প্রেম পায়রা ?️?️ সূচনা_পর্ব

0
2644

প্রেম পায়রা ?️?️
সূচনা_পর্ব
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)

” আমি আপনাকে কোনোদিনই বিয়ে করতে পারবো না! বিকজ আ’ম প্রেগন্যান্ট!
আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের বাচ্চার মা হতে চলেছি!!”

চোখ দুটো নিচের দিকে স্থির করে নির্বিকার ভাবে কথাটি বলে বসলো মিশরাত। তবে সামনে থাকা ব্যক্তিটির মাঝে যেন বিন্দু পরিমাণ ও পরিবর্তন এলো না। সে পূর্বেই মতোই কফি কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। এতে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত। সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ে বসে,

– ” আমি আপনাকে কিছু বলেছি মিস্টার স্নিগ্ধ!”

স্নিগ্ধ এবার চোখ তুলে তাকালো। দৃষ্টি তার মিশরাতের চোখে আবদ্ধ। কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– ” আর কিছু? ”

থতমত খেয়ে যায় মিশরাত। এ কেমন উত্তর? সে তাকে এতো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে উল্টো জিজ্ঞেস করছে যে আর কিছু আছে কিনা! রাগে দুঃখে হাত মুঠো করে ফেলে সে। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠে,
– ” আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না! দ্যাটস ইট!!”

মিশরাতের কথা কানে আসতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধ। হাতে থাকা ঝুলন্ত কোট টা ঠিক করতে করতে বলে উঠে,

– ” ঠিক আছে! তোমার উত্তর তুমি কাল পেয়ে যাবে!”

বলেই রেস্টুরেন্টের বাহিরের দিকে গটগট করে হাঁটা শুরু করে স্নিগ্ধ। আর মিশরাত‌ এখনো ড্যাবড্যাব করে বোকার মতো স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে কয়েক পলক তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সেও পার্স হাতে তুলে রওনা দেয় বাইরের দিকে।

আগস্টের মাঝামাঝি সময়। আবহাওয়া কখন কি রূপ নেয় বলা অনেক মুশকিল। এই কখনো রোদ আবার কখনো বৃষ্টি। ঠিক তেমনি খাঁ খাঁ রৌদ্রতপ্ত দুপুরে রিকশায় বসে আছে মিশরাত‌। রিকশার হুড উপরে উঠানো থাকায় আশেপাশে বেশি কিছু নজরে পড়ছে না। প্রায় আধঘন্টা পর রিক্সা এসে থামলো বাসার সামনে। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে বাসার সামনে এসে কলিং বেলে চাপ দেয় সে।
মিনিট পাঁচেক পর একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দেয়। মিশরাত‌ ও মহিলাটিকে দেখে খুশিতে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।

– ” আরে খালামনি! তুমি? কেমন আছো তুমি?
কখন এসেছো?”

ভেতরে যেতে যেতে প্রশ্ন গুলো করে মিশরাত। মিসেস ইশিতা ওরফে মিশরাতের খালামনি হালকা হেসে বলে উঠলেন,
– ” আমি আসবো না এটা হয় নাকি!
আমার একমাত্র ভাগ্নির বিয়ে ঠিক হয়েছে ‌অথচ আমি থাকবো না? কোনো মানেই হয় না!”

মিসেস ইশিতার কথা শুনে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে মিশরাত‌!
মনে মনে বলে উঠে,

-” বিয়েটা হলে তো!”

মিশরাত। পুরো নাম মিশরাত ফারাহ্। দেখতে মাঝারি গড়নের। নাকটা সরু, চোখ গুলো গাঢ় বাদামী বর্ণের! আর ঠোঁটের নিচে কালো কুচকুচে একটা তিল। অনার্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পরিবারের সদস্য বলতে মা, বাবা, বড় ভাই এবং ভাবী রয়েছে। দুই ভাই বোনের মাঝে মিশরাতের চঞ্চলতাই একটু বেশি।

মিশরাতকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে পেছন থেকে মিসেস ইবনাত ওরফে মিশরাতের মায়ের ডাক পড়ে।

– ” কি ব্যাপার, ওভাবে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে? এতো তারাতাড়ি ফিরে আসলি?
ওখানে গিয়ে কি হলো কিছু তো বলবি!!”

মায়ের কথায় আমতা আমতা করে উঠে মিশরাত‌। এখন যদি রেস্টুরেন্টে ঘটা কান্ড বলে দেয় তাহলে নির্ঘাত তার কপালে কোনো অঘটন রয়েছে। তাই মিনমিনে গলায় বলে উঠল,

– ” আমি আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর না হয় সবটা বলবো!”

মিসেস ইবনাত কিছুক্ষণ সন্দিহান দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেন,

– ” আচ্ছা ঠিক আছে! আগে উপরে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নে!
তারপর না হয় সব শোনা যাবে!”

মায়ের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতো গুটি গুটি পায়ে উপরে চলে যায় মিশরাত‌। রুমের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করতে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয় মিশরাত‌। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে!

পেছনে ফিরতেই আঁতকে উঠে সে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,

– ” ব,বউ,বউমনি তুমি!”

——————–
সারাদিনের ধকল কাটিয়ে বাড়ি ফিরে স্নিগ্ধ। টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে দু গ্লাস পানি নিমিষেই ঢকঢক করে শেষ করে ফেলে সে। পাশ থেকে মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী এসে দাঁড়ায় স্নিগ্ধর সামনে।

– ” মা, তুমি এখানে কি করছো?
বাবা কেমন আছে? ডাক্তার কি বলেছে?
বাবার শরীরের কন্ডিশন কি?
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী কাতর কন্ঠে বলে উঠেন,
– ” কিছু বলা যাচ্ছে না! ডক্টর বলেছে এখনো তোর বাবা আগের কন্ডিশনেই আছেন!
কি থেকে কি হয়ে গেল!”
বলেই হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী।
স্নিগ্ধ রাগে ক্ষোভে পাশে থাকা কাঁচের গ্লাস হাতে নিয়ে এতো জোরে চেপে ধরে যে সেটা কিছুক্ষণ পরই টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ভাঙা কাঁচের কয়েক টুকরো হাতের মধ্যে বিঁধে যায়। তাতেও যেন কোনো হেলদোল নেই তার মাঝে। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বিলাপ করতে থাকে,

– ” সব আমার জন্য হয়েছে!
আমি আমার জেদ ধরে রাখতে গিয়ে বাবার এমন অবস্থা হয়েছে!
আমি যদি হ্যাঁ বলে দিতাম তাহলে এভাবে বাবাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হতো না!”

এদিকে মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন স্নিগ্ধর হাত নিয়ে। টুপ টুপ করে লাল রক্তের স্রোত তার বেয়ে ভেসে যাচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে তুলো দিয়ে প্রথমে রক্ত গুলো মুছে নিলেন মিসেস ইয়ামিন। কাঁচের টুকরো গুলো এক এক করে বের করতেই আহ্ শব্দ করে উঠে স্নিগ্ধ। মিসেস ইয়ামিন ধীরে ধীরে স্নিগ্ধের হাত ব্যান্ডেজ করে দিলেন।

স্নিগ্ধ। পুরো নাম আশফিন‌ চৌধুরী স্নিগ্ধ। উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। শ্যামলা রঙের হলেও চোখে রয়েছে অদ্ভুত রকমের নেশা! ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়েছে। চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্ট্রির অনার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু একরোখা আর রগচটা স্বভাবের কারণে সবাই তাকে ভয় পায় আর এড়িয়ে চলে।

বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছেন ইফতেখার চৌধুরী ওরফে স্নিগ্ধের বাবা। পরপর দুবার স্ট্রোক করার ফলে শরীরের অনেকটা অংশই ড্যামেজ‌ হয়ে গিয়েছে। এবারের স্ট্রোক আঘাত করায় অনেকটা বেশি ইফেক্ট পড়ে যার কারণে তাকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে প্রভার কারণবশত এবারের স্ট্রোক আগের দুটোর থেকে অনেকটাই ভয়ঙ্কর ছিলো।

– “ওখানে গিয়ে কি হলো? মেয়েটার সাথে দেখা করেছিস? কি মনে হলো!
তোর পছন্দ হয়েছে মেয়েটাকে?”

বেশ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ইয়ামিন। স্নিগ্ধ সবে মাত্র এক লোকমা ভাত মুখে পুরেছিলো, মায়ের কথা শুনে মুখ আপনাআপনি আটকে গেল। কোনোমতে সেটুকু শেষ করে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে,

– ” হ্যাঁ মেয়েটার সাথে আজকে দেখা হয়েছে! আর আমার ও মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে!”

না চাইতেও জোরপূর্বক মিথ্যে কথা বলতে হলো স্নিগ্ধকে। সে চায় না তার জন্য আবারো তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ুক।
এতো বছর পর ছেলের মুখে সম্মতি পেয়ে অনেকটাই খুশি হলেন মিসেস ইয়ামিন। যার কারণে তিনি বলে উঠেন,
– ” আলহামদুলিল্লাহ!”

ড্রয়ার থেকে কালো রঙের ডায়েরিটা বের করে পাশে রাখলো স্নিগ্ধ। দীর্ঘ ছ মাস পর আবারো ডায়েরিটায় হাত ছোঁয়ালো সে। সময়ের পরিক্রমায় তার জীবনের অধ্যায়গুলো ওলোটপালোট করে দিয়েছে যেগুলো চাইলেও বোধহয় আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
ফোনের ভাইব্রেশন এর শব্দ কানে যেতেই ধ্যান ভেঙে যায় স্নিগ্ধর‌। ফোনের আফরান নামটা জ্বলজ্বল করছে। আফরান হচ্ছে স্নিগ্ধর এসিস্ট্যান্ট। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে
আফরান বলে উঠে,

– “স্যার ………….!”
আফরানের বলা কথায় স্নিগ্ধর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠে।
কল কাট করে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠে,

– ” বিয়ে তো তোমার আমাকেই করতে হবে মিস মিশরাত‌। সেটা যেভাবেই হোক না কেন!”

– “বউমনি তুমি এখানে কি করছো!”
অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসে মিশরাত‌।
এতক্ষণ ফোনে স্ক্রল করলেও মিশরাতের কথা কানে যেতেই ফোন থেকে মাথা তুলে তাকায় মেহের। মুখের মধ্যে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠে,

– ” আরে ননদিনী‌, এসেছো তাহলে!
অনেকক্ষণ ধরে তোমার জন্য বসে থাকতে হয়েছে!
এবার যখন এসেই পড়েছো তখন ঝটপট করে বলো কি হলো ওখানে?
ছেলে পছন্দ হয়েছে?”

মেহেরের কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে ফেলে মিশরাত। ভাবীকে অনেক আগে থেকেই বউমনি বলে ডাকাটা তার অভ্যাস। হাতে থাকা পার্সটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে উঠল,

– ” বউমনি তুমিও মা’র মতো আসতে না আসতেই জেরা শুরু করে দিলে!
তোমরা সবাই মিলে আমার বিয়ের পেছনে এভাবে লেগেছো কেন? বলবে আমাকে?”

মিশরাতের কথায় মেহের হালকা হেসে বলে,
– ” আরে পাগলী এভাবে বলছিস কেন? বাবা তো তোর ভালোর জন্যই এসব করছেন!
আর প্রত্যেক বাবা মাই চায় তার আদরের রাজকন্যা কোনো বিশ্বস্ত একটা মানুষের কাছে তুলে দিতে।
আর আমার মনে হয় এবারের বিয়েটা ফাইনাল ই হবে!
কেননা ছেলেটা দেখতে যেই হ্যান্ডসাম, মাশাআল্লাহ! তোর তো এক দেখায়ই পছন্দ হওয়ার কথা!!”

আড়চোখে একবার মেহেরের দিকে তাকায় মিল্লাত। অতঃপর মুখে একটা দুষ্টু হাসি বজায় রেখে বলে উঠে,
– ” আর আমি যদি বলি বিয়েটা হবে না!!
ইভেন ছেলে নিজেই আমাকে রিজেক্ট করবে! সেখানে বিয়ের কোনো প্রশ্নই আসে না!”

ভ্রু কুঁচকে ফেলে মেহের। কি এমন হয়েছে যে ছেলে নিজেই রিজেক্ট করবে?

– ” কেন তুই এত গ্যারান্টি দিয়ে কিভাবে বলছিস যে ছেলে নিজেই তোকে রিজেক্ট করবে আর বিয়েটাও হবে না!
কি এমন বলেছিস ছেলেকে?
সাসপেন্স না রেখে সবটা খুলে বল।”

চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে উঠলো মেহের।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে কপালে থাকা কালো কুচকুচে টিপ টা উঠাতে উঠাতে মিশরাত নির্বিকার ভাবে বলে উঠলো,

– ” বেশি কিছু না, শুধু এটুকুই বলেছি যে আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের বাচ্চার মা হতে চলেছি। আমার গর্ভে তার সন্তান বেড়ে উঠছে!!”………..

চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here