প্রেমবিভ্রাট ০৩ তানভীর তুহিন

0
895

প্রেমবিভ্রাট
০৩
তানভীর তুহিন

দীপ্তি চেঁচিয়ে উঠল, ” সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি? ”

দীপ্তির প্রশ্ন শুনে তুহিনের দীপ্তিকে জাতপাগল বৈ অন্যকিছু মনে হচ্ছে না। মানে কী? সারাদিন তো বাসায়ই ছিলাম। রিসেপশনের হ্যাপা পোহালাম সারাদিন। আর এখন জিজ্ঞেস করছে কই ছিলেন? নেশা-পানি করেনি তো মেয়েটা? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই তুহিন বলল, ” বিয়ে সেলিব্রেট করার জন্য বান্ধবিদের সাথে ড্রিংকস করেছ? বিয়ার বা এ্যালকোহল কিছু নিয়েছ? ”
– ” সেলিব্রেশন? কীসের বিয়ে হয়েছে আমার? কার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার? যে আমি সেলিব্রেট করবো? ”

তুহিনের কপাল কুঁচকে গেল। এই মেয়ে নিশ্চিত নেশা করেছে। নাহয় নিজের বিয়ের রিসেপশন থেকে এসে কেউ নিজের স্বামিকেই জিজ্ঞেস করে কীসের বিয়ে হয়েছে আমার? কার সাথে বিয়ে হয়েছে? ” দীপ্তি কী খেয়ে নেশা করেছ তুমি? আর কী পরিমাণে খেয়েছ? ” তুহিনের স্বাভাবিক প্রশ্ন।

দীপ্তি এবার রেগে রক্তবর্ন হয়ে গেল। আগের চেয়ে গুনকয়েক বেশি রাগ দর্শাতে চিৎকারে ফেটে পড়ল সে, ” একদম মাতাল বলবেন না আমায়। আমি কোন নেশা করিনি। ”
– ” তাহলে এসব উল্টোপাল্টা কী বলছো? ”
– ” আপনাকে যা জিজ্ঞেস করেছি, তার ঠিক-ঠিক উত্তর দিন। কোথায় ছিলেন সারাদিন? ”
– ” সারাদিন বাসায় ছিলাম রিসেপশনের জন্য। ” তুহিনের ত্যক্তযুক্ত জবাব।
– ” গুড! এবার এসেছেন আলোচ্য বিষয়ে। আমাদের রিসেপশন শুরু হয়েছে কয়টায়? ”
– ” এরাউন্ড বিকেল চারটায়.. ” তুহিন কিছুটা অনিশ্চিত।
– ” এখন ক-টা বাজে? ”
তুহিন নিজের হাতে থাকা ফোনে সময় দেখে নিল। ” রাত সোয়া এগারটা। ”
– ” পুরো রিসেপশনে আপনি ন-টার পর থেকে কোথায় ছিলেন? ”

তুহিনের রাগ মাথায় উঠল। ঝাঁঝযুক্ত গলায় বলল, ” হেয়ালি না করে কী বলতে চাও সেটা বলো। মাথা খারাপ করবে না। তুমি দেখোনি আমি কোথায় ছিলাম? রিসেপশনেই তো ছিলাম। তাহলে বারবার একই কথা কেন জিজ্ঞেস করছো? ”
– ” রিসেপশন টা কাদের ছিলো? আমার আর আপনার? নাকি আপনার আর আপনার বন্ধুদের? ” দীপ্তির গলা তুহিনের চেয়ে উঁচুতে।
– ” মানে? ”
– ” আবার মানে জিজ্ঞেস করছেন আপনি? আমার যে বান্ধবিগুলো এসেছিলো ওদের সঙ্গে আপনি কতক্ষণ ছিলেন? আপনি আমার পাশে ঠিক কতক্ষণ ছিলেন? ওরা কী ভাবলো বলুন তো? ওরা ভাবলো যে আপনি আমাকে পছন্দই করেন না। একদম পাত্তা দেননা। হেলাফেলা করে দেখেন। সেজন্য আমার কাছে ছিলেন না। আর সেজন্য ওদের সাথে আড্ডাও দেননি। ”

তুহিনের বিষ চেখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কোন মানে আছে এসবের? কোথায় সময় দিলাম না? পুরো রিসেপশন তো ওদের সাথেই ছিলাম। তুহিন হাত সামনে বেঁধে পিঠ টান করল, ” পুরো রিসেপশনে তোমার বান্ধবিদের সাথে ঠিক যতগুলো সেলফি আমি তুলেছি ওগুলো দিয়ে আস্ত একটা যাদুকর বানিয়ে ফেলা যাবে। আর এমনভাবে বলছো যেন তুমি এসব জানো না? তুমি তো প্রত্যেকটা গ্রুপ সেলফিতে ছিলে। তারপরেও এরকম অহেতুক অভিযোগ কেনো টানছো? ”
– ” সেলফি তুললেই কী সময় দেয়া হয়ে যায়? হ্যাহ? ওরা যাবার সময় দুলাভাই দুলাভাই করে বেহুঁশ গিয়েছে। কই ছিলেন আপনি? আপনাকে খুঁজেও পাওয়া গেল না কেনো? শেষে ওরা আপনাকে না দেখেই মন খারাপ করে চলে গেল। ”
– ” মন খারাপ.. মন খারাপ কীসের জন্য হবে? আমি সম্পর্কে ওদের দুলাভাই। স্বামি না যে আমায় না দেখলে ওদের মন খারাপ হবে। ”
– ” একসঙ্গে বহু মেয়ের স্বামি হবার খুব শখ, তাইনা? ”

চোখ বুঝে চোখা মুখে শ্বাস বিয়োগ করল তুহিন। ” আমি কী বলেছ আর তুমি কী বুঝছো? ”
– ” যেটা বোঝাতে চাচ্ছেন সেটাই বুঝছি। এখন কথা না ঘুরিয়ে বলুন কোথায় ছিলেন আপনি? ওরা যাবার সময় আপনাকে খুঁজে পেলাম না কেন? ”
– ” আরে রিসেপশনে শুধু তোমার বান্ধবিরা এসেছে নাকি? আমার ফ্রেন্ডরাও তো এসেছিল নাকি? ওদের সাথেই ছিলাম। ”
– ” হ্যা থাকুন। তাই বলে ওরা যাবার আগে একবার ওদের সাথে দেখা করে যাওয়া যেত না? ”
– ” উফফ! আমি কী করে বুঝবো যে ওরা যাবার আগে আমায় খুঁজবে? আর আমি তোমাদের প্রাইভেসি দিচ্ছিলাম। যাতে তোমরা তোমাদের মতো করে কথা বলতে পারো। ”
– ” আহা! এখন প্রাইভেসির অজুহাত দিচ্ছেন? খুব ভালো কথা ঘোরাতে পারেন তো আপনি। ”
– ” কথা ঘোরাতে পারি কি-না জানিনা। তবে তোমার এসব কথায় মাথা ঠিকই ঘুরছে। ”

দীপ্তি এতোক্ষণ সব জেনেবুঝেই শাসাচ্ছিল তুহিনকে। দীপ্তি বেশ ভালো করেই জানে যে তুহিন ওর বান্ধবিদের সঙ্গে যথেষ্ট ভাল ব্যাবহার করেছে এবং ওদের পর্যাপ্ত সময়ও দিয়েছে। দীপ্তি এটাও জানে যে তুহিন এতোক্ষণ ওর বন্ধুদের সঙ্গেই ছিল। তবুও সে জেনেবুঝে একটু শায়েস্তা করে নিল তুহিনকে। ওই কথায় বলে না, বিয়ের পরে জামাইকে একটু টাইটে-টাইটে রাখতে হয়। দীপ্তি মুলত সেই প্রবাদেরই ব্যবহারিক প্রয়োগ করছিল তুহিনের ওপর। আর এটাও পর্যবেক্ষণ করে দেখছিল যে তুহিনের ধৈর্য্যধারণ ক্ষমতা কতটুকু। দীপ্তি ভেতরে ভেতরে মিটিমিটি হাসছে তুহিনের অসহায় এবং বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে। তুহিন ঘেমে প্রায় নেয়ে গেছে। দীপ্তি আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে তুহিনকে দিয়ে বলল, ” এই নিন ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”
– ” তোমার শাড়িতে অস্বস্তি হচ্ছে বোধহয়। তুমি আগে যাও। তুমি বের হলে নাহয় আমি যাব, সমস্যা নেই। ”
– ” আমার কোনোপ্রকার অস্বস্তি হচ্ছে না। আর আমি শাড়ি পড়তে পছন্দ করি তাই কোনো সমস্যাও হচ্ছে না। যেটা বলেছি সেটা করুন। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”

তুহিন কাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোয়। তুহিন বাথরুমে ঢোকার আগে দীপ্তি তুহিনকে পিছুডাকে। ” এই আপনার ফোন আনলক করে দিয়ে যান। ”
– ” আমার ফোন দিয়ে তুমি কী করবে? ”
– ” ঘেটে দেখব। আনলক করে দিয়ে যান। ”

অগত্যা তুহিন ফোন আনলক করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। দীপ্তি পূর্ণ মনোযোগে তুহিনের ফোন ঘাটতে ব্যস্ত। সৌভাগ্যক্রমে তুহিনের ফোনে এমন কিছুই পায়নি দীপ্তি যা নিয়ে তুহিনের সঙ্গে তর্কে জড়ানো যায়। দীপ্তি তুহিনের কিছু ছবি নিজের ফোনে এবং নিজের কিছু ছবি তুহিনের ফোনে দিয়ে দিল। সেখান থেকে তুহিনের একটা ছবি নিজের ফোনের ওয়ালপেপার সেট করে নিল। নিজের একটা ছবি তুহিনের ফোনের ওয়ালপেপার সেট করে দিল। এসব করতে করতে তুহিন বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোল। তুহিন বের হতেই দীপ্তি গিয়ে নিজের ফোনের ওয়ালপেপারটা তুহিনকে দেখাল। তুহিন প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করল যে ফোনটা আসলে কার? সন্দেহর অবসান ঘটাতে দীপ্তি বলল, ” আপনার ছবিটা সুন্দর লেগেছে তাই ওয়ালপেপার দিয়েছি তা ছাড়া আর কিছু না। আর বিনিময়ে আপনার ফোনেও আমার ছবি ওয়ালপেপার সেট করে দিয়েছি। ”

এই আকাম না করলে হতো না? তোমার ফোনে আমার ছবি ওয়ালপেপার সেট করে যে আমার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করবে না সেটা আমি জানি। দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলো তুহিন। দীপ্তি তুহিনের মুখের সামনে তুড়ি মেরে বলল, ” আমার দুটোর আগে ঘুম আসবে না। শুনেছি আপনিও দেরি করে ঘুমান। তো কী করবেন রাতে? ”
– ” মুভি দেখা যায়। ”
– ” আচ্ছা আপনি বিছানা ঠিক করে ল্যাপটপ নিয়ে বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”
– ” মানে? আমি কীভাবে বিছানা ঠিক করব? আমি এসব কখনো করিনি। আর আমি এসব পারিও না। ”
– ” আদিক্ষেতা করবেন না তো। পারেন না মানে কী? আমি কী আপনাকে গাছ কেটে কাঠ বানিয়ে, কাঠ দিয়ে খাট বানাতে বলেছি নাকি? নাকি সুতো বুনে বুনে চাদর, তোষক এসব বানাতে বলেছি? শুধু বালিশ গুলো পেতে দিয়ে মশারিটা টাঙাবেন; দ্যাটস ইট! ”
– ” আমি মশারি টাঙাতে পারি না। ”
– ” এত ডেডলি সার্জন সামান্য একটা মশারি টাঙাতে পারবেন না? চেষ্টা করুন, পেড়ে যাবেন। ” বলেই দীপ্তি বাথরুমের দিকে হাটা ধরল। দীপ্তি বাথরুমে ঢোকার আগে তুহিনকে শাসিয়ে বলল, ” মশারি টাঙাতে না পারলে আজ সারারাত মশারি ছাড়াই মশার সাথে ঘুমাবেন আপনি। আমি গিয়ে আশুর রুমে শুয়ে পড়ব। ” বাথরুমে ঢুকে গেল দীপ্তি। বাথরুমে ঢুকেই নিঃশব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দীপ্তি। তুহিনের অসহায় চেহারাটা মনে করছে আর হাসছে দীপ্তি। এদিকে বিয়ে করে বিদ্ধস্ত তুহিন মশারি টাঙাতে ব্যাস্ত। মশারি টাঙাতেও যে প্রতিভার প্রয়োজন পড়ে সেটা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তুহিন। অবশেষে নিউটনের গতি সূত্র, আর্কিমিডিসের প্লবতার সূত্র এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সূত্র প্রয়োগ করে মশারি টাঙাতে সক্ষম হলো তুহিন।
দীপ্তি বাথরুম থেকে বের হয়ে মশারি দেখে বলল, ” এই তো ঠিকমতই টাঙাতে পেরেছেন। তাহলে তখন পারবেন না, পারবেন না কেন করছিলেন? ”
তুহিন কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্তি তুহিনের দিকে তাকিয়ে ভনিতা করে আহ্লাদি সুরে বলল, ” কামচোর! ” তুহিন দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলেও এই কথাটার মানে তুহিন জানে। তুহিন দীপ্তিকে বলে, ” কামচোর হলে মশারি নিচে পড়ে থাকতো। ”
– ” হয়েছে হয়েছে এখন ল্যাপটপ নিয়ে বসুন মুভি দেখি। ”

তুহিন আর দীপ্তি পাশাপাশি বসে ফিল্ম দেখছে। ল্যাপটপটা তুহিনে কোলে রাখা। দীপ্তি একদম তুহিনের পাশ ঘেষে বসেছে। দুজনেই চুপচাপ। মনোযোগ দিয়ে ফিল্ম দেখছে। তুহিন দীপ্তির গায়ের স্পষ্ট মিষ্টি ঘ্রানটা উপলব্ধি করছে। কই? কাল তো পেলাম না এই ঘ্রান। আর এটা আর্টিফিশিয়াল ও মনে হচ্ছে না। গায়ের ঘ্রান আবিষ্কার করতেই আমার একদিন লেগে গেল? দীপ্তিকে নিয়ে এখনো কত কি না জানি আবিষ্কার করা বাকি আমার। এসব ভাবছিল তুহিন। হঠাৎ দীপ্তি নরম গলায় তুহিনকে জিজ্ঞেস করল, ” আপনার তো নাকি বিয়েতে অসম্মতি ছিল। বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ কী? বিয়ে কেন করতে চাচ্ছিলেন না? বলবেন আমায়? ”

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ❤️
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here