#প্রেমমানিশা-০৪,০৫
(০৪)
‘ আমার সানার নাম্বার চাই অতসী… ‘
আচমকা কথাটা বলতেই ফারহানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো কারণ কথাটা সে বেশ জোরেই বলেছে যার কারণে আশেপাশের সব স্টুডেন্টরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অতসী ফারহানের অবস্থা দেখে কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। হাসির এক পর্যায় ফারহানের হাত ধরে টেনে ফারহানকে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো ‘ আরে আরে এত তাড়া কিসের মিস্টার দুলাভাই ? বিয়ের তো আর মাত্র এক মাস। তারপর যত ইচ্ছা কথা বলতে পারবেন আমার আপাইয়ের সাথে। আপনি বললে আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারি যাতে আপনি আপাইকে নিয়ে যেতে পারেন। বলুন করবো নাকি ? বলুন বলুন……. ‘
অতসীর কথা শুনে ফারহানের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। তার এখন নিজের মাথা নিজেই ফাটাতে ইচ্ছে করছে না বুঝে কথা বলার জন্য। ফারহান তো আগে থেকেই জানত অতসী ঠোঁট কাটা স্বভাবের তাহলে ওর আরও গুছিয়ে কথাটা বলা উচিত ছিল। এভাবে সরাসরি না বলে কোনো একটা এক্সকিউজ দিয়ে বলতে পারতো।
না ভুল যখন করেছে তখন তো শুধরাতে হবেই। যে কোনো একটা এক্সকিউজ দিয়ে অতসীকে ভোলাতে হবে নাহলে ওর আর সানার বিয়ের ব্যাপারটা আগুনের মত পুরো কলেজে ছড়িয়ে পড়বে। অতসীর যা ক্ষমতা তাতে এখনও যে পুরো কলেজে ব্যাপারটা রটেনি এই অনেক।
ফারহান বা অতসীর কথাবার্তায় কেউ তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না। যে যার যার মতো আবারও নিজেদের আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ক্যান্টিন আবারও কোলাহলে মুখরিত হলো। পাবলিক ভার্সিটির এই এক সুবিধা… যে যার যার মতো যা ইচ্ছা করতে পারে। সকলে ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে……কি রকম একটা ছন্নছাড়া ভাব। সবাই প্রথমে ফারহানকে দেখে অবাক হয়েছিল কারণ ফারহানকে এই সময় কেউই এখানে আশা করেনি। অন্য প্রফেসররা যাও একটু আধটু আসে কিন্তু ফারহানকে লাঞ্চ টাইম ছাড়া পাওয়াই মুস্কিল। সে সর্বদাই হয় ক্লাস নিতে ব্যস্ত নয়তো লাইব্রেরীতে ব্যস্ত।
‘ সানাহ্কে কিছু নোটস দেওয়ার ছিল….…ও তো কাল আসেনি তাই……. ‘
কথাটা বলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো ফারহান। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে তার, বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলাও এক ধরনের ট্যালেন্ট যা সবার থাকে না। অন্তত ফারহানের যে নেই সেটা সে ভালো করেই জানে। অতসী ফারহানের কথা শুনে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলল ‘ আপনি বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর হয়ে আপাইকে কি নোটস দিবেন ? আপনি কি বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংলিশেও ডিগ্রি নিয়েছেন দুলা….ভাই…… ? ‘
ব্যাস ধরা পড়ে গেল ফারহান। আসলে মনে যা আসে তাই বলে দিলে তো আর চলে না। বলার আগে ভেবেচিন্তে বলতে হয়। আগাগোড়া কিছু না ভেবেই বলে দিলে তো এমন হবেই। অতসীর কথা শুনে ফারহান আমতা আমতা করে ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু অতসী এক গাল হেসে তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো ‘ আরে দুলা……ভাই…. এত এক্সকিউজ না দিয়ে সরাসরি বললেই তো হয়। আপনি কি মনে করেছেন এক্সকিউজ দিলে আমি আপনাকে জ্বালাবো না ? আপনি এক্সকিউজ দিন বা না দিন আমি আপনাকে ঠিক জ্বালাবো। আরে বাবা শালী বলে কথা। আপনার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র শালী। একটু মজা তো করবই। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন ? ‘
অতসীর কথা শুনে ফারহান মাথা চুলকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হাসলো। মাথা নেড়ে অতসীর প্রশ্নে ছাকা জবাব দিলো ‘ নাহ……কিছু মনে করিনি ‘ ।
ফারহানের কথা শুনে অতসী আর কথা বাড়ালো না। ফোন বের করে সানার ফোন নাম্বার খুঁজতে ব্যস্ত হতে পড়লো। সেকেন্ড কয়েক পর ফোনটা ফারহানের দিকে বাড়িয়ে দিল। ফারহান নাম্বার নেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই অতসী আবারও হাত পিছিয়ে নিলো। অতসীর কাজে ফারহান হকচকিয়ে গেলো। ফারহান নিজেকে সামলে কিছু বলার আগেই অতসী বললো ‘ আপাইয়ের ফোন নাম্বার তো আমি দিবো কিন্তু এর বদলে আমি কি পাবো দুলা……ভাই ‘
ফারহান অতসীর কথা শুনে মৃদু গলায় বললো ‘ কি চাই তোমার ? ‘
‘ ও……সে আমার যখন সময় হবে আমি নিয়ে নিবো। পাওনাটা ডিউ রইল। একসময় মনে করে চেয়ে নিবো। তা নাম্বারটা তুলে নিন দেখি…. ‘ অতসী কথাগুলো বলে ফোন এগিয়ে দিল ফারহানের দিকে আর ফারহান আলতো হাতে ফোনটা হাতে নিলো নাম্বার নেওয়ার উদ্দেশ্যে।
—-
সবেমাত্র ভার্সিটির সব কাজ মিটিয়ে বাড়ি হওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে প্রণয়। ভার্সিটির ক্যাম্পাস পেরিয়ে পার্কিং লটে এসে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো প্রণয়। আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে…… দাদু বলে দিয়েছে। হয়তো বাড়ি গিয়ে দেখলো দাদু আজও বাড়ির সদর দরজার কাছে পায়চারি করছে। এই মানুষটা এখনও বদলালো না। সেই কোন ছোটো থেকে দেখছে সে যতক্ষণ না বাড়ি ফিরে ততক্ষণ অব্দি লোকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারে না, ক্রমাগত পায়চারি করে। পায়চারি করা এখন তার নিত্য দিনের অভ্যাস। আবার দিদুনের জন্য montelukast নিতে হবে। দীদুনের শ্বাস কষ্টের সমস্যাটা আবারও বেড়েছে।
‘ বুঝলি অব তুই বরং আজ বাড়ি ফিরে যা.. আমার বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। বাচ্চাদের খাবারগুলো দিতে হবে ‘ কথাগুলো বলে অতসী আরেকবার তার হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটগুলো দেখে নিলো। আজ বাচ্চাদের বিরিয়ানি দিবে… মানসী সেদিন আবদার করেছিল।
‘ ওহ আচ্ছা… তা অতস তোর কি আদৌ বিয়ে শাদি করার কোনো ইচ্ছা আছে ? কারোর সঙ্গে প্রেমও তো করছিস না। কত ছেলে আজ অব্দি প্রোপজ করলো বলতো… তুই তো একটারও রিপ্লাই দিলি না বরং হাসিমুখে ” ভাই আমি আপনার বোনের মতো ” বলে কেটে পড়েছিস সবসময়। তা তুই যেই দাদুর কথা সারাদিন বলিস মানে জালাল উদ্দিন সাহেব। উনার নাতিকেই তো বিয়ে করে নিতে পারিস… ভদ্রলোক কত আশা নিয়ে তোর কাছে তার নাতির প্রশংসা করে বলতো… ‘ শেষের কথাগুলো বেশ ঠাট্টার স্বরেই বলল অবনি ।
অবনির কথা শুনেও অতসী তার কথার জবাব দিলনা বরং এহেন ভাব করলো যেন সে শুনতেই পারেনি। অতসী অবনিকে তাড়া দিয়ে বললো ‘ কই তুই এখন যাচ্ছিস না ? আজ না আন্টি তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বললো… তোকে না আজ দেখতে আসবে ? ‘
অতসীর কথায় হতাশ হলো অবনি। সে বললো ‘ তুই আজও আমার প্রশ্নের জবাব দিলি না… যাক জ্যাকেটটা পড়ে নেয়। তোর তো অল্পতেই আবার ঠান্ডার ধাত আছে, বাহিরে একটু ঠান্ডা পড়েছে।জ্যাকেট কোথায় তোর ? ‘
‘ বড় চেইনটাতে আছে দেখ, ওটা খুলে তুই আমার হাতে দে আর তুই এই প্যাকেটগুলো ধর।আমি জ্যাকেটটা পড়ছি। ‘
‘ কী যে করিস… জ্যাকেট কি আন্টি তোকে ব্যাগে রেখে দেওয়ার জন্য দিয়েছে ? এনে ব্যাগে রেখে দিস কেন না পড়ে ? এই নে ধর… পড়ে নে আর প্যাকেটগুলো আমার হাতে দে… ‘ কথাগুলো বলে অবনি অতসীর হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে অতসীর হাতে জ্যাকেটটা ধরিয়ে দিলো।
অতসী জ্যাকেটটা পড়ে অবনির হাত থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নিলো। অবনি বললো ‘ আচ্ছা তাহলে আজ আসি…… মা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া না দিলে এখন কিছুতেই তোকে একা ফেলে যেতাম না। ‘
‘ আরে আমি কি কচি খুকি নাকি যে আমাকে একা রেখে যেতে তোর এত আপত্তি ? এত ভনিতা না করে তাড়াতাড়ি যা নাহলে দেরী হলে আন্টি পাত্রপক্ষের সামনেই তোর পিছনে ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে আসবে..… ‘ অতসী হাসতে হাসতে বললো।
‘ নাউজুবিল্লাহ এমন কথা বলিস না বোন। বন্ধু হয়ে বন্ধুর ক্ষতি চাস…… তোর ভালো হবেনা কখনও। এর প্রতিশোধ আমি পরে নিবো। আজ তাড়া আছে বলে…… ‘ কথাটা পুরো শেষ না করেই অবনি ছুট দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অবনিকে এভাবে ছুটতে দেখে অতসী হেসে উঠলো। খানিক হেসে বিড়বিড় করে বললো ‘ প্রতিশোধ তো নিতেই হবে..…Otosi’s special revenge..… ‘
—-
‘ আর কতক্ষন এভাবে জ্যামে বসে থাকবো আমি ? এই কারণেই বাংলাদেশে ফেরার ইচ্ছা ছিল না। কতবার দাদুকে বললাম দিদুন আর এশাকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে এসো কিন্তু দাদু শুনলে তো। তার কাছে তো তার এই জ্যামে আটকে থাকা দেশই পছন্দ। কিছু করার নেই…… এখন থেকে এসব সহ্য করার অভ্যাস করে নিতে হবে…… জাস্ট প্যাথেটিক ইয়ার…. ‘ জ্যামে আটকে থেকে একসময় রাগে হাতটা গাড়ির স্টারিং এ বারি দিয়ে কথাটা বললো প্রণয়।
রাগে রীতিমত শরীর জ্বলে যাচ্ছে প্রণয়ের। এই শীতকালেও তার গরম লাগছে জ্যামে আটকে থেকে। পুরো রাস্তায় জ্যাম। এতক্ষণ তো ঠিকই ছিল…… এই পাঁচ মিনিট আগে এসে জ্যামে আটকা পড়লো অথচ এই পাঁচ মিনিটের জ্যামই প্রণয়কে অধৈর্য্য করে তুলেছে। প্রণয় রাগে দুঃখে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। হঠাৎ এক দৃশ্যে চোখ পড়তেই প্রণয় থমকে গেলো। তার পলক ফেলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো সে।
প্রণয় দেখলো জ্যামে আটকে থাকা রাস্তার ওপারে ফুটপাতের উপর একটা মেয়ে ডেনিম জ্যাকেট গায়ে কিছু ছোটো ছোটো বাচ্চাদের প্যাকেটে করে খাবার দিচ্ছে। তার পরনে জ্যাকেটটা গাঢ় নীল রঙা আর পিছন ফিরে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না। প্রণয় মেয়েটাকে এভাবে রাস্তার ধারে থাকা বাচ্চাদের খাবার দিতে দেখে অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো এখন আর কাউকে এভাবে রাস্তায় থাকা মানুষদের খাবার দিতে খুব কমই দেখা যায়। প্রণয় এরকম ঘটনা তার জীবনে খুব কমই দেখেছে। তার দাদুর পর এই প্রথম কাউকে দেখলো সমাজসেবা করতে। মেয়েটার মুখ দেখতে প্রণয়ের খুব ইচ্ছা করছে। ভাবলো জ্যামেই তো আটকে আছে…… একবার নেমে গিয়ে দেখবে কি ?
কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভাবনা বাদ দিতে হলো কারণ ততক্ষনে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে আর পিছন থেকে অন্যরা হর্ন বাজাচ্ছে গাড়ি নিয়ে এগোনোর জন্য। প্রণয়ের আর দেখা হলো না মেয়েটাকে…… প্রণয় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলো কিন্তু মেয়েটা চোখের আড়াল হওয়ার আগ অব্দি বারবার পিছন ফিরে তাকালো এই আশায় যদি মেয়েটা একবার পিছনে ফিরে। কিন্তু তার আশায় জল পড়লো……নাহ মেয়েটা পিছন ফিরে তাকায়নি।
প্রণয় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেই অতসী বাচ্চাদের হাতে খাবারের প্যাকেটগুলো দিয়ে শেষ করে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো। একটা বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ কিছুদিন পর তো তোর জন্মদিন তাই না বিল্টু ? ‘
বিল্টু ছেলেটা অতসীর কথা শুনে অবাক হয়ে বললো ‘ তোমার মনে আছে অতস দি ? ‘
‘ আমার মনে থাকবে নাতো কার মনে থাকবে ? তোর জন্মদিনে তোদের সবাইকে আমি রেস্টুরেন্টে খাওয়াবো….… ‘ অতসী বললো।
‘ সত্যি অতস দি ? ‘ খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো ময়না ।
‘ সত্যি সত্যি সত্যি……তিন সত্যি……পাক্কা প্রমিজ ‘ অতসী হেসে বললো ।
অতসীর কথা শুনে বাচ্চারা সকলে খুশিতে অতসীকে জড়িয়ে ধরলো আর অতসী তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। হঠাৎ অতসীর ফোন বেজে ওঠাতে তাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটলো। অতসী বাচ্চাদের ছেড়ে দাড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো দাদু ফোন করছে। অতসী হাসি মুখে ফোন রিসিভ করেই বললো ‘ ও দাদু..… ‘
‘ তোর কাজ হয়েছে রে অতস ? ‘ ফোনের ওপার থেকে চিন্তিত মুখে বললেন জালাল সাহেব। উনার গলা কম্পিত যেন খুবই চিন্তিত কোনো বিষয়ে।
অতসী দাদুকে অভয় দিয়ে বললো ‘ ভয় পেও নাগো দাদু…… আমার কাজ শেষ। আমি এখনই বাড়ি ফিরছি। এত ভয় পেলে কি চলে…… এত ভয় পেলে দুনিয়াতে টিকে থাকব কি করে ? ‘
জালাল সাহেব অতসীর কথায় কিঞ্চিৎ হেসে বললেন ‘ এই জন্যই তো ভয়…… তোর কথা শুনলে আমার মনে ভয় আরও বেড়ে যায়। যাই হোক এখন এসব কথা থাক..… কাজ যখন শেষ তখন এখনই বাড়ি ফিরে যা। ‘
‘ তুমি ফোনটা না রাখলে আমি ফিরবো কি করে শুনি ? তুমি ফোনটা রাখো আমি ফিরছি…… বাড়ি পৌঁছে তোমাকে টেক্সট করবো। রাখছি..… ‘ বলেই জালাল সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অতসী ফোন কেটে দিলো। ফোন কেটে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
উফফ এই লোকটাও না পারে বটে…… অল্পতেই রাজ্যের টেনশন নিয়ে বসে থাকা তার কাজ। এমন ভাব করছে যেন অতসী ছোটো বাচ্চা আর সে কিছুতেই কয়েক ঘন্টা বাড়ির বাইরে একা থাকতে পারে না। তবে মানুষটার তার জন্য করা এই ছোটো ছোট চিন্তাই অতসীকে দেয় তার নিজের দাদু থাকার সুখ। অতসীর দাদু নেই…… মারা গেছে সেই অতসীর দিদি জন্ম হওয়ার আগেই তাই এই মানুষটাকে দেখলেই অতসীর মনে হয় তারও দাদু আছে।
জালাল সাহেব হলেন একসময়কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর একটা বড় এনজিওর মালিক। অবশ্য তার এখন আর ব্যবসায়ে কোনো প্রভাব নেই কারণ ব্যবসাতো এখন তার ছোটো ছেলে সামলাচ্ছে। উনি এখন শুধুই এনজিওর সঙ্গে যুক্ত আছেন আর সেই এনজিওর সঙ্গে অতসীও যুক্ত আছে এজ এন এম্প্লই। অতসীর সঙ্গে তার পরিচয় গত তিন বছর ধরে।
—-
‘ বাবা বলছি আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন..… প্রণয় তো ছোটো বাচ্চা নয় বাবা। ওকে নিয়ে এত চিন্তা করবেন না……আজ ছেলেটার ভার্সিটিতে প্রথম দিন তাই হয়তো একটু দেরী হচ্ছে । ‘
‘ তুমি বুঝতে পারছো না ছায়া…… প্রণয় এখানকার কিছুই চিনে না। সবে সবে কিছুদিন হলো বাংলাদেশে এসেছে। এখনই তো পথঘাট সব চিনে ফেলতে পারবে না। চিন্তা আমি এমনই এমনই করছিনা……কারণ আছে চিন্তা করার। ‘ চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে ছেলের বউকে বললেন জালাল সাহেব।
‘ দাদু তুমি শুধু শুধু এত চিন্তা করছো……আরে বাবা ভাইয়া অন্তত ভার্সিটি থেকে বাড়ি আসা যাওয়ার রাস্তা তো চিনে। ও ঠিক কোনোমতে চলে আসবে। তুমি শান্ত হয়ে বসো……ও দিদুন কিছু বলো দাদুকে ‘ এশা তার দাদুকে শান্ত করতে কথাগুলো বললো।
নাতনির কথা শুনে মিসেস আসমা (জালাল সাহেবের স্ত্রী) তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন ‘ আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন…… এই তো এখনই চলে আসবে প্রণয়। আপনি দয়া করে এত চিন্তা করবেন না। ‘
‘ তুমি বুঝতে পারছ না আসমা……প্রণয় এখানকার কোনোকিছুই চিনে না। কতকিছু হতে পারে……পথেঘাটে বিপদ হতে পারে। ছায়া তুমি গিয়ে এক কাপ আদা চা করে আনত। চিন্তায় আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে । ‘ অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে বললেন জালাল সাহেব।
‘ এত চিন্তা করার কি আছে দাদু ? আমি তো ছোটো বাচ্চা নই…… ‘
জালাল সাহেব যখন অতিরিক্ত চিন্তায় বিভোর তখনই শুনতে পেলেন অতি পরিচিত কণ্ঠ। জালাল সাহেব খুশি হয়ে পিছনে ফিরে দেখলেন তার নাতি, প্রণয় দাড়িয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য প্রণয়কে দেখে জালাল সাহেবের তার বড় ছেলে মানে প্রণয়ের বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। চোখ সজল হয়ে উঠলো ছেলে আর ছেলের বউয়ের পুরনো স্মৃতিতে। মনে পড়ে গেলো সেই কালো রাতের কথা যেদিন এই পুরো পরিবার হারিয়েছিল পরিবারের বড় ছেলে আর তাদের আদরের ছেলের বউকে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#প্রেমমানিশা(০৫)
নিজের দাদুকে হঠাৎ আনমনা হয়ে উঠতে দেখে প্রণয়ের ভ্রু কুচকে এলো। সে দাদুর দিকে এগিয়ে গিয়ে দাদুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ কি হয়েছে দাদু ? কি ভাবছো ? ‘
প্রণয়ের ডাকে জালাল সাহেব অতীতের স্মৃতি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। নিজের মন খারাপের মেঘ মনেই লুকিয়ে রেখে মেকি হেসে বললেন ‘ তুমি বাড়ি ফিরছিলে না বলেই টেনশন হচ্ছিল দাদুভাই ? এখন তুমি ফিরে এসেছ তাই এখন আর কোনো টেনশন নেই। ‘
দাদুর কথা শুনে প্রণয় বললো ‘ দাদু আমি এখন বড় হয়েছি……নিজেকে বিপদ আপদে রক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি…… আমাকে নিয়ে খামোখা এত চিন্তা করো না। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে গিয়েই তো বিপিটা বাড়িয়ে নিলে…… কই এশা ? যা গিয়ে প্রেসারের মেশিনটা নিয়ে আয়…… দাদুর বিপি মেপে দেখি। ‘
নাতিকে তাকে নিয়ে এত চিন্তায় পড়ে যেতে দেখে জালাল সাহেব হেসে বললেন ‘ আরে দাদুভাই এত চিন্তা করছো কেন ? এত চিন্তার কিছু নেই….… আমার কিছু হয়নি ‘।
‘ তুমি তো কিছু বলোই না দাদু…… কই এশা গেলি না ? আর চাচীমণি খাবারের ব্যবস্থা করো তো….…জবরদস্ত খিদে পেয়েছে। পেট পুড়ে খেতে হবে ‘
প্রণয়ের কথায় মিসেস ছায়া দৌড়ে গেলেন ভাতিজা ভাতিজির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে আর এশা তার ভাইয়ার আদেশ পেয়ে ছুটে গেলো।
—-
মোবাইল হাতে দাড়িয়ে আছে ফারহান। তার দৃষ্টি মোবাইল পানে স্থির। চোখ জোড়া যেন হাজার বছরের ক্লান্তিতে ঠাসা। আসলে সে ভেবে পারছেনা সানাহ্কে ফোন করবে নাকি করবে না…… মোবাইলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফারহান চোখ দিলো ঘড়ির দিকে । রাত ১ টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। অবশেষে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলো সানাহ্কে ফোন করবে। তাই যেই ভাবা সেই কাজ।
এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের….
মধ্য রাতে ফোনের মধুর শব্দে বিভোর পুরো ঘর। বিছানার উপর চারদিকে ছিটিয়ে পড়ে আছে বই খাতা, কিছু কিছু বই খাতা আবার স্তূপ আকারেও সাজানো। তাদের মাঝেই গুটিসুটি মেরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঠান্ডায় শুয়ে আছে এক তরুণী। ঠান্ডায় তার জবুথবু অবস্থা তবুও তার চোখের ঘুম হার মানতে নারাজ।
অবশেষে অনেক্ষন ফোন বাজার পর সানাহ্ ঘুমঘুম চোখে আশপাশ হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে ফোন লাউস্পিকারে দিয়ে মাথা আবারও বালিশে এলিয়ে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলল ‘ Who’s speaking ? ‘
সানার ঘুমঘুম মোটা গলা ফারহানের বুকে এক তীব্র ঝড়ের সৃষ্টি করলো। ফারহান তার বুকের মধ্যে হওয়া ঢিপঢিপ শব্দের আভাস পেলো। ফারহান দাতে দাত চেপে অনেক চেষ্টা করলো বুকের ভিতর ধড়াম ধড়াম আওয়াজটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার কিন্তু ব্যর্থ হলো। সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষকে অন্য মানুষের ভিতর হওয়া আওয়াজ শোনার ক্ষমতা দিতেন তাহলে কত বিপর্যয়টাই না ঘটে যেত। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা এই ক্ষমতা কাউকে দেননি তাইতো সানাহ্ আজ ফারহানের বুকে হওয়া তীব্র উথাল পাথালের হদিস পেলো না।
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সানাহ্ কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। ঘুমঘুম বিরক্তিমাখা গলায় আবার বললো ‘ who’s speaking ? ‘
এবার সানার বিরক্তি মিশ্রিত স্বর ফারহানের বোধদয় ঘটালো। ফারহান সচকিত হয়ে বললো ‘ আমি…… ‘
ঘুমে বিভোর থাকায় সানাহ্ ফারহানের গলার স্বর চিনতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে বললো ‘ আমি কে ? পরিচয় দিন…… ‘
ফারহান আবছা মৃদু গলায় বললো ‘ আমি….আমি……আমি ফারহান ‘
এবার ‘ ফারহান ‘ নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সানার চোখের ঘুম উড়ে গেলো। সানাহ্ লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু হড়বড় করতে গিয়ে হাতের কাছে থাকা বইয়ে টান লেগে বইগুলো মাথায় পড়ে গেলো। ভারী ভারী বইয়ের জোরে সানাহ্ ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো।
ফোনের ওপাশ থেকে সানার আর্তনাদ মিশ্রিত সুর শুনতে পেয়ে ফারহান ব্যস্ত হয়ে উঠলো। অস্থির গলায় বললো ‘ আপনি কি ঠিক আছেন মিস সানাহ্ ? আপনি কী ব্যথা পেয়েছেন ? ‘
ফারহানের প্রশ্নের জবাবে সানাহ্ কিছুই বললো না বরং সে জিজ্ঞাসু গলায় বললো ‘ আপনি ? ‘
সানার কথার ধরনে ফারহান বুঝলো সানাহ্ তার প্রশ্নের জবাব দিবে না তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো ‘ জি আমি……আসলে আমার আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল ‘ ।
হঠাৎ সানাহ্ গম্ভীর হয়ে গেলো। নিরস গলায় অনাড়ম্বরে বলে ফেললো সেই ভয়ঙ্কর কথা ‘ আপনি কি জানেন মাঝ রাতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকের কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর কাছে ফোন দেওয়াটা অভদ্রতার লক্ষণ ? ব্যাপারটা অশোভন…… ‘
সানার কথায় ফারহান হতভম্ব হয়ে গেলো। মিনিট পাঁচেক লাগলো তার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে যে সানাহ্ গম্ভীর গলায় একদম স্বাভাবিক ভাবেই তাকে ঠেস মেরে কথা বলেছে। ফারহানের সুন্দর শ্রী সঙ্গে সঙ্গে রক্তিম হয়ে উঠলো তা রাগে নাকি লজ্জায় বোঝা গেলো না। ফারহান অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো । স্বাভাবিক গলায় বললো ‘ আসলে আপনার সঙ্গে আমার অতীব জরুরি কিছু কথা আছে যেগুলো অন্য সময়, অন্য কোথাও বলা যেত না বিধায় এত রাতে এই সময় আপনাকে ফোন করে বলতে হলো। আপনার কি এতে কোনো আপত্তি আছে ? ‘
‘ না…… ‘ সানাহ্ এক কথায় ফারহানের প্রশ্নের উত্তর দিলো।ফারহান সানার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ‘ আপনি কি সত্যিই এই বিয়েতে রাজি ? আপনার কি কোনো আপত্তি নেই এই বিয়েতে ? ‘
‘ অবশ্যই আমি রাজি……আপনার বারবার কেন এটা মনে হচ্ছে যে আমার এই বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা ? ‘
‘ কারণ আপনি এই বিয়েতে রাজি হলেও আমি এই বিয়েতে রাজি নই……আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না । ‘
ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ এক অন্য রকমভাবে শান্ত যেন এই শান্তি ঝড়ের পূর্বাভাস। সানাহ্ শান্ত গলায় বললো ‘ আমাকে আপনার বিয়ে না করার কারণ কি জানতে পারি ? আমাকে আপনার পছন্দ নয় ? ‘
‘ আমার আপনাকে পছন্দ নাকি পছন্দ না ব্যাপারটা সেটা নয়…… ব্যাপারটা হলো আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি না…… ‘
‘ আমার আশেপাশে যারা থাকে তারা সবাইই বলে আমি নাকি আগুন সুন্দরী আই মিন ভয়ংকর সুন্দরী। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যা। আমি এতটা সুন্দরী হলে আপনাকে আমার রূপে ঘায়েল করার মতো ক্ষমতা আমার থাকার কথা…. আমার মধ্যে কি কোনো খুঁত আছে ? ‘ শেষের কথাগুলো সানাহ্ খানিকটা থেমে বললো।
‘ কথাটা নিঃসন্দেহে সত্য কিন্তু কারোর সৌন্দর্যের ক্ষমতা নেই আমাকে ঘায়েল করার। আমি সৌন্দর্যের প্রেমে নই ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ি তবে এই জীবনে আমি কারোর প্রেমের পড়ব না কারণ আমার মনের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ। আর নিঃসন্দেহে আপনার মধ্যেও খুঁত আছে কারণ সৃষ্টিকর্তা কাউকেই নিখুঁত ভাবে তৈরি করেন নী। সবার মধ্যেই কিছু না কিছু খামতি আছে তবে আপনার ব্যাপারটা এক্সসেপশনাল। আপনি হলেন imperfectly perfect……imperfection আপনার ব্যক্তিত্ব…… ‘
ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ কিছুই বললো না……ফারহান প্রহর গুনছে সানাহ্ তার কথার জবাবে কিছু বলবে এই ভেবে কিন্তু সানাহ্ তাকে নিরাশ করে কিছুই বললো না। ফারহান আর উপায় না পেয়ে নিজে থেকেই বললো ‘ আপনি কি বুঝতে পারছেন যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি না..… ‘
‘ না বোঝার মত তো কিছু বলেন নি আপনি……আপনি আপনার বক্তব্য বাংলা ভাষাতেই বলেছেন যা মোটামুটি আমারও আয়ত্তে আছে। ‘
সানার কথা শুনে ফারহান নিশ্চিন্ত হলো। প্রশান্তির হাসি হেসে বললো ‘ তাহলে আপনি আন্টি আর আঙ্কেলকে বলে দিবেন যে আপনার আমাকে পছন্দ নয় তাই আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না…… ঠিকাছে ? ‘
সানাহ্ কিছু বললো না। ফারহান ফোনের এপার থেকে শুধু সানার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। সেকেন্ড কয়েক কেটে যাওয়ার পর ফোন টুট টুট আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গেলো। ফারহান বুঝতে পারলো ফোনের ওপারে থাকা মানুষটা ফোন কেটে দিয়েছে। তবে এই ভেবে শান্তি পেলো যে মানুষটাকে অন্তত বোঝানো গেছে যে সে তার জন্য ঠিক নয়।ফারহান খুশি মনে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে শান্তির এক ঘুম দেবে এই উদ্দেশ্যে কিন্তু তার এটা জানা নেই তার কিছুক্ষণ আগে বলা কথাগুলো একজনের মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে।
–—
পুরো বাড়ি তমসায় ছেয়ে আছে তবে শুধু আলো জ্বলছে অতসীর ঘরে। সে ব্যস্ত রাত জেগে ভার্সিটির পড়া শেষ করাতে। নতুন প্রফেসর আজ সব পুরনো চ্যাপ্টারের কনফিউশন ক্লিয়ার করেছেন বলে আজ আর নতুন চ্যাপ্টার ধরা হয়নি আর এটাই অতসীর জন্য প্লাস পয়েন্ট। নতুন প্রফেসরের পড়া না থাকায় একটা পড়া কমেছে। এই সাবজেক্ট শেষ করতে পারলেই আজ রাতের জন্য পড়া শেষ হয়ে যাবে।
বারান্দার ইজি চেয়ারে অন্ধকারের মাঝে একলা বসে আছে সানাহ্। বাড়ির বাইরের আবছা স্ট্রিট লাইটে সানার টকটকে লাল হয়ে যাওয়া চোঁখ ধরা পড়েছে। সানার চোঁখ লাল, কপালের রগ ফুলে উঠেছে…… মাথার ভিতর ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হচ্ছে যেন কেউ বারবার আধ ভাঙ্গা দরজা জোর খাটিয়ে লাগানোর চেষ্টা করছে।
সানার রক্তিম চোখ এই মুহূর্তে কেউ দেখলে নির্ঘাত ভয় পেয়ে যাবে। আজ অনেক বড় এক ঝামেলা বেধেছে। এরকম ঝামেলা হলেই সানার শরীর আস্তে আস্তে খারাপ করতে শুরু করে। এই শরীর খারাপ এক সময় এতটাই খারাপ পর্যায় চলে যায় যে সানাহ্ আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় সেই সঙ্গে গা জালানো ১০৪° জ্বর।
সানাহ্ আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তার রক্ত লাল চোখ থেকে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে। এমনও মনে হচ্ছে সানাহ্কে এখন কেউ আগুনের চুলার উপর থাকা প্রকান্ড এক পাতিলে বসিয়ে দিয়েছে আর সেই আগুনের তাপে সানার শরীরের ভিতর রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সানাহ্ জানে সে এখন আস্তে আস্তে ঘোরে চলে যাচ্ছে, জ্বরের ঘোরে। সানাহ্ যত ঘোরে চলে যাবে ততই সে অবাস্তব কাল্পনিক চরিত্র দেখবে যাদের অস্তিত্ব এক সময় ছিল তবে এখন আর নেই।
‘ মাম্মাম ‘
সানাহ্ জ্বরের ঘোরে অন্ধকার বারান্দার দরজার কাছ থেকে ডেকে ওঠা পরিচিত লোকটার গলার আওয়াজ পেল তবে উত্তর দিলো না। সেই লোকটা এবার সানার দিকে এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুঁকে আবারও মৃদু গলায় ফিসফিস করে বললো ‘ মাম্মাম তুমি শুনতে পারছো ? ‘
লোকটার কথা শুনে সানাহ্ অবাক হওয়ার ভান করলো। চেহারায় অবাকের রেশ ধরে দ্বিগুণ উৎসাহে ফিসফিস করে বললো ‘ কি শুনবো বাবাই ? ‘
লোকটা বললো ‘ ওই যে আমার প্রিয় তোমার আমার গান…… ‘
লোকটার কথা শুনে সানাহ্ তার কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো….
এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার
সানাহ্ তার অবচেতন মনে শুনতে পেলো তার বাবাইয়ের প্রিয় গান ‘ এই রাত তোমার আমার ‘। সানাহ্ ফিসফিসিয়ে বললো ‘ হ্যাঁ বাবাই শুনতে পাচ্ছি.. ‘ ।
মেয়ের উত্তর পেয়ে এবার লোকটা নিঃশব্দে সানার পাশে বসে আকাশ পানে তাকালো। আকাশের দিকে তাকিয়েই বললো ‘ মাম্মাম তুমি কার মেয়ে ? তোমার মামনির না আমার ? ‘
সানাহ্ লোকটার কথা শুনে বিভ্রান্তিতে পড়লো না। সহসা অনাড়ম্বরভাবে জবাব দিলো ‘ আমি আফজাল করিমের মেয়েও না আবার আয়াত আমরীনের মেয়েও না। আমি তাদের দুজনের মেয়ে তাই সেই অর্থে আমি তোমাদের কারোরই একার মেয়ে নই। আমি যেমন তোমার মেয়ে তেমনই মামনিরও মেয়ে। ‘
আফজাল সাহেব যেন মেয়ের মুখ থেকে এই কথাই আশা করেছিলেন। উনি এক গাল হেসে মেয়ের গাঁয়ে হাত বুলিয়ে দিতে নিলেন কিন্তু তৎক্ষণাৎ মেয়ের শরীরের আগুন তাপে ছিটকে সরে গেলেন আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মৃদু চেঁচিয়ে বললেন ‘ মাম্মাম তোমার তো অনেক জ্বর…… ‘
সানাহ্ তার বাবাইয়ের কথায় আবারও অবাক হওয়ার চেষ্টা করলো যেন সে জানতোই না তার জ্বর এসেছে। অবাক গলায় বললো ‘ তাই নাকি বাবাই ? ‘
‘ হ্যাঁ মাম্মাম…… মাম্মাম তুমি এখানে বসো..আমি এক্ষুনি তোমার মামনিকে ডেকে আনছি ‘ বলেই আফজাল সাহেব বসার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
সানাহ্ তার বাবাই এখন চলে যাবে এই ভয়ে এই কনকনে শীতেও হালকা ঢোক গিললো। তার বাবাইকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। কাতর কন্ঠে বলল ‘ বাবাই ওটা কিছু না…… তুমি যেও না। তুমি এখানেই বসো……আমার কাছে বসো। আমায় ছেড়ে যেও না তুমি ‘
কিন্তু মেয়ের কথা আফজাল সাহেব শুনলেন না। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন ‘ আরে কী মুশকিল আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো কোথায় ? জেদ করে না মাম্মাম..…আমি এই যাবো আর এই আসবো। শুধু তোমার মামনিকে ডাকতে যাচ্ছি। তোমার মামনিকে ডেকে এসেই আমরা হাসপাতালে যাবো। তুমি বসো আমি আসছি তোমার মামনিকে ডেকে ‘ ।
কথাটা বলতে বলতেই আফজাল সাহেব এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে আর সানাহ্ সেই দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে জানে এই যে তার বাবাই গেছে সে আর ফিরবে না। তার আর ফেরা হবে না। সেও ফিরবে না……মামনিও ফিরবে না। দুজনেই মামনির ক্লিনিক থেকে ফিরতে সময় হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে….
সকাল হয়েছে….… আজ অতসী ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠেছে। উদ্দেশ্য ভার্সিটি যাওয়ার আগে একবার বিল্টুদের সঙ্গে দেখা করা। তাই অতসী তাড়াতাড়ি করে রেডি হচ্ছে। ভার্সিটির পথে রওনা দিবে স্কুটি নিয়ে। কোনোমতে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে সেটা কাধে তুলে অতসী ছুটলো তার আপাইয়ের ঘরের দিকে। ভাবলো একবার দেখা করে যাওয়া যায় কিন্তু আপাইয়ের ঘরে যেতেই দেখলো তার মা আপাইয়ের মাথায় পানি দিচ্ছে আর আপাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।
‘ মা আপাইয়ের কি হয়েছে ? এভাবে শুয়ে আছে কেন আর তুমিই বা ওর মাথায় পানি কেন দিচ্ছ ? ওর কি আবার জ্বর হয়েছে ? ‘ অতসী অবাক হয়ে বললো।
‘ সেই পুরোনো রোগ…… ভোরবেলা উঠেছিলাম ভাবলাম তোর আপাকে ডেকে দেই। উঠে দেখি মেয়েটা বারান্দায় বসে আছে……চোঁখ তার টকটকে লাল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কপালের রগ ফুলে উঠেছে আর শরীর প্রচন্ড গরম। বিশ্বাস কর আবছা আলোয় তোর আপার ওই রক্ত লাল চোঁখ দেখে আমি পুরো ঘাবড়ে গেছিলাম। কোনোমতে তোর বাবাকে ডেকে ওকে ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটার মাথায় দুইবার পানি ঢাললাম কিন্তু জ্বর কমার বদলে আরও হু হু করে বাড়ছে । ‘ মিসেস কায়নাত শঙ্কিত গলায় বললেন।
‘ মা আপার এরকম অবস্থা কি করে হলো ? আপার তো স্ট্রেস নিলেই এরকম হয়। আপাই কি আবারও স্ট্রেস নিতে শুরু করেছে ? ‘ অতসী বললো।
‘ ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। উনি এসে দেখে গেছেন সানাহ্কে। এও বলেছেন সানাহ্ কোনো কারণে অনেক ডিপ্রেসড আর তুই তো জানিস তোর আপাই কেমন । যতই প্রবলেমের মধ্যে থাকুক না কেন কোনদিন মুখ ফুটে বলবে না। তাই ডাক্তার বলেছেন ওর জন্য ওয়েদার চেঞ্জ দরকার। আপাতত ও এই জায়গা ছেড়ে কোথাও গেলে সেটা ওর জন্য ঠিক হবে ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।
‘ কোথায় পাঠাবে আপাইকে ? ‘
‘ তোর মামার বাসায় ..… ‘
‘ তাহলে আজ আমার আর কোথাও যেয়ে কাজ নাই..… আমি আপাইয়ের কাছেই থাকি। ‘
‘ না না বাবা দরকার নেই। তোর আপাই যদি জানতে পারে না তার অসুস্থতার জন্য তুই ভার্সিটিতে যাস নি তাহলে তোর তো ক্লাস নিবেই সঙ্গে আমারও নিবে। তুই তো জানিস তোর আপার শরীর খারাপ করলে তার মেজাজ তুঙ্গে উঠে থাকে…… ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।
অগত্যা অতসী আর উপায় না পেয়ে বেরিয়ে এলো। অতসীর খুব খারাপ লাগছে তার আপাইকে ওভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখছে, যবে বাবাই আর মামনি মারা গেছে তবে থেকে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….