প্রেমবিভ্রাট
০৯
তানভীর তুহিন
দুপুর দুটোর কাছাকাছি ওরা রিশপ পৌঁছাল। রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে ট্যুর গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হোটেলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথেই দীপ্তি বলল যে, সে হোটেলে থাকবে না। কারণ হোটেলের থেকে বেটার হবে নাকি রিশপে হোম স্টে করা। যখন হোম স্টে’র সুবিধা আছে তখন হোটেলের প্রশ্নই ওঠে না। হোটেলের কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতার চেয়ে কারো বাড়িতেই ঘরোয়া পরিবেশে পেয়িং গেষ্ট এর মত থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কী?
রিশপের পাহাড় ঘেষা একটা দোতলা বাড়িতে হোম স্টে করছে তুহিন আর দীপ্তি। এদিকের হোম স্টে’র বাড়িগুলো যেন আলাদা ধাঁচেই বানানো হয়।বাড়িগুলো এতোই সুন্দর যে বারংবার মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। দীপ্তি তো হোম স্টে’র দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুহিনকে বলেই ফেলল, ” চলুন না এখানে একটা ছোট বাড়ি কিনে এখানেই পাকাপোক্তভাবে সেটেলড হয়ে যাই? ”
তুহিন জবাবে শুধুই মুচকি হাসল। ঠিক এই খেয়ালটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুহিনও উপলব্ধি করেছে।
সকাল থেকে ননস্টপ জার্নি করায় দুজনই ক্লান্ত। তবে ততটাও ক্লান্ত নয়। কিন্তু দুজনেরই দেহে একটা গা ছাড়া ভাব চলে এসেছে। সেজন্য দুজনেই স্বিদ্ধান্ত নিল যে এখন কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নেবে। আর ঘুমোতে যাবার আগে হোম স্টে’র হোম মেড একটা শরবত। আহ! এই শরবতে যেন ঘুমের ঔষধ মেশানো। শরবতের ইনগ্রিডিয়েন্টস স্বমন্ধ্যে কোন আইডিয়া নেই ওদের। তবে শরবতটা দারুণ ছিল। শরবত খেয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। খাটের ঠিক পাশেই একটা বেশ লম্বাচওড়া জানালা। সেই জানালা দিয়ে ভেতরে হিম হাওয়া ঢুকছে। তারসাথে বাইরে উড়ন্ত মেঘেদের ছোটাছুটি। চারপাশের ন্যাচারাল ভাইভ তারসাথে এক অসাধারণ মেঘপ্রকৃতির ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে যেন মেঘের ঘ্রাণ অনুভব করছে ওরা। ঐ শরবত খাবার পরে এই প্রকৃতিতে ওরা আর বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারল না। শোয়ার কিছু মুহূর্ত বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল দুজনে।
বিকাল প্রায় পাঁচটা বাজে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে দুজনেই বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছে। হালকা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে আশপাশটা। বাতাসের ঠান্ডাভাবটাও তীব্র হচ্ছে। এর মধ্যেই হোম স্টে’র মহিলা এসে ওদের বড় গোলকাপে চা, বিস্কুট, আর পাউরুটি দিয়ে গেল। বারান্দায় চেয়ারে বসে এই চা। আহ! জীবন এভাবে এখানে থেমে গেলেই পারত। এই চা আর প্রকৃতির চেয়েও বেশি স্নিগ্ধতা যেনো দীপ্তির চা খাওয়ায়। কাপে ঠোঁট লাগিয়ে হালকা টান দিয়ে চা মুখে নিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে যেন চায়ের সাথে বাসর করছে। চা শেষ করতে করতেই বাইরে ঠান্ডার পরিমাণ বেড়ে গেল। দুজনে গায়ে ভারী জ্যাকেট জড়িয়ে নিল। খানিক অন্ধকার, খানিক আলো, আবছা কুয়াশা, হিমেল হাওয়া আর তার সাথে এই অদ্ভুত এক ঠান্ডা। এই প্রকৃতির প্রেমে উত্তাল হবে না এমন মানুষ বোধহয় ইহোলোকে নেই।
বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সাথে সূর্যের লুকোচুরি দেখছে দুজন। এভাবে লুকোচুরি করতে করতে সূর্যটা একেবারে লুকিয়েই পড়ল একসময়। চারপাশটা অন্ধকার। ওরা এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে। খানিকবাদেই অন্ধকারটা ঠেলে নিচ থেকে একটা আলো উঠে এলো। সামনে উঠোন মতো ফাঁকা জায়গাটায় বর্নফায়ার জ্বালানো হয়েছে। এই রাতে বিশেষ কোথাও ঘোরার সুযোগ না থাকায় নিচে নেমে বর্নফায়ারটা উপভোগ করল ওরা। এই বর্নফায়ারেরও যেন এক আলাদা সৌন্দর্য আছে। বর্নফায়ারের আগুনটা যেন সিপাহী; বিদ্রোহে নেমেছে অন্ধকারের বিরুদ্ধে। আগুনের ক্ষীণ শব্দটা কান না পাতলে শোনা অসম্ভব। কান পাতলেও শোনা কষ্টকর। সেই শব্দটাই যেন মনে হচ্ছের যুদ্ধের ঢাল-তলোয়ারের টুংটাং শব্দের মতো।
রাতে খাবার পরে তুহিন বুঝতে পারল দীপ্তির হোম স্টে করার সিদ্ধান্তটা আসলেই সঠিক ছিলো। হোম স্টে’তে আসলেই ঘরোয়াভাব আছে একটা। এনাদের খাবারের রেসিপিগুলো একদম অসাধারন। এনাদের আপ্যায়ন, বন্ধুসুলভ আচরন সবমিলিয়ে ওরা নিশ্চিত হয়ে গেল যে এই ১০ দিন ওদের কোন প্রকার থাকা খাওয়ার অসুবিধা হবে না।
দুজনে শুয়ে আছে ঘুমোবে বলে। এই ব্যাপক রোমান্টিক আবহাওয়ায় দীপ্তির খুব ইচ্ছে হচ্ছে তুহিনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে। কিন্তু এভাবে তো চাইলেই আর হুট করে জড়িয়ে ধরা যায় না। যদিও তুহিন তার বিয়ে করা স্বামি। তবুও অধিকারের স্বাধিনতা বলেও তো একটা কথা আছে নাকি। তুহিন চোখ আর কপালের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। দীপ্তি চোখ খুলে টুকটুক করে দেখছে তুহিনকে।
আচ্ছা এই মানুষটা কি একটু রোমান্টিক ওয়েদারও বোঝে না? পাশে সুন্দরি বউ শোয়া আর ব্যাটা কিনা চুপচাপ শুয়ে আছে? দীপ্তি দাঁত দিয়ে নখ খুটছে আর ভাবছে কী করে উস্কানো যায় তুহিনকে। দীপ্তি একটু আলহাদি স্বরে তুহিনকে উস্কানোর জন্য বলল, ” বাইরের আবহাওয়াটা অনেক রোমান্টিক তাই না? ”
তুহিন চুপচাপ চোখ বুজে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না। দীপ্তির এখনও মেজাজ বিগড়ে যায়নি। দীপ্তি আবার বলল, ” আসলেই ওয়েদারটা কিন্তু ব্যাপক রোমান্টিক। আহ! ”
তুহিন বুঝতে পারল দীপ্তি কী বোঝাতে চাচ্ছে। সবটা বুঝেই তুহিন বলল, ” ভয় নেই। আমার নিজের ওপরে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। নিশ্চিন্তে ঘুমোও, আমি টাচও করবো না। ”
তুহিনের কথাশুনে দীপ্তি আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌছে গেল। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে দীপ্তির।
আহারে! আসছে আমার চরিত্রবান। হ্যা রে ব্যাটা কে ভয় পায় তোকে? ভয় পাই না বলেই তো বললাম। আর তুই কী বললি? তুই সেলফ কন্ট্রোলড? হানিমুনটা এভাবেই মাটি করবি তুই?
মনে মনে তুহিনকে এসব বলছিল দীপ্তি। দীপ্তির কোনো আওয়াজ না পেয়ে তুহিন চোখের ওপর থেকে হাত নামিয়ে নিল দীপ্তির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। দীপ্তি ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তার কপালের ভাজে স্পষ্ট রাগ। তুহিন দীপ্তির রেগে যাবার কারণ জানে না। কারণ জানতেই দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করল, ” কী হয়েছে? এভাবে দেখছ কেন আমায়? ”
দীপ্তি দাঁত, মুখ, চোখসহ পুরো শরীর খিচুনি দিয়ে বলল, ” এ্যাই কে বলেছে আপনি টাচ করলেই আমি আপনাকে টাচ করতে দেব? একদম নিজের মতো আজগুবি কথাবার্তা ভেবে এ্যডভান্টেজ নিতে আসবেন না। ” এবারও দীপ্তি কৌশলে ইঙ্গিত দিল তুহিনকে।
– ” আমি ঘুমের মধ্যেও তোমার সুযোগ নেব না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারো দীপ্তি। ” তুহিনের বেজায় স্বাভাবিক গলা।
দীপ্তির রাগ সপ্তমে। কটমট করে ওপাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ” আপনি জেগে আছেন কোন সুখে? বউ আরেকটা আছে নাকি যে তার সাথে লুতুপুতু করবেন? ”
– ” বউ আরেকটা থাকতে যাবে কেন..”
তুহিনের কথা শেষ না হতেই দীপ্তি খেঁকিয়ে উঠল, ” আপনার একটা নিঃশ্বাসের শব্দও যাতে আমার কানে না আসে। চুপচাপ ঘুমান। একদম চুপচাপ! ”
তুহিন বেয়াক্কেল বনে চুপ মেরে গেল। তুহিন বিস্মিত হয়ে ভাবছে, দীপ্তি রেগে গেলো কেন? দীপ্তি ওপাশ ফিরে রাগে ফুসছে আর তুহিনকে অন্তর্মনে গালাগাল দিচ্ছে, ব্যাটা নিরামিষ, চরিত্রবান ব্যাঙ, সাধু বিড়াল, বিলেতি বেয়াদব খরগোশ, তিতা ভাল্লুক এসব বলে। তুহিন দীপ্তির রাগের কারণ খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়ে গেল। দীপ্তি ঘুমিয়ে গেল তুহিনকে গালাগাল দিতে দিতে।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে! ♥
” Tanvir’s Writings “