প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (২৭)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি
তিনদিনে সুন্দরভাবে বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই আরাফ আর হিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হলো।আজ সবাই যার যার নিজ ঠিকানায় চলে যাবে।হিয়া হাউমাউ করে কান্না করছে।কতোক্ষন মাকে ধরছে তো এই বাবাকে ধরছে।হেমন্তকে ধরে তো সেই চিৎকার।নিজের কাকা কাকির কাছে গিয়েও কান্না করেছে।
প্রাহির কাছে গিয়ে ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিলো,’ আমার ভাইটাকে দেখে রেখো প্লিজ।’ প্রাহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।প্রাহির চোখ দিয়েও জল পরছে।
সবার শেষে অর্থ’র কাছে গেলো।অর্থ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।কলিজার বোনটা চলে যাবে।আর কখনো কোন বায়না নিয়ে আসবে ওর কাছে।মুখ ফুলিয়ে অভিমান করবে না ওর কাছে।অর্থ’র কলিজাটা যেন কেউ টেনে হিচঁরে ছিরে ফেলছে।ছেলেমানুষ হয়ে এই একসমস্যা সহজে সবার সামনে কাঁদতে পারেনা।তাহলে যে বাহিরের মানুষদের কাছে সে দূর্বল প্রমান হবে।ছেলেদের তো হতে হয় শক্ত মনের। যারা কঠিন পরিস্থিতিতেও কাঁদে না।অর্থ হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে,’ কাঁদেনা তো।ভাইয়া আছি তো।আবার কালকেই তো চলে আসবি আমার কাছে।কাঁদেনা।’
হিয়া অর্থকে ঝাপ্টে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,’ আমি যাবো না ভাই।আমি যাবো না।’
অর্থ হিয়াকে ধরে নিয়েই আরাফের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর আরাফের হাতে হিয়ার হাতটা তুলে দিলো।আরাফ করুন চোখে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে।মেয়েটার কান্না একদম সহ্য হচ্ছে না ওর।একদম না।অর্থ ভেজা কন্ঠে আরাফকে বলে,’ আমার বোনটাকে দেখে রাখিস প্লিজ।বড় আদরের তো।কখনো কষ্ট দিস না।তোর কাছে এই ভাইয়ের এক করুন অনুরোধ।’
আরাফ একসাইড থেকে জড়িয়ে ধরলো অর্থকে।বললো,’ কেন কষ্ট পাচ্ছিস।তোর বোনের কান্না থামা প্লিজ।ওকে আমি কতোটা ভালোবাসি সেটা তো জানিস তুই।ওর কান্নায় আমার কলিজা ছিরে যাচ্ছে।’
অর্থ শুকনো ঢোক গিললো।নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে আরাফকে কিছু একটা ইশারা করলো।আরাফ ইশারা পেয়েই।হিয়াকে টেনে অর্থ’র কাছ থেকে ছাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো।তারপর সাবধানে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।দ্রুত দরজা আটকে গাড়ি স্টার্ট করতে বললো।হিয়া জানালা দিয়ে চেচাচ্ছে, ‘ ভাইয়া! আমি যাবো না ভাইয়া।’
দেখতে দেখতেই চলে গেলো গাড়িটি সুদূরে।ওরাও রওনা হবে।হেমন্ত আর অর্থ নিজের মা, চাচিকে সামলালো।তারপর তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।হেমন্ত আর ইশিও তাদের সাথে চলে গেলো।আস্তে আস্তে সব মেহমানও চলে গেলো।শুধু রইলো প্রাহি আর অর্থ।অর্থ প্রাহিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তারাও রওনা হলো।পথে একটা কথাও হলো না।গাড়ি যখন ঢাকা এসে পরলো।অর্থ একটা শুনশান খোলা মাঠে গাড়ি থামালো।তারপর হঠাৎ নিজে গাড়ি থেকে নেমে প্রাহিকে নামালো।পরে দ্রুত পায়ে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে প্রাহিকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও ঢুকলো।প্রাহিকে একেবারে গাড়ির দরজার সাথে চেপে বসিয়ে দিয়ে।অর্থ প্রাহির কোলে মাথা রাখলো।
আকস্মিক কি হলো প্রাহির সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেলো।প্রাহি অর্থ’র দিকে তাকিয়ে দেখে ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।তবে কি লোকটা কাঁদছে?প্রাহি আৎকে উঠে বলে,’ কি হয়েছে আপনার?দেখি সোজা হন তো।’
অর্থ নড়লো না প্রাহির কোমড় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ধীর কন্ঠে বলে,’ ডোন্ট মুভ প্রাহি।আমি কিছুক্ষন তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে চাই প্লিজ।’
প্রাহি আর কিছুই বললো না।থাক কিছু সময় একান্ত তাদের মধ্যেকার।যেখানে থাকবেনা কেউ।শুধু সে আর অর্থ।প্রাহি মনে মনে বললো,, ‘ হ্যা আল্লাহ্। আমাকে উনাকে সারাজীবন এইভাবেই রেখো।আমরা যেন কোনদিন আলাদা না হই।’
কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত কয়েক ঘন্টা।অর্থ ঘুমিয়ে আছে প্রাহির কোলে ঠিক বাচ্চাদের মতো করে।প্রাহির পা ঝিমঝিম করছে তাও ভালো লাগছে।এইযে লোকটা তার সাথে আছে তার ভালো লাগছে।প্রাহি আলতো হাতে অর্থ’র চুলগুলো নড়াচড়া করছে।কি সুন্দর চুলগুলো অর্থ’র।
প্রায় ঘন্টা খানিক পর উঠলো অর্থ।উঠেই প্রাহির কপালে চুমু খেলো। প্রাহি লাজুক হাসলো।অর্থ ঘড়ির টাইম দেখে প্রাহিকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসলো।তারপর রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
—————
পরেরদিন সকালে,,
আজ হিয়া আর আরাফের বউভাত।সবাই রেডি হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্যে।প্রাহি সুন্দর একটা পুরো লাল টকটকে রঙের গাউন পরেছে।রেডি হয়ে নিচে নামতেই অর্থ বাঁকা হেসে ওকে চোখ টিপ মেরে দিলো।প্রাহি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।অর্থ প্রাহিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।পিছনের সিটে হেমন্ত আর ইশি বসেছে।হেমন্ত বারবার আঁড়চোখে ইশির দিকে তাকাচ্ছে।ইশি মুখটা কাচুমাচু করে বসে আছে।হেমন্ত ওর পাশে বসাতে ওর যেন কেমন লাগছে।আবার ভালোও লাগছে।
অর্থ ড্রাইভিংয়ের ফাকে ফাকে প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটাকে লাল গাউনে যেন একটা ফুটন্ত গোলাপ মনে হচ্ছে।
চোখ সরানো দায় হয়ে পরেছে।
প্রাহি তো লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না।হেমন্ত আর ইশির সামনে লোকটা কি শুরু করেছে।আবার হাতটাও ধরে রেখেছে।গাড়ির গিয়ারের উপর রেখে তার উপর নিজের হাত রাখা।ইসস, অসম্ভব ভালো লাগছে প্রাহির।কিন্তু আবার লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে।
সেন্টারের সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় ওরা।তারপর সেন্টারের মাজে প্রবেশ করে। রায়হানা,হিয়াজ,হেনা, হিয়ান্ত আর ওদের দাদা অনেক আগেই এসেছে সেন্টারে।শুধু ওদেরই আসতে একটু দেরি হয়েছে।
অর্থ আর হেমন্তকে দেখেই হিয়া প্রায় একপ্রকার দৌড়ে গিয়েই ওদের জড়িয়ে ধরে।তারপর কান্না ভেজা গলায় বলে, ‘ আমার কথা বুজি তোমাদের মনে পড়ে না?এতো দেরি করলে কেন?’
অর্থ আর হেমন্ত’র চোখজোড়াও ছলছল করছে।অর্থ হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’ এইতো এসে গেছি।আজ আমার বোনটাকে নিয়ে যাবো সাথে করে।’
হেমন্ত হিয়ার মন ভালো করার জন্য দুষ্টুমি করে বললো,’ ইসস, কালকের দিনটা অনেক ভালো ছিলো।শাকচুন্নি বাড়িতে ছিলো না।আজ আবার বাড়িতে শাকচুন্নির তাণ্ডব শুরু হবে।’
হিয়া মুখ ফুলিয়ে কাঁদো গলায় বললো,’ ভাইয়া!!!! এই হেমন্ত ভাইয়াকে কিছু বলবে?’
সবাই হেসে দিলো ওদের দুষ্টুমি দেখে।হিয়া গিয়ে প্রাহি আর ইশিকেও জড়িয়ে ধরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো।আরাফও এসে ওদের সাথে হাসি ঠাট্টায় যোগ দিলো।
প্রাহি এর মাজে পানির তৃষ্ণা লাগায় ও সবাইকে বলে একটু পানি খেতে যায়।যাওয়ার পথে একজন ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লেগে ওর গায়ে জুস পরে যায়।ওয়েটারটা দ্রুত বললো, ‘ সরি সরি। সরি ম্যাম।আমি খেয়াল করতে পারিনি।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করুন।’
প্রাহি ওর গাউনের জুসগুলো ঝেরে সোজা হয়ে বলে,’ ইট্স ওকে ভাইয়া।আমাকে একটু ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিন। এতেই হবে।’
‘ সিয়র ম্যাম।চলুন।’
প্রাহি ওয়েটারের সাথে ওয়াশরুমের সামনে আসলে ওয়েটারুটাকে প্রাহি চলে যেতে বলে।তারপর ও ওয়াশরুমে ডুকে পানি দিয়ে নিজের জামা ক্লিন করতে লাগলো।হঠাৎ ওয়াশরুমের লাইট ওফ হয়ে গেলো।প্রাহি আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে যায়।ঘাবড়ানো গলায় বলে, ‘ এক্সকিউজ মি?প্লিজ?কেউ আছেন?এক্সকিউজ মি?’
প্রাহি দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলেই দেখে দরজা খুলছে না।প্রাহি অনবরত ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ শুনে না কারন বাহিরে লাউডে গান বাজছে।প্রাহির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।প্রাহি পিছাতে গিয়েই কারো সাথে ধাক্কা খায়।আৎকে উঠে পিছনে ঘুরতেই।ব্যাক্তিটি ওর মুখে কিছু একটা চেপে ধরে।প্রাহির চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে।আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসছে।শুধু চোখের সামনে ওর অর্থ’র চেহারাটাই ভেসে উঠছে।প্রাহি চোখ বুজে বিরবির করতে লাগে, ‘ অর্থ ভাইয়া।কোথায় আপনি।প্লিজ জলদি আসুন।’
আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেললো প্রাহি।আর ওই ব্যাক্তিটি বিশ্রি ভাবে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে প্রাহিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, ‘ তোকে ওই অর্থের সাথে এতো সহজে দিয়ে দিবো কিভাবে?যেখানে তোর দিকে আমার সেই কবে থেকেই।ভাবছিলাম তোকে এই একটা বছর কিছুই করবো না।কিন্তু তোর প্রতি অর্থর ভালোবাসা দেখে সহ্য হচ্ছিলো না।আবার তুইও ওকে ভালোবাসিস।দ্যাট্স নট ফ্যায়ের।আমি একরাত হলেও তোকে চাই।চাই মানে চাই।তুই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলি। এখন থেকে একটা বছর তুই আমার কাছে থাকবি।পাখিকে খাচায় এমন ভাবে আটকাবো যাতে ও কখনই উড়াল দিতে না পারি।যদি বেশি ফর ফর করে ওর ডানাটাই আমি ভেঙ্গে দিবো।’
——————-
অনেকক্ষন যাবত প্রাহিকে দেখছে না অর্থ।নিজে একা একাই এদিক ওদিক খুজে বেরাচ্ছে।তাও পাচ্ছে না খুজে।অবশেষে একা আর না পেরে হেমন্ত আর আরাফকে জানালো কথাটা।আস্তে আস্তে ওদের পুরো পরিবার জানলো যে প্রাহিকে পাওয়া যাচ্ছে না।সবাই ভয় পেয়ে যায়।পুরো সেন্টার তন্নতন্ন করে খুজতে থাকে।কিন্তু না প্রাহি নেই কোথাও নেই।অর্থরতো পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম।ওর প্রাহি হঠাৎ কোথায় গেলো।কি হলো ওর প্রাহির।এখন কোথায় খুজবে সে।চাইলেও নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না অর্থ।চিৎকার করে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে, ‘ প্রাহি, কোথায় গেলে তুমি?আর কোথায় খুজবো তোমাকে।প্লিজ প্রাহি।কোথায় তুমি একবার বলো প্লিজ।আর কোথায় খুজবো।কেন বার বার তোমার সাথেই এমনটা হয়।’
অর্থ কিছু একটা ভেবে চোয়াল শক্ত করে হনহন করে হেটে গিয়ে ইলফার গলা চেপে ধরলো।হুংকার ছুরে বলে,’ কোথায় আমার প্রাহি?কি করেছিস ওর সাথে। বল নাহলে আজ তোকে মেরে ফেলবো।’
ইলফার চোখ উলটে আসছে।শ্বাস নিতে পারছে না।হেমন্ত আর আরাফ গিয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনে।হেমন্ত বলে,’ কি করছিস ভাই।ও তো মরে যাবে।’
অর্থ রেগে আগুন হয়ে দাঁত খিচিয়ে বলে, ‘ মরে যাক।ওই আমার প্রাহিকে কিছু করেছে।ওকে বল বলে দিতে আমার প্রাহিকে ফিরত দিতে।’
আরাফ তেড়ে গিয়ে ইলফাকে ঠাস করে একটা চর বসালো।তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে বলে,’ ভালোই ভালোই বলে দে প্রাহি কোথায়?নাহলে তোকে এক্ষুনি স্যুট করে দিবো।ভুলে যাবো তুই আমার বোন।’
ইলফা কাঁদছে।সাথে কাঁদছে ওর মা।ইলফা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ বিশ্বাস করো ভাইয়া।আমি কিছু করেনি প্রাহিকে।সেদিনের পর থেকে তো আমি ওর সামনেও যায়নি।ওর ক্ষতি করার কথা সেই কবেই মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছি।’
আরাফ আবারও একটা থাপ্পর মারলো।ওর গাল চেপে ধরে বলে, ‘ সত্যি করে বল।প্রাহি কোথায়?’
ইলফা এইবার চিৎকার করে বলে, ‘ আমি কিছু করনি।যা করেছে অন্য একজন করেছে।আমি সত্যি প্রাহির ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আমাকে একজন ফোন করে থ্রেড দিলো যে প্রাহির কিছু করলে নাকি আমাকে মেরে ফেলবে সেই থেকেই আমি প্রাহিকে ক্ষতি করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছি।কারন আমার নিজের জানের মায়া আছে।’
অর্থ রাগি কন্ঠে বলে, ‘ কে কি বলেছে।জলদি বল?কে তোকে থ্রেড দিয়েছে?’
ইলফা একবাক্যে বলে দিলো, ‘ ব্লাকহান্টার নামের একজন ফোন করে থ্রেড দিয়েছিলো।’
হেমন্ত, আরাফ আর অর্থ একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো।আরাফ ইলফাকে প্রায় একপ্রকার ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে।ওরা তিনজন হন্তদন্ত হয়ে সেন্টার থেকে বেড়িয়ে গেলো।এদিকে বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো।তবে একজনের মুখে শুধু শয়তানি হাসি।ও ফিসফিস করে বলে৷,’ যতো খোজার খুজে নে।তোরা পাবিনা ওকে কোনদিনই।’
#চলবে________