প্রেমালয় ২ #পর্বঃ_১০_শেষ

0
1458

#প্রেমালয় ২
#পর্বঃ_১০_শেষ
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

আজ পাঁচ দিন ধরে মুগ্ধর কোনো খোজ নেই। ফোনেও পাচ্ছে না তাকে। মারিয়া চৌধুরি অচেতন হয়ে পরেছে তার একমাত্র ছেলের জন্য। মেহের চৌধুরিও বেশ চিন্তিত। তাদের একমাত্র ছেলে নিরুদ্দেশ। মুগ্ধর হুট করে এমন নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। কপালে পরছে চিন্তার ভাজ। চার দিকে খুজেও মুগ্ধকে খুজে পেলো না কেউ।

এদিকে বাড়ির সামনে তীসাকে দেখে চমকে উঠে শিশির। গেট পেড়িয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে সে। তীসাকে আসতে দেখে দৌড়ে নিচে চলে যায় শিশির।
– কেমন আছিস শিশির,,,
– আপু তুমি এখানে? ঠিকানা কোথায় পেলে?
– সামান্য একটা ঠিকানা জোগাড় করতে পারবো না আমি?
– আচ্ছা আসো ভেতরে আসো।
– ভেতরে যেতে আসিনি আমি, তোকে নিয়ে যেতে এসেছি।
– কোথায়?
– বাড়িতে।
– কিন্তু বাবা তো আমার মুখও দেখতে চায়না আপু।
– ওসব নিয়ে ভাবিস না তুই, আমি বাবাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। পুরো ঘটনা বলেছি বাবাকে। বাবা এখন তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।
– কিন্তু মুগ্ধ?
– মুগ্ধ কোথায়?
– জানিনা, আজ পাঁচ দিন ধরে কোনো খোজ নেই তার।
– কোথায় গিয়েছে, বলেছে কিছু?
– না,,,
– আচ্ছা এখন চল ওসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। বাবা মা অপেক্ষা করছে তোর জন্য। এমনিতেও এতোদিন খুব রেগে ছিলো তোর উপর। এখন আগে ওইদিক টা ঠিক হোক বাকি সব পরে ভাবা যাবে।
,
,
ওদিকে চুপচাপ বাড়িতে বসে আছে সুশান্ত। কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। সবার উপর অভিমান জন্মেছে তার। শিশিরকে হারানোর পেছনে তার ভুল থাকলেও তা মেনে নিতে পারছে না সে। আর শিশিরকেও জোড় করার ইচ্ছে নেই তার। সবার জীবনে তো আর সকল চাওয়া পূরণ হয় না। তেমন করে হয়তো তারটাও অপূর্ণ থেকে যাক।
আজ তীসাকে আনতে যায়ার কথা ছিলো। কিন্তু যায়নি। বললো আগামি কাল যাবে। শিশিরকে না পেলেও শিশিরের শেষ কথাটা রাখবে সে।

বাড়ি ফিরে শিশির দেখলো বাবা মা দুজনই বসে আছে ঘরে। মাথা নিচু করে তাদের সামনে গিয়ে দাড়ালো শিশির।
শিশিরের মা এসে তার গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো। শিশির এখনো চুপচাপ।
শিরিনা আহমেদ আর কিছু না বলে হুট করে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে।
– কিভাবে এতোদিন দুড়ে ছিলি আমাদের ছেরে? কেন সত্যটা কাউকে জানাস নি? সব সময় নিজে কেন কষ্ট পাস সব কিছু গোপন রেখে?
– মুগ্ধ খুব ভালো ছেলে মা, তার কোনো দোষ ছিলো না,,,
– তীসা সব বলেছে আমাদের।
শিশির তার বাবার দিকে তাকালো। করুন চোখে বললো,
– আমার সাথে কথা বলবে না বাবা?
,
,
পাঁচ দিন খুজেও কোথাও মুগ্ধকে না পেয়ে হতাশার নিশ্বাস ছারলেন মেহের চৌধুরি। মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো সেখানেও যেতে পারেনি। এটা নিয়ে মোটেও আফসোস করছে না মারিয়া। তার একটাই কথা, সে তার ছেলেকে ফেরত চায়। তার একটাই ছেলে। আর সে এতোদিন ধরে নিখোঁজ। মনে বার বার কুহু কুহু ডাকছে। কোনো ক্ষতি হয়নি তো মুগ্ধর?

সন্ধার পর দরজার সামনে মুগ্ধকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাত থেকে চায়ের কাপ পরে যায় তার মা মারিয়ার। দ্রুত পায়ে মুগ্ধর কাছে গিয়ে গুই গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– তুই ঠিক আছিস তো বাবা? কোথায় ছিলি এতোদিন?
মুগ্ধ উত্তর দিলো না। কিছুক্ষন স্থির থেকে শুধু তার মায়ের দিকে করুন চোখে চেয়ে বললো,
– ভালোবাসার মানুষ গুলো চোখের আড়াল হয়ে গেলে কেমন কষ্ট হয় বুঝতে পারছো মা? আমিও ঠিক এমন ভাবে তোমার মতোই এলোমেলো হয়ে যাবো। বাবাকে বুঝাও না মা। প্লিজ মা। আমার ভালোবাসা তোমরা কেড়ে নিলে আমিও নিজেকে তোমাদের থেকে কেড়ে নিবো। আর ফিরবোনা কখনো।

বেশ কিছুক্ষন পর মুগ্ধর বাবা ফিরে আসে বাড়ি। ভেবেছিলো আজ পুলিশের কাছে যাবে। প্রয়োজনে সারা দেশে তল্লাসি করবে। তার একমাত্র ছেলে, একমাত্র সম্বল।
মারিয়া ফোন করে বললো, মুগ্ধ বাসায় এসেছে। মুহুর্তেই বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরে গেলো মেহের চৌধুরির। প্রান ভরে নিশ্বাস নিয়ে বাসায় আসে।

সোফায় চুপচাপ বসে আছে মেহের চৌধুরি। বাবার পাশে মেঝেতে অসহায়ের মতো বসে আছে মুগ্ধ। বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে সে। সবার মন রক্ষা করে ভালোবাসাটা পূর্ণতা দিতে বাচ্চা নয়, পাগল হতেও রাজি সে। কারণ একবার হারিয়ে ভালোবাসা কি তা বুঝে নিয়েছে সে। এবার হারালে সত্যিই সব এলোমেলো হয়ে যাবে তার।
– প্লিজ বাবা সব ভুলে যাও না। তোমাদের ছারা আমি যেমন অসহায়, তেমনই তাকে ছারাও আমি নিঃস্ব। তোমরা আমার পুরো একটা জীবন, আর শিশির হলো সেই জীবনের অনুপ্রেরনা। তোমাদের ছারা যেমন আমি বাচতে পারবো না, ঠিক তাকে ছারাও আমি এলোমেলো হয়ে যাবো। ছোট থেকে যা চেয়েছি, তুমি তাই দিয়েছো বাবা। আমার বেচে থাকার শক্তিটুকু কেড়ে নিও না বাবা। তোমার দেওয়া শর্তে আমি কাউকেই বেছে নিতে পারিনি। আমি ব্যর্থ। তোমাদের সবাইকে এক সাথে নিয়ে আমি বাচতে চাই।

রাতে খাবার খেয়ে বেলকনিতে বসে আছে মেহের চৌধুরি। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মারিয়া চৌধুরির উপস্থিতিতে উঠে বসে সে। মারিয়া চৌধুরি স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,
– কি করবেন, ভেবেছেন কিছু?
একটা নিশ্বাস ছারলো মেহের। তারপর বললো,
– কি আর করবো? দেখছোনা ছেলেটা কেমন বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে? পাগলের মতো কাঁদছে?
,
,
আজ তীসাকে নিতে এসেছে সুশান্ত আর তার দাদি। মাথা নিচু করে বসে আছে সুশান্ত। সুশান্তকে ডেকে আলাদা নিয়ে গেলো তীসা। আজ সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করছে, তাকে মেনে নিতে পারবে কি না? নয়তো ওই বাড়িতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
সুশান্ত অন্য দিকে তাকি রইলো। বললো,
– আমার একটু সময় দিবে তুমি? নিজেকে একটু গোছাতে হবে আমার। সব কিছু মানিয়ে নিতে সময় লাগবে।
সুশান্তের মুখে তুই থেকে তুমি শব্দ শুনো কেপে উঠলো তীসা। সুশান্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন পর হাত বাড়িয়ে বললো,
– আচ্ছা যত ইচ্ছে সময় নিন। ততোদিন না হয় বন্ধু হয়েই থাকুন।
সুশান্ত তীসার হাতে হাত রেখে একটা মুচকি হাসি দিলো। আর বিছু না বলে সিড়ির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সুশান্ত। শিশিরকে সিড়ি দিয়ে উঠতে দেখে মুখ ফিরিয়ে সোজা সামনের দিকে চেয়ে এক নিয়মে নেমে যাচ্ছে। শিশির একটু হেসে বললো,
– কেমন আছেন দুলাভাই।
শিশিরের কথায় পাত্তা দিলোনা সুশান্ত। সোজা নিচে চলে গেলো।
,
,
রাতে ছাদে এসে দাড়ালো শিশির। হালকা বাতাসে চুল গুলো নাড়াচারা করছে। ফোনের স্কিনের দিকে তাকালো। মুগ্ধর কোনো রেসপন্স নাই। হুট করে কেন ছাদে আসতে বললো, এটাও তার অজানা। ছাদ থেকে রাস্তা দেখা যায়। ওখানে হলুদ একটা লেম্পপোষ্ট। হয়তো লেম্প পোষ্টের হলদে আলোর নিচে মুগ্ধ এসে দাড়াবে। দুর থেকে ইশারায় কথা হবে তাদের। একজন আরেক জনকে অনুভব করবে দুর থেকে।
আচ্ছা, পূর্ণ মিলন এতো মধুময় হয় কেন?
শিশির চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। পেছন থেকে কেউ কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে উঠতেই শিশিরের সারা শরির অবস হয়ে যায় মুহুর্তেই। পেছনে ফিরে মুগ্ধকে দেখতেই একটা বড় নিশ্বাস ছাড়লো। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দমটা বেড়িয়ে গেছিলো।
শিশির অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
– ছাদে উঠলেন কি করে? গেট তো বন্ধ।
– বাড়ির পেছনের আম গাছ টা দিয়ে উঠলাম।
শিশির গালে হাত দিয়ে বললো,
– ওটার পাশের রুমটায় তো বাবা-মা থাকে, যদি দেখে ফেলতো?
– তাই বলে কি আমার শিশুর কাছে আসবো না? ওসব সামান্ন ভয় আমাকে কাবু করতে পারবে না।
– এই আপনি আবারও এই নামটা ধরে ডাকলেন?
– এখনো মনে আছে?
– থাকবেনা কেন? আমার সব মনে আছে।
– পাগলি,,,,
– এটা সবচেয়ে বেশি মনে আছে। কথায় কথায় পাগলি বলে সম্বোধন করতেন তখন।
– আমার প্রতিটি সম্বোধনেই লজিক থাকে।
– আচ্ছা বুঝলাম, আপনি না হয় পাগল তাই আমি আপনার পাগলি। তাহলে শিশুর লজিক টা কি?
– তোমার বয়স কতো?
– কেন আপনি জানেন না? ২১,,,,
– আর আমার ২৫, তো তুমি কি এখনো অস্বীকার করতে পারবে যে তুমি আমার কাছে শিশু নও? আর দ্বিতীয়’ত শিশিরকে সংক্ষেপ করতে গেলে শিশু চলে আসে মুখ দিয়ে।
– এতো সংক্ষেপ করতে হবে না, এখন যান। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।
– তোমার বাড়ি আসলাম দেখে তাড়িয়ে দিচ্ছো? বাপের বাড়ির ক্ষমতা দেখাচ্ছো? ব্যাপার না কয়দিন পর তো আমার বাড়িতেই একেবারে নিয়ে যাবো।
– আচ্ছা ভালো, এখন যানতো।
– আরেকটা কথা, বাবাকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। কয়েকদিনেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর শিশু আমার হবে।
শিশির একটু রাগি ভাব নিয়ে বললো,
– আবার শিশু,,,,
মুগ্ধ হাসলো, আম গাছ টা দিয়ে নেমে যাচ্ছে সে। শিশির ফিসফিসিয়ে বললো,
– সাবধানে নামুন।
মুগ্ধ শিশিরের দিকে তাকালো। মুখে হাসি ফুটিয়ে ফ্লাইং কিস দিতেই হাত ফসকে নিচে। মুখ দিয়ে ব্যাদনা দায়ক শব্দ করলো মুগ্ধ।
কোমর ধরে উঠে দাড়িয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে মুখে জোড় পূর্বক হাসির রেখা টানলো। তার পর এক পা এক পা করে আগাচ্ছে মুগ্ধ। শিশির হাসবে না কাঁদবে ওটা বুঝে উঠতে পারছে না।
তখনই কানে বাবার গলা ভেষে আসলো। শিশির ভয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো।
তার বাবাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। শিশির না জানার ভান করে বাবাকে বললো,
– কি হয়েছে বাবা?
– আরে চোর,,, চোর এসেছে বাড়িতে। আমার ডাক শুনেই অন্ধকারে দৌড়ে পাললো।
শিশির মনে মনে হাসলো। হুম চোরই তো, মন টা যে অনেক আগেই চুরি করে ফেলেছে।
,
,
গভির রাত। একটা খাতা আর কলম নিয়ে বসলো শিশির। অভিজ্ঞতা না থাকলেও কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ।
“– সেই দিন পাগলের মতো কেঁদেছিলাম দরজা লাগানো কোনো এক বন্ধ ঘরে। ব্লেডের টানে হাত থেকে ছিটকে রক্ত পরে ভিজেছে ফ্লোর। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট টা কতটা ভয়ঙ্কর তা উপলব্ধি করেছিলাম খুব কাজ থেকে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি আমি। সত্যি টা না জেনেই আপনাকে ভুল বুঝে নিজের উপর অনেক অন্যায় করেছি আমি। আপনার থেকে আড়াল হতে সরে গেলাম অনেক দুরে। মনে তখন একটাই জেদ,,, আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না আমি, কক্ষনো না। আমি মেয়েটা বড্ড অভিমানি।
আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি আপনাকে। অন্ধ চোখে মিত্যাকে বরণ করে সুধু ভুলই বুঝেছি সব সময়। এতো কিছুর পরও আপনি আমায় ভুলেন নি, ঠিকই খুজে নিয়েছেন। সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে কানের খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘ভালোবাসি’। আচ্ছা আপনি আমায় কখনো ছেরে যাবেন না তো??? একেবারে এলোমেলো হয়ে যাবো আমি,,,,,,

~~ ইতি- বড্ড অভিমানি মেয়ে, যাকে আপনি পাগলি বলে সম্বোধন করেছিলেন।

কাগজ টা নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো শিশির। ভাজ করে লুকিয়ে রাখলো কাগজটা। কারণ তার অনুভুতি গুলো সে কাউকে দেখায় না।
এই তো আর অল্প কিছু দিন মাত্র। ভাবতে ভাবতেই বিছানায় এসে চোখ বুজতেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।

দুই পক্ষের প্রেমই ছিলো অন্ধ। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই প্রেমের মাঝে আলো খুজতে ব্যস্ত সবাই। হ্যা, প্রেমের আলো। অন্ধকার প্রেম গুলো এবার প্রেমালয়ে আলোকিত হয়ে পরিপূর্ণতা পাবে। ভুলিয়ে দিবে অতিতের সব বিষাদের দিন গুলো। প্রেমে অন্ধকার কেটে আলো নেমে আসুক প্রেমের আলোয় ফুটে উঠুক আগামি দিন গুলো ‘প্রেমালয়’।

সমাপ্ত,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here