প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (১২)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি
সকাল হতেই রায়হানা বেগম ছেলের জন্যে রান্নার তোরজোড় শুরু করে দিয়েছেন।ছেলের পছন্দের হরেক রকম খাবার রান্না করে টেবিলে পরিবেশন করছেন তিনি।কাজের মাজেই সবাই এসে উপস্থিত হলেন।কিছুক্ষন পর অর্থও আসলো।ব্রেকফাস্ট করতে সবাই টেবিলে বসতেই।রায়হানা বেগম যখন অর্থকে পছন্দের খাবার আলু পরোটা দিতে নিলেন।অর্থ প্লেট সরিয়ে দিলো।মাত্রই প্লেটে ডিমটা তুলেছিলো প্রাহি। তাকে রাগি গলায় ডেকে উঠে অর্থ।
-” প্রাহি।”
হঠাৎ এমনভাবে ডাক দেওয়াতে ভয় পেয়ে যায় প্রাহি।ও হুরমুরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।অর্থ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না।দীর্ঘ একটা মাস যে যন্ত্রনাগুলো ভোগ করেছে তা যেন রাগের মাধ্যমে ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।অর্থ প্রাহিকে প্রায় ধমকে বললো,
-” যাও আমার জন্যে এককাপ কফি আর ব্রেড টোস্ট নিয়ে আসো।”
রায়হানা বেগমের চোখ ভরে আসতে চায়।তিনি বলেন,
-” পরোটাটা খা বাবা এটাতো তোর অনেক পছন্দ।”
অর্থ তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
-” সবচেয়ে বেশি যা ভালোবেসেছি তার থেকেই দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিলে।আর এই সামান্য পছন্দ করা খাবার আর কি হবে?এইগুলোও সরিয়ে নেও।আমার আজ থেকে কোন পছন্দ নেই।”
টেবিলের প্রতিটা মানুষ আজ উপলব্ধি করতে পারছে অর্থ ঠিক কতোটা কষ্ট পেয়েছে।নাহলে নিজের মায়ের সাথে এরকম করতো না।প্রাহির নিজেকে অপরাধি লাগছে ওর জন্যেই তো এতো কিছু হয়েছে।অর্থ ভ্রু-কুচকে প্রাহিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ডোন্ট ব্লেম ইউরসেল্ফ।এখন আমি যা বলেছি তা করো গিয়ে জলদি যাও।”
প্রাহি তাড়াতাড়ি করে কিচেনে চলে গেলো।কফি বানাতে বানাতে বিরবির করে অর্থকে বকা দিচ্ছে।হুহ্, রাক্ষস একটা সারাক্ষন শুধু ধমকাধমকি করে।কাল সে আই লাভ ইউ বলেছিলো সেই পরিপেক্ষিতে আমাকেও আই লাভ ইউ বলতে বলেছিলো।আমি কিভাবে বলবো?আমি এখনো ভালোবাসার আসল মানে ভালোভাবে বুজতে পারি না।তবে লোকটাকে আমার ভালোলাগে এটা জানি।কিন্তু উনার সামনে ওটা কিভাবে বলি?আমার তো লজ্জা করে তাই না?আই লাভ ইউ বলি নাই তাই আমাকে এমন ধমক দিলো।আমার এটোমেটিকলি কান্না করতে করতে মনে হয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।ব্যাটা বজ্জাত।
এভাবে বকে কফি আর ব্রেড টোস্ট নিয়ে অর্থকে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় যেতে নিলে অর্থ ওকে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো।প্রাহি অসহায় দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো।হিয়া এমন একটা ভান করলো যেন সে কিছুই জানে না।প্রাহি এইবার অর্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” আমার প্লেট তো ওইসাইডে।আমি ওইখানে গিয়ে খাই?”
অর্থ প্রাহির কথা জবাব দিলো না।হেমন্তকে বললো,
-” হেমন্ত ওর প্লেটটা এদিকে দে না।”
হেমন্ত তাই করলো।অর্থ ঠাস করে প্লেটটা প্রাহির সামনে রাখলো।তারপর রাগি চোখে প্রাহির দিকে তাকালো। প্রাহি ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।আস্তে আস্তে খেতে লাগলো।
সবাই অর্থ আর প্রাহিকে দেখছে।এখন সবাই বুজতে পারছে অর্থ প্রাহিকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে। ব্রেকফাস্ট শেষে অর্থ প্রাহির হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো বাড়ির থেকে।প্রাহি মুখ ফুলালো।
অর্থ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তারপর ভ্রু-কুচকে প্রাহির দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কি সমস্যা?”
প্রাহি মিনমিনিয়ে বলে,
-” কিসের সমস্যা?”
অর্থ দাঁতেদাঁত চিপে বললো,
-” সেটাই তো আমি জিজ্ঞেস করছি।”
প্রাহি বলে উঠে,
-” আসার সময় ওইভাবে টেনে আনলেন কেন?সবাইকে একবার বলে তারপর তো বের হতে পারতাম।সবাই কি ভাবছে?”
অর্থ রাগি স্বরে বললো,
-” সবার কথা এতো চিন্তা করে কি হবে?আমাকে নিয়ে তো দু মিনিটও চিন্তা করো না?”
প্রাহি অন্যমনস্ক হয়ে মুখ ফুসকে বলে উঠলো,
-” কে বলেছে চিন্তা করিনা?জানেন গত একমাস আমি আপনাকে কতো মিস করেছি?কতো চিন্তা করেছি?”
সাথে সাথে অর্থ গাড়িতে ব্রেক কষলো।অবাক হয়ে তাকালো প্রাহির দিকে।এদিকে প্রাহি হঠাৎ ব্রেক লাগানোতে হালকা ভয় পেয়েছে।তারপর ওর খেয়াল হলো ও কি বলে ফেলেছে।ইসস,কি লজ্জা কি লজ্জা।কাল থেকে এমনিতেও ওর কি যে কি পরিমান লজ্জা লাগছিলো।এখন তো তা আরও দ্বিগুন বেরে যাবে।প্রাহি মুখে হাত দিয়ে ভীতু চোখে অর্থ’র দিকে তাকালো।
অর্থ’র ঠোঁটের কোনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু প্রাপ্তির হাসি দেখা যাচ্ছে।অর্থ সরাসরি প্রাহিকে জড়িয়ে ধরলো।অনেকক্ষন ওইভাবেই থাকলো।অর্থ শীতল কন্ঠে বলে,
-” আই মিস ইউ টু প্রাহি।”
তারপর প্রাহিকে ছেড়ে দিয়ে ওর দুগালে হাত দিয়ে বলে উঠে,
-” প্রাহি?আমি অনেক খারাপ?তোমাকে কথায় কথায় ধমক আর বকা দেই তাই বলে কি তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে বলো?আমার এই শাষকের পিছনে তোমার জন্যে যে অফুরন্ত ভালোবাসা আছে তা তুমি কি দেখতে পাওনা বলো?তবে আমি প্রমিস করছি আমি তোমাকে আমার সবটা দিয়ে আগলে রাখবো।তুমি থাকবে তো আমার সাথে?”
প্রাহি মায়াভরা চোখে অর্থের দিকে তাকিয়ে আছে।প্রাহি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে অর্থ’র গলা জড়িয়ে ধরলো।তারপর আলতো করে অর্থ’র কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো।অর্থ’র হৃদয়টা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো। এই মেয়েটা নিশ্চিত ওকে পাগল বানিয়ে দিবে।প্রাহি নিজেও অবাক ও এতো সাহস কোথাথেকে পাচ্ছে।এতোকিছু কিভাবে করতে পারলো?তবে এই মুহূর্তে অর্থকে এতো খুশি দেখে ওর নিজেরও অনেক ভালো লাগছে।প্রাহি হালকা আওয়াজে বলে,
-” যাবো নাহ।আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আপনার সাথেই থাকবো সারাজীবন।এখন আমাকে ছাড়ুন স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
অর্থকে প্রাহিকে ছেড়ে দিয়ে প্রাহির কপালে ঠোঁট ছোয়ালো।প্রাহি আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।
তারপর অর্থ সোজা হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
প্রাহি আঁড়চোখে বারবার দেখছে অর্থকে।লোকটা অনেকটা পাগলাটে।রাগিও বটে।তবে প্রাহি এতোটুকু বুজতে পারছে অর্থ ওকে ছাড়া মরে যাবে।বাচঁতে পারবে না।আর প্রাহি বুজতে পেরেছে ওর মনেও অর্থের জন্যে কিছু আছে।হোক সেটা ভালোলাগা।একদিন এই ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা হতে কতোক্ষন।একদিন না একদিন তো প্রাহিকে কারো স্ত্রী হতে হবে।তাহলে সেটা অর্থ’র স্ত্রী হলে সমস্যা কোথায়?লোকটা ওকে ভালোবাসে।প্রাহি তো এটাই চেয়েছিলো সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে যে ওর জীবনে এমন কাউকে সে পাঠাক যে ওকে অনেক ভালোবাসবে।আর প্রাহি এখন এটা বুজতেও পারছে যে সেই লোকটা আর কেউ না অর্থ।হ্যা অর্থ রাগি বেশি।কিন্তু তার এই রাগের পিছনে প্রাহি নিজের জন্যে অসীম ভালোবাসা খুজে পায়।প্রাহি এতোটাও অবুঝ না যে এতোটুকু সে বুজবে না।
হিয়া বলেছে ওকে গত একমাস অর্থ কতোটা পাগলামি করেছে ওর জন্যে।এই লোকটা যে ওকে ভালোবাসে এটা তো ওর জন্যে সৌভাগ্য।আর তার এই ভালোবাসেকেই প্রাহি সারাজীবন আগলে রাখবে।
অর্থ ড্রাইভিং এর ফাকে ফাকে প্রাহিকে দেখা মিস করছে না। স্কুল ড্রেসে মেয়েটাকে এতো কিউট লাগে, বলে বুজানো যাবে না।ইসস,এই পিচ্চি মেয়েটাকে এতোটা ভালোবাসলো কিভাবে অর্থ?এই পিচ্চিটা ওর পুরো অস্তিত্বে মিশে গিয়েছে।কবে যে তার পিচ্চিটা বড় হবে।আর কবে যে সে ওকে একেবারে নিজের করে পাবে।সেই অপেক্ষাতেই আছে অর্থ।তবে অর্থ নিজেকে দিয়ে গ্যারান্টি দিতে পারছে।বেশি দিন অপেক্ষা ওর পক্ষে সম্ভব না।যখন বেশি বেতাল দেখবে প্রাহি উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে আনবে।
প্রাহি আবারও আঁড়চোখে অর্থ’র দিকে তাকাতে নিলে চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।অর্থ চোখ টিপে দেয় প্রাহিকে।প্রাহি সাথে সাথে লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।ইসস এই লোকটা ওকে এইভাবে লজ্জা না দিয়ে পারে না।প্রাহি মাথানিচু করে বসে রইলো।আর একবারও তাকালো না অর্থ’র দিকে।
কিছুক্ষনের মাজেই ওরা প্রাহির স্কুলের সামনে চলে আসলো।অর্থ প্রাহির কপালে চুমু খেয়ে ওকে সাবধানে থাকতে বললো।আর কোন সমস্যা হলে সেটাও যেন ওকে জানায়।এই স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে অর্থ কথা বলেছে এটাও জানিয়েছে।তারা প্রাহির খেয়াল রাখবে। প্রাহি মাথা নাড়িয়ে সব কথা শুনলো।তারপর স্কুলের ভীতরে চলে গেলো।অর্থও চলে গেলো নিজের কাজে।
#চলবে_______