#প্রেমময়_প্রদীপ
#পর্ব_৮
Saji Afroz
.
.
জ্ঞান ফিরতেই বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করলো সাফা ।
চারদিকে সবাইকে দেখে উঠতে চায়লো সে ।
.
তাইফ বলল-
শুয়ে থাকো । রেস্ট নাও সাফা ।
.
তাইফের কথা শুনে সাফা উঠলো না । তার সাথে কি ঘটে গিয়েছে মনে পড়তেই বুকটা কেপে উঠলো ।
এখানে কিভাবে এলো সে?
ভাবতে ভাবতে তার মা এসে উপস্থিত হলেন । মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে দেখে, পাশে বসে কেঁদেই ফেললেন তিনি ।
.
তনিমা তাকে শান্তনা দিয়ে বলল-
আন্টি শান্ত হোন । সাফা সুস্থ আছে ।
.
সাফার বাবা এসেও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন ।
সাফার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রেমকে । সে ছাড়া ওই অবস্থা থেকে তাকে কেউ উদ্ধার করার ছিল না । সম্ভবও ছিলনা এটা ৷ তবে কি প্রেম তার দ্বিতীয় ইচ্ছে পূরণ করেছে?
.
সামিনা রশিদ কাঁদতে কাঁদতে বললেন-
কলেজ ফাঁকি দিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল তোর? আর সবাই বের হয়ে গেলেও তুই কেন হতে পারলি না! ভাগ্যিস তাইফ ছিল । বাঁচিয়ে নিয়েছে তোকে ।
.
কথাটি শুনে তাইফের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো সাফা । সত্যিই কি তাইফ বাঁচালো তাকে!
.
তাইফ কিছু বলল না । চুপচাপ বসে রইল ।
সাফা তাইফকে ধন্যবাদ জানিয়ে মায়ের হাত ধরে বলল-
সরি মা । আর কখনো তোমাকে না জানিয়ে কোথাও যাব না ।
.
মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে সামিনা রশিদ বললেন-
তোমরা বসো । আমি খাবারের ব্যবস্থা করি ।
.
সামিনা রশিদ বেরিয়ে যেতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো সাফা ।
.
তনিমা তার পাশে বসে বলল-
সরি সাফা । হঠাৎ আগুন দেখে আমরা সবাই ঘাবড়ে যাই । মাথায় কাজ করছিল না কি করব । সবাইকে ছুটতে দেখে আমরাও ছুটে বেরিয়ে যাই । যখন তোর কথা মনেপড়ে, অনেক দেরী হয়ে যায় ।
.
তনিমাকে থামিয়ে সাফা বলল-
এসব ঠিক আছে । কিন্তু
আমাকে তাইফ বাঁচায়নি । তবে মাকে মিথ্যে কেন বললি তোরা?
-তবে কি বলব? তুই হাওয়ায় ভেসে এসেছিস?
-মানে?
.
তনিমা সাফাকে সবটা খুলে বলতেই সে মুচকি হেসে বলল-
তার মানে আমাকে প্রেম বাঁচিয়েছে ।
.
সকলে তার দিকে ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে সে বলল-
আমি জানি তোরা কিছু বুঝতে পারছিস না । ওকে আমিই বুঝিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু এই কথা যেন আমাদের মাঝেই থাকে ।
.
তারা সাফাকে আশ্বাস দিলো, এই কথা তাদের মাঝেই থাকবে ।
.
সাফা বলতে শুরু করলো-
বান্দরবান নাফাখুমে আমি একটি প্রদীপ পাই ৷ যেটি আমি বাসায় নিয়ে আসি ৷ এক রাতে প্রদীপ ঘষতেই একজন হ্যান্ডসাম ছেলে বেরিয়ে আসে ৷ সে জানায় আমার তিনটি ইচ্ছে পূরণ করবে সে । প্রথমে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনি । কিন্তু প্রদীপ ঘষতেই তাকে পেতাম আমি । তাকে একটি ইচ্ছের কথাও জানাই । বরিশালের শাপলা বিল দেখার ইচ্ছে পোষণ করি । সে আমার ইচ্ছে পূরণ করে । এরপর এই যে দ্বিতীয় ইচ্ছেতে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম । সেই আমাকে বাঁচিয়েছে ।
.
রাইমা বলল-
তার মানে তুই আমাদের সত্যি বলেছিলি!
-হ্যাঁ । তোরাই বিশ্বাস করলিনা । আজ হলো তো বিশ্বাস?
.
উপস্থিত সকলের সাফার কথা বিশ্বাস না করেও উপায় ছিল না । তারা নিজের চোখে দেখেছে, সাফা হাওয়ায় ভেসে এসেছে!
সবটা শুনে তারা বেশ অবাকই হলো ।
.
তাইফ প্রশ্ন করলো-
প্রেম দেখতে কেমন?
-প্রেম? এমন সুদর্শন ছেলে আমি আমার লাইফে দেখিনি । টকটকে ফর্সা রং গায়ের, ঘন কালো চুল, গোলাপি ঠোঁট! ছেলেরাও তাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে বসবে ।
.
সাফার মুখে প্রেম সম্পর্কে এসব শুনে ভালো লাগলো না তাইফের । আজ যদি সে সাফাকে রেখে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে না আসতো, তবে হিরোটা সেই হতে পারতো ভেবে আফসোস হচ্ছে তার ।
.
শফিকুল তাইফের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল-
প্রেম নিশ্চয় তিনটে ইচ্ছে পূরণ করার পর চলে যাবে ?
.
সাফা মুখটা ফ্যাকাসে করে বলল-
যদি না যেত….
.
আর কিছু বলতে চেয়েও বলল না সাফা ।
সব কথা সবাইকে জানানোর প্রয়োজনটায় বা কি!
.
.
রান্নাঘরে খাবার তৈরী করতে করতেও কেঁদে চলেছেন সামিনা রশিদ । ফারুক রশিদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
এখনো কান্না থামেনি আমার মিসেস এর!
-ছাড়ো এখন । রোমান্সের মুড নেই আমার ।
-কিসের মুড আছে শুনি? কান্না করে রান্নাঘর ভাসিয়ে দেয়ার?
.
তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সামিনা রশিদ বললেন-
গ্যাস পাইপ লিক হয়ে কিচেন থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল । আমাদের সাফার সাথে খারাপ কিছু হতে পারতো । আমি কিভাবে স্বাভাবিক থাকি বলো?
-কিছু হয়নি, তাই থাকবে ।
-কিন্তু…
.
তাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে বুকে টেনে নিলেন ফারুক রশিদ ।
.
সামিনা রশিদ বললেন-
তোমরা দুজন ছাড়া আর কেইবা আছে বলো আমার জীবনে! তোমাদের কিছু হলে আমি বাঁচতে পারব না ।
-কিছুই হবেনা । এবার শান্ত হও প্লিজ ।
-হুম ।
.
.
বন্ধু-বান্ধবরা চলে যেতেই সাফার পাশে আসলো প্রেম ।
সাফা বিছানার পাশে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে পড়লো । আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
আপনি না থাকলে আজ আমার কি যে হত! আমি তো আজ মরেই যেতাম ।
.
এদিকে সাফার এমন কান্ডে প্রেমের বুকটা ধড়ফড় করে উঠল । বাস হঠাৎ ব্রেক করলে যাত্রীদের অবস্থা যেমন হয়, প্রেমের কলিজার অবস্থাও ঠিক তেমনি এখন । এই বুঝি তার কলিজাটা বের হয়ে এলো! পুরো শরীর কাঁপুনি দিতে থাকলো তার ।
সাফা নিজের কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে তাকে ছেড়ে বলল-
আমি সরি । আসলে…
-ইটস ওকে ।
-ভাগ্যিস আজ আপনাকে প্রদীপের মাঝে পাঠাইনি । তবে তো আজ আমি শেষই হয়ে যেতাম!
-আপনাকে আমি শেষ হতে দিতাম না । প্রদীপ থেকে চলে আসতাম নিজে নিজেই ।
-কিন্তু আপনি তো মানুষের ইচ্ছে পূরণ করা ছাড়া কিছুই করেন না ।
-নিজের ইচ্ছে বলেও একটা কথা আছে ম্যাডাম ।
-তাই! আমি বিপদে পড়লে আপনি বুঝতে পারতেন?
-উহু ।
-তবে যে বললেন?
-মজা করলাম ।
-ওহ তাই বলেন ।
-হুম ।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাফা বলল-
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
-আমি থাকলে বন্ধুদের সাথে কথা না বলে আমার সাথেই বলতেন । তাই সময় দিয়েছি । আমি তো আছিই ।
-বাহ! এত কিছু বুঝেন আপনি?
-হুম, তাই তো আমি আর আপনার মাঝে তফাৎ আছে ।
-যেমন?
-যেমন আমি স্বাভাবিক কেউ নই । এসব ছাড়ুন আপনি রেস্ট নিন । শুয়ে পড়ুন তো ।
.
সাফাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে প্রেম বলল-
আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছে পূরণ হয়েছে । আর একটি ইচ্ছে বাকি রয়েছে ৷ তারপরেই আমার মুক্তি ।
-হু ।
-এবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন ।
-আপনি থাকবেন প্লিজ আমার পাশে একটু?
-হ্যাঁ আছি আমি ।
.
সাফার ডান হাতের উপরে নিজের এক হাত রাখলো প্রেম ।
পরম আবেশে সাফা চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো । বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার ।
.
.
তাইফের সাথে তার বাসায় এসেছে শফিকুল। তাইফের মনের অবস্থা তার অজানা নয় ।
.
শফিকুল তবুও বলল-
কি ভাবছিস?
-আজ আগুন টা না লাগলে সাফার উত্তর টা পেতাম ।
-সে তোকে পছন্দ করে । এত ভাবছিস কেন?
-তবে এতদিন জানায়নি কেন?
-মেয়েরা এমনি । সহজে ধরা দিতে চায়না । তবে তুই কি ওকে সত্যিই ভালোবাসিস?
.
ভ্রু জোড়া কুচকে তাইফ উল্টো প্রশ্ন করলো-
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আজ আমাদের কারোই ওর কথা মনে ছিল না । তোর অন্তত থাকা জরুরী ছিল । প্রেম না থাকলে আজ অঘটন ঘটে যেত ।
-প্রেম! এই প্রেমের কথা শোনার পর থেকেই মনে অশান্তির ঝড় বয়ে চলেছে আমার ।
-কেন?
-সাফা যদি প্রেমের প্রেমে পড়ে?
.
শফিকুল হাসতে হাসতেই বলল-
তোর মাথা ঠিক আছে? প্রেম আমাদের মতো মানুষ নই । সাফা তার প্রেমে কিভাবে পড়তে পারে! তুই অহেতুক চিন্তা করছিস । এত ভাবিস না ৷ শরীর টা ভালো হলেই সাফা জানাবে দেখিস, সেও তোকে ভালোবাসে ।
-হুম ।
.
শফিকুলকে আর কিছু বলল না তাইফ । তবে তার অশান্ত মন শান্ত হয়নি এখনো । ততক্ষণ হবেনা, যতক্ষণ না সাফাও তাকে ভালোবাসে জানাবে ।
.
.
ঘুমের মাঝে কিসব আবুল তাবোল বলে যাচ্ছে সাফা । প্রেম তা শোনার চেষ্টা করতে লাগলো । তখনি সাফা এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-
আমি বের হতে চাই এখান থেকে, বের হতে চাই ।
.
প্রেম বুঝতে পারলো সে ভয় পেয়েছে । তখনের ঘটনাটি ভুলতে পারেনি ।
প্রেম সাফার পাশে বসে নিজের কাঁধে সাফার মাথাটা রেখে বলল-
আমি আছি তো! শান্ত হও।
.
নিশ্চুপভাবে প্রেমের কাঁধে নিজের মাথা রেখে চোখ বুজে রইল সাফা ।
.
সামিনা রশিদ এসে বললেন-
সাফা? খুনীকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে । এবার এসব খুন বন্ধ হবে ।
.
চলবে