আর রিসেপশন থাকছে না। ”
– ” রিসেপশন থাকতে যাবে কেন? পাঁচ দিন পর দশ দিনের জন্য হানিমুনে যাচ্ছিস তুই আর দীপ্তি। ”
– ” কী? এই সময়ে আমি পনের দিন নষ্ট করব হানিমুনে গিয়ে? বাবা কত ক্রিটিকাল সার্জারি কেস ফেইস করতে পারে ক্লিনিক, ধারণা আছে? ”
– ” আছে। ক্লিনিকে আরো এক্সপেরিয়েন্সড সার্জন আছে। হ্যা মানছি তুই এশিয়ান হার্ট সার্জনদের মধ্যে অন্যতম। তাই বলে তো এই না যে তোর আগে ক্লিনিকে হার্ট সার্জারি হতো না। আর পনের দিন নষ্ট করছিস মানে কী? হানিমুনে যাচ্ছিস তুই। কথা বাড়াস না আর এসব নিয়ে। ”

আসাদ সাহেব, তুহিনের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ। আবার অপছন্দের মানুষও। তার বাবার সব কিছুই তার পছন্দ শুধু একটা জিনিস বাদে। সেটা হলো তুহিনের ওপরে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া। ছোটবেলা থেকেই তুহিন তার পছন্দ মাফিক কিছু করতে পারে না। সব চলে তার বাবার স্বিদ্ধান্তে। যদিও তুহিনকে নিয়ে তার বাবার নেয়া সিদ্ধান্তগুলো সব নির্ভুল এবং নিখুঁত। তবুও নিজের ইচ্ছা, নিজের সিদ্ধান্ত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, তাইনা?

রাত এগারটা। রিসেপশনের ঝামেলা চুকিয়ে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকল তুহিন। রুমে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া তার। দীপ্তি পেছনে হাতবেধে পায়চারি করছে। বেশ জোড়গতিতেই পায়চারি করছে। একপ্রকার রুমের এমাথা-ওমাথা ছুটে বেড়াচ্ছে। চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্রোধ। তুহিনকে রুমে আবিষ্কার করেই হুংকারে ফেটে পড়ল দীপ্তি।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ❤️
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here