#প্রেমসরনী,#পর্ব ৪
#নাজমুন_বৃষ্টি
নিহির ঘুমন্ত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহান। দেশে আসার পর থেকে তার নিহুকে ভালোভাবে দেখায় হয়নি। আজ সাতবছর পর তার নিহুকে সে প্রানভরে দেখছে। মুখটা আর আগের মতো নেই, একদম শুকিয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নিহুর সেই আগের চঞ্চল রূপটাও মিলিয়ে গেল। রাহান নিজেই পরম যত্নে নিহির মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। পাশেই রেহেনা খালা কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে নিহির পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর রাহানের পাশে পারভীন বেগম দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছে। একটু দূরে দরজার পাশে তিশা ‘কিছুই হয়নি’ এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে। পারভীন বেগম বুঝতে পেরেছে এসবকিছু তিশার কারণেই হয়েছে। অন্যসময় তিশার এসব কাজের জন্য পারভীন বেগম খুশি হলেও আজ যেন খুশি হতে পারছে না কারণ আজ রাহান আছে, আর সে নিজেই পরম যত্নে নিহিকে কোলে নিয়ে রুমে এনে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো যা পারভীন বেগম সহ্য করতে পারছে না। এতদিন মনে মনে যেটার ভয় পেয়েছিলো আজ তার নিজের মেয়ের কারণে সেটাই হলো। পারভীন বেগম তিশার দিকে কিছুসময় পর পর রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করছে।
-‘রাহান বাবা, নিহি তো ঘুমাচ্ছে। আমি আছি ওর সাথে। তুই রুমে গিয়ে রেস্ট কর।’
-‘মা, নিহি সিঁড়ি থেকে কীভাবে পড়লো?’ রাহান নিজের রাগ যথাসম্ভব সংযত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো।
রাহানের কথা শুনে পারভীন বেগম আর তিশা দু’জনের পিলে চমকে উঠলো। তারা মোটেও এমন কিছু ভাবেনি- যে রাহান এমন প্রশ্ন করবে।
-‘হহ্হ..হয়ত সি..সিঁড়ি মুছতে মুছতে পানি পড়ে ওখানে ওর পা পিছলে পড়েছিল।’ পারভীন বেগম রাহানের প্রতিত্তরে আমতা আমতা করে কোনোমতে বলে উঠলো।
-‘মা, নিহির জ্বর ছিল আর এখনো আছে। সেই অবস্থায় তুমি ওকে সিঁড়ি মুছতে দিয়েছিলে?সকালে বোধহয় নিহিকেই গালিগুলো দিচ্ছিলে তুমি!’
রাহানের কথায় পারভীন বেগম আমতা আমতা করতে থাকলো।
-‘বাবা, তুই ভুল বুঝছিস আমি তো,,,’
রাহান পারভীন বেগমকে কথাগুলো শেষ করতে না দিয়ে রেহেনা খালার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘খালা, নিহিকে দেখে রেখো। আমি ড্রেসিং টেবিলের উপর আরেকটা ওষুধ রেখেছি ঐটা খাবারের পর খাইয়ে দিও নিহিকে। এই বাড়িতে অন্তত তোমার উপর ভরসাটা আছে।’ রাহান আড়চোখে তার মা পারভীন বেগমের দিকে তাকিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে নিহির দিকে আরেক ফলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিশার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। তিশা ভাইয়ের এমন রাগী চেহেরা দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইলো। তার মানে কী..! নিহি পড়ে যাওয়ার সময় তিশার হাসিটা রাহান ভাইয়া দেখে ফেলেছে! তিশা আর কিছু ভাবতে পারলো না।
রাহান রুমে গিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে রইল। সে নিহিকে কোলে করে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দেওয়ার পরে নিহির হাতে ফুটন্ত তেলের দাগ দেখেছিলো – যেগুলো মাত্র কিছু-সময়ের মধ্যে পড়েছে এমন। সকালেই মেয়েটা হাত চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় রাহানের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। তখনো মেয়েটা কান্নারত অবস্থায় ছিল। তার অজান্তে তার ছোট্ট পরীটা কী অনেক কষ্ট পাচ্ছে! রাহান আর কিছু ভাবতে পারলো না।
.
.
বিকেলের দিকে নিহি চোখ খুলতেই আবছা আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পেল কেউ একজন তার দিকে ঝুকে তাকিয়ে আছে। নিহি এটা তার চোখের ভ্রম ভেবে উঠতে নিলেই সামনে ঝুঁকে থাকা মানবটার মাথার সাথে কপালের ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় ‘আহ’ করে কপাল চেপে ধরল। নিহি এইবার বুঝতে পারলো এটা তার ভ্রম নয়, বাস্তবেই রাহান ভাইয়া তার রুমে তারই সামনে বসে আছে। নিহির তৎক্ষণাৎ চাচির কথা মনে পড়লো যে চাচি বলেছিলো নিহি যেন রাহানের আশেপাশে না যাই কিন্তু এখন তো স্বয়ং রাহান ভাইয়াই তার রুমে! চাচি দেখতে পেলে নিহির আর রক্ষা নেই ভেবে নিহি দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে রুমের দরজা খুলে আশেপাশে উঁকি দিয়ে এসে রাহানের সামনে দাঁড়ালো।
-‘ভাইয়া, আপনি আমার রুমে! কিছু কী লাগবে? লাগলে তাড়াতাড়ি বলে চলে যান প্লিজ আমি পাঠাচ্ছি।’ নিহি মাথা নিচু করে মিনিমিনিয়ে বলল।
রাহান এতক্ষন ধরে নিহিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়েটি কী পাগল হয়ে গেল না-কি! শোয়া থেকে উঠে রুমের দরজার আশেপাশে কী দেখছে! আজিব! এখন আবার বলছে চলে যেতে। রাহান মূলত এসেছিলো রেহেনা খালার কাছ থেকে নিহির জ্বর আবারো বাড়ার কথা শুনে। এমন কেন করছে নিহু!
-‘আরে রিলাক্স নিহুপাখি। আমার কিছুই লাগবে না। আমি তোর জ্বর আর আসছে কী না দেখতে আসছি।’ রাহান শান্ত-দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
‘নিহুপাখি’ ডাকটা নিহির কর্ণগোচর হতেই সে মাথা উঁচু করে রাহানের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখ এক জায়গায় নিবদ্ধ হলো। ফলে নিহি দ্রুতই চোখ নামিয়ে ফেলল। এই চোখের দিকে তাকানোর সাহস নিহির নেই। এই চোখের দিকে তাকালেই নিহি বাস্তবতা ভুলে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে বহুদূর। কতদিন পর এই ডাকটা শুনলো নিহি তা ভাবতেই মনের ভেতর খুশির জোয়ার বয়ে চলল। এই ‘নিহুপাখি’ ডাকটা শুধুমাত্র রাহানই ডাকতো। নিহি মনে করেছিল আর সেই ভালো লাগার ডাকটা শুনতে পারবে না কিন্তু না! আজ আবারো শুনলো। রাহান ভাইয়া নিহিকে এখনো মনে রেখেছে।
-‘আচ্ছা, আমি যাই নিহু। তুই মেডিসিন ঠিকমত নিস্। আমি রেহেনা খালাকে তোর জন্য খাবার আনতে পাঠিয়েছি নিচে , ঐগুলো আনলে খেয়ে নিস্। আমার কাজ আছে। নিচে যাস না, তোর কাজ করতে হবে না, রেস্ট কর।’ এই বলে রাহান নিহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
নিহির হঠাৎই মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্ত রাহানের ‘নিহুপাখি’ বলার জায়গায় নিহু বলাতে মনটা একটু খারাপ হলেও এতদিনের প্ৰিয় মানুষটা তার মতো ক্ষুদ্র মানুষটাকে মনে রেখেছে ভেবেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। রাহান ভাইয়া বদলে যায়নি, আগের মতোই আছে।
কারো ধাক্কাতে নিহির হুশ ফিরে। সে সামনে তাকিয়ে দেখলো রেহেনা খালা খাবারের প্লেট নিয়ে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে।
-‘আরে খালা যে! তুমি কখন এলে!’
-‘তোর কল্পনার রাজ্যেতে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এসেছি। এইবার বল কী এতো ভাবছিস। আজকে এতো খুশি খুশি ক্যান লাগছে?’ রেহেনা খালা প্লেটটা থেকে নিহির মুখে খাবার খাইয়ে দিতে দিতে বলল।
-‘আরে তেমন কিছু না খালা। আচ্ছা তখন কী হয়েছিল? আমি তো আমার ধারণা অনুযায়ী এতক্ষনে মারা যাওয়ার কথা!’ নিহি খাবার চিবাতে চিবাতে বলল।
-‘আরে দূর পাগলী! সিঁড়ি থেকে পড়লে কী কেউ মারা যায়! তুই পিচ্চিই রয়ে গেলি এখনো নিহি।’
-‘আরে বলো না খালা!’
-‘তুই মাত্র সিঁড়ির কয়েক ধাপ পড়েছিলি নিহি। রাহান ধরে কোলে নিয়ে ফেলেছিল তোকে। তাই কিছু হয়নি, একটু কপালে কাঁটা গিয়েছিলি তাও রাহান ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।’
রেহেনা খালার কথা শুনে নিহির মনে আবারো খুশির জোয়ার বইতে লাগলো। লজ্জা লজ্জাও লাগছে। সে তার রাহান ভাইয়ার কোলে ছিল! ইসস! যদি সেন্স থাকতো তাহলে তো নিহি বুঝি লজ্জায় মরেই যেত!
-‘শাকচুন্নি, তুই এখানে বসে বসে গিলছিস। আর ঐদিকে আমার তিশা মামনি দুপুর থেকে না খেয়ে আছে সেই ভাবনা কী আছে তোদের!’ পারভীন বেগম কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলে নিহির দিকে তেড়ে আসতেই নিহি ভয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
-‘আর রেহেনা তোরে যেন নিহির আশেপাশে আর না দেখি। নিচে যা তুই।’
রেহেনা মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
-‘আমার মেয়ের জন্য গরম গরম রুচি আর চিকেন মাসালা করে নিয়ে আয় নিহি। পুরো দিনই তো রুমেই কাটালি, এইবার বের হো।’
নিহি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে নিচে রান্নার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুসময় পর রাহান সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিলেই নিহিকে রান্নাঘরে রুচি ভাজতে দেখে তার মাথা মুহূর্তের মধ্যে খারাপ হয়ে গেল। সে যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দিয়েছিলো যাতে নিহি রেস্ট করে কিন্তু মেয়েটা,,! রাহানের কথাকে মূল্যই দিল না।রাহান নিহির দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে রুমে গিয়ে আওয়াজ করে দরজা আটকে দিল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।