প্রেমের শুরু,পর্ব:১

0
3919

প্রেমের শুরু,পর্ব:১
তৃধা আনিকা

তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা মেজো মামার বিয়েতে৷ সে আমার নতুন মামীর বড়বোনের ছেলে হয়। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার্থী। আমি সবে নাইনে উঠেছি।কিশোরী তকমা কাটেনি।
খাবারের পর আমার খুব পেট ব্যথা করছিল। সব্বাই তখন বর-কনের মিষ্টিমুখ করা দেখতে ব্যস্ত। ওই অত বড় কমিউনিটি সেন্টারে কে আমায় বাথরুম খুঁজে দেবে? আর বাথরুমের দরজায়ই বা কে দাঁড়িয়ে থাকবে? যদি কেউ বাইরে থেকে আটকে দেয় আমায়! ইশশিরে…
শেষমেষ ওকে খুঁজে পাওয়া। বিরক্ত মুখে এক কোণায় বসে বিড়বিড় শব্দে পড়ছে। মোটা একটা বই হাতে।আমার এদিক ওদিক ছুটাছুটি দেখে এগিয়ে এলো।
-কিছু হয়েছে?
-বাথরুম খুঁজে পাচ্ছি না। এত পেট ব্যথা করছে। এক্ষুনি বাথরুম যেতে হবে।
ঝাঁকরা চুলের ছেলে বই বন্ধ করে বিরক্ত মুখ করে বললো,
-এইসব বাচ্চা ফাচ্চারা কেন যে বিয়ে খেতে চলে আসে! একটু ঝাল খেলেই পেটব্যথা। ওই যে ওদিকে টয়লেট।
-আপনি একটু দরজায় দাঁড়াবেন? কেউ সিটকিনি বাইরে থেকে আটকে দিলে আমি মরে যাবো।
তাঁর মুখের বিরক্তি এবার আরো ঘন হলো।
-দেখি চলো। একদম দেরি করবে না। আমার কাল পরীক্ষা। দেখছোনা পড়ছিলাম।
-একটুও দেরি হবে না। দু’মিনিট লাগবে।

আমি বাথরুমে দেরি করলাম। উঁহু পেট ব্যথা নিয়ে বসে নয়, আমার লেহেঙ্গার পাশের হুক আটকাতে পারছিলাম না বলে। ও এক পর্যায়ে ডেকেই ফেললো,
-একবারেই যদি এত টাইম লাগে তাহলে জীবনের পুরোটাই তো এই করে করেই চলে যাবে। চলে যাচ্ছি আমি।
আমি কোনোমতে জবাব দিলাম
-হুক আটকাচ্ছে না। এক পাশে তো, পারছি না।
-পরেছিলে কি করে?
-রূপা ছিল তখন।
সে এত রেগে গেল! চেঁচিয়ে উঠলো।
-আমি কি রূপা?
আমি জবাব না দিয়ে এক-হাতে স্কার্ট ধরে দরজা খুলে বেরোলাম৷ সে কিছুই বললো না। ঝট করে বইটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে কোমরটা টেনে ধরে হুকটা আটকে দিলো।
আমি এত লজ্জা পেলাম যে বইটা ছুঁড়ে ফেলেই ছুটে দৌড় দিলাম। ইশ্! কে না কে? আমার কোমরের হুক আটকে দিলো। ছিঃ!
তারপর আর পুরো অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা নেই। আমি মনে মনে এদিক ওদিক খুঁজছিলাম। আসলে একটুখানি দেখা তো। চেহারাও মনে নেই। কালোমতন হ্যাংলা পাতলা গড়নের লম্বা একজন ছিল এতটুকুই মনে পড়ছিল শুধু।

একদম বিয়ে শেষে চলে আসবার সময় যখনি গাড়িতে বসতে যাবো। তখনি সে উদয় হলো। এবার চোখে চশমা। কপালে কুঁচকানো ভাঁজ। চেহারায় বিরক্তি।
-আচ্ছা, স্কার্টের তো নিচের দিক খোলা। তুমি পাশের হুকটা কেন খুলতে গেলে?
-খুব পেট ব্যথা করছিল। হুক খুলে নিলে ব্যথাটা কমবে ভেবে! এটা স্কার্ট নয় লেহেঙ্গা।
-ওহ। আমি ভেবেছিলাম হুক খুলে বুঝি পেট ঢিলে করলে। তা জমাজমি ঠিক হয়েছিল তো? এখন কি পেট ব্যথা আছে নাকি আরেকবার যাবে? গাড়িতে কিছু ঘটে গেলে?
আমি এত লজ্জা পেলাম যে দু-হাতে মুখ লুকিয়ে ফেললাম।
সেই তাকে দেখা। আমি ওর নামটাও জানি না তখন। শুধু আমার মন জানলো, রুবিকস কিউবের মত রং বেরঙের ঘর ঘর প্রিন্টের টি-শার্ট পরা একটা হ্যাংলামতন শ্যামলা ছেলে খুব লজ্জা দিয়ে কথা বলে৷ পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি এমন অসভ্য ছেলে আর একটাও নেই। শুধু এই পৃথিবী কেন? পৃথিবীর বাইরের গ্রহেও নেই। ছিঃ।সামান্য পেট ব্যথা নিয়ে এমন করে কেউ কথা শোনায়?

বৌ-ভাতের দিন সে চলে এলো। তাঁর খালার বরের বাড়ি, আসবেই তো। আমি সেদিন সালোয়ার কামিজ পরে শক্ত হয়ে আছি। কিছুতেই মুখোমুখি হবো না তাঁর। সে এদিক দিয়ে গেলে, আমি ওদিকে। সে সামনে গেলে, আমি ধাপ করে পিছিয়ে আসি। এত গা বাঁচিয়ে লাভ হলো না অভিশপ্ত লম্বা চুলের জন্য। বিণুনি ধরে এক পাশ থেকে এমন টেনে নিল সে।বড়ঘরের পিছনের দেয়ালে পিঠে ঘেষে নিয়ে দাঁড় করালো। আমি তখন চোখ বন্ধ করে ওড়না মুঠো করে ধরে থরথর করে কাঁপছি। আর সে? সে শান্ত ভঙ্গিতে আমার বেণীর ফাঁকে ফাঁকে একটা একটা করে গোলাপ গুঁজছে।
-সেদিন আমি বাথরুম খুঁজে না দিলে তো সর্বনাশ হতো। আর আজ আমাকে দেখেই পালানো। কেন? এখন আমার যদি বাথরুম দরকার হয় তবে?
আমি চোখ মেললাম। ততক্ষণে আমার পুরো বেণীতে গোলাপ গুঁজা শেষ তাঁর।
বুকের উপর হাত ভাঁজ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে। আমি নিজের চুলের বেণী গোল করে ধরলাম সাথে সাথে।
-বাথরুম তো শোবার ঘরের সাথেই লাগোয়া। ওটা তো কমিউনিটি সেন্টার ছিল। এখানে তো বাড়ির লোক আছে সবাই।
-তোমার বাড়ির লোক কি আমার বাড়ির লোক হলো?
আমি সরে আসবার জন্য পা বাড়াতেই সে দু-হাতে চেপে ধরলো আমাকে।
-তুমি একদম মাঝখানে চুল সিঁথি করবে না। বুড়ি মা’দের মত দেখতে লাগে। মুখের শেপ তো লম্বাটে। এক পাশে করবে।
আমি হাত ছাড়িয়ে চলে এলাম। ইশ্। তখনো নাম জানা হলো না। শুধু আমার মন জানলো কফি কালারের টিশার্ট পরা ছেলেটার হাতঘড়ির চেনটা খুব ধারালো। হাত টানার সময় এত লেগেছিল আমার যে লম্বা হয়ে হাতে আঁচড়ের মত কেটে গিয়েছিল একটু খানি।
সেদিন মামীর সাথে উনার বাপের বাড়িতে কারা যাবে যখন জিজ্ঞেস করা হলো। আমি মনের ইচ্ছেকে দু-হাতে দমিয়ে বললাম,
-আমি যাবো না।
সেই তখনই কেউ একজন পেছন থেকে ঠেলে দিলো আমাকে।
-কেন যাবে না? বাথরুমের ভয়ে? ইশ্ সারাবছর বুঝি পেটব্যথা থাকে?
আমি ফিরে তাকালাম। ঘড়ি দিয়ে ব্যথা দেওয়া সেই নিষ্ঠুরটা।
আমি ধমকে উঠতে যেই না গলা বাড়িয়েছি।
-এঁই.. বাথরুমের কথা একদম বলবেন না আমায়।
সে নাম বললো,
-এঁই এঁই করবে না জুঁই। আমি এঁই না। একটা নাম আছে আমার, আবীর।
আমি আবীরকে জবাব দিতেই সবার সাথে মামীর বাপের বাড়িতে গেলাম। সেখানে গিয়ে আবীর হাওয়া। একদম দেখা নেই। আশ্চর্য মানুষ! এত কথা শুনালো আমায়! এখন কোথায় সে? এসে দেখে যা না বাবা, আমি কত লিমিটেড বাথরুম করি। উঁহু। একদম নিঁখোজ মানুষটা।
ব্যস… সেই তখন আমি টের পেলাম এই নিঁখোজ মানুষটার জন্যই বোধহয় জন্মেছি আমি।
প্রেমের শুরু তখন থেকেই।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here