প্রেমবিভ্রাট ০৬ তানভীর তুহিন

0
762

প্রেমবিভ্রাট
০৬
তানভীর তুহিন

তুহিন মৃদু করে হাসল। ” পুরনো একটি ঘটনা দেখছিলাম স্বপ্নে। কলেজের প্রথম সপ্তাহ না যেন দ্বিতীয় সপ্তাহে সিনিয়রদের র‍্যাগ খেয়ে একটা দেয়ালে প্রস্রাব করেছিলাম। দেয়ালে স্পষ্ট করে লেখা ছিলো পোষ্টার কিংবা চিকা মারা নিষেধ। নিচে মোটা লাল কালি দিয়ে এ-ও লেখা ছিল, দেয়ালের আশেপাশে প্রস্রাব করা দণ্ডনীয় অপরাধ। আমি সহ ফার্স্ট ইয়ারের আরো তিনটা ছেলেকে পিওন এসে প্রিন্সিপালের রুমে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন কী প্যাদানিটাই না দিয়েছিল প্রিন্সিপাল। পুরো ভুঁড়ি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জোড়া বেত দিয়ে সপাৎ সপাৎ করে মেরেছিল। আমরা অসহায়ের মতো নেচে নেচে বেতের আঘাত সহ্য করেছিলাম। ”

দীপ্তি তুহিনের বর্ণীত ঘটনা শুনে হো হো করে হেসে উঠল। হাসি খানিক সামলে দীপ্তি জিজ্ঞেস করল, ” আচ্ছা আপনারা প্রিন্সিপালকে বলেননি কেন যে সিনিয়রদের র‍্যাগ ছিলো ওটা? ”
– ” আমাদের মাথা তোমার মতো মোটা ছিলো না তাই। ” প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল তুহিন।

রাগে লাল হয়ে গেল দীপ্তি। সে কত মজা করে মনযোগ দিয়ে তুহিনের ঘটনা শুনছে, আর তুহিন কিনা তাকে অপমান করে মাথামোটা বলল? ” তুই মাথামোটা, তোর চৌদ্দপুরুষ মাথামোটা, হারামাজাদা! ” অন্তর্মনে বিড়বিড় করল দীপ্তি। তুহিন ভ্রুকুটি চোখে তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে। দীপ্তির কোন নড়চড় নেই। সে কপাল কুঁচকে বিরক্ত চোখে তুহিনকে দেখছে। দীপ্তির আগ্রহ না দেখে তুহিনই আগবাড়িয়ে বলল, ” আরে সিনিয়রদের নাম বলে ডাবল মার খেতাম না-কি? প্রিন্সিপাল তবুও চারদেয়ালের মধ্যে রেখে পিটিয়েছিল। কিন্তু সিনিয়রদের নাম প্রিন্সিপালের কাছে বললে সিনিয়ররা তো পুরো মাঠে দৌড় করাতো আর ঘাড়াত। ”

তুহিনের কথা শুনে মুহূর্তেই রাগ পড়ে গেল দীপ্তির। কপাল ভাঁজহীন হলো তার। দীপ্তিকে কিছু বলতে-ভাবতে না দিয়েই তুহিন বলল, ” এজন্যই মাথা মোটা বললাম তোমায়। ” কথা শেষে বিজ্ঞ ভঙ্গিতে আলতো হাসল তুহিন। দীপ্তি নিজের হাতদুটো সামনে বাধলো। কণ্ঠদেশ টানটান করে বলল, ” মাথামোটা হওয়া ভাল। মাথা যত মোটা হবে মাথার ভেতর তত বেশি জায়গা হবে। যত বেশি জায়গা হবে তত বড় মস্তিষ্ক হবে। যত বড় মস্তিষ্ক হবে তত বেশি বুদ্ধি হবে। মাথামোটা মানে হলো অধিক বুদ্ধিমান। আপনি আমায় মাথামোটা বলে বুদ্ধিমতী বললেন। থ্যাংকস ফর ইওর কম্পলিমেন্ট মিস্টার তুহিন। ”

দীপ্তির অবান্তর যুক্তি শুনে তুহিন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হো হো শব্দে হাসছে তুহিন। দীপ্তি মুগ্ধনয়নে দেখছে তুহিনকে। মানুষটা কী সুন্দর করে হাসে। ইশ! ওনার হাসিটা যদি গায়ে মাখা যেত। তাহলে আমি সারাক্ষণ ওনার হাসি গায়ে মেখে ঘুরতাম। মুখে ব্রাশ নিয়ে একদৃষ্টে তুহিনের দিকে ঘাড় বাঁকা করে তাকিয়ে আছে দীপ্তি। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মুগ্ধতার হাসি। সারামুখে তৃপ্তির ঝলক। এই মুহূর্তে দীপ্তিকে দেখতে লাগছে অনেকটা আ্যান্টিক শোপিজের মতো। জীবন্ত চিত্তাকর্ষক এক আ্যান্টিক শোপিজ। হাসতে হাসতে তুহিনের পেটে খিল ধরে গেছে। চোখ থেকে পানি বেড়িয়ে গেছে তার। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে তুহিন বলল, ” দীপ্তি প্রতিদিন সকালে আমি ঘুম থেকে ওঠার পর তোমার এরকম আইনস্টাইনের নানি মার্কা কয়েকটা যুক্তি শুনিয়ো আমায়। আমি সকালে হেসে তাজা হওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না। ” ফের হাসিতে ভেঙে পড়ল তুহিন।

তুহিনের কথার জবাবে দীপ্তি মুখ ভেংচাল। বলল, ” এত হাসির কিছুও বলিনি আমি। যথেষ্ট যুক্তিসংগত কথাই বলেছি। ”
– ” মাথামোটা মানে বেশি বুদ্ধি! বুদ্ধিমান! ওহ গড! ” হাসির তোড়ে কথা বলতে পারছেনা তুহিন। দীপ্তি মুচকি হাসি লাগা মুখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তুহিন হাসি থামিয়ে বলল, ” দীপ্তি আমি তোমার এই যুক্তিসংগত কথা আরো শুনতে চাই..”

দীপ্তি তুহিনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ” অনেক সময় আছে শোনার। এখন ফ্রেশ হয়ে নিচে চলুন। সেই কখন এসে আয়েশা ডেকে গেছে। নিচে আব্বু-আম্মু অপেক্ষা করছে আপনার আর আমার জন্য। ”
– ” আচ্ছা যাও, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর আমি যাব। ”

দীপ্তি মুচকি হেসে ব্রাশ এপাশ ওপাশ করতে করতে বাথরুমে ঢুকে গেল। তুহিন খাটে বসে দীপ্তির কথাটা ভাবছে আর হাসছে। হাসি থামাতেই পারছে না সে।

মিনিট বিশেক পর ওরা দুজন একসাথে নিচে নামল। নিচে নামতেই তুহিনের বাবা আসাদ সাহেব বললেন, ” তুহিন কাল ভোর ছ’টায় তোদের ফ্লাইট। ”
– ” ফ্লাইট মানে? কোথাকার? আর তোদের মানে কার কার? ” তুহিনের অবাক গলা।
– ” তোদের মানে দীপ্তির আর তোর। কাল তোরা রিশপ যাচ্ছিস। হানিমুনে। ”
– ” হানিমুনে না পাঁচদিন পড়ে যাবার কথা ছিল? আর যাচ্ছি যখন দেশে কোথাও যাই না.. রিশপ যাবার কী দরকার? ”
– ” দিনকয়েক পর থেকেই মেডিকেল কলেজের ক্লাস শুরু হবে। তখন ক্লিনিকে প্রেশার থাকবে। তাই একটু আগে আগেই পাঠিয়ে দিচ্ছি তোদের। ”
– ” তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু রিশপ যাবার কী দরকার? দেশে কোথাও যাই না? এই যেমন জাফলং, সাজেক, কক্সবাজার, বান্দরবান এসব কোথাও? ”
– ” রিশপ যাবার দরকার আছে। কারণ দীপ্তির ড্রিম, ও হানিমুনে রিশপ যাবে। আর স্বামি হিসেবে তো এটা তোর দায়িত্ব যে স্ত্রীর পছন্দের যায়গায় হানিমুনে নিয়ে যাওয়া, তাইনা? ”
– ” দীপ্তির ড্রিম রিশপ? কই দীপ্তি তো আমায় কিছু বলেনি.. ”
– ” দীপ্তি আমায়ও কিছু বলেনি। আশু বলল। সে অনুযায়ি আমি প্লেনের টিকেট কেটে দিয়েছি। ওখানকার ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথাও হয়ে গেছে আমার। ওরা তোদের বেষ্ট ট্রাভেল গাইড প্রোভাইড করবে। তোদের ভ্রমন অভিজ্ঞতা যাতে সর্বোত্তম এবং উপভোগ্য হয় সে দায়িত্ব তাদের। আর তাছাড়া হানিমুন প্লেস নিয়ে তোর স্পেসিফিক কোনো চয়েস আছে বলে তো আমার মনে হয় না। তোর কোন চয়েজ আছে? ”
– ” না, আমার কোন চয়েজ নেই। ”
– ” ব্যস তাহলে তো চুকেই গেল। ব্যাকপ্যাক শুরু করে দে। কাল ভোর ছয়টায় ফ্লাইট। আর হ্যা ওখানে নাকি এখনো বেশ শীত পড়ে, গরম জামাকাপড় নিয়ে নিস। কোন শপিং প্রয়োজন হলে আজকেই করে নে। ”
– ” আমার কোন শপিং লাগবে না। ”

আসাদ সাহেব দীপ্তির দিকে তাকালেন। ” কিরে বুড়ি! চুপ কেন? হানিমুনে রিশপ যাচ্ছিস, খুশি হসনি? ”
দীপ্তি দাঁত কেলিয়ে হাসল। ” খুশি মানে? খুশিতে লাড্ডু হয়ে আছি! ”
আসাদ সাহেব একটু হাসলেন। বললেন, ” তা তোর কোন শপিং-টপিং লাগবে না? ”
– ” কিছু লাগবে। ”

আসাদ সাহেব তুহিনকে বললেন, ” আচ্ছা তাহলে নাস্তা করে দীপ্তিকে নিয়ে শপিংয়ে চলে যা। আর হ্যা শপিং থেকে ফেরার পথে বেয়াই-বেয়াইনকে হানিমুনে যাবার ব্যাপারটা জানিয়ে আসিস তোর শশুরবাড়ি গিয়ে। ” তুহিন নিশ্চুপ ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।

ডাইনিং রুম থেকে শায়লা বেগমের উঁচু গলা শোনা গেল, ” হ্যা গো! তোমাদের আলোচনা শেষ হলে নাস্তা করতে এসো। ”
আসাদ সাহেব ঘাড় পিছুকাত করে বললেন, ” আসছি। ”

সবাই নাস্তা করছে। শায়েলা বেগম এখনও বাড়ির প্রায় সব রান্না নিজ হাতে করেন। বুয়া অবশ্য সাহায্য করে তাকে। শায়েলা বেগমের রান্নায় আলাদা একটা ব্যাপার আছে। যেকেউ একবার তার রান্না মুখে নিলেই ভক্ত হতে বাধ্য। নাস্তা করার এক পর্যায়ে গিয়ে দীপ্তি শায়েলা বেগমকে বলল, ” আম্মু আমায় এসব রান্না করা কবে শেখাবে? ”
শায়লা বেগম তৃপ্ত হাসলেন। ” হানিমুন থেকে আয়। ”

শায়েলা বেগম আয়েশার দিকে তাকালেন। বিদ্রুপের সুরে বললেন, ” এই যে নবাব নন্দিনী! দীপ্তি রান্না শেখার সময় আপনিও রান্না শিখবেন। মনে থাকে যেন। ”
আয়েশা শায়েলা বেগমের কথা আমলে না নিয়ে রসিকতা শুরু করল, ” তুমি বরং আমার বরকে রান্না শিখিয়ো। বিয়ের পরে আমার জামাই রান্না করে আমার মুখে তুলে দেবে আর আমি ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে শুধু গিলবো। ” কথা শেষ করেই শব্দ করে হেসে উঠল আয়েশা।
– ” কথার জন্য কারো কাছে যাওয়া লাগে না শয়তানের। চুপচাপ রান্না শিখবি। নাহলে তোর হাত-পা ভেঙে আমি তোকে কিচেন শেলফে সাজিয়ে রাখব। ” শায়েলা বেগমের কথায় সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল।

নাস্তা শেষে তৈরী হয়ে দীপ্তিকে নিয়ে শপিংয়ের জন্য বেরোল তুহিন।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে! ♥
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here