#প্রেমাস্নাত_সন্ধ্যায়,পর্ব_০১
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
১.
বিয়ের তিন মাস পর হিমায়ন আজ বাড়ি ফিরছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে এক নজর তাকে দেখে আমার পুরো পৃথিবী অগোছালো মনে হতে লাগলো। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। সে আসবে বলে আজ বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন এসে বাড়িভর্তি করে ফেলেছে। দুপুর বেলা এখন। সে বসার ঘরে ঢুকতে সকলের মিলিত আনন্দ ধ্বনির তীব্র শব্দ কানে এলো। লজ্জায় আমি বের হলাম না।
হিমায়ন ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করে। তার চাকরির বয়স বেশিদিন হয়নি। সবেমাত্র ছয় মাসের ট্রেনিং সমাপ্ত করতে গিয়েছে। তার তিন মাস পূরণ হওয়ায় তিনদিনের ছুটি পেয়েছে। সেই উপলক্ষে বাড়ি আসা। হিমায়নের ট্রেনিং এর বয়স যতদিন, তার সাথে আমার বিয়ের বয়সও ঠিক ততদিন। সে ট্রেনিং এ যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় আমার সাথে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়েটা ধুমধাম করে না হলেও দুই পরিবারের সম্মতিতে হয়েছে। সেদিন দুপুরবেলা তার বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর মশাই আমাকে দেখতে গিয়েছিল। এক দেখায় পছন্দও করে ফেলেন। তার রেশ ধরে বিকেল বেলা হিমায়ন তার পুরো পরিবার নিয়ে দেখতে আসে। আমায় পছন্দ হয়েছিল বোধ হয়। কারণ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের বিবাহ কার্য সমাপ্ত হয়। সেই রাতে আমায় তাদের বাড়ি নিয়ে আসে। দীর্ঘ সময় জার্নি করে এই বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ফজরের আযানের সময় হয়ে গিয়েছিল। জার্নির ধকল সহ্য করতে না পেরে রুমে ঢুকে গাঢ় ঘুম দিয়েছিলাম। আমার তখনো ঘোর কাটেনি৷ ঘোর কেটেছিল সকালবেলা যখন হিমায়ন লাজুক স্বরে বলেছিল,
‘আমি তাহলে চলে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখবেন। ফোনে যোগাযোগ করবো।’
আমি প্রতিত্তর করতে পারিনি সেদিন। হিমায়নের চলে যাওয়ায় বুকের ভেতর কোথাও সূক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করেছিলাম। ঠিক তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমার বিয়ে হয়েছে। আমি কারো অর্ধাঙ্গীনি। কিন্তু হিমায়ন নিজের কথা রাখেনি। আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেনি। বলতে গেলে ট্রেনিং এর কঠোরতার জন্য করতো পারেনি। গত তিনমাসে কদাচিৎ ফোনালাপ হয়েছে আমাদের। চার-পাঁচ মিনিট করে সপ্তাহ এক অথবা দুদিন। এত অল্প সময় তবুও দুজনের কেউ কথা খুঁজে পেতাম না। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সম্পর্ক এখনো একে অপরের আপনিতে আটকে আছে।
রান্নাঘর থেকে বাইরে বের হলাম। ভিড়ের মাঝে উঁকিঝুঁকি মেরে আমি হিমায়নের লম্বা দেহটা আরেকবার দেখার চেষ্টা করলাম। সুবিধা করতে পারলাম না। জায়গা বদল করে সদর দরজার কাছে গেলাম। পায়ের উপর ভর দিয়ে উঁচু হতে হঠাৎ করে দুই জোড়া চোখ একে অপরের উপর আবদ্ধ হলো। বুকের ভেতর দ্রিম একটা শব্দ হলো আমার। নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। হিমায়নের দৃষ্টির গভীরতা থেকে রক্ষার জন্য দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
রান্নাঘর থেকে কান খাড়া করে আমি তার কন্ঠ শুনতে লাগলাম। মৃত্তিকার মতো ঝরঝরে সুরে কথা বলা যাচ্ছে সে। মাঝে মধ্যে ঝর্ণার মতো স্ব শব্দে হেসে উঠছে। ভীষণ হিংসে হলো আমার। মন ভার হয়ে গেল। এত মানুষকে চারপাশে পেয়ে আমায় বেমালুম ভুলে গেছে। মন ভারাক্রান্ত করে আমি পানির গ্লাসে চুমুক দিলাম।
ঘন্টাখানেক পর হিমায়ন ফ্রেশ হয়ে এলো। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তাতে আয়েস করে বসলো। আর তাকে ঘিরে বসলো জনা বিশেক বা তার চেয়ে বেশি আত্মীয় স্বজন। আমি রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে সব খেয়াল করছিলাম। হঠাৎ শ্বাশুড়ি মা রান্নাঘরে এসে বললেন,
‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন নিশি? হিমায়নের পাশে গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
‘না, মা। আমি পরে আপনার সাথে খাব।’
‘তাহলে খাবার গুলো নিতে আমাকে সাহায্য করো।’
জোরপূর্বক মুখে হাসি টানলাম। বসার ঘরে যেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু কিছু করার নেই। পর্বতসম অস্বস্তি নিয়ে আমি মাংসের বাটিটা দুহাতে চেপে ধরলাম। ধীরপায়ে বসার ঘরে এগিয়ে গেলাম। কোনোদিকে তাকালাম না। মাংসের বাটিটা নামিয়ে রেখে চলে এলাম। রান্নাঘরে আসতে শ্বাশুড়ি মা ডালের বাটি ধরিয়ে দিলেন। আবার অস্থিরতা নিয়ে হিমায়নের সামনে গেলাম। ডালের বাটি নামিয়ে রাখার এক ফাঁকে হিমায়নের দিকে তাকালাম। তার হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টি আমার দিকেই ছিল। ফের চোখে চোখ পড়তে আমার বুকের নদীতে ছলাৎ করে ঢেউ খেলল। হাত কেঁপে উঠলো আমার। ডালের বাটিটা কাত হয়ে অল্প একটু ডাল ছিটকে মেঝেতে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আত্মীয় স্বজন সবার বিস্ময় ভরা দৃষ্টি আমার উপর ন্যস্ত। আমি আর দেরি করলাম না। এক দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
এ বাড়িতে আমি দুদিন হলো এসেছি। তিন মাস বিয়ের সময়সীমার মধ্যে দশটা দিনও থাকা হয়নি এখানে। সেজন্য কারো সাথে তেমন পরিচয় হয়ে উঠেনি। তবে এ বাড়ি আসলে হিমায়নের রুমটাতে থাকি। মানুষটা খুব একটা পরিচিত না হলেও এই রুমের প্রতিটি ধূলিকণা, ইট, সিমেন্ট, বালিসহ সবকিছুর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। রুমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। চোখ গেল ওয়াশরুমের পাশে রাখা বড় ট্রলিটার দিকে৷ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম এটা ওই মানুষটার। রুমের বারান্দায় ভেজা কাপড়ও ঝুলতে দেখলাম। তার মানে হিমায়ন রুমে এসে গোসল করে নিয়েছে। ট্রলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা চেইনে তালা নেই। একবার মনে হলো খুলে দেখি ভেতরটা! পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম। চুপচাপ সরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার সময় এক ননদের ডাকে। হিমায়নের কাজিন রূপা মেয়েটা। ভীষণ মিষ্টি মেয়েটা। মুখ ধুয়ে তার সাথে বের হলাম। মাথা নিচু করে আমি হাঁটাহাঁটি করছিলাম। যাতে হিমায়নের সাথে চোখাচোখি না হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম সে বাড়ি নেই৷ বিকেলবেলা বাবার সাথে বাজারের দিকে ঘুরতে গেছে। ফোঁস করে শ্বাস ফেললাম। কিছুটা স্বস্তি মিললেও মনের কোথায় যেন খচখচানিটা রয়ে গেল। কোথায় যেন এক ফোঁটা তীব্র দুঃখ বিরাজমান। আমি পাত্তা দিলাম না। খাবার খেয়ে রান্নার কাজে শ্বাশুড়ি মাকে সাহায্য করতে লাগলাম।
রাতের খাবার শেষ করে বসার ঘরের এক পাশে হিমায়ন ছোট ছোট কাজিনদের সাথে লুডু খেলতে বসে গেল। আমি তখনো রান্নাঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফুপি শ্বাশুড়ি আমায় হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলেন। মাদুরে বসিয়ে দিলেন খাওয়ার জন্য। বাড়ির পুরুষরা সবার খাওয়া শেষ। এখন শুধু মেয়েদের খাওয়ার পালা। বাল্বের আলো কে পেছনে রেখে আমি একটুখানি জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে পড়লাম। প্লেটে ভাত নিয়ে মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। প্লেটে এক চামচ ডাল নিয়ে নিলাম। ভাতের লোকমা করে মুখে দেওয়ার এক ফাঁকে কর্ণারের দিকে নজর গেল। দেখি হিমায়ন পূর্বের মতো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ভাত আটকে এলো আমার। খকখক করে কাশতে লাগলাম। পাশ থেকে শ্বাশুড়ি মা পানির গ্লাস ধরিয়ে দিলেন। আমি এক নিঃশ্বাসে সম্পূর্ণ গ্লাস খালি করলাম। প্লেটের উচ্ছিষ্ট খাবার শেষ না করে আমি রান্নাঘরে ছুট লাগালাম।
২.
অন্ধকার রুমটা হঠাৎ শুভ্র রঙের আলোয় ছেয়ে গেল। চোখ খিঁচে বন্ধ করলাম আমি। ওড়নার একটা অংশ খামচে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলাম। বন্ধ চোখেও বুঝতে অসুবিধা হলো যে হিমায়ন সবেমাত্র রুমে ঢুকেছে। পরিচিত একটা ঘ্রাণ নাকে আসছে। এই ঘ্রাণটা আমি প্রথমবার পেয়েছিলাম যখন হিমায়ন আমাকে দেখতে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ রেখে কান খাড়া করে রইলাম। রুমে মৃদু পদধ্বনির আনাগোনা। একটু পর ওয়াশরুমের দরজা বন্ধের শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেললাম। এক লাফে উঠে বসে রুমের চারিদিক নজর বুলালাম। হিমায়ন আসবে বলে মোটামুটি গুছিয়ে রেখেছি। তবুও আরেকবার পরখ করলাম। বন্ধ দরজার ছিটকিনির উপর নজর যেতে হৃদপিন্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। উনার সাথে এক রুমে থাকবো কি করে? কি অস্বস্তিকর ব্যাপার! অস্থির চোখজোড়া দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে পড়তে স্থির হয়ে এলাম আমি। চোখ দুটো আস্তে ধীরে ঝাপসা হতে লাগলো। বুকের কোণে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। রাত ১২ টা বেজে ৫১ মিনিট। উনার সবেমাত্র সময় হলো আমার কাছে ফেরার?
তীব্র মন খারাপ নিয়ে আমি আগের মতো শুয়ে পড়লাম। খোলা চুল দিয়ে মুখ ঢেকে রইলাম। আমার ব্যথাতুর মনের ছাপ কারো নজরে যেন না পড়ে। কয়েক মিনিট পরে ওয়াশরুমের ছিটকিনি খুলে গেল। আমি মটকা মেরে আগের মতো পড়ে রইলাম। ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। না রুমের বাল্ব বন্ধ হলো, না হিমায়ন এসে আমায় কিছু বললো। সময়ের সাথে মন খারাপ যেন আনুপাতিক হারে বাড়তে লাগলো। তার কি কিছুই বলার নেই আমাকে? এভাবে চুপচাপ রাত কাটিয়ে দিবে? ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতে সেই চির-পরিচিত সুগন্ধটা খুব কাছে অনুভব করলাম। কয়েক সেকেন্ড পরে সে গাঢ় কন্ঠে ডাক দিল,
‘নিশি?’
সেই গাঢ় কন্ঠে এতক্ষণ জমে থাকা অভিমানের পাহাড়চূড়া চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। অভিমান গুলো অশ্রু হয়ে ধরা দিল। ভাগ্যিস চুল দিয়ে মুখ ঢাকা বলে হিমায়ন সে অশ্রু দেখতে পেল না। আমার অভিমানী মন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
‘এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো? আমার কাছে আসার সময় হলো?’
(চলবে)