প্রেমমহল,৪
মুমুর্ষিরা_শাহরীন
রৌদ্রময়ে তপ্ত ছাদঘরের টিনের চাল। তপ্ত ছাদের পাটাতন। চালের উপর রোদ পরে ঝিলিক দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে চোখে লাগছে। ছাদের মোটা রশিতে নেড়ে দেওয়া কাপড়গুলো শুকিয়ে ঝড়ো বাতাসে তখন উড়াউড়ি চলছে। উড়ছে তোশকার চুল। এহেন অবস্থায় ছাদের দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হলো সোহান। বলল,
‘আজকে তো রোদ ভালোই উঠেছে, আমার তোষক টা রোদে দিতে হবে।’
তোশকা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। ভ্রু কুচকে আবার চলে যেতে নিলেই সোহান ডেকে বলল,
‘এই তোর সমস্যা কি? এতো ইগনোর করিস কেনো? এতো ইগনোর কিন্তু আমি ডিজার্ভ করি না তোশকা।’
তোশকা ভ্রু বাকিয়ে বলল, ‘আশ্চর্য! তুমি আমার সাথে চড়া গলায় কথা বলছো কেনো?’
‘বলবো না তো কি করবো? তুই সব জেনেও কেনো আমার সাথে এরকম করিস?’
‘কারন আমার বিয়ে ঠিক।’
‘হৃদয় তো তোকে বিয়ে করতে চায় না।’
‘দেখা যাক।’
তোশকা, আমি তোকে ভালোবাসি। বুঝতে চাস না কেনো?’
‘আমি তো বাসি না।’
,
ভর দুপুর। চারিপাশ ঝিমুচ্ছে। আকাশ ফাঁটা রোদ্দুর। নীল সাদায় একাকার আকাশের দখলদার প্রকাণ্ড সূর্য। হৃদয় ঘুমিয়ে। তার আবার পাতলা ঘুম। পাশ দিয়ে কেউ হেটে গেলেই যার ঘুম ভেঙে যায় আজ তার পাশে পা টিপে টিপে প্রেয়সী এসে বসলো। বেশ খানিকটা সময় হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা বাতাসে ফু দিলো। হৃদয় তড়িৎ বেগে চোখ খুলে তাকালো। মুখের উপর আরেকটি মুখের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেই ভড়কে উঠলো। প্রেয়সীকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সটাং উঠে বসে বাজখাঁই গলায় চিল্লিয়ে বলল,
‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমার ঘরে কোন সাহসে ঢুকেছো তুমি?’
প্রেয়সী একটা অবাক কাজ করে বসলো। আচ্ছন্ন ভরপুর চোখ দুটোতে তাকিয়ে প্রায় অবচেতনেই তৎক্ষণাৎ হৃদয়ের গালে চুমু একেঁ দিলো। হৃদয় মিনিট খানিক স্তব্ধ স্থির নয়নে তাকিয়ে থেকে প্রেয়সীকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়ালো। নাসরিন জাহানকে ডাকতে ডাকতে ঘর ছেড়ে বের হলো। নিজের কাজে প্রেয়সীও বোকা বনে গেলো।
‘আম্মু। আম্মু।’
‘হুম। বল।’
‘এক্ষুনি এই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করো। রাইট নাও।’
শুকনো কাপড় হাতে এসে দাঁড়িয়েছে তোশকা। নাসরিন জাহান অবাক গলায় বললেন, ‘কি?’ হৃদয় বাড়ি ভাঙা চিতকারে বলে উঠলো,
‘এক কথা বার বার বলতে ভালো লাগছে না। আমার বাড়ি। আমি যা বলবো সেটাই শেষ কথা। এই মেয়েকে বের করো।’
নাসরিন জাহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘাড় নাড়লেন, ‘না বের করবো না। ওর সাথে তোর বিয়ে। ও চলে গেলে এ বাড়ির বউ কে হবে?’
‘সাট আপ। কিসের বউ বউ করো তুমি? বিয়ে তো আমি করবো নাকি? আমার বউ লাগবে না সেখানে তোমার এতো বাড়ির বউ বউ কীসের? বউ দিয়ে কি করবে তুমি?’
নাসরিন জাহান তাক লাগা গলায় বললেন, ‘হৃদয়…’
হৃদয় দমলো। চেয়ারে বসে মাথায় হাত রেখে ঠান্ডা আওয়াজে বলল, ‘মা এই মেয়েটাকে বের করো। আমি তোশকাকে বিয়ে করবো। প্লিজ মা, এই মেয়েটাকে নয়।’
প্রেয়সী লুকিয়ে হাসলো। নাসরিন জাহান অবাক হয়ে বললেন, ‘এই মেয়েটাকে তাহলে বিয়ে করবি না?’
‘আবার এক কথা। আরে বাবা, আমি বলছি তো এই মেয়েটাকে আমি চিনি না চিনি না। কে এই মেয়ে? আন্তাজে বিয়ে করে বসবো?’
নাসরিন জাহান প্রেয়সীর দিকে তাকালেন। প্রেয়সী মুখটাতে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলল। নাসরিন জাহান আবেগি হয়ে বললেন,
‘আচ্ছা, তোশকার সাথেই তোর বিয়ের বন্দোবস্ত করছি। কিন্তু প্রেয়সী থাকুক। তোর বিয়ের আগ পর্যন্ত।’
চোখ লাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে হৃদয় এই ভরদুপুরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। নাসরিন জাহান বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে রওনা হলেন। যাওয়ার আগে প্রেয়সীর দিকে কপট রাগ নিয়ে বললেন,
‘কেমন প্রেয়সী তুমি, প্রেমিকের রাগ ভাঙাতে পারো না? সামান্য ঝগড়ার জন্য সে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।’
প্রেয়সী হাসলো। মুচকি হাসি। আবার খানিকটা বিদ্রুপাত্মক হাসি। চোখ ঘুরিয়ে তোশকার দিকে তাকাতেই দেখা গেলো বড় করে হেসে তোশকা ওর উদ্দেশ্যে চোখ টিপে দিলো। প্রেয়সীর মুখ শক্ত হয়ে এলো। এদিক ওদিক চারিদিক তাকিয়ে তোশকার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে দরজায় খিল দিলো।
,
তোশকা খুশিতে বাক-বাকুম। ঝুমুরঝুমুর তার হাসির ধ্বনি। প্রেয়সী ধমকে উঠলো,
‘মুখ বন্ধ কর। হে হে করে হাসোছ কেন?’
তোশকা প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে দুলতে দুলতে বলল, ‘দোস্ত আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ।’
প্রেয়সী বিরক্তিতে মুখ বাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল, ‘এতোদিন সন্দেহ ছিলো। আজ নিশ্চিত তোর ক্যারেক্টর এ সমস্যা আছে।’
‘যা খুশি বল, আমি আজ কিছু মাইন্ড করছি না, দোস্ত।’
‘শোন, তোর রাস্তা ক্লিয়ার। এবার টুপ করে বিয়ের আসরে যাবি। বিয়ে করে বর নিয়ে চলে আসবি। আমার কাজ শেষ।’
‘হুম। শেষ তো। তবে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তো তোকে ছাড়ছি না। কে বলতে পারে যদি তুই চলে যাওয়ার পর হৃদয় ভাইয়া আবার বেকেঁ বসে? আমি মরে যাবো দোস্ত।’
‘আগে পেমেন্ট দে।’
‘কিসের পেমেন্ট? দোস্ত, আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড লাগি?’
‘তোশকার বাচ্চা…. লাত্থি খাবার না চাইলে আমার টাকা দে। মাগনা মাগনা আমি কারো হেল্প করি না। যতোই বেস্ট ফ্রেন্ড হও। পনেরো হাজার টাকা দিবি বলছিলি। এখন দশ দে। বাকি পাঁচ বিয়ে করে দিস। সমস্যা নাই।’
তোশকা মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘হাতে টাকা নাই আমার এখন। বিয়ে যেহেতু হবে তো শপিং করতে যাবো না? তখন তোকে দশ হাজার টাকার শপিং করে দিবোনি।’
‘বাড়াবাড়ি করিস না। আমার মাস কি জামা-কাপড় দিয়ে চলবে? আমার ভরণপোষণ আমার নিজের দায়িত্বে। তুই আমার মাসের বাকিদিনের খাওয়া-পড়া দিবি? নিজে তো চ্যালচ্যালাইয়া বিয়ে করতাছোস এখন আমি মূল্যহীন।’
‘আরে আমার হাতে টাকা নাই দোস্ত?’
‘নাই?’
‘না।’
‘তোর কাছে টাকা নাই এটা আমার বিশ্বাস করতে হবো?’
‘আরে বাবা, সত্যি নাই।’
‘আচ্ছা তবে আমি, সো কল্ড বোকা গিদর কে গিয়ে বলে দিতাছি সব।’
প্রেয়সী যেতে নিলেই তোশকা আটকিয়ে বলল, ‘না না না। আমি দিতাছি। বাল।’
তোশকা নিজের ঘর থেকে পনেরো হাজার টাকাই আনলো। প্রেয়সীর হাতে দিতেই প্রেয়সী টাকা গুনে নিয়ে বলল,
‘পুরো টাকা তো দিলি এবার যদি আমি বাকি কাজ না করি? আমি যদি এখনি চলে যাই? বিয়ের দিন অবধি যদি না থাকি কিংবা তোর বিয়ের পর যদি আমি থ্রেট দিয়ে আরো টাকা চাই?’
‘তুই এসব কিছুই করবি না, আমি জানি দোস্ত। করার হলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমার সামনে বলতি না। তোর মতো মেয়ে কখনো সিক্রেট মিশনের কথা ঢোল পিটিয়ে বলতো না।’
‘এই নাহলে আমার বেস্টফ্রেন্ড। একদম ঠিকঠাক চিনছস আমারে, দোস্ত।’
‘সিরিয়াসলি দোস্ত, তোর মতো শকুন আমি আর একটাও দেখি নাই। তুই কেমনে যে এতো নিরীহ বোকা সেজে অভিনয় করলি?’
চলবে❤️