প্রেমবিভ্রাট
০৮
তানভীর তুহিন
দীপ্তি ভোরে উঠে গোসল সেরে এসে তুহিনকে নিজের ভেজা চুলের পানি দিয়ে ঘুম ভাঙানোর লোভটা সামলাতে পারেনি। দীপ্তির খুব লোভ হচ্ছিলো তুহিনের ওই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটায় নিজের চুলের ডগায় জমে থাকা পানির ফোটা ফেলতে। দীপ্তি বেশ কয়েকটা সিনেমা এবং সিরিয়ালে দেখেছে এভাবে ঘুম থেকে ওঠানোর পরে নায়ক একদম মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকে নায়িকার দিকে। তুহিনও কী ওভাবেই মুগ্ধনয়নে দেখবে আমায়? ক্যাবলার মতো ওই ঘুমুঘুমু চোখদুটো কী উন্মাদ হয়ে যাবে আমাতে? ওভাবে ঘুম থেকে ওঠালে কী তুহিনের অনুভুতি ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে নামবে আমায় জয় করার প্রয়াসে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই দীপ্তি তুহিনের দিকে ঝুঁকে নিজের লম্বা ভেজা এলোকেশের ডগায় জমে থাকা পানির ফোটা বিসর্জন দেয় তুহিনের মুখে। তারপর চুলের আগাটা গুচ্ছমতো করে লেপটে দেয় তুহিনের মুখে।
ভেজা চুলের স্পর্ষে ঘুম ভেঙে গেল তুহিনের। সকাল সকাল এভাবে ঘুম থেকে ওঠার প্রস্তুতি মোটেই ছিল না তার। পাকা ঘুমের ব্যাঘাত তার কাছে শ্রেষ্ঠ বিরক্তির ব্যাপার। কপালে বিরক্ত ভাজ ফেলে চোখ খুলল তুহিন। চোখ খুলতেই বিরক্তি উধাও। কপালের ভাজও দৌড়ে পালিয়েছে অজানায়। তুহিন মুগ্ধতায় হয়েছে বেখবর। চোখদুটো যেন স্বাভাবিক পরিধির চেয়ে বেশ বড় হয়ে গেছে তুহিনের। পরনে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি, ভেজা চুলে লেপটে থাকা ঘাড়, ফর্সা গলাটা বেয়ে পানি সোজা বুকে নেমে যাচ্ছে; যেন এক জীবন্ত জলস্রোত! পেটে ফোটা ফোটা পানি জমে আছে, আর কাঁপাঠোট দুটো যেনো তুহিনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে। তুহিনের অনুভূতির বিদ্রোহ মিছিল শুরু হয়ে গেছে। আবেগ পৌঁছেছে অনুভুতির পরম পরিণয়ে। এর চেয়ে সুন্দর আর স্নিগ্ধভাবে কী সকাল শুরু হতে পারে?
দীপ্তি যতটা আশা করেছিল তার চেয়ে সহস্র কোটিগুন বেশি পেয়েছে। তুহিনের চোখ স্পষ্ট প্রকাশ করছে যে সে কতটা মুগ্ধ। তুহিন যেন মুগ্ধতারও সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে। তুহিনের এই চাহনি উন্মাদ করে দিচ্ছে দীপ্তির বুককে। তুহিন নিজে হৃদপিন্ড বিশেষজ্ঞ হয়েও যেন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছে নিজের হৃদস্পন্দনের ওপর থেকে। পুরো নিস্তব্ধ রুমে, হালকা বাতাসে দুজনে অনুভব করছে প্রথম মুগ্ধতার মুহূর্ত। তুহিন চোখ সরাচ্ছে না, নামাচ্ছে না, এমনকি তুহিনের চোখ পলক ফেলতেও নারাজ। দীপ্তি আর পারছে না দাঁড়িয়ে থাকতে। তুহিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার শরীরে মরন কাঁপন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তুহিন আর পারছে না এভাবে বসে থাকতে। তার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে এই অপ্সরাকে, চরিত্রহীন হতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। দুজনই যেন একদম স্তব্ধ হয়ে গেছে, ওদের আশেপাশের পরিবেশও যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওদের আপন সময়ও যেন থেমে গেছে আপন দায়িত্বে। শুধু কথা বলছে ওদের মাতাল চাহনি আর উন্মাদ হৃদস্পন্দন।
হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘোর কাটল ওদের। এই শব্দের সৃষ্টি না হলে যেন ওরা এভাবেই থেকে যেত অনন্তকাল। দীপ্তি গিয়ে দরজা খুলল। প্রত্যেকদিনের মতো আজও দরজার ওপাশে আয়েশা। দীপ্তির দিকে না তাকিয়ে, চোখ বন্ধ রেখেই আয়েশা বলল, ” এই প্যারা আর ভাল লাগে না। প্রত্যেকদিন আম্মু আমার ঘুম হারাম করে দেয়। হানিমুনে আর যাই করিস একটু নিয়ম করে ঘুম থেকে ওঠার রুটিনটা করিস। ” কথাগুলো বলতে বলতেই আয়েশা চোখ কচলাতে কচলাতে তাকাল দীপ্তির দিকে। তাকাতেই আহ্লাদি সুরে চেঁচিয়ে উঠল, ” এ্যায় জানু! লুকিং সো হট। বোম লাগছে পুরো। ”
হট পর্যন্ত ঠিক ছিল। বোম কথাটা শুনতেই দীপ্তি আয়েশার মুখ চেপে ধরল। দাঁত চিপে বলল, ” চুন্নিই! আস্তে; তোর ভাইয়া জেগে আছে। ”
– ” তো কোন ঘোড়ার ডিম হয়েছে? ” বলেই আয়েশা দীপ্তিকে ঠেলে নিয়ে রুমে ঢুকল।
তুহিন বসে চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলছিল। আয়েশা গিয়ে তুহিনকে বলল, ” ভাইয়া জানুকে কেমন লাগছে? ”
মোষ্ট প্রেটিয়েস্ট লেডি ইন দ্য ইউনিভার্স! মনে মনেই কথাটা বলে ফেলল তুহিন। কিন্তু আয়েশাকে বলল, ” ঠিকই তো আছে। তোর মতো তো মুখ ট্যারা-বাকা হয়ে যায়নি। আগে যেমন ছিলো এখনও তেমনই আছে। কোন চেঞ্জেস তো দেখছি না। ”
আয়েশা নাক সিঁটকাল, ” সক্কাল সক্কাল আমার পা ধরে না টানলেও পারতি। কানাটা! আমি জিজ্ঞেস করেছি এই পিঙ্ক কালারের শাড়িতে কেমন লাগছে জানুকে? ”
– ” ভালোই। ”
– ” শুধু ভালোই? ” আয়েশার চোখ কপালে।
– ” হ্যা.. ”
– ” আমি তোর জায়গায় হলে এটম বম্ব বলে কমপ্লিমেন্ট দিতাম। পুরো বাংলা বোম! ”
আয়েশার কথা শুনে আহাম্মক হয়ে গেল দীপ্তি। বাইরে বলেছে ঠিক ছিল। কিন্তু সোজা তুহিনের সামনে এভাবে বলায় ভেতরে ভেতরে লজ্বায় যেন মরে যাচ্ছিল দীপ্তি। আয়েশার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তুহিন।
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের জন্য বেরোল ওরা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। ব্যাকসিটে তুহিন আর দীপ্তি বসা। তুহিন বাইরে তাকিয়ে নিস্তব্ধ, স্নিগ্ধ পরিবেশ আর দীপ্তিরে গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ উপভোগ করছে। দীপ্তি উদযাপন করছে নিজের প্রিয়তমের প্রথম মাতাল চাহনির উচ্ছাস। দীপ্তি জানালা দিয়ে মাথাটা খানিক বের করে সকালের নির্মল বাতাসে বিলিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। খানিকবাদে বাদে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে আর চোখদুটো এক হয়ে সৃষ্টি করছে এক মৃদু মাতাল মুহূর্ত।
দুজনে এয়ারপোর্টে বসে আছে। ফ্লাইট ১৫ মিনিট ডিলে। তুহিন বাইরে তাকিয়ে প্লেন দেখছে। বেশ কয়েকবার প্লেনে চড়েছে তুহিন। প্লেন দেখেই তুহিনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ তুহিন দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করল, ” তুমি কখনো সংসারে অভাব দেখেছ? ”
তুহিনের আচানক, অদ্ভুত প্রশ্নে অবাক হলো দীপ্তি। ভ্রুকুঞ্চন করে জবাব দিল, ” হঠাৎ এই প্রশ্ন? ”
– ” বলো না। দেখেছ কখনো? ”
দীপ্তি মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়ল, ” না দেখিনি। আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই আমার পরিবারকে যথেষ্ট স্বচ্ছল দেখেছি। ”
তুহিন নিশ্চুপ বাইরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চরম নিরবতা কাজ করল দুজনের মাঝে। নিরবতা কাটাতে দীপ্তি আলতো গলায় বলল, ” কী হয়েছে? হঠাৎ এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন? ”
তুহিন নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাস বিয়োগ করল। ” আমি ছোটবেলায় নিজেদের সংসারে অভাব দেখেছি। অভাব ছিল সেটা জানতাম। কিন্তু বাবা কখনো বুঝতেই দিতেন না। আমার নানুবাড়ি, মানে আমার মায়ের বাবার বাড়ি খুবই স্বচ্ছল ছিল। চাইলেই বাবা তাদের থেকে সাহায্য নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। আজ যে এই ক্লিনিক দেখছ, এই ফার্মাসিউটিক্যাল বিজনেস দেখছ, এই পুরো ব্যাবসাটা বাবা নিজে দাঁড় করিয়েছেন। পুরোটাই বাবা আর মায়ের অবদান। বাবা যে কী পরিমাণে হার্ড ওয়ার্কিং তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। আমার দাদাকে আমি দেখিনি। কিন্তু বাবা বলেছেন আমার দাদা নাকি কৃষক ছিলেন। খুব গরীব ফ্যামিলি থেকে বিলং করতো বাবা। বহু কষ্ট, ত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম, আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরেই বাবা ডাক্তারি পাশ করে। আসলে কথাগুলো মনে পড়ে গেছে প্লেন দেখে। আমার দাদা নাকি প্লেনকে আকাশের নৌকা বলতেন। বাবা যেদিন প্রথম প্লেনে চড়েছিলেন তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বিদেশ থেকে বাড়ি ফেরার সময় আমার আর আয়েশার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলেন তিনি। আয়েশা তখন তেমন কিছু বুঝত না। বাবা আমায় বলেছিলেন। সেদিন নাকি প্লেনে ওঠার পরে বাবা প্লেনে শুধুই কেঁদেছিলেন। আর উপভোগ করছিলেন নিজের চরম কষ্টে পাওয়া সাফল্য। ওই দিনটা কোনদিন ভুলতে পারব না আমি। আমার সামনে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছিলেন বাবা। একদম বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়েছিলেন। সেদিন পাশ থেকে মা-ও আনন্দ অশ্রু ঝড়াচ্ছিলেন। ”
দীপ্তি মনযোগ দিয়ে ডুবেছিল তুহিনের কথায়। আসাদ সাহেবের ব্যাপারে অনেক কথা শুনেছে দীপ্তি। দীপ্তির অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ আছে নিজের শশুরের প্রতি। দীপ্তির চোখটা হালকা ভিজেছে, তুহিনের চোখদুটোও ভিজেছে। এর মধ্যেই প্লেনের শিডিউল এনাউন্স করা হয়। প্লেনে দুজনে বেশ গল্প গল্প করতে করতেই কাটিয়েছে। একদম একঘেয়ে লাগেনি দুজনের। খানিক গল্প করেছে, খানিক অকারণ ঝগড়া করেছে, খানিক প্রেমচর্চাও করেছে। এভাবেই দুজনে পৌঁছে গেছে মেঘরাজ্য রিশপে।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে! ♥
” Tanvir’s Writings “