” ওহে রমণী তোমার উপস্থিতি যে কারো মনে দোলা দিয়ে যায় তা কি তুমি জানো? তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন যে কারো জীবন উতালপাতাল করে দিয়েছে সে খেয়াল কি তোমার আছে?”
বয়সে ছোট ইনানের মুখে এধরণের কথা শুনে আরশিয়া থমকালো, ভড়কালো। ছেলেটা এমন সাবলীলভাবে কথাটা বললো যেন কোন সাধারণ কথা বলেছে। আরশিয়া ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলো মিটিমিটি হাসছে ইনান।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। উৎসুক কন্ঠে বলল,
” তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না?”
” নাকি গো দামী নূর কহিনূর আপু। আপনি আমার বড়, আপনার সাথে কি আমি আর মজা করতে পারি? আবার হতেও পারে মজা করছি।” ঠোঁটে দুষ্টমি মাখা হাসি রেখে কথাটা বলেই ইনান বড় বড় পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে গেটের বাইরে চলে গেলো। কয়েকমূহূর্তেই দৃষ্টিগোচর হয়ে গেলো সে।
তার যাওয়ার দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে আরশিয়া। কি বলে গেলো ছেলেটা? ইনানের কথাগুলো মস্তিষ্ক হাতড়ে আরেকবার স্মৃতিচারণ করলে সে। আচমকা হালকা কেঁপে উঠলো তার কায়া।
” ইশ, কিসব ভাবছি আমি! ইনান পাজি ছেলে, তার কথায় দুষ্টমির রেশ স্পষ্ট ছিলো। নিশ্চয় সে মজা করে আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য কথাগুলো বলেছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাড়ির সামনে থাকা উঁচু ছোট মাঠের মতো জায়গা থেকে নেমে এলো আরশিয়া। জুতো খুলতে খুলতে শান্ত চোখে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। আপাতত তার ঘুমের প্রয়োজন। আচমকা জায়গা পরিবর্তনের কারণে দু’দিন ধরে সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেনা। কাউকে কিছু না বলে নিজের জন্য বরাদ্দ রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লো সে।
.
.
কারো কণ্ঠস্বরে ঘুম হালকা হয়ে এলো আরশিয়ার। তবে সে চোখ খুললোনা। আগের মতোই শুয়ে থেকে কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো রুমে কারা আছে। কণ্ঠস্বর এবং খিলখিল করা হাসির শব্দে আরশিয়া বুঝতে পারলো রুমে জেবা, জায়রা, তৃষাণ বসে আছে। জেবা, জায়রা সম্পর্কে আরশিয়ার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন। তাদের মা আরশিয়ার মায়ের মামাতো বোন। অন্যদিকে তৃষাণ তার আপন বড় মামার ছেলে। শোয়া থেকে সে উঠবে সেই মূহুর্তেই তার কানে এসে ঠেকলো চতুর্থ কোন ব্যক্তির কন্ঠ। নিচু, প্রাণোচ্ছল কোন পুরুষালী কন্ঠ। শোয়া থেকে উঠলোনা আরশিয়া, বারংবার চেষ্টা করতে লাগলো কণ্ঠস্বরের মালিক কে তা মনে করার। কিন্তু সে কিছু বুঝে উঠার আগেই কণ্ঠস্বরের মালিক রুম থেকে প্রস্থান করলো।
” জায়রা এভাবে হেসোনা, আপু ঘুমাচ্ছেন। তৃষাণ ভাইয়া চলো আমরা বরং এখন এখান থেকে যাই।”
জুবার কথায় সম্মতি দিলো দু’জনে। তারা চলে গিয়েছে বুঝতে পেরে ধীরে সুস্থে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। বিছানা ঘুছিয়ে মুখ হাত ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
তার মা, আন্টি, ছোট-বড় সবাই বাড়ির সামনে থাকা বালি দিয়ে তৈরি মাঠে পাতা চেয়ারগুলোর মধ্যে বসে নিজেদের মতো গল্প করছে। বর্তমানে তারা আছে নীলাবরী গ্রামে, যেটা আরশিয়ার মায়ের মামারবাড়ি। এই মামাবাড়ি সম্পর্কের আরশিয়া শুনেছে তার মায়ের কাছে কিন্তু তাদের কারো সম্পর্কেই সে পূর্বে অবগত ছিলোনা আর না কখনো কারো সাথে তার দেখা হয়েছে। এবারো হয়তো সে আসতো না। সে না করলে তার মাও বাঙালি মায়ের মতো সন্তানদের রেখে কোথায় সচারচর যায়না। তবে এবার কি যেন হলো! সুমনা আহমেদ জীদ ধরলেন তিনি যাবেন, তারা কেউ না গেলে তিনি ছোট ছেলে আরহামকে নিয়ে একাই রওনা দেবেন। অাত্ননির্ভরশীল নারী হওয়াতে টাকা-পয়সা নিয়ে কোন বাধাবিপত্তি নেই। মায়ের আচরণে আরশিয়া খানিকটা অবাক হয়েছিলো। পরে জানতে পেরেছে মায়ের একমাত্র মামার শারীরিক অবস্থা খারাপ, ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ। কেমো দিয়েও কোন লাভ না হওয়াতে এখন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। ওনার শেষ ইচ্ছে তিনি তার সব ছেলে-মেয়ে, ভাগ্নে-ভাগনী এবং তাদের ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখতে চান। এসব শুনে আরশিয়া আর না করতে পারেনি, বিবেকে বাধা দিচ্ছে তার। থাক না সবসময় তো মা তাদের জন্যই করে গিয়েছে, এবার না হয় তিনি একটু নিজের আত্নীয়দের সাথে দেখা করে আসুক। এবার না গেলে হয়তো ওনার আর মৃ’ত্যুপথযাত্রী মামাকে আর দেখা হবেনা। এই ভেবে আরশিয়াও আসতে রাজী হয়েছে।
এসব চিন্তা করতে করতে ধীরে সুস্থে সে একটা চেয়ারে বসলো, চোখ দু’টো তার ফোনের মাঝে আবদ্ধ।
” কহিনূর আপু, তুমি ওখানে একা বসে আছো কেন? আমাদের সাথে এসে বস।”
আরশিয়া সামনে তাকিয়ে দেখলো কাজিনমহলের সবাই গোল করে চেয়ারে বসে আছে। জায়রার কথায় সবার চোখ এসে ঠেকলো আরশিয়ার উপর। এতোগুলো মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে আরশিয়ার অস্বস্তি হতে লাগলো।
” না জায়রা, তার দরকার নেই। আমি এখানেই ঠিক আছি, তোমরা কথা বলো।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। চঞ্চলাবতী জায়রা উঠে এসে আরশিয়াকে নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। প্রথমতো অপরিচিত মানুষ, সেইসাথে নিজের অর্ন্তমুখী স্বভাবের কারণে আরশিয়া সবাইকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। কিন্তু তারা হতে দিলে তো।
” হাই।” অপ্রস্তুভাবে হেসে বললো সে। জুবা একে একে সবার সাথে আরশিয়ার পরিচয় করিয়ে দিলো। আশ্চর্যজনক হলেও দু’দিন অতিবাহিত হলেও সে এখনো কাউকেই ঠিকমতো চেনেনা। জুবা আর জায়রার নামেও সে দ্বিধায় পড়ে যাই। পরিচয় পর্ব শেষে তারা পুনরায় গল্পগুজবে ব্যস্থ হয়ে পড়লে আরশিয়া নিরবে একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
” এই নে তোদের স্প্রাইট। এই ঠান্ডার মধ্যেও কি করে তোদের এসব খেতে ইচ্ছে করে বুঝিনা বাপু! নে নে ধর, গলা খারাপ হলে তখন আমার দোষ দিতে পারবিনা।”
কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো আরশিয়ার হাত। এইতো সেই কন্ঠ, এই কণ্ঠস্বরের মালিককেই তো এতোটা সময় ধরে সে চেনার চেষ্টা করছে। চোখ তুলে তাকাতেই নিজের সামনে এলোমেলো চুলে ক্লান্তিমাখা এক অপরিচিত যুবককে দেখতে পেলো আরশিয়া। চোখ বুঝে চেয়ারে হেলাম দিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, যেন কত বড় কাজ করে এসেছে। আচমকা তার কি মনে হলো কে জানে, হুট করেই চোখ খুলে সে সরাসরি তাকালো আরশিয়ার দিকে। তার চোখাচোখি হতেই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো আরশিয়া। দ্রুতগতিতে চোখ সরিয়ে নিলো, তবে সে বুঝতে পারছে যুবকটি এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরশিয়া বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো কে এই যুবক।
” ওয়াসিম ভাই সামান্য স্প্রাইট আনতে গিয়ে এতোটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো যে একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লে। ইশ, এতোটা অলস তুমি কবে থেকে হলে?” জুবার কথায় হেসে উঠলো সবাই। তবে আরশিয়া হাসলোনা, শুধু আড়চোখে ওয়াসিম নাম পুরুষটিকে আরেকবার পরখ করে নিলো।
সোজা হয়ে বসলো ওয়াসিম। গলা ঝেঁড়ে টি-শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
” ক্লান্তির কথা তোরা কি বুঝবি? সারাদিনতো বসে বসে গল্প করিস। জানিস এতোগুলো মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য কত খাটাখাটনি করতে হচ্ছে? অবশ্য তোরা কি করে তা বুঝবি? দেখি স্প্রাইটের বোতলটা দে। এভাবে সঙের মতো সাজিয়ে রাখার জন্য তো আর বয়ে নিয়ে আসিনি। তোরা না খেলে আমিই বরং খেয়ে ফেলি।” তার বলতে দেরি তবে বোতল খুলে খেতে দেরি নেই।
মূহুর্তের মধ্যেই আবারো রমরমা হয়ে উঠলো পরিবেশ। কে কার থেকে বেশি খাবে তা নিয়েই কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেলো।
” আরে তোমরা থামো। কহিনূর আপুকেও কেউ একটু দাও। এই তাজ তুমি গিয়ে আপুর জন্য একটা গ্লাস নিয়ে এসো।”
জায়রার কথার বিপরীতে আরশিয়া কিছু বলবে তার আগেই ওয়াসিম প্রশ্ন করে বসলো,
” কহিনূরটা আবার কে? আমি তো জানতাম এটা একটা দামী পাথর, এটা আবার কারো নাম হয় নাকি?”
ওয়াসিমের প্রশ্ন শুনে আরশিয়ার মুখ থমথমে হয়ে গেলো।
” এটা আরশিয়া আপুর পারিবারিক নাম যাকে বলে ডাকনাম। আপু এটা হচ্ছে ওয়াসিম ভাই, আমাদের খালাতো ভাই। তুমি ওনার কথায় কিছু মনে করোনা।”
জুবার কথা শুনে ওয়াসিমের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আরশিয়ার উপর। পুনরায় আড়চোখে ওয়াসিমকে দেখে আরশিয়া মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কিছু মনে করেনি।
এরইমধ্যে তাজ একটা গ্লাস নিয়ে দৌড়ে এলো। জায়রা তাতে কিছুটা স্প্রাইট ঢেলে আরশিয়ার দিকে বাড়িয়েছ দিলো।
” না জায়রা এটা বরং তোমরাই খাও। আমি স্প্রাইট খাইনা।”
” খাও না মানে! এই আপু তুমি কি ওয়াসিম ভাইয়ের কথায় রা’গ করেছো?”
” আপু তুমি প্লিজ কিছু মনে করোনা। ওয়াসিম ভাই না বুঝে মজা করে ফেলেছে।”
” না জুবা, জায়রা এরকম কিছুই নয়। আমি স্প্রাইট খাইনা, আমি সবসময় কোলাকোলা, মোজো এগুলো খাই। তোমরা প্লিজ আমাকে জোড় করোনা।”
এরই মাঝে আরহাম দৌড়ে এসে আরশিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।
” নূর তুমি কি খাচ্ছো? আমাকেও দাও।”
জায়রার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছোটভাইকে দিয়ে দিলো আরশিয়া। সে বেশ মজা করে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তা পান করতে লাগলো।
আচমকা ওয়াসিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীরমুখ করে একবার চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত পায়ে গেটের বাইরে চলে গেল। আরশিয়া তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের অবচেতন মনে বলল,
” কি অদ্ভুত!”
চলবে……
#প্রেম_এসেছে_গোপনে
#পর্ব_০১
#অনন্যা_অসমি