প্রেমবিভ্রাট
৩১
তানভীর তুহিন
সকাল প্রায় ১০ টা বাজছে। আয়েশা গাড়িতে, রাস্তায় আজ উপচে পড়া জ্যাম। গাড়ি যেনো এক ইঞ্চি এগিয়ে, এগিয়ে থেমে যাচ্ছে। আয়েশা ভাবছে তুহিনকে ফোন করবে না করবে না। তুহিন না আবার এয়ারপোর্টের জন্য বেরিয়ে যায়। এই জ্যাম, পুরো ঘটনার নির্মম সারমর্ম, আর খুব দেরি হয়ে যাবার আশংকায় চরম অস্থির হয়ে পড়েছে আয়েশা।
সাতপাঁচ না ভেবে তুহিনকে ফোন করে আয়েশা। তুহিনের ফোন বন্ধ। আয়েশার রক্তচলাচল দ্রুত হতে থাকে। জ্যাম কিছুটা ছেড়েছে। আয়েশা ড্রাইভারকে বারবার তাড়া দিচ্ছে, গাড়ি আরো দ্রুত চালানোর জন্য। এমন সময়ে আয়েশার ফোনে ফোন আসে। আকাশ ভাইয়া ফোন করেছে। আয়েশা ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই গর্জে ওঠে আকাশ, ” কী পেয়েছে তুহিন? ওর সাহস কী করে হয় দীপ্তির এই সময়ে দীপ্তিকে ডিভোর্স লেটার পাঠানোর? ”
আয়েশার পায়ের তলার মাটি দুভাগ হয়ে যায়। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তারমানে ভাইয়া ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েই বিদেশ চলে যাচ্ছে?
আয়েশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আকাশ আবার গর্জে ওঠে, ” তুহিনের ফোনটা অফ কেনো? ওকে হাতে পেলে সোজা খুনই করে দেবো আমি। একটা সাধারন ইস্যু নিয়ে সবটা না জেনে ও কীভাবে করতে পারলো এটা? দীপ্তির মুখের দিকে জাস্ট তাকাতে পারছি না আমি। সেই তখন থেকে সমানএ পাথর হয়ে বসে, ডিভোর্স পেপারটার দিকে তাকিয়ে আছে। ”
চোখ বন্ধ করে নেয় আয়েশা। আয়েশা কাঁপাকন্ঠে বলে, ” আকাশ ভাইয়া প্লিজ জানু যাতে সাইনটা না করে। জানু আর আঙ্কেল, আন্টিকে একটু সামলাও প্লিজ। ”
– ” আর কী সামলাবো? আসলে আমাদেরই ভুল হয়েছে তোর ভাইয়ের মতো মানুষের কাছে দীপ্তিকে বিয়ে দেওয়াটা। ” ফোন কেটে দেয় আকাশ। তার মাথায় এখন এখন আগুন জ্বলছে। সে চায় না এই মেজাজে আয়েশার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে ফেলুক। আয়েশার গাড়ি তুহিনের এপার্টমেন্টের নিচে চলে এসেছে। আয়েশা গাড়ি ছেড়ে একদৌড়ে লিফট ধরে সোজা তুহিনের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ায়।
তুহিন ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে একটু বাদেই এয়ারপোর্টের জন্য বের হবে। আয়েশা দরজা ধাক্কাচ্ছে প্রচন্ড জোরে। আয়েশার হাত থামছেই না। করাঘাত করেই চলেছে দরজায়। প্রত্যেক মুহুর্তে নিজের ভাইয়ের প্রতি তীব্র রাগ জমা হচ্ছে আয়েশার ভেতরে। তুহিন দরজা খুলতেই আয়েশা সজোরে তুহিনের গালে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়। মুহুর্তেই চারপাশটা নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ হয়ে যায় তুহিনের কাছে। তুহিনের মধ্যে তেমন কোনো বিস্ময়ভাব কাজ করছে না। তুহিনের মেজাজের ভাবান্তরও হচ্ছে না। আয়েশা কেঁদে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে, চোখদুটোতে খানিক লালরঙা আভা বিরাজ করছে। তুহিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়েশা আরেকটা থাপ্পড় মেরে দেয় তুহিনকে। মাত্রই নিজের ছোটবোনের হাতে দু দুটো থাপ্পড় খেয়েছে তুহিন। অথচ তার মধ্যে কোনো প্রকার বিস্ময় বা রাগ দেখাই যাচ্ছে না। তুহিন স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করে, ” কী হয়েছে আশু? ”
চিৎকার করে ওঠে আয়েশা, ” কেনো এমনটা করলি ভাইয়া? কেনো আজ আমার তোকে থাপ্পড় মারতে হচ্ছে? কীভাবে করতে পারলি এটা? আমি তো তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে ম্যাচিউড মানুষ বলে মনে করতাম। অথচ তুই এরকম নির্বোধের মতো একটা কাজ কীভাবে করতে পারলি? ”
আয়েশার কথা, কান্না, চিৎকার, রাগ, অভিমানি বর্ণন সব তুহিনের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তুহিন বোকাদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আয়েশার দিকে। আয়েশা গিয়ে তুহিনের কলারটা চেপে ধরে তারপর নিজেই কাঁদতে কাঁদতে কলারটা ছেড়ে তুহিনের পায়ের কাছে বসে পড়ে। তুহিনের কাছে কিছুই স্পষ্ট না। ঘটনার স্পষ্টতার জন্য তুহিন কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই আয়েশা কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে বলে, ” ভাইয়া ওইদিন রাতে জানু যে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেছিলো সেটা অনন্ত। অনন্ত মানে আদনান। যার সাথে তোর ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি ওকে আদনান বলে ডাকি। ওর পুরো নাম আদনান অনন্ত। আদনান আকাশ ভাইয়ার বন্ধু। জানু ওকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখে। সেদিন রাতে আদনান আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। আমাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগেছিলো। মনে আছে তুই যখন বার্সেলোনায় থাকা অবস্থায় আমায় জিজ্ঞেস করেছিলি আমি কাঁদছি কেনো? আর আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনকার কান্নার কারন আদনানের সাথে হওয়া ঝগড়া ছিলো। দীপ্তিই প্রত্যেকবারের মতো আমাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিয়েছিলো। আদনান প্রায় সপ্তাহখানেক আমায় দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলো। সেজন্যই রাতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো আর যাবার সময় দীপ্তিকে ঝগড়া মেটানো আর আমার সাথে দেখা করার ব্যাবস্থা করে দেবার জন্য জড়িয়ে ধরেছিলো। আর তুই বার্সেলোনা থাকা অবস্থায় দীপ্তির ফোন ইঙ্গেজ থাকার কারনও আদনানই ছিলো। তুই বেশ কয়েকবছর বিদেশে ছিলি ভাইয়া আমি তোর চরিত্র স্বমন্ধ্যে পুরোপুরি জানি না আমি। তোর চরিত্রের নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। কিন্তু জানু! জানুর চরিত্র নিয়ে আমি সব জানি। ওর চরিত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে আমি কয়েক সহস্র কোটিগুন নিশ্চয়তা তোকে হেসেখেলে দিয়ে দিতে পারবো। তুই ওকে বিশ্রি বিশ্রি অপবাদ দিয়েছিস যা কখনই জানু ডিজার্ভ করে না। ও এতোটাই সফট আর পিওর হার্টেড যে এতোদিন ও এসব কথা আমায় বলেনি কারন তুই ছোট হবি, তোর অসম্মান হবে তাই। আর সেই মেয়েটাকেই কিনা তুই? ”
কথাগুলো কেমন যেনো দুবার দুবার করে মোটা হয়ে কানে ঢুকছে তুহিনের। কোথাও একটা তীব্র ব্যাথা হচ্ছে তুহিনের। পিছনের দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে তুহিন। গায়ে থাকা হালকা আকাশি রঙের শার্টটা ভিজে চুপসে গেছে একদম। দেয়াল ঘেষে নিচে বসে পড়ে তুহিন। ঠিক সেদিন দীপ্তি যেমন দরজা ঘেষে বসে পড়েছিলো ঠিক তেমন। আজ তুহিনেরও বুক ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে ঠিক দীপ্তির মতোই। কিন্তু তুহিনও দীপ্তির মতো চিৎকার দিতে পারছে না। খুব নির্মমভাবে চিৎকারটা বুকের কোথাও আটকে রাখতে হচ্ছে। আর সে আটকে থাকা চিৎকারটায় যেনো এক বুক ব্যাথা মিশে আছে। একদম অসহনীয় ব্যাথা, যে ব্যাথায় দমটা আটকে যায় যায় অবস্থা। তুহিনের অপরাধবোধ আজ বিদ্রোহে নেমেছে। যে বিদ্রোহে কাছে মাথা নত করতে হচ্ছে তুহিনকে। সে বিদ্রোহের কাছে সে হেরে যাচ্ছে বারংবার।
আয়েশা তার তর্জনী আঙুলটা তুহিনের দিকে তাক করে বলে, ” তুই সেদিন বাবাকে বলছিলি না যে বাবা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোকে নিয়ে। না নেয়নি। বাবা একদম সঠিক আর নিখুত সিদ্ধান্তটাই নিয়েছিলো তোকে নিয়ে। সব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই। সব কিছুর জন্য দায়ী তুই। ”
একটা অভিযোগও তো মিথ্যে নয়। সবগুলোই চরম সত্য। আয়েশাকে প্রত্যুত্তর দেবার মতো কোনো শব্দ তুহিনের শব্দকোষে নেই। লজ্বা আর অপরাধবোধের নিষ্ঠুর মারপ্যাঁচে মাথা নিচু করে ফেলে তুহিন।
আয়েশার কান্না যেনো থামতেই চাচ্ছে না। কান্না থামানোর জন্য মুখটা চেপে ধরে আয়েশা। কান্না ভাঙা কন্ঠে বলে, ” এখন কেনো মাথা নামিয়ে নিচ্ছিস ভাইয়া? সেদিন তো খুব বাবার সামনে উচু গলায় কথা বলছিলি। বাবা না তোর অনুপ্রেরনা, তোর আদর্শ ছিলো কই সেদিন তো বাবার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেও দ্বীধাবোধ করিসনি তুই। তাহলে আজ কেনো মাথা নামিয়ে নিচ্ছিস? আমার সাথেও ঠিক ওই দিনের মতো কর। উঠে এসে আমায় ও কুড়ি পাচেক থাপ্পড় মেরে যা। সেদিন যেভাবে নির্দোষ দীপ্তিকে মেরেছিলি ঠিক সেভাবে। ”
নিশ্চুপ তুহিন। বলার মতো কী আদৌ কিছু বাকি রেখেছে সে? নিজের ভুল বোঝাবুঝির জন্য কতগুলো মানুষকে ভুগিয়েছে সে। কতগুলো মানুষের অহেতুক মানষিক অশান্তির কারন সে।
আয়েশা চিৎকার করে কাঁদছে। কান্না থামিয়ে থামিয়ে কথা বলছে আয়েশা। একেবারে কান্না থামিয়ে একনাগারে কথা বলার ক্ষমতা তার নেই, ” আজ এটা কী করলি ভাইয়া? ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলি? কেনো পাঠালি? মেয়েটার অপরাধ কী ছিলো? তোর বোন আর তোর বোনের প্রেমিকের মারাত্মক ঝগড়া মেটানো মেয়েটার অপরাধ ছিলো? তোর মুখে বিশ্রি-বিশ্রি অপবাদ শুনেও শুধু একটাবার সত্যিটা বলতে না চাওয়াটা মেয়েটার অপরাধ ছিলো? যে মেয়েটার গায়ে ওর বাপ-ভাই কোনোদিন হাত তোলেনি সেই মেয়েটা নিশ্চুপ ভাবে তোর পশুর।মতো হিংস্র আঘাত সহ্য করেও শুধু একটা সুযোগ চেয়েছিলো সত্যিটা বলার জন্য, এটা অপরাধ ছিলো মেয়েটার? কথা বলছিস না কেনো? উত্তর দে ভাইয়া। সব কষ্ট নিজে সহ্য করেও কাউকে জানতে দেয়নি সত্যটা এই ভেবে যে তোর অসম্মান হবে এটা মেয়েটার অপরাধ ছিলো? কোনো অপরাধ ছিলো না ওর। না এখন কোনো অপরাধে অপরাধী ও। সব অপরাধ তোর, সব অপরাধে অপরাধী তুই। মেয়েটা এতকিছু করলো তোর জন্য, এতকিছু, অথচ তুই কী করলি? কী করলি তুই? ডিভোর্স পেপার পাঠালি? তাও এমন সময় পাঠালি যখন দুদিন হয়েছে মেয়েটা জানতে পেরেছে যে ও প্রেগনেন্ট। ”
কথাটা শোনার পর নিজেকে নরপশু ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয়নি তুহিনের। তার মতো নির্বোধ, অসুস্থ, আর অমানুষ জীব কি এভুবনে আছে? কী মহা মারাত্মক ভুলটাই না করে ফেলেছে সে। আদৌ কী এ ভুলের কোনো ক্ষমা হয়? এ ভুল ক্ষমার অযোগ্য নয় কী?
আয়েশা থেমে থাকে না। আজ যেনো তার সমস্ত যুক্তি গিট খুলে ছড়িয়ে পড়ছে। এই যুক্তিগুলো দিয়ে সে আজ তুহিনের ভেতরের ভ্রান্র সত্তাটার প্রাণনাশ করবেই। যে সত্তা কিছুক্ষন আগেই অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে তুহিনের ভেতর থেকে। তুহিনের মধ্যে শুধুই এখন অস্তিত্ব রয়েছে অপরাধবোধের। আয়েশা তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলে, ” কীরে ভাইয়া এখনও চুপ থাকবি? কিছু তো বল। এভাবে চুপ করে কেনো আছিস। কিছু তো বল। আমার কাছে এই পৃথিবীতে মোস্ট রেস্পেক্টেড দুইটা পার্সন ছিলো একটা আব্বু আরেকটা তুই। এখন আর তোর প্রতি কীভাবে রেস্পেক্ট বেঁচে থাকবে বলতো? ভেবে দেখেছিস একবার। মেয়েটা এখন ঠিক কেমন যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কাল অবধিও ওর মনে আশা ছিলো তুই একদিন ঠিকই তোর ভুল বুঝে ওকে নিয়ে আসবি। কিন্তু আজ তুই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে মেয়েটার সমস্ত আশা বাজেভাবে, চরম নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে দিলি। আশা ভাঙার কষ্ট বুঝিস ভাইয়া? কতটা কষ্ট হয় সেটা কী তুই জানিস? ”
তুহিন আয়েশাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না। টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায় তুহিন। তারপর আনমনে বলে, ” তুই বাড়ি গিয়ে আমার আর দীপ্তির রুমটা হালকা পরিষ্কার করে রাখ। বহুদিন রুমে কেউ থাকে না তো ধুলোবালিতে ভরে গেছে বোধহয়। আমি দীপ্তিকে নিয়ে আসছি। চিন্তা করিস না আমি দীপ্তিকে নিয়েই ফিরবো বাড়িতে। ”
আয়েশার চোখে আনন্দ ঝরনা। আয়েশা জড়িয়ে ধরে তুহিনকে। আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” খালি হাতে ফিরিস না ভাইয়া। ”
তুহিন আয়েশার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আশ্বস্ত করে তাকে।
তুহিন এখন দীপ্তির বাড়িতে। সবাই ড্রয়িং রুমে বসা। দীপ্তিকে দেখতে পায় তুহিন। কী হাল হয়েছে মেয়েটার? চুলগুলোর এমন এলোমেলো অবস্থা কেনো? ওর চুলগুলোতো গোছানোই থাকতো সবসময়। অদ্ভুত নয়নে উন্মাদের মতো এখনও ডিভোর্স পেপারটাই দেখে যাচ্ছে দীপ্তি। ভেতরে তার কষ্টের ঝড়। যে ঝড় বাইরে আসতে পারছে না। কারন সে ঝড় বাইরে আনার মতো ক্ষমতাই যে তার মধ্যে নেই। সবাই চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে দীপ্তিকে দেখছে। আর দীপ্তির পরিস্থিতির ব্যাথায় কাঁদছে। কিন্তু দীপ্তির চোখে পানি নেই। একপ্রকার উন্মাদ হয়ে গেছে সে। কাঁদতেই যেনো ভুলে গেছে দীপ্তি। তার ভেতরকার কান্নার যেনো নির্মম অকাল মৃত্যু হয়েছে। তুহিনকে দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই আকাশ তেড়ে আসে। এসেই এলোপাথাড়ি তুহিনকে থাপড়ানো শুরু করে আকাশ। নিজের বোনের নরক যন্ত্রনার এই কারনটাকে আজ ছাড়বে না সে। মেরেই ফেলবে একদম। দীপ্তি চোখ তুলে তাকায়, চিৎকার করে নিজের ভাইকে আটকানোর চেষ্টা করে দীপ্তি। কিন্তু গলাটাও কেমন যেনো বেইমানি করে তার সাথে। আওয়াজ ই বের হতে চাচ্ছে না। একসময় আকাশ নিজ দায়িত্বেই ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়। তুহিন নিশ্চুপ প্রহার হজম করছিলো। প্রতিবাদের বর্নমালা সে উচ্চারন করেনি। তুহিনের গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। তবুও সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। এইযে মাত্রই আকাশের কাছে মার খেলো সে তাতেও তার কিছু যায় আসে না। সে এসবেরই যোগ্য বলে মনে করে নিজেকে। তুহিন এখন কোন জগতে তা সে নিজেও জানে না। তবে তার শুধু দীপ্তিকে লাগবে এটুকু জানে সে, দীপ্তিকে চাই তার। কীভাবে পাবে তা সে জানে না। তবে দীপ্তিকে তার চাই ই চাই। তুহিন কড়া দৃষ্টিতে আগুনমাখা চোখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকাতেই তুহিনের চোখের আগুন খানিকটা নিভে যায়। তবে এখনও চোখে আগুনের অস্তিত্ব বর্তমান। তুহিন শক্তস্থির গলায় বলে, ” তুমি যা করেছো ঠিক করেছো। আমি তোমার যায়গায় হলে বোধহয় আমিও ঠিক এমনটাই করতাম। হয়তো এর চেয়েও বেশি করতাম। তুমি চাইলে আরো জোড়ালো ভাবে নিজের রাগ ঝেড়ে নিতে পারো আমার উপরে। আমি কিচ্ছু মনে করবো না। তোমায় আটকাবো না। আত্মসম্মানের দোহাইয়ে প্রতিবাদও করবো না। তবে তুমি যদি এখন আমায় দীপ্তির কাছে যেতে আটকাও তাহলে খোদার কসম বলছি, আরেকবার ওয়ার্ন করবো না সোজা এখানে মেরে পুতে রেখে দেবো। ”
আকাশ তুহিনের পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। তুহিন ভেতরে ঢোকে। নাক আর ঠোট টা একটু ফেটে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে। তুহিন হাত উঁচু করে নাক আর ঠোটের রক্ত শার্টের হাতায় মুছে নেয়। আকাশি রঙের শার্টটায় মুহুর্তেই রক্তের দাগ স্পষ্ট হয়ে যায়। তুহিন একবার তার শশুড়-শাশুড়ির দিকে তাকায়। তারা নীরব দর্শকের মতো দেখছে সবটা। তুহিন হাটুগেড়ে দীপ্তির সামনে বসে পড়ে। তুহিন আর দীপ্তির মাঝখানে শুধু একটা টি-টেবিলের দুরত্ব। দীপ্তি মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। তার ভেতরকার জমে থাকা বস্তাপচা অভিমান তাকে আটকে দিচ্ছে বারবার। তুহিন কাপাস্বরে বলে, ” কেমন আছো দীপ্তি? ”
দীপ্তি নিশ্চুপ।
তুহিন আবার স্তব্ধতা মিশ্রিত শক্ত কন্ঠে বলে, ” আমার তোমার সাথে অনেক কথা আছে দীপ্তি। অনেক কথা। ”
দীপ্তির চোখে পানি এসেছে এখন। বহুদিন পরে চোখে পানি আবিষ্কার করেছে দীপ্তি। চোখ বন্ধ করে কয়েকফোটা চোখের পানিকে ছুটি দিয়ে দিলো চোখ থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয় দীপ্তি। একবুক শ্বাস টেনে নেয় দীপ্তি। মনে হচ্ছিলো শ্বাসের সমস্যা আছে তার। তাই বুকে একটু বেশি করে অক্সিজেন মজুদ করে নিলো। দীপ্তি তুহিনের চোখে চোখ রেখে আহতকাঁপা গলায় বলে, ” আর কী ই বা বলার বাকি আছে? আমি বরং পেপারটায় সাইন করে দিচ্ছি তুমি পেপারটা নিয়ে চলে যাও এখান থেকে। আর কখনো এসো না আমার খোঁজে। ”
তুহিন সামনে থাকা ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে একটানে ছিড়ে ফেলে। ‘ফ্যাড়’ আওয়াজ হয়। তুহিন আবার বলে, ” দীপ্তি আমার তোমার সাথে কথা আছে। অনেক কথা আছে। ”
দীপ্তি নিশ্চুপ। দীপ্তির এই চুপথাকাটা সহ্য হচ্ছে না তুহিনের। কেনো দীপ্তি চুপ করে আছে? ওর তো আমায় গালাগালি করার কথা। আমায় তাড়িয়ে দেবার কথা। তাহলে কেনো চুপ করে আছে মেয়েটা? তুহিন উঠে দাঁড়ায়। সামনে থাকা টি-টেবিলটাকে ডান পা দিয়ে পিছুলাথি মারে। টি-টেবিলটা তিন-চারবার উল্টে চুপচাপ শান্ত হয়ে পড়ে থাকে মেঝেতে। তুহিন দীপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। দীপ্তির ওজন কোথায়? মেয়েটা কী খেয়ে বেঁচে আছে এতোদিন? দীপ্তিকে আড়কোলা করে নিয়ে দীপ্তির রুমের খাটের উপর নামিয়ে দেয় তুহিন। তারপর এসে রুমের দড়জাটা বন্ধ করে দেয়।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
” Tanvir’s Writings “