প্রেমের শুরু,পর্ব_৪ শেষ

0
4327

প্রেমের শুরু,পর্ব_৪ শেষ
তৃধা আনিকা

আবীর ভাবলো, আমিই কাঁচের ওপাশে তাকে ডাকতে যাবো। উঁহু! আমি গেলাম না। মাঝে মাঝে অন্যের ছটফটানি দেখতে যে এত আনন্দ হয় বলে বুঝাতে পারবো না। বেচারা! না বলতে পারছে, না ঘুমুতে পারছে। আমার তো সেই এক কথা, আমায় পেতে চাও তো চোখ বন্ধ করে আমার পায়ে পড়তে হবে। অথচ সে মচকাবে না। সময় কাটতে লাগলো। আমাদের এই কাঁচের এপাশ ওপাশ অস্থিরতাময় ভালোবাসাও দিন দিন অস্থির হতে থাকলো। আহারে শেষমেষ জেলে ভেদা মাছের জেদের কাছে হার মানলো। এক ঝুম বৃষ্টির রাতে বেচারা অভিমান করে গিয়ে বৃষ্টিতে বসে থাকলো। মুখে এক কথা, জ্বর হয়ে মরে যাবো আমি। কপাল ছুঁয়ে কেউ যেন আমার জ্বর না দেখে। আর আমি? তাও শক্ত হয়ে দূরে থাকলাম। আবীরের জ্বর হলো৷ সত্যিই খারাপ অবস্থা! হসপিটালাইজড করতে হলো। ডাক্তার-নার্স ছুটোছুটি করে একাকার। এর মাঝে সে আমায় অবাক করে দিয়ে বললো,
—ওইসব মেডিসিন ফেডিসিনে কিচ্ছু সারবে না জুঁই! এ আমার “তোমার নিঃশ্বাস চাই” জ্বর!
—কি করতে হবে?
—ওই যে, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নিঃশ্বাস দিতে হবে। দম আটকে আসা নিঃশ্বাস তখন প্রাণ পাবে।
আমি তখন দর বাড়াই আরো নিজের। আরো শক্ত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিই। ওই যে কথায় আছে, নারী সে পুরুষের বিসর্জন পায়ে দলতে খুব মজা পায়। আমারও সেই অবস্থা। বিসর্জিত আবীর, আর আমি ধনুক হাতে প্রতিমুহূর্তে ধারালো প্রত্যাখ্যানের তীর ছুড়ি। কিন্তু তা আর কতক্ষণ!

মানুষটার সত্যিই জ্বর ছাড়ে না। কি আশ্চর্য! তারপর
হাসপাতালে এক ভোর হওয়ার সময় নরম রোদের ধারায় আবিরকে আমার প্রথম নিঃশ্বাস দেওয়া চুমু।
ভালোবাসায় এত এত পেয়ে যাবার রং হয়, এত এত সুখের ধরন হয় সেই প্রথম জানতে পারা। আমাদের দুজনের আনন্দ নামক সমুদ্রে তলিয়ে যাবার যাত্রার শুরু। জীবন তখন আকাশের নানা রংয়ের মেঘে মেঘে ভাসছে। আমি, আবীর আর আশপাশময় মিশে যাওয়া পৃথিবীর সব আনন্দ-আলো। জীবনের শুরুর সময় তো ওটা, সংসার কি সেটা একদম টের পাইনি। শুধু হৃদয় বুঝলো, নরম অনুভূতিতে গড়িয়ে পড়ার সময় ওটা, হাওয়ায় উড়ে যাওয়া পালক হওয়া মুহূর্ত ওটা। আবীরের ছুটি শেষ হবার পর ও চলে গেল। আর আমি? আমাদের বাড়িতেই থাকলাম।
শুরু হলো, এক নতুন অপেক্ষা। আমার সাথে অপেক্ষা করে “কবে আসবে? কবে আসবে?” এই প্রশ্নটাও। আমাকে অপেক্ষা করতে হয় দুই বছর। আবীর সব প্রসিডিউর শেষ করে নিজের মতো করে বাসা ঠিক করে আমায় সঙ্গে নিয়ে যায়। মনে আছে যাবার দিন বাড়ির সবাই যখন আমায় জড়িয়ে কেঁদে ব্যাকুল হচ্ছে, আমি তখনও অন্য স্বপ্নে। ওখানে গিয়েই আমি আবীরের দেওয়া সব নিষিদ্ধ নাইটিগুলো পরবো। দুজনে অন্য পানীয় হাতে ভিন্ন দৃশ্য দেখবো।

ভিনদেশে গিয়ে সবাইকে ছেড়ে শুরু হলো আমাদের নতুন সংসার। অন্যরকম জীবন। যে জীবন তিনটি নতুন শব্দ আমার কাঁধের উপর জিরোবে বলে বসলো। দায়িত্ব, মানিয়ে নেওয়া, গুছিয়ে চলা। স্বপ্নের সাথে যে জীবনের কোনো মিল নেই। মনের ভেতর রিগ্রেট শুরু হলো, ইশ! কি ভালো ছিলাম আগে। এখানে তো আর্থিক অনটন। ঠিক অনটন নয়, ঢের টাকা পয়সা থেকে আমি গিয়ে পড়লাম হিসেবি টাকা পয়সায়। এত অবাধ অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে টাকা পয়সা হিসেবের ছক কাটা জীবনে মানিয়ে নিতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হবার যোগাড়। শুরু হলো ছোট ছোট ব্যাপারে আমার কষ্ট। এটা নেই, ওটা নেই। এটা ফুরিয়ে গেছে। ওটা সেকেন্ড হ্যান্ড কিনতে কেন হলো? এটা এরকম হলে ভালো হতো, ওটা ওরকম হলে ভালো হতো। হাজার অভিযোগ! হাজারবার আবীরকে দোষ দিই, তোমার টাকা কম; টাকা কম। জীবনে সবকিছু এত অবাধ ছিল আমার কাছে। আমি কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। কিছুতেই না! যন্ত্রণায় আর গোঙানিতে রাত কাটতো পাশ ফিরে। আবীর গায়ে হাত রাখলে, আমি হাঁটু ভাঁজ করে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আবীর আদরে, অভিমানে আমার শরীরের ভাঁজ ভাঙবার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তবু কখনোই জোর খাটায় না আমার উপর। আমি দোষ দিয়ে ওকে ছোট করি। আবীর মাথা নেড়ে সায় দেয়। নিজেই বলে,
—এত ভয়ংকর বড়লোকবাড়ির মেয়েটা কেন প্রেমে পড়লো আমার। আমি বেগুন ভাজি খাওয়া বউ চেয়েছিলাম, ইলিশ মাছের ডিম ভাজা খাওয়া মানুষ এসে কষ্ট পাচ্ছে। আহা!
আমি হুমকি দিতে থাকলাম ওকে।
—করবো না সংসার। ছেড়ে চলে যাবো তোমায়!
আবীর অসহায় মুখ করে হুমকি শুনে। তবু নিজের ভালোবাসা থামায় না।

আবীর নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আমাকে সবরকম সুবিধা দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি নিজেও কাজ করতে শুরু করলাম। সচ্ছলতার যুদ্ধে নিজেও নামলাম। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসবার মাঝেই আমাদের সাথে আরেকজন যোগ হলো। নতুন অতিথি। পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর অতিথি। পৃথিবীর সবথেকে আকাঙ্ক্ষিত অতিথি। অতিথির নাম রাখলাম আমি বাবার সাথে মিলিয়ে বীর। বীর সাহেব শান্ত শিষ্ট! একদম বাবার মতো। আমায় একটুও জ্বালায় না। বীর সাহেবের সাথে আমাদের দুজনের শুরু হলো বাবা-মা জীবন। বাবা-মা হলে নাকি নিজেদেরকে শক্ত বর্ম বানিয়ে ফেলতে হয়। সন্তানের জন্য আমরাও নিজেদের বীরের বর্ম বানিয়ে নিলাম।
বীরের আট মাসের সময় আমরা প্রথম টের পেলাম বীর কথা বলতে পারে না। আকাশ ভেঙে পড়া ব্যাপারটা নিজে অনুভব করলাম সত্যিকারভাবে। শুধু আবীর বললো,
—কথা বলাটাই সব নয়। আমাদের সন্তান সুস্থ, এই বেশি জুঁই!
আমার জীবনে অভাব অনটনের অভিযোগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সেই প্রথম অনুভব করলাম, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাই জীবনের কষ্ট নয়। এর বাইরেও করুণাময় অনেকভাবে পরীক্ষা নিতে পারেন। এর থেকে অনেক বড় কষ্টও জীবনে আছে।

আমার ভেতরকার দুঃখ তখন অন্যরকম। আবীর যেন প্রতিমুহূর্তে ওর জীবনের সেরা পরীক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছিলো। যেমন আমার অসন্তোষ্টিতেও কখনও আমায় বকেনি, তেমনি বীরের ক্রাইসিসের সময়েও ও একদম শক্ত।
এক রাতে আমি ওকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
—তুমি সব এত পারো কি করে আবীর? এত মানিয়ে নেয়া৷ এত কিছু! আমি তো কিছুই মানিয়ে নিতে পারি না। তুমি কি করে একসাথে এত প্রবলেমের সাথে ফাইট করতে পারো বলোতো?
আবীর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল,
—মা-বাবাহীন এই পৃথিবীতে আমায় কেন করুণাময় একা পাঠিয়েছেন জানো? আমি সব সামলাতে পারবো বলে। আমার ভেতর আল্লাহপাক সব ট্রায়াল ফেইসের শক্তি দিয়ে তবেই একলা ছেড়েছেন।
—তাও এত এত কঠিন সিচুয়েশনে কি করে পার করো বলোতো? আমার তো হাল ধরতেই ইচ্ছে করে না।
—হাল তো আমিও ধরি না জুঁই। শুধু এটুকু সবসময় মনে রাখি “পারি না” এটা বলা লজ্জার। বরং “চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা” এটা বলা গর্বের! সফলতার মতো ব্যার্থতাও একটা অনুমোদিত সনদ। যেটা প্রমাণ করে অন্তত তুমি কাজটা করেছো।
আমি মন ঠিক করলাম। এখন থেকে আবীর হবে আমার আদর্শ! আমি প্রবলেমের সাথে ফাইট করবো না। আমি শুধু আমার স্বভাবটা ওর মতো করে নেবো।

শুরু হলো আমার নিজের গ্রুমিং। আবীরের মতো নিজেকে অভিযোগ করা জিনিসটা থেকে সরিয়ে ফেললাম। প্রথম প্রথম যুদ্ধটা কঠিন মনে হচ্ছিলো খুব। আস্তে আস্তে পারতে লাগলাম। একদম আবীরের মতো করে। শুধু ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস, এনাফ! নিজেকে ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঢালতে লাগলাম। একদম ওর ছাঁচে ফেললাম নিজেকে। সে কি এক অদ্ভুত ভালোলাগা! জীবনে অশান্তি কমে যেন শূন্যতে চলে এলো। আমিও আবীরের মতো হয়ে গেলাম। সবকিছু সামলাতে পারি। সবকিছুতে করুণাময়ের উপর সন্তুষ্ট। ঘরের মধ্যে সব যেন শান্তিময় সমৃদ্ধিতে ভরে এলো। আমি তখন মনে মনে জানি সৃষ্টিকর্তা পরীক্ষা নিয়েছিলেন আমার।

কিন্তু এরপরও যে বিশাল চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানতো? আবীর যে কার কোম্পানিতে কাজ করতো, সেখানে সে ইলেভেন পারসেন্ট শেয়ার পেয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে নয়, ওটা তাঁর দীর্ঘদিনের চেষ্টা আর কাজে। আমাদের জীবনে স্বচ্ছলতা ফিরে এলো সুন্দরভাবে। কি ভাবছেন? আচমকা বড়লোক হয়ে উঠায় আমাদের জীবন বুঝি বদলে গেল। উঁহু। আমরা আমাদের মতোই রয়েই গেলাম। কারণ ততদিনে আমার “টাকা আর সবকিছু চাই” এই নেশা কেটে গিয়ে আমিও যে আবীরের মতো হয়ে গেছি। বিশাল সেই টাকা পয়সায় আমি আর আবীর নতুন একটা কাজ শুরু করলাম। যা আমার অনেক বড়লোক বাপের বাড়ির কেউ করতে পারেনি সেটা আবীর শুরু করলো। ওখানেই একটা হোম শুরু করলো ছোট্ট করে। যেখানে শুধু অস্বচ্ছল কথা বলতে পারে না এমন শিশুদের পড়াশোনা থেকে সব ধরনের দায়িত্ব নেয়া হবে। আমরা খুঁজে খুঁজে এমন শিশুর দায়িত্ব নিতে শুরু করলাম। আমরা শুধু এসোসিয়েশনটা শুরু করেছিলাম। এত এত হেল্প আসতে লাগলো। চোখের পলকে আমাদের সেই সংস্থা কানাডায় সাড়া ফেলে দিলো। আজ আমরা দুজনে অনেকের গল্পের পেছনের গল্প! তারপরের গল্পটা শুধু আনন্দের আর আনন্দের। আমাদের আনন্দের!

আজ যখন এই গল্পটা লিখছি, আনন্দে আর গর্বে আমার বুক ভরে আসছে। আবীরের হাত ধরে আমি আমার নতুন জীবনের শুরু করেছিলাম মাত্র কয়েকবছর আগে। আমি নতুন করে মানুষ হয়েছিলাম ওকে ভালোবেসে। নতুন করে পৃথিবী দেখেছি ওর মতো একজন হয়ে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছি ওর মতো করে। বিশ্বাস, ভরসা, সন্তুষ্টি মাত্র তিনটি শব্দের তৈরি আবীর মানুষটা যেন আমার জীবনের অন্য আরেক ছাঁচ! যে ছাঁচে পড়ে আমি নিজের মতো করে ফুটেছি।

ও হ্যাঁ! এখন মাঝে মাঝে আমি যখন আমার ছেলেকে নিয়ে দেশে আসি, বেশিদিন থাকতে পারি না। আবীর কাজের ব্যস্ততায় এত আসতে পারে না। আমি আসি। আমাদের বাড়ির সবাই আবীর আবীর করে গলা শুকায়। বাবা একশোবার বলে, সোনার ছেলে একটা, হীরের খনি একটা। যে জামাইর কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে একদিন সবার প্রাণে পানি ছিল না, আজ সেই মেয়ের জামাইর গল্প বলতে বলতে দম ধরে পানির তৃষ্ণা পেয়ে যায় সকলের। আমি মনে মনে তখন সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিই। মনে মনে বলি, হে করুণাময় আমি সব পরীক্ষায় শুধু তোমার সাহায্য চাই। আর কিচ্ছু না!

ছেলে বড় হয়ে গেছে এখন অনেক। আমি মাঝে মাঝে আবীরকে যখন জড়িয়ে ধরি, আবীর দূরে ঠেলে আমায়। বলে,
—ইশ বীর দেখলে বলবে, বাবা-মা পঁচা ছিঃ!
আমি মিথ্যে রেগে বলি,
—তোমার ছেলে কথা বলতে পারলে তো বলবে!
আবীর এক পৃথিবী বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকায়। পাথর সম কঠিন কণ্ঠে বলে,
—আমাদের সন্তান একদিন না একদিন কথা বলবেই। আমি জানি, উপর থেকে উনি আমার ভরসার জোর দেখছেন।
আমি বিস্ময় আর ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে পৃথিবীর সেরা মানুষটাকে, সেরা স্বামীটাকে, সেরা বাবাটাকে দেখি। এই তো সেই মানুষ যে কখনোই অসন্তুষ্ট হয় না, কখনোই বিশ্বাস হারায় না। এই মানুষের সাথে প্রতি মুহূর্তেই আমার মনের প্রেমের শুরু হয়! প্রতি মুহূর্তেই আমি তাঁর প্রেমে পড়ি। প্রতিবারই ফিসফিস করে বলি, ভাগ্যিস তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। ভাগ্যিস! এখনো পড়ছি। এ যেন আমার আমৃত্যু প্রেমের শুরুর গল্প!

ও হ্যাঁ আমাদের ছেলে, কথা বলতে পারে না এই ব্যাপারটার পেছনে আমি একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিয়েছি। যদি বীর কথা বলতে পারতো তবে হয়তো, আমি বদলাতাম না। হয়তো অনেক কথা না বলা অস্বচ্ছল শিশু আবীরের ভেতরকার ভালোবাসা পেতো না। আসলেই সৃষ্টিকর্তার রহস্য বুঝবার সাধ্যও কারো নেই। কারো নেই। একেবারেই নেই।

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here