#প্রেমসরনী#পর্ব ৬
#নাজমুন_বৃষ্টি
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ শহরটা ব্যস্ত শহরে পরিণত হলো।
নিহি সকালেই ঘুম থেকে উঠে রেহেনা খালার সাথে হাতে হাতে কাজ শেষ করে ফেলেছে।
আজ পারভীন বেগম রান্নাঘরে এসে কোনো কিছু নিয়ে চিল্লাচিল্লি করতে পারে নি কারণ নিহি সব কাজই অতিদ্রুত শেষ করে ফেলেছে। আজ নিহির কলেজে ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে। ফাইনাল এক্সামের আর মাত্র কয়েকমাস আছে তাই এখনের ক্লাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নিহি ক্লাস করার জন্য কলেজে যেতেই পারে না। যেতে পারে না বললে ভুল হবে আসলে চাচি চায় না নিহি পড়াশোনা করুক। ধরতে গেলে তিশা আর নিহি সমবয়সী। তিশা পড়ালেখায় ভালো না সবসময় পরীক্ষায় খারাপ করেই আসে অথচ প্রতিদিনই তিশা ক্লাস আর প্রাইভেট যায় কিন্তু তবুও খারাপ করে আর অপরদিকে নিহি তিশার বিপরীত। সে মাঝে মাঝে ক্লাস করেই পাস করে ফেলে। নিহি যতবার ক্লাসে যায় তিশাকে একবারই দেখেনি, অনেকের কাছ থেকে শুনে তিশা একদিনও ক্লাস করে না কিন্তু চাচিকে ক্লাসের কথা বলে প্রতিদিনই বের হয়। নিহি ক্লাস শেষ করে আসার সময় রাস্তায় মাঝে মাঝে তিশা কোনো একটা ছেলের সাথে দেখতে পায়। এতে নিহি যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। নিহি অতটাও অবুঝ নই – এর পরবর্তী ফলাফল কতটুকু ভয়ানক হতে পারে সেসব ভেবে নিহি কয়েকবার তিশার কথা চাচিকে বলেছে কিন্তু চাচি উল্টা নিহিকে এসবের দোষারোপ করেছে। চাচি বলেছে- তার মেয়ে এমন কখনোই হবে না,উল্টা নিহিই না-কি এমন অথবা তিশাকে হিংসা করে এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছে। নিহি চাচিকে প্রমান দিতে চাইলে উল্টা চাচির কাছ থেকে চড়-থাপ্পড় খেত। এরপর থেকে নিহি বলতে চাইলেও আর কিছু বলে না। তিশার সাথে সম্পর্ক ছেলেটাকে নিহি অন্য মেয়ের সাথে দেখেছিল ঠিক তিশার সাথে যেভাবে চলাচল করতে দেখেছিল। নিহি তিশাকে অনেক বার বোঝাতে চাইছিলো কিন্তু তিশা পরেরদিন ক্লাসে নিহিকে সবার সামনে যা নয় তা অপমান করেছিল। তখন নিহিকে নিয়ে সম্পূর্ণ ক্লাসে হাসির রোল পড়েছিল। নিহির মাঝে মাঝে তিশার জন্য মায়া হয় – মেয়েটা না বুঝে কতটা ভয়ানক পথে পা দিয়েছে এই ভেবে। চাচা সবসময় ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে যার কারণে এসব জানে না, চাচা মাঝে মাঝে বাসায় আসলে নিহি অনেকবার চাচাকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু চাচি নিহিকে সেই সুযোগ দেয়নি যার ফলে চাচার সাথে একা কথা বলারও সুযোগটা নিহি হারিয়ে ফেলেছে। চাচা নিহি আর উনার মাঝে কথা বলার সময় বেরিয়ে যেতে বললে চাচি রুমের বাইরে বেরিয়ে দরজার সাথে সবকিছু শুনে থাকত – এসবকিছু নিহি বুঝতে পেরেছিল যার ফলে চাচা নিহিকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও নিহি চাচা বাসার বাইরে যাওয়ার পর এর পরিণতি কী হতে পারে ভেবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতো না। আর রাহান ভাইয়া দেশে আসছে মাত্র কয়েকদিন, উনি এমন কিছু জানার কোনো চান্সই পায় নাই। নিহির এসবকিছু ভেবে তিশার জন্য মাঝে মাঝে ভীষণরকমের আফসোস হয়।
নিহি আর কিছু না ভেবে চাচি আর তিশাকে নাস্তা দিয়ে রুমে ঢুকে কলেজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গেল।
-‘চাচি আমি একটু কলেজ যাচ্ছি। একটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।’
-‘মাসে মাসে তোর এতো কলেজের জন্য মন উতলা ক্যান হয়ে যায়? কী আছে ওই কলেজে?’চাচি নিহিকে নিচে থেকে উপরে একবার পরক করে নিয়ে সন্দীহান কণ্ঠে বলল।
‘আমাকে এতো জেরা না করে আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর আরো সুন্দরভাবে পাবেন’ নিহির ইচ্ছে হলো এই কথাটা মুখ ফুটে বলতে কিন্তু কথাটা বলার পর নিহির গালটা আর গালের জায়গায় থাকবে না তাই মনের কথা মনেই রয়ে গেল।
-‘কী হলো? কিছু বলছিস না ক্যান?’ চাচি আবারো সন্দীহান কণ্ঠে নিহিকে উদ্দেশ্যে করে বলল।
– ‘ মা, তুমিও না বুঝো না? ইম্পরট্যান্ট ক্লাস বলছে নিহি। ভাবতে পারছো বিষয়টা? কী এমন ইম্পরট্যান্ট ক্লাস, নিহি?’ তিশা টিটকারি সুরে নিহিকে উদ্দেশ্যে করে কথাটা বলে হেসে দিল।
‘তুই ক্লাসই করিস না, জানবি কেমনে টিশু, তুই তো তোর প্রেমের তালে তালেই থাকবি। যখন প্রেমে চ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে পরীক্ষায় ডাব্বা মারবি তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।’ নিহি আপন মনে মাথা নিচু করে হেসে বিড়বিড় করে বলল। এখন আর এসব কথা গায়ে মাখে না। সরাসরি জবাব দিতে না পারুক অন্তত মনে মনে হলেও এসবের জবাব দিয়ে মনের শান্তি মিটুক। মন শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।
-‘এই মেয়েটার আজ কী হয়েছে। আমাদের কোনো কথারই জবাব দিচ্ছে না। বেশি বাড় বেড়েছিস তুই। তোকে তো আমি,,,’ এই বলে পারভীন বেগম নিহিকে থাপ্পড় মারতে গেলেই কেউ একজন এসে পারভীন বেগমের হাত ধরে ফেলল।
নিহি তো মার খাওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করে প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল কিন্তু এতো দেরি হয়ে যাওয়ার পরেও গালে কোনো থাপ্পড়ের অনুভব না হওয়ায় আস্তে আস্তে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখতে পেল- তার সামনে রাহান ভাইয়া পারভীন বেগমের নিহিকে থাপ্পড়ের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আটকে ধরে উনার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-‘আ,,,আ,, রে বা,,বা তুই!’ পারভীন বেগম আমতা আমতা করে মুখে কোনোমতে হাসির রেখা টেনে রাহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
রাহানকে এই অবস্থায় দেখে তিশা তাড়াতাড়ি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
-‘মা, তোমার এই অসভ্যতামি দিন দিন বেড়েই চলেছে। তুমি নিহুর গায়ে হাত তুলতে পারো না। এই বাড়িতে আমাদের যেমন অধিকার আছে সেই সমান অধিকার নিহিরও আছে। এই বাড়ির অর্ধেক আমাদের শাহেদ চাচার অর্থাৎ নিহির। ধরতে গেলে তুমি ওরই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওকেই মারতে আসছো। নিহি চাইলে তোমার এসবের প্রতিবাদ করতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি, কারণ সে তোমাকে সম্মান করে। বাবাই নিহি আর তিশা দুজনকেই একসাথে কোচিংয়ে দিয়েছে কিন্তু তুমি নিহিকে যেতে দাওনি। কেন মা? যদি আজ নিহির জায়গায় আমাদের তিশা থাকতো? ওকেও যদি কেউ এভাবে নিহির মতো হাঁটতে-বসতে অত্যাচার করতো তাহলে তুমি ভাবতে পারছো তোমার কেমন লাগতো? একটু মন থেকে ভাবো মা। নিহির বাবা-মা যে নিহিকে রাজকন্যার মতো করে রাখতো সে নিহিই আজ কোনো প্রতিবাদ না করে তোমার বাসায় সব কাজ করছে। যে নিহি চাচা-চাচি বেঁচে থাকতে সামান্য কিছুর জন্য পুরো বাড়ি কান্নায় মাথায় তুলতো আজ সে নিহিই তোমার সব অত্যাচার নীরবে কোনো শব্দ ছাড়াই মেনে নিচ্ছে। এমনকি তুমি তার পড়াশোনাও বন্ধ করতে চাইছো। এখন যদি চাচা-চাচি বেঁচে থাকতো তুমি এমন কিছু কখনোই করতে পারতে? তারা তো আমাদের তিশাকে কোনোদিন তোমার নজরে দেখেনি, নিহিকে যেভাবে ভালোবাসতো আমাদের তিশাকেও সেভাবেই ভালোবাসতো। নিহির জন্য কিছু আনলে তিশার জন্যও একই জিনিস আনতো। তিশা আর নিহির মাঝে কোনোদিন পার্থক্য দেখিনি আমি তবে তুমি কেন তিশা আর নিহির মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করছো? নিহির মা-বাবা বেঁচে নেই বলেই কী এই পার্থক্য? নিহির যথেষ্ট বোঝার বয়স হয়েছে, চাইলে সেও এই বাড়িটা অর্ধেক নিয়ে রাজকন্যার মতো থাকতে পারতো কিন্তু সে এটা করেনি , তোমার সবকিছুই মুখ বুঝে সহ্য করেছে।
জানো মা? তুমি নিহিকে তখন থেকেই অন্য নজরে দেখতে যা আমি বুঝতাম তার জন্যই তো তুমি আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছো। কিন্তু তুমি কী জানো? শেষ-পর্যন্ত তোমার তখনকার সেই চিন্তাটাই সত্যিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নিহুর জন্য আমার অনুভূতি দেশের বাইরে যাওয়ার আগে থেকেই ছিল। তোমার মতো আমারো মনে হতো মা – যে হয়ত এটা আবেগ বা মোহ! কিন্তু না,, দেশের বাইরে গিয়েও নিহুর প্রতি আমার টান এক বিন্দুও কমেনি বরংচ বেড়েছে। হ্যাঁ,, আমি নিহুকে ভালোবাসি মা। সেই তখন থেকে।’
রাহান কথাগুলো বলে একটু থামলো। পারভীন বেগম, তিশা, রেহেনা খালা সবাই পলকহীন-ভাবে তাকিয়ে রইল রাহানের দিকে। নিহি তো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখ বেয়ে অঝোরো ধারায় অশ্রু ঝরছে। না,, এই কান্না দুঃখের নই, সুখের। মা-বাবা চলে যাওয়ার পর নিহি মনে করেছিল তার কপালের সুখপাখি বুঝি উড়েই গিয়েছিলো। একেবারের জন্য বিদায় নিয়েছিল কিন্তু না বহুদিন পর তার কপালে আবার সুখ ফিরে এলো। তার রাহান ভাইয়া! তার স্বপ্নপুরুষ তাকেই ভালোবাসে! এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাই নিহির!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।