প্রেমের শুরু,পর্ব_৩

0
2315

প্রেমের শুরু,পর্ব_৩
তৃধা আনিকা

মনের ভেতরটা ছেয়ে গেল অপরাধ বোধে। আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হলো না। কিন্তু বাড়ি থেকে আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা থেমে গেল। একটা পারিবারিক আনুষ্ঠানিক বিচারসভার মাধ্যমে আমায় বলা হলো, ‘যদি আবীরকেই আমি জীবনে চাই, তাহলে এই পরিবারকে ছাড়তে হবে’।
আমি মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলাম, আবীরের জন্য পরিবার ছাড়বো। মন ঠিক করে আবীরকে ফোন করলাম।
আবীর উল্টো ধমকালো আমায়।
—পরিবার ছেড়ে আসবে মানে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! আমি নেই তোমার সাথে।
—এসব কি কথা? আমি মরতে গেছিলাম তোমার জন্য!
—ওই ভালোবাসা তো আমার পাওনাই ছিল জুঁই। আমি পরিবার বিহীন বড় হওয়া ছেলে। সৃষ্টিকর্তা তো আমার জন্য এমন গভীর ভালোবাসা বরাদ্দ রেখেছেনই।
—আমি মরে যাচ্ছিলাম এর কোনো দাম নেই তোমার কাছে?
—অবশ্যই দাম আছে। আমি এসেই দাম দিচ্ছি। মাত্র ক’দিনের অপেক্ষা।
আমার এত রাগ হলো আবীরের উপর! যার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ বিসর্জন দিতে নেমেছিলাম, সে বলে এসে দাম দেবে। আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। আবীর বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করলো। আমার আত্মীয়স্বজন যাকে যাকে ফোন করা যায় করলো। মোটামুটি যতভাবে চেষ্টা করা যায় করলো। আমি কোনো সাড়া দিলাম না। জেদ চেপে গেল আমার। একদম যোগাযোগ করবো না আমি। দেখি কি হয়? মনের টানের জোর কত এবার সত্যিই পরীক্ষা করা যাক।

আবীর এলো মাস তিনেক পর এক বিকেলবেলা।
একদম না জানিয়ে। সোজা আমাদের বাড়ি এসে হাজির। তখন আমার পরীক্ষা চলছে। বাড়িতে তো পুরো থমথমে অবস্থা। বাবা রেগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন।
—এত বড় স্পর্ধা! আমাদের বাড়ি চলে আসে। কে দিয়েছে এত সাহস? কোথায় পেলো এত ব্যাকিং?
দাদুরও মাথা গরম হয়ে গেল ভীষণ! ছোটচাচা আমাকে ক্ষণে ক্ষণে চোখ রাঙাতে থাকলেন। আর এদিকে আমি আবীরকে দেখবো বলে উন্মুখ হয়ে আছি। ছোট বোন যূথী খবর নিয়ে এলো, আবীর নাকি ড্রয়িংরুমের বারান্দায় বসে আছে। ঘরে ঢু্কতে নাকি কেউ তাকে এলাউ করছে না।
আমি নিরুপায় হয়ে দাদীমায়ের পায়ে ধরলাম।
—একটা মানুষ তো এমনি পড়ে থাকতে পারে এ বাড়িতে। আমি নাহয় আর কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না তোমাদের কাছে। মানুষটা বিদেশ থেকে এলো।
দাদীমায়ের মন একটু নরম হলো। তিনি দাদুর
কাছে খবর পাঠালেন। দাদু ডেকে পাঠালেন আবীরকে।
ভারী ধমকে জিজ্ঞেস করলেন,
—কি চাও?
আবীর শান্ত স্বরে বললো,
—খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ভাত খাবো।
দাদু তো ভীষণ অবাক।
—আর কিছু চাও না?
—জুঁই তো বললো, আপনাদের সাথে কথা বলেছে। ওর কথার উপর বেস করেই আমি ছুটি নিয়ে এলাম।
দাদু আবীরের সামনেই আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি তো দিশেহারা।
—এই ছেলে কি বলে জুঁই? তুই বলেছিস আসতে ওকে? একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছিস! এত বড় হয়ে গেছিস তুই!

আমি আবীরের দিকে তাকালামও না। ভয়ে আধমরা হয়ে দাদুর পায়ে ধরে বসে পড়লাম। সেদিন দাদু আর কিছু বললেন না। আবীরকে আমাদের বাড়িতে থাকতে দিলেন। বললেন, উনি ভেবে জানাবেন। আমি তো এদিকে আবীরের সাথে একটু দেখা করার জন্য মরি মরি অবস্থা। অথচ আবীর! তাঁর কোনো চেষ্টাই নেই। যুথী খবর দিলো, খেয়ে দেয়ে সে নাকি আরামসে শুয়ে পড়েছে।
অনেক রাতে আমি লুকিয়ে গেলাম আবীরের সাথে দেখা করতে। আবীর পায়ের উপর পা তুলে বই পড়ছে।
আমি ঘরে যেতেই বললো,
—চা খেতে ইচ্ছে করছে জুঁই। রান্নাঘরে ঢুকতে দেবে? আমি বানিয়ে নেবো।
আমি তখন এতদিন পরে আমার মানুষটাকে দেখছি। ফিনফিনে টিশার্ট আর শর্টস পরনে যেন অন্য আবীর। দীর্ঘদিন এই মানুষটা যেন ঘর করছে আমার সাথে।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
—তোমার হাত-পা এত লম্বা লাগছে কেন?
—আগের থেকে একটু লম্বা হয়েছে। ওখানে বসে থেকে বাংলাদেশের একটা ভীতু মেয়েকে বারবার ছুঁতে চেয়েছি বলে। দেখি রান্নাঘরে নিয়ে চলো তো।
আমি আবার দাদীমা’কে ডাকলাম। দাদীমা এত রাগ করলেন।
—রান্নাঘরে যাবে কেন? সে কি বাবুর্চি?
—একটু চা খাবে দাদী।
—চা বানাইয়া দিয়া আয়। নাকি চায়ের ডেগ না দেখলে তাঁর তৃষ্ণা মেটে না।
আমি দাদীকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবীরকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম।
আবীর আমাকে চমকে দিয়ে একটা প্যাকেট বের করলো।
—এগুলো কি জানো? একটা বিশেষ ধরনের নুডলস!
—তুমি তো বলেছিলে চা খাবে?
—ওখানে গিয়ে এই দারুণ প্রিপারেশনটা শিখেছি শুধু তোমার জন্য।
আবীর যত্ন করে আমার জন্য নুডলস রান্না করলো।
সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে বললো,
—এত দারুণ একটা ডিশের জন্য আমি নিশ্চয়ই একটা চুমু পেতেই পারি!
—আগে তো টেস্ট করে দেখি।
আবীরের রান্না মুখে দিয়ে আমার মনে হলো, এই মধ্যরাতে এরকম রান্না খাবার জন্য হলেও আমি নির্ধিদ্বায় ঘর ছাড়তে পারি। গাছতলায় থাকতে হলে থাকবো। সমস্যা কি? আমার এই মানুষের জন্য সব যাক। গোল্লায় যাক।
আমি চোখ বন্ধ করো গলা জড়িয়ে ধরলাম আবীরের। সেই প্রথম আমাদের গভীর চুমু।
—এক্ষুনি দূরে কোথাও চলে গেলে কি হয়?
আবীর ঠান্ডা স্বরে বললো,
—পরিবার ভীষণ দামী জিনিস জুঁই। তোমার আছে তাই বুঝতে পারছো না। যদি না থাকতো আমার মতো, কেঁদে কেঁদে ঘাস গুণতে রাস্তার। যা চাও, পরিবারের মধ্য থেকেই চাইতে হবে।
—তুমি চাও না?
—সেটা তো তুমি বুঝবে। আমার সব বুঝবার দায়িত্ব তোমার। আমার কথা তুমি ভাববে।
—সব আমি ভাববো?
—হুঁ!
আমি এক পৃথিবী দুশ্চিন্তা নিয়ে সব ভাবতে ঘরে এলাম।
দশমিনিটেই বাড়ির লোকেদের কিভাবে ম্যানেজ করবো ভেবে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন আমি না খেয়ে মায়ের পিছন পিছন ঘুরলাম।
মায়ের এক কথা।
—বেড়াতে এসেছে, বেড়াক। বিয়ে শাদীতে আমি নেই। তোর জন্য একলা যুদ্ধ করতে পারবো না আমি।
এদিকে আমি আবীরের কাছাকাছি থাকবার জন্য দিশেহারা। নিরুপায় আমি আরেকদিন রাতে লুকিয়ে আবার আবীরের ঘরে গেলাম।
আবীরের পুরো উল্টো ভাব।
কড়া স্বরে চোখ রাঙিয়ে বললো,
—রাতে এলেও কাজ হবে না জুঁই। বিয়ের পর অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এসব ব্যাপারে আমি খুব স্ট্রিক্ট!
—তুমি এতদিন পর এলে অথচ আমায় একটু কাছে টানতেও চাইলে না!
—তুমিও তো চাওনি!
—কি করে জানলে? এই এত রাতে কেন এলাম তবে?
—এটা তো অন্য কারণে।
—নিজেও তো একটু সবার সাথে কথা বলবে। একা আমাকে দিয়ে কেন সব?
আবীর আলতো করে আমার হাত ধরলো। আমার হাতের তালুতে আঙুল দিয়ে কিছু একটা লিখতে লিখতে বললো,
—অনেক শুকিয়ে গেছ তুমি। জামা সব লুজ হচ্ছে।
আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।
—আমি তো জানতাম কাছে আসার ক্ষেত্রে ছেলেদের আগ্রহ বেশি। আর তুমি?
—ভুল জানতে। একটা ছেলে চাইলেই নিজের ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এসব ব্যাপার হচ্ছে পুরোটা মাইন্ড সেটআপের ব্যাপার। নাহলে শুধু বিয়ে নামক একটা শব্দের দোহাই দিয়ে একদম প্যারলাজাইড হয়ে যাওয়া মানুষটাকে নিয়েও তো মানুষ সারাজীবনটা অনায়াসে কাটিয়ে দেয়! কামনা পূরণই ভালোবাসার একমাত্র দিক না।
—তাই বলে, এত শক্ত? এমন একটা ভাব করে আছো, আমাকে কাছে না পেলেও চলবে তোমার!
—শারীরিক ব্যাপারটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার জুঁই। নাহলে এতদিন কানাডাতে থাকতে পারতাম বলো! কাছে আসার পুরো ব্যবস্থা তোমায় করতে হবে। তোমাকেই..

আমার এত রাগ হলো। এই পাথরকে ভালোবেসেছি আমি। এ তো আমায় বিয়ে না করেও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে সারাজীবন। সারাজীবন শুনে এলাম, ছেলেদের তেষ্টার কথা। আর এ দেখো, উল্টো আমায় গলা শুকিয়ে মারতে চাইছে।
আবীর দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
—আর তাছাড়া তুমি তো সিল করাই আছো আমার! আমি জানি এই লকার আমি ছাড়া আর কারো ফিঙ্গারপ্রিন্টে খুলবে না।
আমি তক্ষুনি গলার চেইন খুলে আবীরের হাতের মুঠোয় দিয়ে দিলাম।
—আমি বিয়ের জন্য আর একটুও চেষ্টা করবো না। তোমার তো বউ চাই না। তাই না?
—বউ না চাইলে এমন ছুটে আসতাম বলো?

আমি চলে আসতে লাগলাম। আবীর পথ আটকালো।
—এই না চাওয়া বউটাকে আমি যদি একটা সুযোগ দিই সে কি নেবে?
আমি চলে এলাম। কোনো সুযোগ চাই না আমার।
সপ্তাহ কেটে গেল। আবীর নিজের মতো করে থাকছে আমাদের বাড়িতে। দাদু বিয়ের কথা তুলেন না। আমিও চুপ। নিজের মতো পরীক্ষা দিচ্ছি। সে যদি পারে, আমি কেন না? আবীর নিরুপায় হয়ে ধরা দিলো আমার কাছে।
—আর মাত্র ছ’দিনের ছুটি আছে। কি চাও জুঁই? আমি এমনি চলে যাই?
—গেলে যাবে…
—এবার গেলে কিন্তু আসবো না আর! আমি কিন্তু থাকতে পারবো।
—খারাপ ছেলেরা যে কোনো ভাবেই থাকতে পারে। থাকতে পারার উপায় বের করে নেয়।
আবীর আমার হাত ধরে মাটিতে বসে পড়লো।
—তুমি থাকতে পারবে না জুঁই। আর তুমি জানো আমি কেমন থাকবো।
আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি দাদুর কাছে আবার গেলাম।
এইবার দাদু রাজি হলেন। বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হবার সময় আবীর অদ্ভুত কথা বললো দাদুকে।
—আমার তিনমাসের ছুটি। বিয়ের পরের বাকি সময়গুলো জুঁইকে নিয়ে আমি আপনাদের সাথে থাকবো। ওখানে গিয়ে তারপর আমি জুঁইকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবো।
আমার মাথায় হাত পড়লো। মিথ্যুকটা আমাকে বলেছে ছুটি নেই।

বিয়ের সময়ে আমার জন্য যেন একটার পর একটা চমক অপেক্ষা করছিল। নাজু আন্টিরা আবীরের বাবা-মায়ের মতো করে সব করলেন। আবীর কোনো ধরনের অভাব রাখলো না আয়োজনে। আমার জীবনে ভালোবাসা নামক শব্দটি ধরা দিলো নতুন করে। একটা মানুষ কতটা গুছিয়ে ভালোবাসতে পারে, আবীর না এলে আমি বোধহয় জানতামই না। আমাদের বাড়ির সবাইও যেন আবীরে মুগ্ধ হয়েছিল।
বিয়ে হলো।
এবার শুরু হলো, আমার পরীক্ষা নেবার পালা।
বিয়ের রাতেই কাঁচ টানলাম মাঝখানে।
—না ছুঁয়ে থাকতে পারবে বলেছিলে না, এখন থাকো। ইচ্ছেমতো থাকো।
আবীর খুব হাসলো আমাকে নিয়ে।
—বুঝলে জুঁই, একধরনের মাছ হয়। ভেদা মাছ। এদেরকে যখন ধরা হয়, এগুলো একটুও নড়ে না। মনে মনে কি বলে জানো, একবার ধরুক আমাকে। ঝুড়ির ভেতর নেওয়ার পর বুঝাবো মজা। মাছটা ধরে যখন ঝুড়িতে নেওয়া হয়, এরা যা লাফালাফি করে বলার বাইরে। অথচ লাভ হয় না কিছুই। ততক্ষণে মাছ ধরা হয়ে গেছে। তুমি হচ্ছো সেই ভেদা মাছ। আমার ঝুড়িতে ঢুকে বলছো, ছুঁতে দেবে না।
আমার এত রাগ হলো।
—আমি সত্যিই ছুঁতে দেবো না। তুমি যদি জোর করো তখন অন্য হিসাব।

ভালোবাসা ভীষণ অন্যরকম রূপ নিয়ে ধরা দিলো আমার কাছে। সুখ আর গর্ব মিলে যেটা হয়, সেটার মতন!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here