#প্রেমমানিশা-৩২,৩৩
(৩২)
গোল্ডফিল্ড এভিনিউ,
জন মূর্তিতে ভরে উঠেছে হল। চারদিকে শুধু হাস্যময় রমণীদের কলকলে হাসির শব্দ। ভেসে আসছে মৃদু শব্দে গানের সুর। আবার কোথাও ভাসছে ফুলের ঘ্রাণ। চারদিক মুখরিত হয়েছে ফুলেল সুবাসে। হলের এক পাশে ফুলে সজ্জিত স্টেজে বসে আছে নব দম্পতি।
মিসেস জামান মেহমান এবং আত্মীয় স্বজনদের অ্যাটেন্ড করার মাঝে ফাঁকফোকরে মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন। মেয়ে টগরকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। মেয়ের মুখের হাসি বলে দিচ্ছে উনি উনার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন।
মিস্টার কবির আর ফারহান মিস্টার জামানের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। পুরনো সম্পর্ক আবারও ঝালাই করে নিচ্ছে তারা। পুরনো বান্ধবী হিসেবে মিসেস জামান,মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাতের মধ্যে ভালই সখ্যতা আছে। আবার তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যেও মোটামুটি যোগাযোগ আছে। টগর সানার সমবয়সী। NSU এর সিএসসি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার দিক দিয়ে সানার জুনিয়র কারণ মাঝে টাইফয়েডের ভুক্তভোগী হয়ে ক্লাস সেভেনে দুইবার পড়তে হয়েছে।
মিস্টার কবির আর অতসী আগেই চলে এসেছেন। মিসেস কায়নাত,জাপান আর সানাহ্ গেছে বিয়ের উপহার কিনতে। মিসেস কায়নাত মেয়ের বিয়ের কাজের মধ্যে পরে বান্ধবীর মেয়ের বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। সেদিন মিসেস জামান ফোন করে মনে করিয়েছিলেন বলেই উপহার কেনার কথা মনে পড়লো।
ফারহান কথার মাঝে বারবার হলের এন্ট্রান্স গেটের দিকে নজর দিচ্ছে। মনটা আনচান করছে এক পলক সানাহ্কে দেখার জন্য। এই প্রথম ফারহান সানাহ্কে একদম ভিন্নভাবে আবিষ্কার করতে চলেছে। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে তারা তাই স্বাভাবিক ভাবেই সানাহ্ অত্যন্ত সেজেগুজে আসবে। আর এই সাজই ফারহান দেখতে চেয়েছিল।
‘ হবু বউকে খুঁজছেন মিস্টার দুলাভাই ? ‘
ফারহান আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সানাহ্কে খুঁজছিল কিন্তু আচমকা ওর পিছন দিয়ে হুট করে এসে অতসী ওর কানের কাছে কথা বলায় চমকে উঠলো। বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে শূন্যে যেন থু থু ফেললো। অতসী দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর কান্ড কারখানা দেখছে। ব্যাপারটা ওর হাস্যকর লাগছে। ওর হবু দুলাভাই যে এতটা ভীতু হবে সেটা ওর জানা ছিলনা।
‘ এত অদ্ভুত অদ্ভুত নাম কোথা থেকে খুজে পাও তোমরা ? তুমি ডাকছো মিস্টার দুলাভাই। তোমার বোন ডাকে কবি সাহেব, মিস্টার কবি ব্লা ব্লা ব্লা। এরকম অদ্ভুত নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি কাউকে ডাকতে। ‘ নিজেকে খানিকটা সামলে ভরাট গলায় বললো ফারহান।
‘ বাপের জন্মে শুনেন নি ? তাহলে বউয়ের জন্মে শুনে নিন। অভ্যাস করে নিন। এখন থেকে এসবই শুনতে হবে। আফটার অল উই আর সাইয়ারা সিস্টার্স… ‘ কথাগুলো বলেই ফারহানের দিকে এক গা জ্বালানো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই গুনগুন করতে করতে চলে গেলো অতসী।
অতসী যেতেই ফারহান কিছু একটা বিড়বিড় করে মাথায় হাত রেখে চোখ দুটো খানিকটা বড় করে আবার স্বাভাবিক করলো। বুঝাই যাচ্ছে এদের দুই বোনের কাজে সে হতবাক প্রায়। যাহ বাবা আধা ঘন্টা তো হয়েই গেলো কিন্তু সানাহ্ যে এখনও এলো না। এতক্ষন লাগছে গিফট কিনতে ?
তবে ফারহানকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সানাহ্ এসে হাজির তার জাপান ভাই আর মাকে সঙ্গে করে। আসার সময় ওয়েডিং গিফটকে তার জায়গামতো দিয়ে এসেছে। ফারহানের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে অপরূপ সুন্দরী সানাহ্কে দেখে। সানাহ্ তার ইচ্ছার মান রেখেছে। তার দেওয়া শাড়িটাই পড়েছে।
বাঙ্গি কালারের পাকিস্তানি শিফন জর্জেট বারিশ শাড়ির সঙ্গে পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া লালচে ঘন লম্বা চুল যেন এক অন্যরকমভাবে মানিয়েছে। হাতে সিলভার রোলেক্স ওয়াচ আর কানে গলায় শোভা পাচ্ছে রেড স্টোন বসানো ডায়মন্ড লকেটের সেট। পরনে মিডিয়াম হিলের ব্ল্যাক শূ।
সানাহ্ কোনোকালেই তথাকথিত হাই হিলের স্টিলেটোতে ইন্টারেস্টেড ছিল না। প্রথমত তার হাইট মোটামুটি ভালোই বলে স্টিলেটো পড়লে তাকে অতিরিক্ত লম্বা মনে হবে। দ্বিতীয়ত স্টিলেটো পড়ে নিজের হাইটের চেয়ে লম্বা জাহির করা তার মোটেই পছন্দ না।
হলে এসেই মিসেস কায়নাত মিসেস আশা এবং মিসেস জামানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বহুদিন পর তিন বান্ধবী এক হয়েছেন। কথা যেন শেষ হতেই চাইছে না। সানাহ্ ওর মাকে তার বান্ধবীদের সঙ্গে এত হেসে হেসে কথা বলতে দেখে খুশি হলো। ওর মামনি চলে যাওয়ার পর থেকে ওর মা যেন হাসতেই ভুলে গেছে। সারাদিন শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। তবে আজ সে অনেকদিন পর মন থেকে হাসছে। শেষবার হেসেছিল যখন ওরা কয়েকদিন আগে রাতেরবেলা ঢাকা শহর ঘুরতে বেরিয়েছিল।
জাপান দেখলো সানাহ্ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর ফারহান সানার সঙ্গে কথা বলার জন্য হাসফাস করছে। জাপান মুচকি হেসে সানাহ্কে বললো ‘ তুই তোর মাকে দেখছিস আর ওইদিকে দেখ তোর হবু বর তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য রীতিমত তড়পাচ্ছে। যা গিয়ে কথা বল ভাইয়ার সঙ্গে। ‘
জাপানের কথার জবাবে সানাহ্ মিষ্টি হেসে ফারহানের দিকে এগিয়ে গেলো। ফারহান ততক্ষনে রুদ্র কল করায় ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সানাহ্ ফারহানের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ফারহানের কথা শেষ হওয়ার। ফারহান যখন তার কথাবার্তা শেষ করে ফোন পকেটে গুজলো তখন সানাহ্ গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে ইশারা করে দেখিয়ে চোখে চোখে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেমন লাগছে আমাকে ? ‘
ফারহান যেন এই কথার অপেক্ষাতেই ছিল। মুগ্ধ চোখে সানার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ বাংলা একাডেমি আপনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার মতো যথোপযুক্ত শব্দের আবিষ্কার এখনও করতে পারেনি উড বি মিসেস ফারহান। তবে আপনি আমার প্রেমমানিশা। হুম আমার প্রেমমানিশা, আমার অমানিশার মতো অন্ধকার জীবনে এক মুঠো প্রেম আপনি। এবার বুঝে নিন আপনাকে কেমন লাগছে। আমার চোখে তো আপনি সবসময়ই অনন্যা। ‘
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। সকলে গ্রুপে গ্রুপে যে যার যার পরিবারের সঙ্গে খেতে বসছে। ফারহানদের পরিবারও নিজেদের হবু বেয়াই পরিবার নিয়ে খেতে বসেছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে আরেক জায়গায়। সবার জায়গা হলেও জায়গা হয়নি ফারহান আর সানার।
গোল টেবিলে জনপ্রতি পাঁচজন করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই হিসেবে মিসেস আশা,মিসেস কায়নাত,মিস্টার কবির,অতসী আর জাপানের বসার জায়গা হলেও সানাহ্ আর ফারহানের হয়নি। সানাহ্ বেশ চিন্তিত এ নিয়ে। ফারহান উপায়ান্তর না পেয়ে বললো ‘ আন্টি আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি সানাহ্কে নিয়ে অন্য টেবিলে বসতে পারি। আর কোনো উপায় তো দেখছি না। সব ফুল হয়ে গেছে। ‘
‘ আরে না না কিছু মনে করার কি আছে। তুমি ওকে তোমার সঙ্গে নিয়েই আলাদা বসাও। বাবা তুমি একটু দেখতো ও ঠিকমত খায় কিনা। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তো সে অনেক গড়িমসি করে। তুমি একটু দেখেশুনে খাইয়ে দিও। ‘ মিসেস কায়নাত ফারহানকে অভয় দিয়ে বললেন।
নিজের মায়ের কথায় বিরক্ত হলো সানাহ্। কি দরকার ছিল ফারহানের সামনে এভাবে বলার ? না জানি ফারহান ওকে নিয়ে কি কি ভাবছে। ওই দেখো ওর জল্লাদ মায়ের কথা শুনে ব্যাটা বজ্জাত হাসছে। সানাহ্ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাত কিরমির করলো। ফারহান মিসেস কায়নাতের কথা শুনে সায় দিয়ে বললো ‘ না না আন্টি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে দেখেশুনেই রাখবো। ‘
ফারহান আর সানাহ্ বসেছে হলের একান্ত নিরিবিলি জায়গায়। এইদিকে মানুষের আনাগোনা কম। খাবার দাবারের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন লোক আছেন যিনি খাবারের দিকটা তদারকি করছেন। একটু পরপর হাকডাক করে সব খাবার হাজির করছেন লোক দিয়ে।
সানাহ্ গেছে বর বউয়ের ছবি তুলতে। এসব ব্যাপারে সে অনেক এক্সপার্ট। বিভিন্ন ওয়েডিং এর ফটোগ্রাফি করা তার হবি। সে বিয়ের ছবি জমাতে পছন্দ করে। তার ঘরের একটা অংশ জুড়ে আছে নানান লোকের নানান বিয়ের ছবি যাদের বিয়েতে হয় সে তার মা বাবার সূত্রে গেছে নয় বোনের সূত্রে গেছে। এই ব্যাপারটা ফারহান যখন লক্ষ্য করেছিল তখন অবাক ওয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ‘ এগুলো কাদের ছবি ? এত জোড়া কাপলের ছবি তোমার রুমে কেন ? ‘
সানাহ্ উত্তর দিয়েছিল ওয়েডিং ফাংশনের থিম ফটোগ্রাফি কালেক্ট করা আমার হবি। আই লাইক ইট। ফারহান সেদিন অবাক হয়েছিল কিন্তু সানার পছন্দকে সম্মান করেছি। এই অপার্থিব পৃথিবীতে অনেকেরই উদ্ভট পছন্দ থাকে। সানাহ্ও তাদের মধ্যে একজন।
সানাহ্ তার শখের ফটোগ্রাফি করে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। ফারহান তাকে বসিয়ে প্লেট উল্টে প্লেটটা হালকা লেবু পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নাপকিন দিয়ে মুছে তাতে পোলাও বাড়লো। সঙ্গে একটু কাবাব আর চিকেন রোস্ট দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে সানাহ্কে খেতে বলার উদ্দেশ্যে ওর দিকে ফিরতেই দেখলো সানাহ্ অলরেডি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সারাদিনের ধকলে সে ক্ষুধার্থ। ফারহান মুচকি হেসে নিজের পাতে খাবার বেড়ে খেতে বসল।
খুদার প্রকোপে প্রথমে খাবারের দিকে তেমন নজর না দিলেও ক্রমেই এসব তেলতেলে খাবার খেয়ে সানার শরীর খারাপ করছে। পরের টাকায় কেনা রসদ পেয়ে বাবুর্চি মন প্রাণ দিয়ে সব রান্নায় ঢেলে দিয়েছে। যার ফলপ্রসূ খাবার এখন তেলতেলে অখাদ্য ছাড়া কিছুই না। অথচ এই খাবারই শত লোকে কত তৃপ্তি নিয়ে ভোগ করছে। সানার ভাবতে অবাক লাগছে চিন্তাধারা আর রুচি একজন মানুষকে কতটা আলাদা করে দেয়।
‘ খারাপ লাগছে সানাহ্ ? খেতে পারছো না ? ‘
খেতে ব্যস্ত ছিল ফারহান। কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতে সানার দিকে ঘুরে বসলো। দেখলো সানাহ্ না খেয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে। ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ বললো ‘ খেতে পারছি না। বিবমিষা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এখনই পেটের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। সারাদিনের টায়ার্ডনেসের পর এসব অয়লি ফুডে মাথা চক্কর দিচ্ছে। এমনিতেই অয়লী ফুড আমার সহজে হজম হয় না। ‘
ফারহান এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। সানার প্লেট দেখে মনে হচ্ছে বড়জোর কয়েক লোকমা খেয়েছে। এখন বাড়ি ফিরেই ঘুমোবে। সারারাত থাকবে খালি পেটে। না খেয়ে খালি পেটে থাকাটা ঠিক না। কিন্তু খাবে কি করে ? খাবারের যে অবস্থা। ফারহানের নিজেরও খেতে ইচ্ছা করছে না।
‘ আচ্ছা থাক জোর করে খেতে হবে না। আমারও ভালো লাগছে না খেতে। সেন্টারে অনেক গরম লাগছে। চলো দুজনে বাইরে গিয়ে আইস্ক্রিম খেয়ে আসি। বাড়িতে ভাত আর সবজি আছে। দুজনে মিলে বাড়ি ফিরে খেয়ে নিবো। ‘ ফারহান প্লেটটা ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বললো।
‘ পাগল হয়ে গেলেন ? আমি আপনাদের বাড়ি কি করে যাবো ? কাল না আমাদের এনগেজমেন্ট ? মা যেতে দিবে নাকি ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। ফারহানের কথায় অবাক সে। বিয়ের আর মাত্র দুই দিন বাকি। এখন কি করে ওই বাড়ি যাবে।
‘ আচ্ছা যেতে হবে না। এখন তুমি বাইরে চলো। নিচে একটা শপ আছে। ওখান থেকে কোণ আইস্ক্রিম কিনে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে খাবো। হালকা শীতের আমেজে বরফ গলা আইস্ক্রিম খাওয়ার এক আলাদা মজা আছে। ‘ ফারহান বললো।
এবার আর ফারহানের কথায় আপত্তি করলো না সানাহ্। এমনিতেও তার কমিউনিটি সেন্টারের পরিবেশে ভীষণ মাথা ধরা ঝিমঝিম ব্যাথা করছে। বোধ হয় সে এখন দম বন্ধ করে মারাই যাবে। ফারহান সার্ভ করা লোকটার হাতে বকশিশের টাকা ধরিয়ে দিয়ে সানাহ্কে নিয়ে সকলের অগোচরে বেরিয়ে পড়লো রাত্রিবিলাস করতে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#প্রেমমানিশা(৩৩)
‘ তুমি আমাকে কখন থেকে পছন্দ করো সানাহ্ ? ‘
সানাহ্ আইসস্ক্রিম খেতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু ফারহানের কথা শুনে যেন নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না। খোলা আকাশ কাপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। ফারহান ওকে এভাবে হাসতে দেখে বললো ‘ আজব তো হাসছো কেন ? ‘
‘ তো হাসবো না ? আমি আপনাকে পছন্দ করি কে বললো ? ‘ সানাহ্ হাসতে হাসতে জবাব দিলো।
‘ পছন্দ করো না ? তাহলে বিয়ে করছো কেন ? তুমি না বলেছিলে আমার মত ছেলে পাওয়ার জন্য সব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে ? তুমিও কি সেই মেয়েদের মধ্যে পড়না ? ‘ ফারহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘ অবশ্যই আমি আপনাকে বিয়ে করছি কিন্তু সেটা আমার বাবা মায়ের পছন্দে। প্রথমত আমি বাবা মায়ের অবাধ্য খুব কমই হই আর দ্বিতীয়ত আমার ইচ্ছা ছিল মামনি আর বাবাইয়ের মত আমিও অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করবো। তাই আপনাকে বিয়ে করছি।
আর স্বপ্ন তো এমন কাউকে নিয়ে দেখা হয় যাকে আমাদের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর আপনি তো আমারই, আমাদের বিয়ে হচ্ছে। ইন ফিউচার আমরা একসাথে থাকবো। আমাদের আলাদা হওয়ার সম্ভাবনাও তো নেই। তাহলে আমি আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো কেন ? ‘ সানাহ্ তার আইসস্ক্রীম শেষ করে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসে বললো।
ফারহান পুরোটা সময় মনযোগ দিয়ে শুনলো সানার কথা। সানার এই অন্যরকম চিন্তাভাবনাই তাকে সানার প্রতি দিন কে দিন আকৃষ্ট করছে। সানার প্রতি আরও তৃষ্ণার্ত করে তুলছে। ফারহান কিছু বলার উদ্দেশ্যে তার ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। সানাহ্কে জিজ্ঞেস করলো ‘ তো তোমার কখনও ইচ্ছা হয়নি প্রেম করার ? ‘
‘ হবে না কেন ? অবশ্যই ইচ্ছা হয়েছে। ‘
‘ তাহলে প্রেম করলে না যে ? আমি তো শুনেছি তোমার আশেপাশে দিয়েও একটা ছেলেকে ঘুরতে অনেক বেগ পেতে হয়। ‘
‘ এই যে প্রেম করছি। আপনার কি মনে হয় আপনার সঙ্গে আমি এখানে মশা মারতে এসেছি ? এই খোলা আকাশের নিচে হাঁটতে হাঁটতে দুজনের একসঙ্গে আইসক্রিম খাওয়া কি প্রেম নয় ? রাতের আঁধারে মাঝ নদীতে সময় কাটানো কি প্রেম নয় ? সকাল সকাল কাউকে না জানিয়ে রেল লাইনে সময় কাটানো কি প্রেম নয় ? প্রেমই তো করছি আমরা। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর প্রেম করছি।
প্রেম করতে হলে যে সমাজের তথাকথিত প্রেম করতে হবে তার তো কোনো কারণ নেই। আমরাও যদি সবার মতো প্রেম করি তাহলে বাকিদের আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? আমাদের লাভ স্টোরি নাহয় হোক অন্যরকম। বিয়ের পর হালাল প্রেম করবো আপনার সঙ্গে। ‘ কথাগুলো বলে শূন্যে নিজের হাত তুলে পোস্টার লাগানোর ভঙ্গিমা করলো সানাহ্।
ফারহান সানার কথা শুনে কিছু বললো না। চোখ দুটো বুজে রাতের আঁধারে সানার হাতে হাত রেখে দুজনের মধ্যে থাকা নিরবতা অনুভব করতে লাগলো। দূর থেকে কোথাও ভেসে আসছে এই রাত তোমার আমার গানের মৃদু সুর। রাতের আঁধারে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে।
—-
বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সানাহ্কে তিন ঘণ্টা ধরে সাজাচ্ছে আয়না(আরাবের স্ত্রী) আর অতসী। এ নিয়ে সানাহ্ বেশ রাগারাগি করেছে। তার কথা হলো তাকে সাজ ছাড়া তো ফারহান হাজারবার দেখেছে তাহলে এখন সাজানোর মানে কি। কিন্তু অতসী আর আয়না ওর কথা শুনলে তো। তারা তো সাজাবেই আর এ নিয়েই বাড়ির উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আগেও ঝড় বয়ে গেছে।
মিসেস কায়নাত চিন্তায় চিন্তায় পায়চারি করছেন। ফারহানরা বেরিয়ে পড়েছে জানিয়েছেন মিসেস আশা। পাত্র পক্ষ থেকে লোকজন বলতে ফারহানের ফুপু মিসেস মারিয়া, ফুপাতো বোন নিনিকা, ফারহানের ছোট ভাই রুদ্র,ফারহান আর মিসেস আশা। ফারহানের ভাই রুদ্র আজ সকালেই হোস্টেল থেকে ফিরেছে। নিনিকা আর মিসেস মারিয়াও আজ সকালেই এসেছেন।
মিসেস মারিয়া আর নিনিকা সিয়াটলের বাসিন্দা। মিসেস মারিয়ার স্বামী মারা গেছেন বিয়ের চার বছর পরেই। তারপর থেকেই মিসেস মারিয়া তার মেয়েকে নিয়ে শশুর বাড়িতে থাকতেন। এই কয়েক বছর আগেই সিয়াটলে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে ভাতিজার বিয়ে উপলক্ষে সুদূর সিয়াটল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
ফারহানের এক দূর সম্পর্কের দাদু মানে ফারহানের দাদার বোন মিনার বেগম আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভদ্র মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে আর আসা হলো না। হয়তো সুস্থ হয়ে আসবেন নাত বৌকে দেখতে।
সানার দুই ফুপুরও আসার কথা ছিল কিন্তু তারা আসতে পারেননি। সানার বড় ফুপু সামান্য ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত অথচ এই টুকু ফিভারে আক্রান্ত হয়েই তিনি তুমুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন। উনার ধারণা উনি এখানে এলে উনার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই উনি ভাতিজির এনগেজমেন্টে এবং বিয়েতে আসার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়েছেন। সানার ছোটো ফুপু দিন দশেক আগে ওমরাহ করার জন্য সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন তাই উনিও আসতে পারেন নি। বস্তুত মহিলা নিঃসন্তান।
মিসেস আশা সম্পর্কে মিসেস কায়নাতের বাল্য সখী হলেও মিসেস কায়নাতের চিন্তার অন্ত নেই। তার একটাই ভয় বেয়াইনকে অ্যাপায়নে কোনো ত্রুটি যেন নাহয়। এর জন্য উনি বেয়াইনদের সর্বোচ্চ অ্যাপায়নের ব্যবস্থা করেছেন। মিসেস রাহেলা সিংজিকে(কুক) সঙ্গে করে রান্নাঘরে নুডুলসের পাকোড়া ভাঁজছেন। এছাড়া যেসব নাস্তার প্ল্যান করেছিলেন ওগুলোও রেডি করছেন।
মিস্টার আশরাফ ভাই আমানকে সঙ্গে করে ‘ Flora ‘ তে গেছেন। সানাহ্ বহু বাছ বিচার করে ফারহানের জন্য আংটি পছন্দ করেছে। তার পছন্দ মতেই ফারহানের জন্য প্লাটিনামের আংটি বানানো হয়েছে। মিস্টার আশরাফ আর মিস্টার আমান সেটাই আনতে গেছেন। ফিরতে সময় একবারে মিস্টার কবিরকে সঙ্গে করে ফিরবেন। জাপান আর আরাব বাইরে গেছে একটা জরুরি কাজে। মূলত মিসেস কায়নাতই ওদের পাঠিয়েছেন।
—-
ফারহানরা সানাহ্দের বাড়ি এসেছে আধা ঘন্টা হয়ে গেছে। নিনিকা তো এসেই সাথে সাথে পগারপার। ছুটেছে তার ফারহান ভাইয়ের বউকে দেখতে। ইতিমধ্যে ভাবির সঙ্গে সে বেশ রসালো আড্ডাও জমিয়েছে। ভাবির প্রত্যেকটা কথায়ই সে মুগ্ধ হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এই মেয়ে ভবিষ্যতে ভাবির অনেক বড় ফ্যান হতে চলেছে।
বাড়ির বড়রা সকলে একজোট হয়েছে। সকলে মিলে আড্ডা দিচ্ছে। মিসেস মারিয়া এসেই ভাতিজার হবু শাশুড়ির সঙ্গে গল্প পেতেছেন। মহিলা বেশ রসিক। কথায় কথায় ফারহান, রুদ্র আর নিনিকার ছোটবেলার গল্প বলে সবাইকে হাসাচ্ছেন। তবে এত সবকিছুর মাঝেও ফারহান একা। তার মনটা আকুপাকু করছে এক ঝলক সানাহ্কে দেখার জন্য। বারবার সিড়ির দিকে নজর দিচ্ছে।
প্রচন্ড উৎকণ্ঠায় ফারহানের গলা শুকাচ্ছে। বারবার সাধ জাগছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়ার। সেই সঙ্গে সানার প্রতি রাগও হচ্ছে। আধা ঘন্টা হয়ে গেছে সে এসেছে অথচ মেয়েটা একবারও এসে দেখে গেলনা। এত সাজার কি আছে ? এমনিতেই যা চোখ ঝলসানো রূপ তারপর যদি আরও সাজে তাহলে ফারহানের চোখের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ও পুড়বে। বিয়ের আগেই মেয়েটা এত অবহেলা করছে, বিয়ে হলে কি করবে ? ভেবে ভেবেই অস্থির ফারহান।
মিসেস রাহেলা সকলের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল ছিলেন। কিন্তু ফারহানের দিকে চোখ পড়তেই ফারহানের অস্থিরতা দেখে আন্দাজ করলেন ফারহানের পানি প্রয়োজন। উনি আড্ডা ছেড়ে উঠে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে ফারহানের সামনে ধরলেন। চোখের সামনে প্রার্থিত জিনিস দেখে ফারহানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ থ্যাংক ইউ ‘ জানিয়ে মিসেস রাহেলার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে খেয়ে নিল। মিসেস রাহেলা ‘ ইউর ওয়েলকাম ‘ বলে নিজের জায়গায় ফিরে আবারও কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
পানিটুকু শেষ করে সানাহ্ সময় কাটানোর উপায় খুঁজতে বের হলো মনের চোরাগলিতে। কিন্তু হাজার কাটাকুটি, ঘাঁটাঘাঁটির পরও যখন ভালো কোনো উপায় পেলো না তখন অগত্যা ফোন বের করে ফেসবুকিং করায় মন দিল। হঠাৎ সিড়ির দিকে নজর পড়তেই ফারহান থমকে গেলো। তার দামী অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভাগ্যিস কার্পেট বিছানো ছিল নাহলে ফারহানের শখের নতুন ফোন আজই অক্কা পেত।
এই মেয়েটা কি আজ ওকে মেরে ফেলার প্ল্যান করে এত সেজেছে ? বিদেশিনী এত রূপবতী হয়েও কেন এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরী সাজ দিয়েছে ? ফারহানের বুক তোলপাড় করছে। মনটা আনচান করছে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।
সানাহ্ নেমে আসছে সিড়ি দিয়ে। মনে হচ্ছে যেন ফুলে সজ্জিত সিড়ি দিয়ে কোনো এক অচিন রাজ্যের শুভ্র পরী নেমে আসছে। পরনে সাদার মাঝে ম্যাজেন্ডা পাড়ের কাতান শাড়ি। গলায় ও কানে পাথর বসানো সোনার গয়না। চুলগুলো মাঝে সিথি করে আলগোছে খোঁপা করা। এলোমেলো খোঁপা করা চুলে বাঁধা বেলি ফুলের মালা। এমন নারীকে দেখাও যেন এক নৈস্বর্গিক সুখ।
সানাহ্ নিনিকার হাত ধরে সাবধানে নামছে। শাড়িটা বেশ ভারী হওয়ায় তার সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। ওদের দুজনের পিছন পিছন আসছে অতসী আর আয়না। সানাহ্ শাড়ির কুচি এক হাতে ধরে আস্তে আস্তে নামছে। আড়চোখে একবার ফারহানের দিকে নজর দিল। সে বেচারা তো হবু বউকে দেখে ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেছে। বড় বড় চোখ করে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে সানার দিকে। সানার মুখ ফুটে প্রচন্ড হাসি আসতে চাইছে কিন্তু কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছে।
‘ আয় হায় ভাবী তুমি এ কাকে ছেলের বউ করলে ? আমাদের বউমা তো রুপে একেবারে লক্ষ্মী ‘ সানাহ্কে নামতে দেখে বসার ঘর থেকেই খোশ মেজাজে হেসে বললেন মিসেস মারিয়া।
মিসেস আশা ননদের কথায় হাসলেন। সানাহ্কে নিজের কাছে ডেকে বসালেন। সানার ললাটে স্নেহ মাখা চুম্বন করে বললেন ‘ আমার ছেলের বউ শুধু রুপে নয় গুণেও লক্ষ্মী। ফারহান অনেক ভাগ্য গুনে সানার মতো মেয়েকে তার স্ত্রী হিসেবে পাচ্ছে। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার ছেলেকে আমি যোগ্য পাত্রীর হাতেই তুলে দিচ্ছি। আমার পাগল ছেলেটাকে দেখে রেখো মা। হয়তো মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা কথা বলে তোমাকে রাগাবে কিন্তু সে মন থেকে তোমাকেই চায়, তোমাকেই ভালোবাসে। ‘
কথাগুলো বলে মুচকি হেসে সানার অনামিকায় আংটিটা পড়িয়ে সানার হাতে আলতো চুমু খান মিসেস আশা। আংটিটা সানার হাতে বেশ ভালই মানিয়েছে আর ঠিকমত বসেও গেছে। বড় একটা হিরের চারদিকে ছোট ছোট পান্না বসানো অভিজাত দেখতে আংটিটা। মিসেস আশা বললেন ‘ এই আংটিটা আমার মায়ের দেওয়া। মাকে দিয়েছিল আমার নানু। বংশানুক্রমে এই আংটি আমার মেয়ের পাওয়ার কথা কিন্তু আমার তো মেয়ে নেই। তবে এই আংটি দিয়ে আজ থেকে তোকে আমার মেয়ে করলাম সানাহ্। আংটিটাকে আগলে রাখিস মা। ‘
‘ আমি আংটিটা যত্নে রাখবো আম্মু। ‘ – সানাহ্
ফারহানের কোনোকালেই আংটি পছন্দ ছিলনা কিন্তু সদ্য হতে যাওয়া শশুরকে মুখের উপর না কি করে করে ? তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই শশুর মশাইয়ের দেওয়া আংটিটা নিতে হলো ফারহানের। তবে আংটিটা যেমন আশা করেছিল সেরকম না। সে ভেবেছিল তার শশুর হয়তো অবিবেচকের মতো তাকে সোনার আংটি দিবে। কিন্তু উনি সেটা করেননি। উনি নিজের অজান্তেই ফারহানকে তার মনমতো আংটি দিয়েছেন। ফারহানের বেশ পছন্দ হয়েছে আংটির ডিজাইন। অবশ্য পরে জানতে পারলো এই আংটি সানার পছন্দ। সানার প্রতি যা ভালোবাসা ছিলো তা যেন আরও এক ধাপ বেড়ে গেলো।
নানান হাসি, মজা, আড্ডায় সময় পেরিয়ে কখন যে ফারহানদের বিদায় নেওয়ার মুহুর্ত এসে হাজির হলো কেউ বুঝতেই পারলো না। যখন বুঝতে পারলো তখন ফারহানের মনে হায় হায় পড়ে গেলো। সবার মাঝে থেকে সানার সঙ্গে তো কথাই বলা হলো না। মেয়েটাও একবারের জন্য চেষ্টা করলো না ফারহানের সঙ্গে কথা বলার। সে দিব্যি হাসতে হাসতে তাদের বিদায় জানালো। ফারহান তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ গাড়ির পিছনের আয়না দিয়ে সানাহ্কে দেখা যায়। একসময় সানাহ্ আর তার পরিবার ধোঁয়াশার মতোই মিলিয়ে গেলো। আজ গাড়ি ড্রাইভার চালাচ্ছে বলেই সানাহ্কে আরও কিছুক্ষণ দেখার সুযোগ পেলো ফারহান।
বাড়ি ফিরেই ফ্রেশ হয়ে ঘরের দরজা চাপিয়ে বারান্দায় মুখ ভার করে বসলো। তার খারাপ লাগছে। বাড়ি ফিরেছে কমপক্ষে আধা ঘন্টা হতে চলেছে অথচ সানাহ্ এখন পর্যন্ত ফোন দিয়ে খোঁজ নিলো না সে ঠিকমত পৌঁছেছে কিনা।
ফারহানের অনেক অভিমান হলো। অভিমানের বশে কিছুক্ষণ পর সানাহ্ ফোন দিলেও সেই ফোন রিসিভ করলো না সে। ক্রমাগত কিছুক্ষণ ফোনটা বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। ফারহানের অভিমান আরও গাঢ় হলো। কেন মেয়েটা মাত্র কয়েকবার ফোন দিয়েই হার মেনে নিল ? ফারহানকে আরও কয়েকবার ফোন দিলেই তো সে ফোনটা ধরতো।
ফারহান রাতের অন্ধকারে অভিমান করা মেঘলা আকাশে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। একমাত্র এই সিগারেটই পারে সানার নেশাটা ভুলিয়ে রাখতে। তবুও অবাধ্য মন সানার কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন মন থেকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই আসে না। সানার নেশা বুঝি সিগারেটের নেশা থেকেও তীব্র।
ঘরের দরজায় করাঘাতের শব্দে ফারহানের ভাবনায় ছেদ ঘটলো। বারান্দার এক কোণে সিগারেট ফেলে পায়ে থাকা স্লিপার দিয়ে সেটা পিষে ফেলে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলতেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস আশা কানে ফোন হাতে নাক মুখ কুচকে ফেললেন। পুরো ঘর ভর্তি সিগারেটের গন্ধ। ফারহান এই সময় তার মাকে দেখে অবাক হলো। তার মা তো নিচে সবার সঙ্গে বসে প্ল্যানিং করছিলো ওদের বিয়ের দিন নিয়ে।
মিসেস আশা কিছুক্ষণ ফোন কানে নিয়ে দাড়িয়ে থেকে ফোনটা ফারহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘ নিজেদের মধ্যে মান অভিমান, রাগারাগি থাকলে সেটা নিজেরা মিটিয়ে নিবি। খামোখা রাগারাগি করে সিগারেট খেয়ে নিজেকে আর অন্যকে কষ্ট দিবি না। ‘
কথাগুলো বলেই ফারহানের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মিসেস আশা। ফারহান তার মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে ফোনের দিকে চোখ দিলো। ফোনের সানার নাম উঠে আছে ডিসপ্লেতে। তারমানে সানাহ্ তাকে না পেয়ে তার মাকে ফোন দিয়েছে। ফারহান আর কোনো কিছু না ভেবে ফোনটা কানে ধরে বারান্দায় চলে গেলো।
‘ ফোন ধরছিলেন না কেন ? ‘
‘ ফোন ধরলেই বা কি হতো ? একজনের কি আমাকে নিয়ে কোনো টেনসন আছে ? সে তো আপন খেয়ালে আছে। ‘ ফারহান খানিকটা অভিমানী গলায় বললো।
‘ হায় আল্লাহ কবি সাহেব আপনি এতটা অভিমানী ? আমি আবার কি করলাম ? আমি তো আমার দোষই জানিনা। অপরাধীকে তার দোষ না জানিয়ে শাস্তি দেওয়াটা কি অন্যায় নয় ? ‘ ফোনের ওই পাড়ে হাসতে হাসতে বলল সানাহ্।
‘ সবাই যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন আমার সঙ্গে বললে না কেন ? বাড়ি ফিরেও তো ফোন দিয়ে খোঁজ নিলে না। ‘
‘ সবার সামনে কি করে কথা বলতাম বলুন তো। আপনি ছেলে মানুষ তাই হয়তো লোকে আপনাকে নিয়ে কিছু ভাববে না কিন্তু আমি তো মেয়ে। আমি এরকম করলে লোকে অনেক কথা বলবে। তাছাড়া ফোন তো দিয়েছিলামই। আপনিই তো রাগ করে ধরলেন না। ‘ সানাহ্ মৃদু হেসে বললো।
‘ লোকে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। তোমার উচিত ছিল কোনো অজুহাত দিয়ে আমার সঙ্গে একা সময় কাটানোর। বিয়ের আগেই এমন করছো। বিয়ের পরে তো চোখেই দেখবে না। তুমি এতগুলো ভুল করার পরও যদি আমি তোমার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলি তখন কি সেটা অস্বাভাবিক হবে না ? ‘
‘ বুঝলাম মিস্টার কবির অভিমান হয়েছে। কিন্তু কবি সাহেব আপনি না ভাবলেও আমাকে যে ভাবতে হয়। ছেলেরা এমন অনেক কিছুই করতে পারে যেটা মেয়েরা করতে পারে না। তবে আই প্রমিজ এরকম আর হবে না। বিয়ের পর তো একেবারেই হবে না। এটা সানার পাক্কা প্রমিজ। ‘ সানাহ্ মিষ্টি হেসে বললো।
ফারহান কিছু বললো না। রাতের আঁধারে শুধু সানার অনেক না বলা কথা মন দিয়ে শুনতে লাগলো। ফোনের ওই পাড়ে থাকা রমণী হয়তো জানেও না ফারহান তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। সে তো ব্যস্ত নিজের কথা বলতে, নিজের না বলা কথাগুলো ফারহানকে জানাতে।
আর ফারহান ব্যস্ত রমণীর মিনমিনিয়ে বলা কথাগুলো শুনতে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….