প্রেমমানিশা-১৪,১৫

0
214

#প্রেমমানিশা-১৪,১৫

(১৪)

মিস্টার আশরাফ যখন তার পুরনো অতীতের স্মৃতিতে পুরোপুরি বিভোর তখনই বাড়ির সামনে এসে ভিড় করলো দুটো প্রাইভেট কার। শব্দ পেয়ে মিস্টার আশরাফের ঘোর ভেঙে গেলো । উনি ছুটলেন কে এসেছে দেখতে। বাড়ির ছাদ থেকে মিসেস রাহেলা আর মিস্টার আমানও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন বলে উনারাও ছুটে এলেন। সানাহ্ ঘরে নেই খবরটা সবাইকে দিতে ছুটে এসে শায়খ নিজেই গাড়ি দেখে অবাক হয়ে গেলো। তারা ঠাওর করে উঠতে পারল না এত সকালে কে এসেছে।

একটা গাড়ি খুলে মিস্টার কবির,মিসেস কায়নাত আর অতসী বেরিয়ে এলো। আরেকটা কালো গাড়িতে করে মিসেস আশা আর ফারহানও এসে পৌঁছল। দুজনেই গাড়ি রেখে বেরিয়ে এলো। সকলে একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে। সকলের মনেই এক চিন্তা…. কোথায় সানাহ্……

—-

‘ এসব কি মজা চলছে ? সানাহ্ তোমাদের বাড়ি এসে রাতের আঁধারে আবার পালিয়েও গেলো অথচ তোমরা ধরতেই পারলে না…. ইজন’ট ইট এ ওরস্ট জোক ? ‘ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলে উঠলেন মিস্টার কবির।

রাগে কথাগুলো বলেও ক্ষ্যান্ত হলেন না মিস্টার কবির। এবার মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন কিছু কড়া বাক্যবাণ ‘ হাজারবার বলেছিলাম মেয়েটাকে একটু নজরে নজরে রাখো। ওর দিকে চোখ রাখো যেন কোনো বিপদ না বাঁধায়। কিন্তু তুমি শুনলে তো। তোমার তো নিজের উপর খুব কনফিডেন্স না ? এই তোমার আদর্শ মা হওয়ার নমুনা। নিজের প্রবল আত্ম বিশ্বাসের জোরে আমার মেয়েটার জীবনই নষ্ট করে দিলে। তুমি মা ডাকার যোগ্য না…. এ ব্লাডি উইচ লেডি। ইউ রুইন্ড ইউর ওউন ফ্যামিলি ‘।

মিস্টার কবিরের এহেন রুঢ় কথাও যেন মিসেস কায়নাতের উপর কোনো প্রভাব ফেললো না। উনি বসে আছেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। মুখে কোনো অনুভুতি নেই। ঠিক যেন অনুভূতিহীন জড় বস্তু। মেয়ের শোকে তার এই অবস্থা হলেও তার নিজেরই এসব কথায় অভ্যাস আছে। মেয়ে এরকম হুট করে হারিয়ে গেলেই তার স্বামী রেগে গিয়ে এসব বলে।

মিস্টার কবিরের এহেন ব্যবহারে ফারহান যেন অবাক না হয়ে পারল না। সে ভাবেনি মিস্টার কবিরের মতো এত ঠান্ডা মাথার মানুষও এভাবে রাগারাগি করতে পারে। কিছুক্ষণ পর নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে বিড়বিড় করে বললো ‘ সানাহ্ ওয়াজ রাইট…. শি টোটালি মেইড ইট ‘।

তবে কথাগুলো নিরুচ্চারে বললেও সম্মুখে মিস্টার কবির এবং সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘ আঙ্কেল এখন এভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার কোনো মানেই হয়না। যা করার সানাহ্ ফিরে এলে করবেন। কিন্তু এখন আগে ওকে খুঁজে বের করাটা দরকার। যা বুঝলাম সানাহ্ কিছুতেই চায়না আমরা ওকে ধরে ফেলি তাই এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে ধরতে হলে আমাদের গামছা বেধে নামতে হবে। সব থেকে ভালো হয় ওর লোকেশন ট্রেস করতে পারলে। ‘

ফারহানের কথায় হার মানলেন মিস্টার কবির। তাৎক্ষণিক মুহূর্তের জন্য নিজের ভিতর জমে থাকা রাগটা চেপে গিয়ে বললেন ‘ তাহলে আমি জাবেদকে ফোন দিচ্ছি। ও আমার ফ্রেন্ড এবং একজন পুলিশ অফিসার। এই বরিশালেই থানার বড় একটা পোস্টে চাকরি করে। সানার লোকেশন বের করা ওর জন্য দুধ ভাত। ‘

ফারহান যেন এই অপেক্ষায় ছিল। মিস্টার কবিরের কথায় খুশি হয়ে বলল ‘ তাহলে আর অপেক্ষা কিসের ? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করুন। এই কাজটা আমাদের আরও আগেই করা উচিত। আপনি উনাকে ফোন দিন তারপর লোকেশন ট্র্যাক হলে আপনার বন্ধু আর আমি মিলে সানাহ্কে খুঁজতে বের হবো। আপনারা সেই ফাঁকে সবাই একটু রেস্ট নিন। ‘

—-

‘ আঙ্কেল সানার লোকেশন কি ট্রেস করা গেছে ? ও কোথায় ? ‘ উদ্বিগ্ন গলায় বললো ফারহান।

ফারহানের কথায় মনে হলো মিস্টার জাবেদ খানিকটা নিরাশই হয়েছেন কারণ ওনার চেহারায় ফুটে উঠেছে ফ্যাকাসে ভাব। উনি আমতা আমতা করে বললেন ‘ লোকেশন ট্রেস তো করেছি…. কিন্তু ‘

‘ কিন্তু কি আঙ্কেল ? ‘ ফারহান অবাক হয়ে বললো।

‘ ওর লাস্ট লোকেশন পাওয়া গেছে সিলেটে যেখানে ও পৌঁছেই ওর ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে। আই থিঙ্ক ও ধরতে পেরেছে আমরা ওকে ট্রেস করছি। ‘ হতাশ গলায় বললেন মিস্টার জাবেদ।

মিস্টার জাবেদের কথায় যেন মিস্টার কবির আরও ভেঙে পড়েছেন। উনি কপালে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়লেন। মিসেস কায়নাত স্থানুর মতো বসে আছেন আর মিসেস আশা উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। অতসী কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে সে তিন চার দফা সবার জন্য কফি করে এনেছে।

সানার মামারাও নিজেদের মতো যথা সাধ্য চেষ্টা করছে সানাহ্কে খোঁজার। নিজেদের যত রকমের সোর্স আছে সব কাজিয়ে লাগিয়েছে তারা। সারাদিন খোঁজাখুঁজি করে যখন উনারা সকলে ফিরে রেস্ট নিচ্ছিলেন তখন মিস্টার জাবেদের এই কথা শুনে শায়খের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। তার মনে মনে আশঙ্কা হলো ফারহান যদি সানাহ্কে খুঁজে বের করে ? মেয়েটা বেরিয়েছে দুদিনও হয়নি। সানার চিঠি পড়ে শায়খ অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে সানার কিছুদিন মেন্টাল পিস দরকার আর এর জন্য ওর একা থাকা খুব দরকার,কাইন্ড অফ ওয়েদার চেঞ্জ।

মিস্টার জাবেদের কথায় এবার খানিকটা অসহায় হয়ে পড়লো ফারহান। সানাহ্কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই ভেবে কাল থেকে তটস্থ তার উপর দিয়ে সানার এসব পাগলামি তাকে সানার উপর আগ্রাসী করে তুলছে। ফারহান আগ্রাসী গলায় বিড়বিড় করে বললো ‘ ইউ হ্যাভ টু রিপেন্ট ফর ইট উডবি মিসেস ফারহান…. ভেরি সুন। আই উইল নট স্পেয়ার ইউ…. ফর গড সেক আই অ্যাম নট গোইং টু স্পেয়ার ইউ ফর দিস টাইম ‘ ।

কথাগুলো নিরুচ্চারে বললেও ফারহান সম্মুখে বললো ‘ তাহলে যতটুকু পেয়েছি তাকেই কাজে লাগাবো। পুলিশ সোর্স তো আছেই….দরকার পরে সিলেটের অলিগলি চেক করবো তবুও সানাহ্কে আমার চোখের সামনে চাই। ‘

‘ তুমি আমার কথা বুঝতে চাইছ না ফারহান। সিলেট কি তোমার ছোট জায়গা মনে হয় ? তুমি ওকে সারাদিনেও খুঁজে বের করতে পারবে না। ‘ মিস্টার জাবেদ বললেন।

‘ আপনি আমার কথা বুঝতে চাইছেন না স্যার। সিলেট বড় বলে কি আমি আমার ওয়াইফকে খোঁজা বন্ধ করে দিব ? শি ইজ গোইং টু বি মাই ওয়াইফ অ্যান্ড আই ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট। একদিনে খুঁজে বের করতে হবে এমন কোনো কথা আছে ? আমরা দরকার পড়ে ওকে কয়েক দিন লাগিয়ে খুঁজব কিন্তু খুঁজব। আপনি চিন্তা করবেন না….আমি সিলেট পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে নিবো। আপনাকে সানাহ্কে খুঁজতে হবে না ‘ ফারহান রাগী গলায় বললো।

‘ সানাহ্ শুধু তোমার উড বি ওয়াইফ নয় আমারও বন্ধুর মেয়ে তাই ওর প্রতি আমার কিছু দায়িত্ত্ব আছে। আর জাবেদ আলী কখনও নিজের দায়িত্বে আপোস করেনা। আই এম গোইং উইথ ইউ…… ‘ থমথমে গলায় বললেন মিস্টার জাবেদ।

‘ এজ ইউর উইশ ‘ বলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফারহান। সে ভাবেনি এভাবে সানাহ্কে পেয়েও হারাতে হবে। ভুলটা তারই..…সে যদি বিয়ে নিয়ে আপত্তি না করতো তাহলে এসব হতো না। তবে নিজের ভুল শুধরে নেয়ার সময় এখন এসে গেছে।

—-

Saanson mein saanson mein
Teri sargamein hai ab rat din
Zindagi meri toh kuch naa
Ab tere bin

Teri dhadkanon ki sargoshi
Meri dhadkanon me bajti hain
Meri jagti nigaahon me

Khwahish teri hi sajti hain
Mere khayal mein har pal
Tere khayal shaamil hain

Lamhe judaiyon waale
Mushkil bade hi mushkil hain
Oh piyaa….

ছাম ছাম ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত পুরো হলঘর। অনবরত বেজে চলেছে সেই মিষ্টি মধুর শব্দ। বিশাল হলঘরের মাঝে হাত পা গানের তালে নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনবরত নেচে চলেছে সানাহ্। মুখে তার মিষ্টি মধুর হাসি আর ঠোঁটও নড়ছে গানের তালে । তাকে ঘিরে খানিকটা দূরেই দল বেঁধে দাড়িয়ে আছে এক রাশ যুবতী। তারা সকলেই মুগ্ধ সানার নাচ দেখে। তারা ভাবেনি যেই মেয়েটাকে দেখতে এত স্থির, অচঞ্চল মনে হয় সে নাচের সময় এভাবে প্রাণবন্ত হয়ে নাচতে পারে।

সানাহ্ তার প্রাণবন্ত হাত পা ছড়িয়ে নেচে চলেছে পুরো ঘরময়। একসময় নাচতে নাচতেই সে তার আজকের তালিম শেষ করলো। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মাঝে নাচ করতে গিয়েও সে ঘেমে একাকার। কাউচে বসে মিলাকে বললো এসির টেম্পারেচার আরও কমিয়ে দিতে। তারপর পাশ থেকে নিজের ওয়াটার পটটা নিয়ে গলায় পানি ঢাললো। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে এবার বললো ‘ যেহেতু আমার আগেও একজন এক্সপেরিয়েন্সড টিচার তোমাদের নাচ শিখিয়েছেন সেহেতু আমি মনে করি এই নাচ তুলতে তোমাদের তেমন সমস্যা হবে না। আজ ডেমো দেখিয়েছি…. কাল থেকে নাচ তোলার প্রয়াস চলবে। ঠিকাছে ? আর আগের নাচটা নিয়মিত প্রাকটিস করবে নাহলে মনে থাকবে না। ঠিকাছে ? ‘

সকলে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল সানার কথায়। তারা সকলেই হতভম্ব সানার নাচ দেখে। তাদের মনে হলো এতটা ভালো নাচ তাদের প্রিভিয়াস টিচারও পারতেন না। সানাহ্ যেই গানে নেচেছে সেই গানে সে খুব ভালো করেই নিজের ব্যালান্স মেইনটেইন করেছে। এই ধরনের নাচ করাটা অনেকটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার কারণ এই নাচ যত দ্রুত নাচা যায় ততই সুন্দর যার কারণে প্রায় সময় ব্যথায় পা টনটন করে। তবে সানাহ্ সেসবের ধারের কাছেও নেই কারণ এসব তার বহু বছরের সাধনার ফসল।

—-

‘ মিস সানাহ্ আপনি দেখছি অল্প সময়েই স্টুডেন্টদের মন জয় করে নিয়েছেন। সকলে এখন আপনার কাছেই নাচ শিখতে চাইছে। প্রথমে তো বাচ্চারা মানতেই চাইছিল না নতুন টিচারকে কিন্তু এখন তারা অবাক আপনার নাচ দেখে। ‘ মিসেস শকুন্তলা বললেন।

মিসেস শকুন্তলা নাচের স্কুলের একজন পুরোনো শিক্ষক। এই স্কুলের সঙ্গে সে জড়িত আছে একদম প্রথম থেকে যখন স্কুলটা একটা কামরার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। উনার আর গুরুজীর যৌথ চেষ্টায় আজ নাচের স্কুল অনেক বড় হয়েছে।

মিসেস শকুন্তলার কথা শুনে আলতো হাসলো সানাহ্। হালকা হেসে জরুরি কথাবর্তা শেষ করে কাধে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। একজন নিউ কামার হিসেবে সে ভালই উন্নতি করেছে সিলেটে এসে। একটা ভালো নাচের স্কুলে চাকরি সেই সঙ্গে কিছু টিউশনি। এর থেকে যা আর্ণ হয় তাতে আরামসে চলে যাবে সানার। এখানে এসে সানার বরং সুবিধাই বেশি হয়েছে।

জাপানের সাহায্যে একটা দুই রুম,একটা বারান্দা আর এক বাথরুমের ফ্ল্যাট পেয়েছে খুবই স্বল্প ভাড়ায়। তার উপর চাকরির ব্যবস্থাও জাপানই করেছে। সব মিলিয়ে হয়তো মাস শেষে হাজার দুয়েক টাকা সেভিংসও করা যাবে। তারপর অনেকগুলো টাকা জমলে সেটা দিয়ে কোথাও ইনভেস্ট করে ভালোই কামাই করা যাবে।

ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনা করতে করতেই এগোচ্ছিল সানাহ্। মনে পড়লো বাড়ি ফিরে ফারহানকে একটা চিঠি লেখা দরকার। বেচারা হয়তো চিন্তায় আছে। সানার খানিকটা খারাপই লাগছে এভাবে সবাইকে ছেড়ে এসে থাকতে। সবাই হয়তো ওকে নিয়ে টেনশন করছে। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে চোয়াল শক্ত করে ভাবলো খারাপ লাগলেও সেই খারাপ লাগা কাটাতে হবে। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সবাই নিজের কথাই ভাবে তাই সে যদি নিজেকে নিয়ে ভাবলে তাতে কোনো অপরাধ নেই।

ফ্ল্যাটে ফিরেই চুলায় রান্না চরাল সানাহ্। এই ক্ষেত্রেও জাপানকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। সে না থাকলে সানাহ্ একলা এতকিছু সামলে উঠতে পারত না। ফ্ল্যাটের টুকিটাকি যা লাগবে তার সবই জোগাড় করে দিয়েছে জাপান। তেল থেকে শুরু করে হাড়ি সবই। সানাহ্ এই প্রথম কারোর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে।

রান্না শেষ করে ঘর পরিস্কার করে ফ্যান ছেড়ে ফ্যানের নিচে বসলো সানাহ্। এই শীতকালেও কাজ করায় সে ঘেমে একাকার। সে সিলেট এসে উঠেছে তার প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো। প্রথম প্রথম বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করবে। মনে হচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে এসে ভুল করেছে। সেই সময় দেবদূত হয়ে এলো জাপান আর ফারাইরা নামের সেই মেয়েটা যে ওকে বাসে হেল্প করেছিল। আসলে মেয়েটা জাপানের উডবি ওয়াইফ। সে প্রথম দিন সানাহ্কে দেখেই চিনতে পেরেছে আর সানাহ্ নিজেও। অবাক হয়েছিল এটা জেনে যে ওই পিচ্ছি মেয়ে জাপানের বাগদত্তা।

সানাহ্ যখন ফ্যানের নিচে বসে নিজেকে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। সানাহ্ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুচকে চিন্তা করলো কে আসতে পারে। জাপান নাকি পাশের ফ্ল্যাটের জয়িতা বৌদি ? তবে দরজা না খুললে তো জানা যাবে না তাই সানাহ্ গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলেই বাইরে দাড়িয়ে থাকা জয়িতা বৌদিকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে আপনিতেই হাসি ফুটে উঠল।

জয়িতা মিত্র হলেন সানার নেইবার। উনার সঙ্গে উনার স্বামী হরিহরও থাকেন। এই হিন্দু দম্পত্তি নিজেদের বিশাল বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ছোটো বাড়িতে থাকতে এসেছেন শুধুমাত্র জীবনের শেষ বয়সে একটু একসঙ্গে আলাদা সময় কাটাবেন বলে।

মিসেস জয়িতা সেই সূত্রে বড়ই মিশুক। উনাদের পাশের ফ্ল্যাটে যেই আসে তার সঙ্গেই বন্ধুত্ত্ব করে ফেলেন তবে উনার এই বন্ধুত্ত্ব কারোরই ভালো লাগে না বলে কয়েকদিন পরই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এক্ষেত্রে সানাহ্ খানিকটা অন্যরকম। সে শত ইন্ট্রোভার্ট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দিনেই মিসেস জয়িতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে।

‘ আরে জয়িতা বৌদি তুমি ? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? ঘরে এসো…… ‘ বলে সানাহ্ মিসেস জয়িতার হাত টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে বারান্দায় বসলো। বারান্দায় জাপান দুটো বেতের সোফা আর একটা কাচের ছোটো টি টেবিল লাগিয়েছে তাই সেখানেই বসেছে ওরা।

‘ তুমি একা কেন ? হরি দা কোথায় ? উনি কি আজও বাজার গেছেন ? কাল না তোমরা বাজার করলে ? ‘ সানাহ্ জিজ্ঞেস করলো।

‘ আরে না না আজ ও বাজার যায়নি। আসলে ও একটু বেরিয়েছে। ওর পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে কদিন ধরে কিন্তু আমায় কিছুই বলেনি। আজ হঠাৎ করে কথায় কথায় বলে ফেললো। তাই আমি বললাম আমি গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি ফার্মেসি থেকে কিন্তু সে শুনলে তো। সে বলে সে থাকতে আমি কেন বের হবো ? তাই সে একাই বেরোলো… ‘ মিসেস জয়িতা বললেন।

‘ ওহ্ আচ্ছা…… তা তুমি কি খাবে বলো। আমি চা করে আনবো ? তারপর দুজনে মিলে বিস্কিট ডুবিয়ে খাবো। চলবে না ? আসলে ঘরে তেমন কিছু নেই। আজ বাজার শেষ। আবার বেরিয়ে আনতে হবে…. ‘ সানাহ্ বললো।

‘ আরে না না ওসবের দরকার নেই। আমি ভাবছি আজ তোকে নিয়ে একবার আমার মেয়ের বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসবো। তুই যাবি আমার সাথে ? ‘ মিসেস জয়িতা আলতো হেসে বললেন।

মিসেস জয়িতার কথা শুনে মনে হয় একটু অসস্তিতে পড়লো সানাহ্। আমতা আমতা করে বলল ‘ না মানে আমি…. আমি কি করে যাবো ? তোমার মেয়ে আমাকে চিনে না আর আমিও তাকে চিনি না। ‘

‘ আরে চিনাচিনি করা লাগবে কেন ? তুই যখন এসেছিলি তখন কি আমাকে চিনতি ? তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে না ? তাহলে ওর সঙ্গেও হবে। আমি কোনোকিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুই আমার সঙ্গে যাবি ব্যাস…. তোর দাদা আজ যেতে পারবে না। তার পায়ে ব্যথা। ‘
অগত্যা সানাহ্ আর কি করবে। তার রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ….

#প্রেমমানিশা(১৫)

‘ ফারহান আর কতদিন এভাবে সানাহ্কে খুঁজবি বাবা ? এবার তো চলে আয়…… এরকম করলে তোর চাকরি কি করে থাকবে ? ‘ মিসেস আশা বিমূর্ষ গলায় ফোনের ওপারে থাকা ফারহানকে বললেন।

ভদ্র মহিলা নিজের ছেলেকে নিয়ে এখন বেশ চিন্তায় আছেন। ছেলে তার সানাহ্কে খুঁজতে গিয়ে চাকরি বাকরি ছেড়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা যে সানার জন্য এতটা পাগল সেটা উনি আগে বুঝতে পারেননি। বুঝলে হয়তো সানার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাই করতেন না। অন্তত সানার জন্য তো নিজের ছেলেকে কষ্টে দেখতে চাননা সে সানাহ্ যতই বান্ধবীর মেয়ে হোক ।

‘ এক কথা আর কতবার বলবে মা ? আমি তো বলেই দিয়েছি আমার এখন ফার্স্ট প্রায়োরিটি হলো সানাহ্কে খুঁজে বের করা। সে এর জন্য যদি আমাকে চাকরি হারাতে হয় তাহলে আমি তাতেও রাজি । তাছাড়া আমি তো ভার্সিটিতে মেইল করে জানিয়েই দিয়েছি যে আমার ছুটি লাগবে। তাহলে এই কথা আসছে কোথা থেকে ? ‘ ফারহান বিরক্ত হয়ে বলল। রোজ রোজ মায়ের এক কথা তার আর ভালো লাগছে না।

‘ এমন পাগলামি কেন করছিস তুই ? সানার জন্য এতটা পাগল তো তুই ছিলি না..… তাহলে কি তোকে সানার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে কোনো ভুল করলাম ? ‘ মিসেস আশা বললেন ।

‘ আমি পাগলামি কেন করছি সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ না মা ? না বুঝলে বলে দিচ্ছি,আমি সানাহ্কে ভালোবাসী। এই কথা তো সানাহ্ আর আমার বিয়ে ঠিক করার আগে ভাবা উচিত ছিল। তোমার থেকে অন্তত এটা আশা করিনি মা। আগে সানাহ্ যখন তোমার কাছে ভালো ছিল তখন তাকে বিয়ে করার জন্য তুমি আমায় জোর করছিলে আর আজ ওর বিপদে ও তোমার কাছে খারাপ হয়ে গেলো বলে ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছো ? মা তুমি কি সেলফিশ হয়ে যাচ্ছ না ? ‘ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ফারহান।

ছেলের কথায় চুপ করে গেলেন মিসেস আশা। কিছু বলার মতো ভাষাই খুঁজে পেলেন না। বারবার মনে হলো তাহলে কি সে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে ? ফারহান তার মাকে চুপ করে থাকতে দেখে নরম গলায় বললো ‘ চিন্তা করোনা,খুব তাড়াতাড়ি তোমার হবু ছেলের বউকে নিয়ে ফিরবো। আমার মন বলছে সে আমার আশেপাশেই কোথাও আছে। ‘

ফারহান কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিল। ছেলে ফোন রাখতেই মিসেস আশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনি জানেন না ফারহান আর সানার এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি। শুধু ভয় হচ্ছে এভাবে করে ওদের জীবনটা না নষ্ট হয়ে যায়।

আজ সানাহ্ মোটামুটি খানিকটা সাজগোজ করেই বেরিয়েছে। পরনে তার টকটকে লাল জামদানি শাড়ি আর বাদামি রঙ্গা চুলগুলো কোমর অব্দি ছাড়া। ডান হাতে একটা রিস্ট ওয়াচ যেটা তাকে তার পঁচিশতম জন্মদিনে তার বাবা দিয়েছিলেন। ব্যাস এই অব্দিই তার সাজ। এর থেকে এক চুলও বেশি সাজাতে পারেননি মিসেস জয়িতা। অবশ্য সানাহ্কে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়াটা পুরোপুরি উনার ইচ্ছা আর সানাহ্ও তাকে শ্রদ্ধা করে বলে না করতে পারেনি।

দুই সুন্দরি রমনী যখন শাড়ি পড়ে সেজেগুজে রাস্তায় বের হলেন তখন রাস্তায় থাকা পথচারীরা সকলেই অন্তত একবার একবার করে তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। যাঁরা সানার এই অসামান্য রুপে চোখ দিচ্ছে তারাই দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার ঘুরে আবারও তাকাচ্ছে। মিসেস জয়িতা সানাহ্কে এসব দেখে একটা চোখ টিপ মারলেন তবে সানাহ্ নির্বিকার। সে চেয়েছিল বিয়ের পর এরকম করেই ফারহানের জন্য সাজবে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি।

সানাহ্দের বাড়ি থেকে মিসেস জয়িতার মেয়ে ঐশানির বাড়ি পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের দূরত্বে তাই ওরা আর কোনো ট্রান্সপোর্ট প্রেফার করলো না। সোজা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যেতে লাগলো। কাটায় কাটায় দশ মিনিট পর তারা এসে পৌঁছল এক মাঝারি আকারের দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটা বাইরে থেকে দেখেই মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি। হয়তো ঐশানির শশুরের বাড়ি।

মিসেস জয়িতা এক প্রকার খানিকটা ঠেলেই সানাহ্কে নিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ডান হাতে কলিং বেল দিলেন। বেল বাজাতেই মিনিট দুইয়ের মধ্যে একটা অল্প বয়সী শাড়ি পরিহিতা মেয়ে এসে দরজা খুললো আর ওদের দেখে বেশ চওড়া এক হাসি দিল। সানাহ্ আন্দাজ করলো বোধ করি এই মেয়েই ঐশানি।

ঐশানি সৌজন্য হেসে মিসেস জয়িতা আর সানাহ্কে অভ্যর্থনা জানিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এলো আর ওদের সোফায় বসিয়ে রেখে স্নাকসের ব্যবস্থা করতে গেলো। ঐশানি প্রস্থান করতেই সানাহ্ আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে পুরো বাড়ি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। বাড়িটা ওদের বাড়ির মত অত বড় নাহলেও তিন চারজনের থাকার জন্য বেশি হয়ে যায়। সানাহ্ মিসেস জয়িতার কাছে জানতে পেরেছে ঐশানির শশুর বাড়িতে আছে বলতে ওই স্বামী, শাশুড়ি আর এক মধ্য বয়সী ভাসুর যার মানসিক কিছু সমস্যা আছে বলে সে সবসময় বাড়িতেই থাকে। বিয়েটা তার হয়নি।

কিছুক্ষণ পরেই মুখে এক চওড়া হাসি নিয়ে স্নাক্সের ট্রে হাতে বসার ঘরে এসে হাজির হলো ঐশানি। ট্রে রেখে দ্রুতই সে আবারও অন্তর্ধান। মিনিট দুয়ের মাঝেই সে ফিরে এলো কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে। সেগুলো টি টেবিলে রেখে সানার মুখোমুখি বসলো। সানাহ্ ঐশানির দিকে তাকিয়ে আছে।

ঐশানি ভট্টাচার্য মিসেস জয়িতা মিত্র এবং হরিহর মিত্রর একমাত্র মেয়ে এবং তাদের তৃতীয় সন্তান। বয়স আনুমানিক ২৩-২৪ হবে তারমানে সে সানার ছোট। মুখভাব তার গোলগাল আর চোখগুলো টানা টানা। মাথার চুল কোমরের অনেকটা উপরে তবে ঘাড়ের নিচে। গলায় সরু এক সোনার চেইন আর কানে সোনার ছোটো কানের দুল। হাতেও শোভা পাচ্ছে শাঁখা পলা আর নোয়া। মাথা ভর্তি সিঁদুর যেন এই অল্প বয়সী নারীর সৌন্দর্য্য আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। তার আরক্তিম গাল জোড়া জানান দিচ্ছে সে রুপে অসামান্য সুন্দরী। সানার কেন জানি ঐশানিকে দেখে ইচ্ছে করলো ‘ পুতুল ‘ বলে ডাকতে। অন্তত মেয়েটা গায়ে গতরে তো পুতুলের মতই দেখতে। হাইটে বেশি নয় আনুমানিক ৫’২” আর শরীরও অনেকটা রোগা তার উপর খানিকটা ফ্যাকাসেও।

মিসেস জয়িতা নুডুলসের পাকোড়া সানার হাতে তুলে দিয়ে সানার সঙ্গে ঐশানির পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই ঐশানি বলে উঠলো ‘ তোমাকে বলতে হবে না মা। আমি জানি ও সানাহ্..…সানাহ্ দি। তুমি ওর অনেক প্রশংসা করেছ এই কদিনে তাই ও কিরকম দেখতে তা আমার মুখস্ত। রিয়েলি শি ইজ এ ব্লন্ড গার্ল……লাইক এ প্রিন্সেস ‘ ।

ঐশানির স্বগতোক্তি শুনে সানাহ্ কি বলবে বুঝে পেলো না। তার হাতে তেলে চিটচিটে পাকোড়া। পাকোড়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সানাহ্। পরিস্থিতির চাপে কতকিছুই না করতে হয়। এর আগে সানাহ্কে কেউ কখনও মেরেও এমন অইলি খাবার খাওয়াতে পারেনি অথচ আজ ভদ্রতার খাতিরে দায়ে পড়ে খেতে হচ্ছে। দা ওরস্ট ডে….

‘ তুমি বসে আছো কেন দিদি ? পাকোড়াটা মুখে দাও না..… তোমার কি ভালো লাগছে না পাকোড়া খেতে ? তাহলে আমি অন্যকিছু করে আনি ? ‘ ঐশানি বললো।
ঐশানির কথায় চমকে উঠে মেকি হেসে আমতা আমতা করে সানাহ্ বললো ‘ নাহ্ খাচ্ছি তো…… এই যে। ‘ মুখে কমপ্লিমেন্ট না দিলেও সানার কাছে পাকোড়াটা খারাপ লাগেনি। খেতে ভালো তবে ডিপ ফ্রাই করা এই যা। যাকগে একদিন খেলে কিছু হবে না। সানাহ্ হাতের পাকোড়া শেষ করে বললো ‘ অনেক ভালো হয়েছে খেতে ‘

‘ তাহলে তুই আরেকটা নে..… বসে আছিস কেন ? এমা এখন কি খাবারও তোর হাতে তুলে দিতে হবে ? দাড়া দিচ্ছি…… ‘ বলে মিসেস জয়িতা সানার হাতে আরও একটা পাকোড়া তুলে দিলো আর সানাহ্ও কোনো আপত্তি করলো না।

‘ মা তোমরা বসো……আমি শাশুড়ি মাকে ডেকে আনছি। তুমি এতক্ষণ হয়েছে এসেছো কিন্তু উনাকে ডাকিনী শুনলে আমি আস্ত থাকবে না। তোমরা গল্প করো..… ‘ বলেই ঐশানি অন্তর্ধান তার শাশুড়ির খোঁজে।
ঐশানি বেরিয়ে যেতেই মিসেস জয়িতা সানাহ্কে সুধালেন ‘ কি হয়েছে ? খারাপ লাগছে ? ‘

সানাহ্ ইনিয়ে বিনিয়ে বললো ‘ না আসলে শাড়ি এই প্রথম পড়েছি তাই অসস্তি লাগছে। ‘ খানিকটা মিথ্যা কথাই বললো সানাহ্ কারণ খাবারের কথাটা বললে জয়িতা দেবীর খারাপ লাগতে পারে।

‘ আচ্ছা একটু সহ্য করে নে……আর এসব পড়িয়ে তোকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো না। সন্ধ্যা অব্দি একটু বসে যাই ঐশানির শাশুড়ি বনলতা দেবী আবার খুব মিশুকে। মানুষ পেলেই আড্ডা দিতে বসে যান। আসলে এই বয়সে কেউ নেই তো গল্প করার জন্য তাই। ‘ মিসেস জয়িতা বললেন।

মিসেস জয়িতার কথায় সানাহ্ আলতো করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে সামলে নিবে। সানার সম্মতি পেয়ে মিসেস জয়িতা পরমানন্দে সমুচা ভেঙে খেতে শুরু করলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঐশানি তার শাশুড়ি নিয়ে হাজির হলো। ভদ্র মহিলা মিসেস জয়িতাকে দেখে যার পরণাই খুশি হলেন। খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি বিনিময় করলেন । কুশলাদি বিনিময় শেষে মিসেস জয়িতা মিসেস বনলতার সঙ্গে সানার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন ‘ ও হলো সানাহ্..…আমার নেইবার। খুবই মিশুকে আর প্রাণবন্ত। ‘

সানাহ্কে দেখে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করলেন মিসেস বনলতা। মিসেস বনলতার এহেন দৃষ্টি দেখে ভরকে গেল সানাহ্। খানিকটা নড়েচড়ে বসতেই মিসেস বনলতা পান খাওয়া দাত মেলে হেসে বললেন ‘ হাও আর ইউ ইয়াং লেডি ? ‘

ভদ্র মহিলা যে সানাহ্কে এভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে সেটা জানা ছিলনা সানার। প্রথমে উনার এহেন ব্যবহারে খানিকটা ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ‘ আই অ্যাম ফাইন ‘ ।

এবার কেন যেন মিসেস বনলতা চিন্তায় পড়ে গেল। গালে হাত দিয়ে উনাকে কিছু ভাবতে দেখা গেলো। সানাহ্ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ঐশানিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো মানুষটার এরকম ব্যবহারের কারণ কি। ঐশানি সেই ইশারা বুঝতে পেরে চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো খানিকটা সবুর করতে, কিছুক্ষনের মধ্যেই বোঝা যাবে।। সানাহ্ সেই মতে স্থির হয়ে বসলো।

‘ ইউ আর এ ভেরি ইন্ট্রোভার্ট পারসন,রাইট ? ‘

আচমকা মিসেস বনলতার এহেন প্রশ্নে চমকে উঠলো না সানাহ্। সে নিজেকে তৈরি করেই রেখেছিল সেভাবে। মাথা নেড়ে বললো ‘ হুম ‘ । মিসেস বনলতা হেসে বললেন ‘ তোমার উত্তর শুনেই বুঝেছি। যারা ইন্ট্রোভার্ট তারা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়।। আর যারা এক্সট্রোভার্ট তারা সবসময় প্রশ্নকর্তার উত্তরের সঙ্গে নিজের কথাও জুড়ে দেয়। তাই তুমি ইন্ট্রোভার্ট। ‘

‘ সে কি সানাহ্ ইন্ট্রোভার্ট ? কই ওর ব্যবহারে তো কিছুই টের পাইনি। বরং আমার সাথে আর ঐশানির বাবার সঙ্গে বেশ হেসে হেসেই তো কথা বলে। ‘ মিসেস জয়িতা অবাক হয়ে বললেন। তার কথায় বিস্ময়ের রেশ। উনি ধারণা করেননি সানাহ্ তার সত্তা লুকিয়ে রেখেছে।

‘ ইন্ট্রোভার্ট মানেই যে হাসতে,কথা বলতে জানে না তা না। যারা ইন্ট্রোভার্ট তারা স্পেসিফিক কিছু মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে আর আপনারা হলেন তাদেরই একজন। ‘ মিসেস বনলতা বললেন।

‘ আন্টি আপনি কি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন ? ‘ সানাহ্ জিজ্ঞেস করলো।

‘ হুম করেছি তো…… কিন্তু মৈনাক ( ঐশানির স্বামী) হওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইউ আর এ ইন্টেলিজেন্ট পারসন সানাহ্। সারাদিন সংসার ছেলে মেয়ে সামলে চাকরি করা সম্ভব ছিলনা সেটা তো বুঝতেই পারছ। ‘ মিসেস বনলতা পরম উৎসাহে বললেন।

মিসেস বনলতার কথা শুনে সানাহ্ বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল যেন এই বিষয়ে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। সানাহ্কে এভাবে মাথা নাড়তে দেখে মিসেস বনলতা মুচকি হেসে বললেন ‘ তা তুমি কি নিয়ে পড়ছো ? ‘

‘ ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে…. ঢাকা ইউনিভার্সিটি ‘ শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো জিহ্বার আগা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বললো।

‘ বাহ্ ভালই তো…. তা এখান থেকে পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়না ? ‘

‘ আমি ঢাকা থেকেই পড়াশোনা করতাম। এখানে শুধু কিছুদিনের ওয়েদার চেঞ্জের জন্য এসেছি। সামনে পরীক্ষা আছে তাই কিছুদিন পরই ফিরে যেতে হবে। ‘

‘ ওহ্…… তুমি কোন ইয়ার ? ‘

‘ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ‘

‘ মাস্টার্স কী ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকেই করবে ? ‘ মিসেস বনলতা কৌতূহল দমাতে সানাহ্কে প্রশ্ন করে বসলেন।

‘ না সেভাবে কিছু ভাবিনি..… দেখি আগে পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট বের হোক ‘ সানাহ্ বিব্রত সুরে উত্তর দিলো। এই প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর নেই তার কাছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সে এখনও করেনি। যা চিন্তা ভাবনা করার তা অনার্স পরীক্ষার পর পাকা করবে। আপাতত নো স্ট্রেস..
সানার কথা শুনে মিসেস বনলতা শুধুমাত্র ‘ ওহ্ ‘ বলে আবারও আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়লেন।

আড্ডায় আড্ডায় কখন যে দিনের আলো পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমে এলো সেটা কারোর খেয়ালই রইলো না। সকলেই তাদের কথায় ব্যস্ত। আঁধার ঘনিয়ে আসতেই মিসেস জয়িতার খেয়াল হলো রাত অনেক হয়ে গেছে, এখন বাড়ি ফেরা দরকার। কথাটা মনে পড়তেই সানাহ্কে বেড়িয়ে পড়ার জন্য তাগাদা দিলেন উনি। অবশ্য মিসেস বনলতা আর ঐশানি রাতে খাওয়া দাওয়া করে ওই বাড়িতেই থেকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু মিসেস জয়িতা আর সানাহ্ কেউই রাজি হননি।
উভয়ই রাজি হননি বলে ভুল হবে কারণ সানাহ্ই চোখের ইশারায় মিসেস জয়িতাকে বলেছিল যে সে এখানে রাতে থাকতে চাইছে না। অগত্যা মিসেস জয়িতাকে সানাহ্কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়তে হলো।

প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে আসায় মিসেস বনলতা মিসেস জয়িতা আর সানাহ্কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার এক বিশ্বস্ত ড্রাইভারকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। অতঃপর ড্রাইভার ওদের দুজনকে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলো। বাড়ি ফিরে সানাহ্ বাইরের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্যানের নিচে বসে খানিকটা জিরিয়ে নিলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে ভাত চড়ালো, মাড় গালা ভাত।

ভাত বসিয়ে দিয়ে কাধে গামছা,জামা কাপড় নিয়ে সানাহ্ বাথরুমে ঢুকলো গোসল সারতে। চুলায় ভাত বসানো আছে আর দেরি হলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এই ভেবে সানাহ্ দ্রুতই গোসল সেরে বেরিয়ে রান্নাঘরে দৌড় দিল। ভাতের মাড় গেলে রান্নাঘরের তাকের উপর রেখে ঘরে ফিরে এলো। মাথার গামছা বারান্দায় মেলে চুল ছেড়ে খানিকটা আছড়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে চুল ছেড়ে দাড়ালো যাতে চুল শুকিয়ে যায়।

চুল খানিকটা শুকিয়ে প্লেটে পাতিলের ভাত নামিয়ে ফ্যান ছেড়ে ঠান্ডা করতে দিলো। দুপুরের রান্না করা তরকারি চুলায় বসিয়ে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে বলক আনিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে এসে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আসন পেতে বসলো। প্লেটে তরকারি নিয়ে খেতে শুরু করলো। এভাবে মেঝেতে বসে খেতে সানার অনেকটা কষ্টই পোহাতে হচ্ছে কারণ মেঝেতে বসে খাওয়া তার অভ্যেসে নেই। খাওয়া শেষে সানাহ্ বাসনকোসন সিংকে জমিয়ে সেগুলো ধুয়ে ঘরটা একটু গুছিয়ে চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে।

সানার সিলেট এসে থেকে অভ্যাস হয়েছে প্রতিদিন রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাইর হাঁটতে বের হওয়া আর সেই হাঁটা চলে নদীর কাছে পৌঁছানোর আগ অব্দি। অবশ্য ওকে এহেন রাতের বেলা বের হতে দেখে রাস্তায় থাকা লোকগুলো প্রায়ই ওর দিকে ভুত দেখার মত চমকে তাকায় কিন্তু ও সেসব পাত্তা দেয়না। কিন্তু আজ নদীর পাড়ে যাওয়াটা যে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে সেটা কে জানতো। তার জীবনের সবকিছু বদলে দিবে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্..…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here