প্রেমবিভ্রাট ১৩ তানভীর তুহিন

0
606

প্রেমবিভ্রাট
১৩
তানভীর তুহিন

কেটে গেল আরো কয়েক সপ্তাহ। ওদের বিয়ের প্রায় তিন মাস হতে চলল। তুহিন দীপ্তির প্রেমে হাবুডুবু, নাকানিচোবানি সব খাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না। কেমন একধরণের জড়তা কাজ করে তুহিনের। কিছু বলতে গেলেই আটকে যায় সে। নিজেকে একদম অপ্রাপ্তবয়স্ক ষোড়শা প্রেমিক মনে হয় তুহিনের। তুহিন খুব চাচ্ছে সম্পর্কটাকে প্রমোশন দিতে। কিন্তু পেরেই উঠছে না। প্রমোশন মানে সবধরনের অধিকার। আসলেই অবাক না? নিজের বিয়ে করা বউয়ের উপর তেমন কোন অধিকারই নেই তার। হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ ওদের যে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। লাভ ম্যারেজ হলে বোধহয় এরকমটা হতো না। দীপ্তি একেবারে ভাবলেশহীন ভাবে দিন কাটাচ্ছে। সে ঠিকই করে নিয়েছে যে, যতদিন না তুহিন নিজে নিজে প্রেমে পড়ে তাকে এসে প্রেমের কথা বলবে ততদিন সেও তুহিনকে বলবে না যে সে তাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে। দীপ্তি প্রায়ই ভাবে যে তুহিনকে সবটা বলে দেবে। তুহিন নিশ্চয়ই তাকে ফিরিয়ে দেবে না। কারণ সে তার বিবাহিতা স্ত্রী। কিন্তু আবার নিজে নিজেই ভাবে কেন আমি আগে বলতে যাব? প্রেমের কথা আগে ছেলেরা বলবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম, নাকি? আমারও শখ থাকতেই পারে। ও না বললে আমারও এত বলার মহাঠ্যাকা পড়েনি নিশ্চয়ই। কোনদিন না কোনদিন তো বলবেই। সবুরে মেওয়া ফলে। সেই মেওয়ার লোভেই দিনের পর দিন সবুর করে যাচ্ছে দীপ্তি।

তুহিন ইদানিং সর্বক্ষণ দীপ্তিকে নিয়েই ভাবে। কীভাবে দীপ্তিকে ব্যাপারটা বলবে তা নিয়েই চিন্তায় মশগুল থাকে তুহিন। নিজের বিয়ে করা বউকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারছিস না ব্যাটা? কী ছাতার পুরুষ মানুষ রে তুই? নিজে নিজেই এসব বলে বলে নিজেকে বকাঝকা করে তুহিন। সাহসও জোগায় যে আজ যেভাবেই হোক বলেই দেব। কিন্তু কোনোদিনই হয়ে ওঠে না। দীপ্তির কাছে জড়তা কাজ করার কোনো কথাই না। কারণ ওরা এখন একদম ফ্রি। একদম কলেজের ইয়ার, জিগারের মতো আচরণ ওদের। কিন্তু তাও তুহিনের কেমন যেন লাগে বলতে গেলে। তুহিনের দীপ্তিকে খুব বলতে ইচ্ছে করে যে, দীপ্তি তোমার কথা ভাবলেই না আমার কেমন যেন সুরসুরি সুরসুরি বোধ হয়। অযথাই হেসে ফেলি। ভেতর থেকে কেমন যেন এক উদ্ভট ধরণের নৃত্য প্রদর্শনী শুরু হয়ে যায়। আমি হার্টের ডাক্তার হয়েও নিজের হার্টবিটের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। যখন রাতে ঘুমন্ত তোমার ওই খোলা ঘাড়টা দেখি। খুব মন চায় শুধু ওখানে ডুবে যাই। কিন্তু অনধিকারচর্চা হবে ভেবে আর ডুব দেওয়া হয় না।

সন্ধ্যাবেলা ক্লিনিকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছে তুহিন। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। তুহিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, আহারে তুহিন এই মাতাল আবহাওয়ায় সব ম্যারেড কাপলরা নিজেদের ফ্যান্টাসি পূরণ করছে। কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ট করছে। অনুভূতি আর আবেগের বিশেষ শখ আহ্লাদ পূরণ করছে। আর তুই নিজের বিয়ে করা বউয়ের প্রেমে পড়েও নিজের বউকে তা জানাতে পারছিস না। এমন হাবা কীভাবে হলি রে? এসব ভাবতে ভাবতেই আচমকা অকারণে ফিক মুচকি হেসে ফেলল তুহিন। হাসিটা আবার অদৃশ্যও হয়ে গেল মুহূর্ত ব্যবধানে। খানিক বাদে এর চেয়েও চওড়া মুচকি হাসলো তুহিন। দীপ্তির সেদিনকার ভেজা পিঠের ওই লেপটে থাকা ব্লাউজটা, হালকা ভিজে যাওয়া চুল ও ঠোঁটদুটোর কথা মনে পড়ে গেল তুহিনের।

এই তো কিছুদিন আগেই তুহিনের ক্লিনিক বন্ধ থাকায় তুহিন বাসায়ই ছিল। বাইরে বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। দীপ্তি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখছিল, আর বাচ্চাদের মতো খিক খিক করে হাসছিল। তারপর দুহাত কোষ করে তাতে পানি নিয়ে সে পানি নিজের মাথার উপর ঢালছিল। তুহিন দীপ্তির এমন আহাম্মকি কান্ড দেখে দীপ্তিকে ডেকে বলল, ” কী করছো এসব? ভিজতে হলে ছাদে গিয়ে ভেজো। ”
দীপ্তি তুহিনের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে বলল, ” আপনি আমায় ছাদে গিয়ে ভিজতে বলছেন? আমায় ভেজা থেকে আটকাবেন না? ”
– ” কেন আটকাব? ”
– ” আমার যদি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসে? তাই আটকাবেন। ”
– ” আহ ন্যাকামিরে! যথেষ্ট বড় তো হয়েছ। পরিমাণমতো ভিজলেই হলো। যাতে বৃষ্টি ভেজাটাও উপভোগ করা যায়, জ্বরও না আসে। ছাদে গিয়ে সেভাবে ভিজে এসো। ”
– ” বৃষ্টি ভেজার পরিমাণ হয় না। বৃষ্টিতে ভিজলে শুধু ভিজতেই ইচ্ছে করে। আপনি বুঝবেন না। নিরামিষ কোথাকার। ”
– ” কীভাবে নিরামিষ? আমায় কেটে রান্না করলেও তো আমিষ। ”
– ” আপনি এত তর্ক করেন কেন? আর সবসময় তর্কে আপনার জিততেই বা হবে কেন? ”
তুহিন একটু হাসল, ” দেখো তর্ক করার কথা কে বলছে? ”
দীপ্তি মৃদু হেসে বলল, ” নিরামিষ বলতে আনরোমান্টিক বুঝিয়েছি। সবজি আর অসবজির বিশদ ব্যাখ্যা দেইনি। ”
– ” আমি মোটেই আনরোমান্টিক না। আমার ভেতরভর্তি রোমান্টিকতা। ”

কী? তুহিন কিনা রোমান্টিক? এটা অবিশ্বাস্য। এ অবিশ্বাস্য কথা মানতে একেবারেই নারাজ দীপ্তি। দীপ্তি ঘাড় এপাশ ওপাশ নেড়ে বলল, ” আমি বিশ্বাস করি না। ”
তুহিন বলল, ” তাহলে আর কী করার? যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। সেখানে তো আর আমি দখল দিতে পারব না। ”
– ” আচ্ছা আপনার ইচ্ছা করে না এই বৃষ্টিতে আমায় জড়িয়ে ধরে, একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। তারপর বৃষ্টির ওই টুপটাপ শব্দে একদম মাতাল হয়ে যেতে? ” একপ্রকার ধ্যানে মজে গিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে পরিণত অনুভূতি অনুভব করে কথাগুলো বলল দীপ্তি।

তুহিন ভ্রু কুঁচকে দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করল, ” এখন তুমি কী চাচ্ছো এসব? ”

দীপ্তি মুখ ঝামটাল, ” আমি আপনার মতো অত চরিত্রহীন না। আমার নিজের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। ”
– ” এই মিথ্যে অপবাদটা একদম সত্য করে দিতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। ”
দীপ্তি বিড়বিড় করে উঠল, ” দিন না সত্য করে। কে আটকে রেখেছে? আমি চাই আপনি আমার প্রেমে চরিত্রহীন হয়ে আমায়ও চরিত্রহীন করে দিন। কবে আসবে সে চরিত্রহীনতার মুহূর্ত? ”

তুহিন এসব কিছুই শুনতে পেল না।

দুজনেই কিছু মুহূর্তের জন্য নিভৃতে তলিয়ে গেল। খানিকবাদে তুহিন জিজ্ঞেস করল, ” তুমি এভাবে বাচ্চাদের মতো মাথায় বৃষ্টির পানি দিচ্ছো কেন? ”

দীপ্তি নাক গুছিয়ে হেসে বলল, ” আমি ছোটবেলা থেকেই এরকম করি। আপনিও দিন না বেশ মজা লাগে ব্যাপারটা। বৃষ্টির দিনে আমার অন্যতম পছন্দের কাজ এটা। ”

তুহিন মেজাজে গুরুগম্ভীরভাব এনে বলল, ” আমার এসব মিনিংলেস কাজের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই। ”

কথাটা দীপ্তির কানে পৌঁছানোর সাথে সাথেই দীপ্তি মনে মনে তুহিনকে একটা ভারী গালি দিয়ে বসল। বিড়বিড় করে বলল, ” চুপ থাক ছ্যাড়া। তুই এসবের কী বুঝবি? আনরোমান্টিক খরগোশের বাচ্চা! ”

বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই ভিজতে থাকল দীপ্তি। তুহিন খাটে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল। কোন উপন্যাস বা সাহিত্যের বই না। মেডিকেল সাইন্সের বই। কিছু কিছু থিউরি আবার একটু ঝালাই করে নিচ্ছিল তুহিন। হঠাৎ দীপ্তির দিকে নজর যেতেই তুহিন হদিস পেলো এক মারাত্মক নেশার। দীপ্তি মাথায় এতই পানি ঢেলেছিলো যে সেটা প্রায় অর্ধেক গোসল হয়ে গেছে। দীপ্তি একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরেছিল। এমনি বাসায় থ্রি-পিস নাহয় ট্রাউজার আর টি-শার্টই পড়ে। মাঝে মাঝে শাড়ি পড়ে। সেদিনও শাড়ি পরেছিল। পরনের ব্লাউজটা ভিজে একদম লেপটে গিয়েছিল পিঠের সাথে। বৃষ্টির পানিতে দীপ্তির পিঠ ও ঘাড়ের অংশট যেন আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল সেদিন। ধবধবে সাদা ঘাড়ের মধ্যে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি জমে আছে। তুহিনের ইচ্ছে হচ্ছিল উঠে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে দীপ্তির ঘাড়ের ওই ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানিটুকু শুষে নিতে। কিন্তু অধিকারবোধ আর জড়তার ঊর্ধ্বে গিয়ে সেদিন তা পেরে ওঠেনি তুহিন। কী কষ্টে যে সেদিন দীপ্তি নামক নেশার লোভ সামলেছিল তুহিন তা একমাত্র তুহিনই জানে। সেদিন বিয়ের পরেও কোলবালিশকে দীপ্তি ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল তুহিন। কথাগুলো ভেবে নিজে নিজেই বোকা হাসতে থাকল তুহিন।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
Tanvir’s Writings

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here