প্রেমবিভ্রাট ২৫ তানভীর তুহিন

0
568

প্রেমবিভ্রাট
২৫
তানভীর তুহিন

ভোর হতে চললো প্রায়। সূর্যটা উঠছে, উঠছে না। সূর্যের আলোটা ছড়িয়েও, ছড়াচ্ছে না। এমন অবস্থা। তুহিন বেলকনিতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুহিন নিজেকে নিজে কড়াকরে শাসিয়ে নিচ্ছে, ” যে তোকে এভাবে ঠকাতে পারে। সে কখনই তোর জীবন অনুচ্ছেদের শেষ দাড়ি হতে পারে না। দীপ্তি তোর জীবন অনুচ্ছেদের একটা সামান্য বিরামচিহ্ন। একটা উটকো পাতি কমা ছাড়া আর কিচ্ছু না। ” আরো নানাভাবে নানানকথা বলে তুহিন নিজেকে শক্ত করে নিচ্ছে। তুহিন বিলাপ করছে, ” নীল মেয়েটাও তো এভাবেই চলে গেছিলো। মরে গেছিলি তুই? মরিস তো নি। এবারও মরবি না। শুধু কয়েকটা দিন কষ্ট হবে তারপর আবার শিখে যাবি ভালো থাকতে। তুই ভালো করেই জানিস, সময় সইয়ে দেয়। এবারও সেটাই হবে। তোর শুধু সয়ে যাবার জন্য সময় বইয়ে দিতে হবে। এসব পাতি পাতি কষ্টের সাথে কীভাবে বোঝাপড়া করতে হয় তা তো তুই জানিস। তাহলে আর কী? আর কিসের কষ্ট? কোনো কষ্ট নেই। কোনো ক্ষত নেই। নেই কোনো পরাজয়ের গ্লানি। সব ঠিকঠাক। সব, সব, সব ঠিকঠাক। ” তুহিনের কোনো যুক্তি কিছুতেই তুহিনের ভেতরটাকে শক্ত করতে পারছে না। পাগল হয়ে যাচ্ছে তুহিন। তুহিন আর কাউকে কাছে এসে হৃদয় ভাঙার সুযোগ দিতে চায়নি। তুহিন চায়নি আর কারো প্রেমে পাগল হয়ে যেতে। কিন্তু দীপ্তি তাকে বাধ্য করেছিলো। অথচ সে দীপ্তিই আজ এক আকাশ বিশ্বাসঘাতকতা আর বেইমানি উপহার দিলো তাকে। সূর্য উঠে গেছে আকাশে। সূর্যের স্নিগ্ধ আলোটা তুহিনের মুখে এসে আছড়ে পড়ছে। সূর্যের হালকা ঝাঝালো তাপের স্বাদ নেয় তুহিন। তারপর কিছুক্ষন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে নিজের ওপর।

সারারাত এক মুহুর্তও বাদ যায়নি যখন দীপ্তি চোখের জল বিসর্জন দেয়নি। কেদেছে দীপ্তি, যে কান্নার কোনো মানেই খুজে পাচ্ছে না সে। অতিকান্নার প্রভাবে তার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। এক প্রবল অভিমানের জন্ম হয়েছে তুহিনের ওপর। এই কান্না যেনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বেশ শক্ত করে দিয়েছে দীপ্তিকে। তুহিন দুর্বল পায়ে হেটে রুমে ঢোকে। রুমে ঢুকেই, দীপ্তিকে হাটুতে মুখ গুজে ফ্লোরে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করে তুহিন। তুহিন পা বাড়িয়ে রুমে ঢুকতেই দীপ্তি মুখ তুলে তাকায়। ঠোটের কোন বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিলো, সে রক্তটুকুই শক্ত হয়ে লেগে আছে চেহারার চামড়ায়। পুরো মুখটা ফুলে গেছে, চোখদুটোর কোটর দুটো যেনো কুয়োর মতো হয়ে ফুলে গেছে। এ দীপ্তিকে দেখেই তুহিনের বুকটা হু! হু! করে ওঠে। কিন্তু পরক্ষনেই নিজের মনকে একটা মারাত্মক গালি দিয়ে তুহিন নিজে নিজেকে বলে, কার জন্য বুক হু!হু! করছে তোর? যে তোর অবর্তমানে তোর রুমেই আরেকটা ছেলেকে নিয়ে রাত কাটিয়েছে? এটা ভাবতেই তুহিনের রক্তের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিনত হয় তুহিনের শরীর। মন চাচ্ছে এখনই গিয়ে দীপ্তিকে চরম শিক্ষা দিতে। দীপ্তিকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তুহিনের। তুহিন দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নেয়। আজ যেনো বাতাসের সাথেও রাগ মিশে আছে। নাক দিয়ে যেনো অক্সিজেন না বরং রাগের বৃদ্ধি মাত্রা ঢুকছে। তুহিন বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়। দীপ্তি কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় তুহিনকে। তুহিন কর্ণপাত না করে এগিয়ে যায়। দীপ্তি আবার ডাকতেই তুহিন দাঁড়িয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দীপ্তির দিকে। দীপ্তি খানিক ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু মুহুর্তেই ভয়টাকে পাশ কাটিয়ে দীপ্তি নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করে বলে, ” হয় তুমি আমার কথা শুনবে নাহয় আমি এখন, এইমুহুর্তে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো। ”
কথাটা শুনেই তুহিনের তীব্র হাসি পায়। পিছন ফিরে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে তুহিন। এ তুহিন দীপ্তির কাছে বড্ড অচেনা। এ তুহিনকে চেনেই না দীপ্তি। তাচ্ছিল্যের হাসিটাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে তুহিন দাঁত চেপে বলে, ” এখন আর এখানে থাকবি কেনো? নতুন নাগরের সাথে থাকার ইচ্ছা জেগেছে যে মনে। আটকাচ্ছে কে তোকে? যা গিয়ে নাগরের সাথে ফূর্তি কর। ”

দীপ্তির বুকে অদৃশ্য কেউ ধারালো একটা ছুড়ি গেথে দেয়। সে তীব্র ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নেয় দীপ্তি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত নামক নোনাজল। দীপ্তির এই আচরন তুহিনের ভেতরের হিংস্রতাকে বাড়িয়ে তোলে। তুহিনে হিংস্র চিতাবাঘের ন্যায় গর্জে ওঠে, ” তুই এবাড়িতে থাক কিংবা ও বাড়িতে, তুই বেচে থাক কিংবা মরে যা আই রিয়েলি ডোন্ট ফাকিং কেয়ার এবাউট ইট। জাস্ট গো হেল। ব্লাডি স্লাট! ” তুহিনের কথাগুলো বিষাক্ত তীরের মতো বিধে দীপ্তির বুকে। আমি মরে গেলেও তুহিনের কিছু যায় আসে না? আমি.. তুহিনের বলা শেষের নির্মম নোংরা কথাটা অন্তর্মনেও উচ্চারন করতে পারে না দীপ্তি। তার বুক হাজার টুকরে ভাগ হয়ে, হারিয়ে যায় অনন্ত অজানায়। এক তীব্র অসহনীয় বুকে ব্যাথা অনুভব করে দীপ্তি।

তুহিন হেটে প্রায় বাথরুমের কাছাকাছি চলে যায়। দীপ্তি শেষবারের মতো বলে, ” শেষবার বলছে, দয়া করো আমায়। আমার কথাটা শোনো। ”

তুহিন দীপ্তির দিকে তেড়ে এসে বলে, ” তোর মধ্যে মনুষত্ব নামক বস্তুটা আছে নাকি তা জানি না আমি। কিন্তু বিন্দুমাত্র মনুষত্বও যদি তোর মধ্যে থাকে তাহলে কোনোদিন আমায় কিছু ব্যাখ্যা করতে আসিস না। লজ্বা নেই তোর না? চলে যাবি তাও মিথ্যে সাফাই গেয়ে নিজেকে ভালোমানুষ, মহান আর আমায় নিকৃষ্ট, অপরাধি বানিয়ে যেতে চাস। কোন শ্রেণির অমানুষ রে তুই? অমানুষ শব্দটার চেয়ে মারাত্বক কোনো শব্দ কী আছে যেটা আমি তোর উপর বসাতে পারি? কী বলে গালি দেবো তোকে? ” কথাগুলো শেষ করে মুখ ফিরিয়ে নেয় তুহিন।

দীপ্তি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, ” আমার আর কোনো দ্বায়ভার রইলো না। তবে মনে রেখো, তুমি একদিন আমার কাছে যাবে। আমায় ফিরে পেতে চাইবে। সেদিন আমি তোমায় মোটেই ফিরিয়ে দেবো না। আমি সেদিনও নিজের আত্মসম্মানবোধ ভুলে নিজেকে তোমার কাছে বিলিয়ে দেবো। কারন আমি মৃত্যুর ঠিক আগের মুহুর্ত অবধি তোমাকেই ভালোবাসবো। আর তোমাকেই ভালোবাসবো। তুমি আমার থাকো, বা না থাকো। কিন্তু একটা কথা অনন্তকাল মনে রেখো, আমি অনন্তকালের জন্য শুধু তোমার। আমি অন্যকারো না। কোনোদিন না। ” কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে দীপ্তির।

তুহিন আকাশ-বাতাস কাপিয়ে হেসে ওঠে। শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে, ” মানে তোর এই ভালোমানুষিটা ধরে রাখতেই হবে নাকি? ভালোমানুষ সেজে থাকতে খুব আনন্দ লাগে তাই না। হায়রে শুয়োয়েরবাচ্চা। এই বিদ্ধংসি অভিনয় শিখলি কোত্থুকে রে? ফিল্ম ফিল্ডে ট্রাই কর, ভালো উন্নতি করবি। ব্রেক বা ডেবিউ নিয়ে চিন্তা করিস না। কোনো মামাওয়ালা প্রডিউসার এর সাথে শুয়ে যাবি। ব্যাস! ডেবিউ পেয়ে যাবি। তোর তো আবার আলাদা আলাদা পুরুষ পছন্দ তাইনা? আলাদা আলাদা পুরুষও পাবি, টাকাও পাবি, নাম, যশ, খ্যাতি সব পাবি। ” কথাটা বলে হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দেয় তুহিন। দীপ্তি কান চেপে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। সে এই মুহুর্তের পর থেকে বেচে নেই। সে মরে গেছে, সে মরে গেছে ভেতরে।

বাথরুমে ঢুকে মুখে পানির ঝামটা মেরে দেয়ালের আয়নাটার দিকে তাকায় তুহিন। মুখ থেকে ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখের ঠিক নিচের অংশের দিকে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। শরীরটা কেমন যেনো হাল ছেড়ে দিচ্ছে তুহিনের।

সকাল প্রায় সাতটা বাজে। তুহিন সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে। দীপ্তি ড্রয়িরুমে দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ সাহেব, শায়লা বেগম এবং আয়েশা নানান প্রশ্ন করছে দীপ্তিকে। দীপ্তি নিশ্চুপ, ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে আছে। তার কানে যেনো কোনো কথাই ঢুকছে না। শুধু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তুহিন ড্রয়িরুমের ভীড় পাশ কাটিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াতেই আসাদ সাহেব তুহিনকে ডাক দেয়। তুহিন শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাওয়া ধরে। আসাদ সাহেব চিৎকার দিয়ে ওঠে, ” তুহিন আমি ডেকেছি তোকে। ”

তুহিন ওখানে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে, ” বলো কী বলবে? ”

আসাদ সাহেব বিস্মিত কন্ঠে বলে, ” তুই বাড়ি এলি কখন? আর দীপ্তি এভাবে কাদছেই বা কেনো? ”
তুহিন কিছু বলবে। তার আগেই আয়েশা দীপ্তির গলা আর গাল শায়লা বেগমকে দেখিয়ে বলে, ” দেখো মা জানুর গলা আর গালে আঙুলের ছাপ। ” শায়লা বেগম সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরু করে পরখ করে নেয় দীপ্তির গলা আর গালটা। তারপর শায়লা বেগম চিৎকার দিয়ে তুহিনকে বলে, ” এই তুই দীপ্তিকে মেরেছিস কেনো? তোর সাহস হয় কীভাবে ওকে মারার? ”

এসব হুংকার চিৎকার শুনে তুহিনের মেজাজ চরম মাত্রায় বিগড়ে যায়। মারাত্মক চিৎকার দিয়ে বলে, ” ও বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছে ওকে যেতে দাও না। আর এখানে এতো প্রশ্নের কী আছে সেটাই তো বুঝছি না। আমি কোনো ব্যাপারে কিছু জানি না। একদম কিছু জানি না। ও এবাড়িতে থাক কিংবা ওর বাপের বাড়িতে। ও বেচে থাক কিংবা মরে যাক আমার কিছু যায় আসে না। আমি ওর ব্যাপারে কোন খোঁজ-খবর রাখতে চাইনা। ওকে মনে রাখতে চাইনা। ফারদার যাতে এ বাড়িতে ওর ব্যাপারে কেউ আমায় কিছু জিজ্ঞেস না করে। কথাটা মনে রেখো সবাই। ” নির্ধারিত কথা শেষ করেনহনহনিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যায় তুহিন। দীপ্তিও বাইরের দিকে পা বাড়ায়। আসাদ সাহেব দীপ্তির পথ আটকে দাঁড়ায়। আসাদ সাহেব বলে, ” এটা তোর বাড়ি। তুই এখান থেকে কোথাও যাবি না আম্মু। আমায় বল কী হয়েছে? ”

দীপ্তি আহত দৃষ্টিতে আসাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আব্বু আমায় আটকিয়ো না প্লিজ। আমি চাই না এখানে থাকতে। আমি নিজের ইচ্ছায় চলে যাচ্ছি। আশা করি আমার ইচ্ছাটাকে অন্তত সম্মান করবে। ”

আসাদ সাহেব আর বলার মতো কিছু খুজে পায় না। সে পথ ছেড়ে দেয় দীপ্তির। আয়েশা দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দীপ্তিকে। আয়েশা কাঁদো স্বরে বলে, ” এই জানু বল না কী হয়েছে? ভাইয়া খুব বেশি মেরেছে তোকে? আমায় বল না কী হয়েছে? প্লিজ বলনা? ”

দীপ্তি আয়েশাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আয়েশার গালে হাত রেখে বলে, ” আমি বলতাম যদি বলার মতো কথা হতো। কিন্তু এটা আমি বলতে পারবো না তাহলে তোর ভাইকে ছোট করা হবে, নিচু দেখানো হবে, অসম্মান করা হবে। আমি পারবো না সেটা। প্লিজ আমায় জোর করিস না, আমায় যেতে দে। ”
আয়েশা কেঁদে দেয়। দীপ্তি আয়েশাকে ছাড়িয়ে, চলে যায়। বাড়ির গাড়ি নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে যায় দীপ্তি।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here